“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৫৫

0
2614

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৫
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে নাস্তার পর যে ঘুমিয়েছে সেই ঘুম ভেঙেছে দুপুরে বড় মা’র ডাকে! নাফিসা ঘুমঘুম চোখে তাকাতেই তিনি বললেন,
– নাফিসা, গোসল করবি না? ওঠ।
চোখ ডলতে ডলতে নাফিসা উঠে বসলো। দুদিন যাবত এক ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে শরীরে যেন অলসতা নেমে এসেছে। কিন্তু এছাড়া তার আর করনীয়ই বা কি!
সে গোসল সেড়ে নামাজ পড়ে নিলো। বড়মা ডাকলো খাওয়ার জন্য। খাওয়ার জন্য এতো ডাকাডাকি করে সেটাও ভালো লাগে না তার! অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে গেলো ওই ঘরে। দুই বছরের পিচ্ছিটা দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করছিলো। নাফিসাকে দেখে আবার সে থেমে গেলো। নাফিসা হাত বাড়িয়ে বললো,
– এসো, জিহান।
জিহান দৌড়ে বড়মার পেছনে লুকিয়ে গেলো! বড়মা বললো,
– ভয় পাও কেন দাদু? সে তোমার চাচী হয়।
নাফিসা আবারও হাত বাড়ালো কিন্তু জিহান দৌড়ে চলে গেলো। বিকেলে ইমরান ফিরেছে সাথে স্নো, পাউডার, লোশন, ফেসওয়াশ নিয়ে। প্যাকেট নাফিসার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– ঘোড়ার ডিম খুজে খুজে পেলাম না। তাছাড়া আর কিছু বলনি তবুও নিয়ে এলাম এগুলো। আরও কিছু প্রয়োজন হলে বলতে পারো। দুপুরে খেয়েছো?
নাফিসা কোনো জবাব না দেওয়ায় ইমরান বললো,
– চতুর দেখে বিয়ে করলাম আর এখন এতো চুপচাপ কেন তুমি! নিজেই নিজের ক্ষতি করলে সবচেয়ে বেশি বোকামি করবে।
সন্ধ্যা থেকে বাকিটুকু সময় ইমরান ঘরেই ছিলো। রাতে নিজের খাবার সহ নাফিসার খাবার এনেছে। ইচ্ছে করছিলো না খেতে বরাবরই তাকে জোর জবরদস্তি করে খাওয়ানো হয়। চতুর্থ দিন নাফিসা বোরকা পড়ে রেডি হচ্ছে। ইমরান নাস্তা করার জন্য ডাকতে এসেছিলো, তাকে হিজাব পড়তে দেখে বললো,
– কোথায় যাচ্ছো তুমি?
– যেদিকে দুচোখ যায়।
এমন অপ্রত্যাশিত জবাবে ইমরান বিরক্ত হলো। গতদিন গুলোতে সে কারো সাথেই ভালো ব্যবহার করছে না। যা দেখে ইমরান অসন্তুষ্ট। সে আবার বললো,
– বাসায় যাবে তুমি?
– না।
– তাহলে?
– বললাম না, দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে।
– দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে যেতে পারবে না। বোরকা খুলো আর নাস্তা করবে, চলো।
– আমি এখন নাস্তা করবো না। আমার তাড়া আছে।
– ভার্সিটিতে যাবে? তাহলে আমি যাওয়ার সময় নামিয়ে দিয়ে যাবো। এখন নাস্তা করবে চলো।
– একবার বললে আপনি শুনতে পান না! বারবার কেন বলতে হয়! আমি নাস্তা করবো না তো করবোই না।
– করবে। তা না হলে কোথাও যেতে পারবে না।
– এখন কি আপনি আমাকে ঘরে বন্দী করে রাখতে চাইছে! বিয়ে করেছেন বলে সব শুধু আপনার কথায়ই চলবে!
– এ পর্যন্ত আমার কথায় কিছুই চলেনি। সব তোমার কথায়ই চলছে।
– তাহলে এখন বাধা দিচ্ছেন কেন?
– যেটা একদমই ঠিক না সেটা কিভাবে চলতে দেওয়া যায়। কোথায় যাচ্ছো সেটাও বলছো না, খেতে যেতে বলছি তা-ও যাচ্ছো না। এভাবে তো স্বাধীনতা দেওয়া যায় না।
হিজাব পড়া শেষ হতেই নাফিসা চুপচাপ বেরিয়ে যাচ্ছিলো। ইমরান তার হাত ধরে বললো,
– এভাবে কোথাও যেতে পারবে না তুমি।
– একশো বার যাবো। হাত ছাড়ুন।
– উল্টাপাল্টা বলে রাগিয়ে দিও না। খাটে গিয়ে চুপচাপ বসো, আমি খাবার এখানে নিয়ে আসছি।
– বসবো না। কি করবেন আপনি?
– দেখবে তুমি কি করতে পারি আমি?
কথাটা বলেই ইমরান তাকে ধাক্কা দিয়ে খাটে ফেলে দিলো এবং বললো,
– ঘর থেকে এক পা ও বাইরে বের হতে পারবে না আমার অনুমতি ছাড়া। একটা কথাও বলতে পারবে না আমার কথার বাইরে! অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না সেটা নিশ্চয়ই তোমারও অজানা নয়। পাগলামো অনেক করেছো গত তিনদিনে! এখন থেকে তোমার ইচ্ছে মোটেও কার্যকর হবে না।
ইমরান বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে চলে গেলো! নাফিসা কান্না করতে করতে খাট ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়লো! জীবনটাকেই অসহ্যকর মন হচ্ছে তার কাছে! ইমরান এক প্লেট খাবার নিয়ে এসে দেখলো পানির জগ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছে মেঝেতে। আর পানিতে ভেসে আছে মেঝে! ইমরান টেবিলে প্লেট রেখে বললো,
– জগ ভাঙলে কেন?
কান্নার সাথেই নাফিসা জেদ নিয়ে জবাব দিলো।
– ইচ্ছে হয়েছে ভেঙেছি। কৈফিয়ত দিতে হবে আপনাকে!
সাথে সাথেই তার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় পড়লো! নাফিসা হতবাক হয়ে গালে হাত রেখে বসে আছে! ইমরান দাতে দাত চেপে বললো,
– এতো জেদ কেন শরীরে! ওঠাও এগুলো। ওঠাও! ইমরানের ধমকে একহাত গালে রেখেই ঠোঁট কামড়ে ধরে কাদতে কাদতে নাফিসা ভাঙা কাচগুলো বড় কাচের টুকরোর মধ্যে রাখতে লাগলো। তোলা শেষ হলে ইমরান সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলো এবং নিশাতের রুম থেকে পানির জগ এনে দিয়ে বললো,
– প্লেটের একটা ভাতও যেন নষ্ট না হয়। চুপচাপ খাওয়া শেষ করো। ঘরের বাইরে এক কদম রাখাও তোমার বন্ধ! কারো সাথে কোনো সাক্ষাতের প্রয়োজন নেই। এক ঘরে বন্দী থাকো।
ড্রয়ার থেকে তালা নিয়ে বেরিয়ে গেলো ইমরান। দরজা চাপিয়ে সে বারান্দার গেইট তালা দিয়ে চলে গেলো। আর এদিকে নাফিসা কেদেই চলেছে। হিজাবের পিন খুলে সে ছুড়ে মারছে এদিক সেদিক! হিজাবটাও খুলে ঢিল মেরে অন্যদিকে ফেলে দিলো।
ওদিকে নাফিসার গায়ে হাত তুলে ইমরানেরও খারাপ লাগছে। কিন্তু তখন যে রাগ কন্ট্রোল করতে পারেনি! সে সকালে নাস্তা না করেই চলে গেছে। বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর যখন বার্থডে উইশ করার জন্য নাজিয়া কল করেছিলো তখন ইমরানের ভেতরটা আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছিলো! সে তো জানতোই না আজ তার জন্মদিন! এমন একটা দিনেই তাকে হাত তুলতে হলো! দুপুরের দিকে ইমরান ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। আসার সময় নাফিসার জন্য কেক নিয়ে এসেছে সাথে। তালা ঝুলছে গেইটে। ইমরান তালা খুলে ভেতরে এসে দেখলো বোরকা পড়নে থেকেই অগোছালোভাবে নাফিসা খাটে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো এই অবস্থা দেখে! সে দরজা লাগিয়ে কেক টেবিলে রাখতে গেলে দেখলো খাবার যেমন রেখে গেছে ঠিক তেমনই আছে! সে নাফিসার কাছে বসে মাথা ঝাকিয়ে ডাকলো। কাদতে কাদতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ইমরানের ডাকে ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই ইমরান বললো,
– এখনে এভাবে বসে আছো কেন! ওঠো।
নাফিসা তার হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো। ইমরান স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে চারটা আঙুলের ছাপ বসে আছে গালে! সে গাল স্পর্শ করে বললো,
– সরি।
নাফিসা এবারও হাত সরিয়ে দিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে উঠে দাড়ালো। ইমরানও উঠে দাড়িয়ে নাফিসার কাছে এসে চোখের ধার মুছে দিলো। নাফিসার জোরাজোরি সত্বেও সে দু’হাতে মুখখানা ধরে থাপ্পড় দেওয়া গালে আলতো চুমু একে বললো, “হ্যাপি বার্থডে।”
নাফিসা তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বললো,
– কচুর বার্থডে! কার বার্থডে আর কিসের হ্যাপি বার্থডে? পুরো লাইফটাকে হেল করে দিয়ে এখন হ্যাপি বার্থডে উইশ করা হচ্ছে! যেই বার্থডে তে সারাদিন এভাবে ঘরে বন্দী করে রাখা হয় সেই বার্থডে হ্যাপি হয় কি করে! যেই বার্থডে তে বিনা কারণে থাপ্পড় খেতে হয় সেই বার্থডে হ্যাপি হয় কি করে! জগটা কি আমি ইচ্ছে করে ফেলেছিলাম! যার কারনে আমাকে থাপ্পড় খেতে হলো! আপনার হাতে নাড়া লেগে কিছু পড়েনি আজ পর্যন্ত! ভাঙেনি কিছু হাত থেকে পড়ে!
– তুমি তো তখন বলনি সেটা! তাছাড়া অতি জেদ করছিলে তাই রেগে গিয়েছিলাম।
– তো এখন আসছেন কেন এতো আদিক্ষেতা দেখাতে!
– সরি, ফর দ্যাট।
– সরি মাই ফুট! সরি বললেই সব ঠিক হয়ে গেলো! সরি বললেই সেই থাপ্পড় মুছে গেলো! আমার লাইফে সবচেয়ে ঘৃণিত পাত্র আপনি! জানেন সেটা? আর অতি অল্প সময়েই জঘন্য কারণে এতোটা ঘৃণিত হয়ে উঠেছেন! পুরো লাইফটাকে হেল করে দিয়েছেন আপনি! আপনার জন্য আমি এতো বড় হয়েও মায়ের কাছে দুইটা থাপ্পড় খেয়েছি! আমার কাছেই তো নিষেধ করে দিয়েছিলেন। তারপরও খুব প্রয়োজন ছিলো সেদিন মায়ের কাছে বিচার দেওয়ার! আমার এতোটা সর্বনাশ করেও শান্তি হননি আজ নিজে মেরে আবার আসছেন বার্থডে উইশ করতে! দুদিন হয়নি বিয়ে করেছেন আর এখনই টর্চার শুরু করেছেন! আপনার জন্য আমি আজ এক্সামটাও দিতে পারলাম না আমি! সব শেষ করে দিয়েছেন আমার। সব! সব!
– আমি বারবার জিজ্ঞেস করা সত্বেও তুমি বলনি কেন ভার্সিটিতে এক্সাম আছে তোমার!
– সব কেন আপনার কাছে বলে বলে করতে হবে! আর সবকিছুর কৈফিয়তই বা কেন দিতে হবে! আমার স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই!
ইমরান তার দিকে এক কদম এগিয়ে বললো,
– স্বাধীনতার মাঝেই তো রাখতে চেয়েছি দিয়েছো সেই মর্যাদা?
– খবরদার, আমাকে টাচ করেছেন তো! আপনাকে তো কিছু করতে পারবো না। নিজেকে শেষ করে দিবো একেবারে!
ইমরান তার বাহু চেপে ধরে বললো,
– এই মেয়ে! এমন করছো কেন তুমি! বিয়ে করেছি বলেই কি আমার খুব অপরাধ হয়ে গেছে! পাগলের মতো আচরণ ছেড়ে স্বাভাবিক কেন হতে পারছো না! তুমি জানো কতগুলো মানুষকে টেনশনে ফেলে রেখেছো! ক’দিন আগে যে তোমার বাবার ব্রেইন স্ট্রোক হলো সেটা জানা আছে তোমার! এখন নিজের এই জেদে স্থির হয়ে তো আরও বেশি ক্ষতি করে যাচ্ছো উনার! সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা কি কম কোনো বাবামায়ের!
নাফিসা একদম হতবাক হয়ে গেছে ইমরানের কথা শুনে! তার বাবার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে! সে মুহুর্তেই বাকিসব ভুলে গিয়ে ইমরানকে বললো,
– ব্রেইন স্ট্রোক হয়নি বাবার। ডাক্তার বলেছে প্রেশার বেড়ে গেছে।
– ডাক্তার বলেনি সেটা। বলেছে আরাফ ভাই। তোমরা টেনশন করবে বলে লুকিয়েছে তোমাদের কাছে! আর সেই তোমরাই এখন উনার আরও বেশি ক্ষতি করে ফেলছো! আমি মনে করি আগেও সেটা তোমাদের জন্যই ঘটেছে। তাছাড়া নিশ্চয়ই আর কোনো দুশ্চিন্তা থাকতে পারে না উনার মাঝে।
– আপনি জানলেন কিভাবে?
আগের চেয়ে একটু শান্তভাবে ইমরান বললো,
– আরাফ ভাই ই বলেছে। তোমাকে এখন বিয়ে দিতো না তোমার পরিবার। তোমার বাবা অসুস্থ বলেই বাধ্য হয়েছে। সন্তানদের ভালো অবস্থানে দেখতে পারলেই কেবল পিতামাতার শান্তি।
– আমি বাবার সাথে কথা বলবো।
– তোমার আপুরাও কেউ কিন্তু জানে না সেটা। শুধু তোমার বাবা মা ও আরাফ ভাই জানে। তোমাদের জানানো হয়নি কারণ তোমরা টেনশন করবে। এখন যদি এ সম্পর্কে তুমি কিছু বলো একে একে সবাই জেনে যাবে। আর বাবা আরও বেশি টেনশন করবে এই ভেবে, যে তোমরা টেনশনে আছো। আমি মনে করি, তোমরা সবাই স্বাভাবিক থাকো আর এতেই তোমার বাবা সুস্থ থাকবেন, ইনশাল্লাহ।
– আমি বাবার সাথে কথা বলবো।
– তুমি এখনো কান্না করছো। বাবা জানলে আরও বেশি কষ্ট পাবেন। আগে নিজেকে শান্ত করো তারপর ঠান্ডা মাথায় কথা বলো। সকালে গোসল করেছো?
নাফিসা চোখ মুছতে মুছতে দু’দিকে মাথা নাড়লো। ইমরান বললো,
– গোসল করে এসো। তারপর কথা বলবে। যাও।
নাফিসা বোরকা খুলে চলে গেলো গোসল করতে। ইমরানও পোশাক পাল্টে নিলো। নাফিসা রুমে আসতেই ইমরান বললো,
– নাফিসা, ওবাড়িতে যাবে? ভাবি কল করেছিলো তোমাকে উইশ করার জন্য। জন্মদিনে তুমি অভিমান ভেঙে তাদের কাছে থাকলে আরও বেশি খুশি হবে।
– যাবো আমি।
– ভাত খাও। তারপর রেডি হও।
খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না তবুও প্লেট হাতে নিলো। ইমরান তার জন্যও খাবার এখানে নিয়ে এসেছে। নাফিসা ভাত মাখতে গেলেই “ওফ্ফ!” শব্দ করে আঙুল মুখে দিলো। ইমরান হাত টেনে নিয়ে বললো,
– কি হয়েছে? দেখি। কাটলো কিভাবে?
“আমাকে মেরে এখন ভুলে গেছে!”
নাফিসা বিড়বিড় করে চোখ কাচুমাচু করে হাত টেনে নিলো। পরক্ষণে ইমরানের মনে হলো জগ ভাঙার কথা। কাচের টুকরো তুলতে গিয়ে কেটে গেছে বোধহয়! তাই সে বললো,
– হাত ধুয়ে নাও। আমি খায়িয়ে দেই।
– লাগবে না।
– সব লাগবে না হলে লাগে কোনটা! হাত ধোও।
অত:পর ইমরানই খায়িয়ে দিলো তাকে। নাফিসার অসস্তি লাগছিলো তার হাতে খেতে তবুও খেয়ে নিলো পেটে ক্ষুধা থাকায়। অন্যথায় নিজ বাড়ি যাওয়ার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here