ভালোবেসেছি_তোরই_মতো পর্বঃ৭(২য় বাকি অংশ)

0
1860

ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
পর্বঃ৭(২য় বাকি অংশ)
লেখিকাঃ শাদিয়া_চৌধুরী_নোন

— এই বেয়াদব! তোকে কতবার বলেছি আমি? বারবার তুমি তুমি করিস কেন? থাবড়ায় দাঁত ফেলে দেবো৷ তারপর ফোকলা দাঁত দিয়ে বুড়ি সাজবি। মহি দেখেছিস বেয়াদবটার অবস্থা?

মহিমা বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকালো। নোরিন ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। শেষমেষ এই মেয়েটার সামনে নিবিড় ভাইয়া অপমান করলো?

নিবিড় কোনোদিকে না তাকিয়ে চলে গেলো। নিবিড়ের পেছন পেছন মহিমা সহানুভূতির হাসি দিয়ে , সেও চলে গেলো। নোরিনের আকাশের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এই জীবনে সে কারো কাছে এতো অপমানিত হয়েছে কিনা মনে পরছে না। কি অসভ্য এই ছেলে! নোরিন যে এতো ভালো সেজে এসেছে একবার তাকায়নি পর্যন্ত। এই ছেলেটাকে কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে চুবাতে হবে, সেখানে পঞ্চাশটা সাপ কিলবিল করবে। অশান্ত নিবিড় কোথাকার!
———————————

অতঃপর একরাশ মন খারাপ নিয়ে নোরিন বরযাত্রীর গাড়িতে উঠলো। গাড়িতে হলো আরেক বিপত্তি। সব গাড়ি ভর্তি। নোরিনের দেরি করে আসার ফল এটা। মাপা মাপা মানুষের জন্য মাপা মাপা জায়গা। খালামণি, মামী পরিবারের কেউই যাচ্ছে না। কারণ মেয়ের বাবার সামর্থ্য কম। নানুমণি কোনোমতেই তাদের উপর চাপসৃষ্টি করতে দিতে চান না। বউ একজন গেলে, আরেকজনের মন কালো হবে। তাই সিদ্ধান্ত হলো বাচ্চারাই যাক। শুধু বাড়ির কয়েকজন বয়স্ক লোক আর ইয়াংস্টার’রা যাচ্ছে।
সমস্যা হলো, নোরিন কাউকে খোঁজে পাচ্ছে না।
জায়িন ভাইয়ার গাড়িতে নোরিনকে যেতে বলা হয়েছিলো। কারণ জায়িন ভাইয়ার মা আর নানুমণি মিলে তাকে আলাদা ডেকে অনেক খুঁটিনাটি দায়িত্ব দিয়েছে। বউকে গয়না পড়িয়ে দেওয়া, বউকে দেখে রাখা, গাড়িতে তোলা, বউয়ের পাশে বসে সেখানকার মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর এইসব। বিয়ে যেহেতু গ্রামে, সেখানকার মানুষের নানা প্রশ্ন থাকবেই। নানুমণি আর বাড়ির বড়দের ধারণা নোরিনের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুনাবলি আছে। যেকোনো বিষয় মিমাংসা করা, বুঝিয়ে দেওয়ায় উস্তাদ সে। চেহারা গাম্ভীর্য আর রাশভারী দেখানোর কারণে সবার মাঝে তার কথার একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। জেরুদের বললে হয়তো দেখা যাবে, কোথায় ঢ্যাংঢ্যাং করে ঘুরতে চলে গেছে। তখন হবে আরেক ঝামেলা। তাই সবাই বিশ্বাস করে নোরিনের উপরেই দায়িত্বটা চাপালো।

নোরিন লেহেঙ্গা আলগিয়ে চোখে মুখে বিরক্তিভাব এনে এদিক ওদিক হাঁটছে। জায়িন ভাইয়ার গাড়িতে কয়েকজন বয়স্ক বসে আছে। ওদের সাথে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে নোরিন বাকিদের খুঁজলো। উফফ নানুমণি এতো ভরসা করে কাজগুলো দিলো আর এখন সামান্য একটা সিট পর্যন্ত পাচ্ছে না। ধূর! এই জেরু, মিমহা, রাইদা সব কোথায় মরেছে কে জানে! নোরিন টিস্যু দিয়ে কপালে চেপে শেষ বাসটাতে উঠলো। ভেতরে ঢুকে তার চক্ষু চড়কগাছ। বাসে সবাই বসে আছে। সবাই বলতে কাজিনদলের সবাই। ফুল ভলিউমে গান বাজছে। জেরু, রাইদা, মিমহা, সাইমা, সাদ ভাইয়া,ইশরাক-ইশমাম ভাইয়া সহ আরো কয়েকজন নিজের সিটে দাঁড়িয়ে নাচছে। নোরিন হাত মুঠ করে নিজের রাগ সামলে আরো খানিকটা এগিয়ে এলো। জেরু তাকে দেখে অবাক হলো,
—- এই নোরিন তুই কোথায় ছিলি? তোকে কত জায়গায় খুঁজলাম তুই জানিস? শেষে না পেয়ে এখানে চলে এলাম।

রাইদাও বললো,
—- ওমা নোরিন! তোমাকে তো আজ পুরো আলিয়া ভাটের মতো লাগছে। আমার ফেবারিট হিরোইন। একটু হাসো তো, টোলটা দেখি?

নোরিন হাসলো না। নির্বিকার তাকিয়ে দুজনকেই অবিশ্রাব্য একটা গালি দিলো। নোরিন যে গালি দিতে পারে এটা কেউ জানে না, শুধুমাত্র তার বাবা ছাড়া। কারো উপর মন বেজার হলে দুজন মিলে একসাথে গালি দেয়।
নোরিন জেরুকে পাশ কাটিয়ে নিজের সিট নির্বাচন করলো। কোথাও জায়গা নেই। একেবারে বাসের শেষ অংশের পুরোটায় খালি। নোরিন রাগ লাগছে। সকাল বেলা কুয়াশায় ঢাকা থাকলেও এই দুপুরে রোদটা কড়া লাগছে। ঘামে নোরিনের কপাল ছিপছিপ করছে। বারকয়েক টিস্যু দিয়ে নাক, কপাল ঘষে একেবারে পেছনের সিটের জানালার পাশে বসলো সে। ব্যাগ থেকে পাওয়ার ব্যাংকের সাথে মিনি ফ্যানটা লাগিয়ে ঘাম শুঁকিয়ে নিলো। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখলো। নিবিড়ের চিন্তাটা মাথায় আসলো আবার। উফফ কি মারাত্মক লাগছিলো আজ নিবিড়কে! গাড়ির কোথাও তো দেখলাম না। মহিমাও দেখিনি। দুজনে কোথায় গেলো? মন ভার করে নোরিন গালে হাত রাখলো। অমনি ধপ করে পাশে বসলো কেউ। নোরিন ঘাড় ফিরিয়ে দেখে জেরু তার পাশে বসা। জেরু নোরিনের গলার গোল্ডেন নেকলেসটা ঠিক করতে করতে বললো,
—- রাগ করেছিস?

—- না।

—- আর কেউ চিনোক না চিনোক, আমি কিন্তু তোকে চিনি। রাগ করলে তোর ভ্রু সবসময় হালকা কুঁচকানো থাকে। গাল ফোলে যায়। নাকে ফোঁস ফোঁস করিস।

—- চুপ কর। আমি কিছু শুনতে চাই না।

—- যাক বাবা! তোর জন্য আমি পেছন থেকে সামনে চলে এলাম। আর তুই বলছিস চুপ থাকতে।

—- দয়া দেখাচ্ছিস আমাকে? আমি বলেছিলাম আসতে? নোরিনের কারো দয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

—- আমি আবার সেটা কখন বললাম! তুই আমার আপন একমাত্র খালাতো বোন। তাই তোর পাশে বসেছি। হুহ! তুই বললেও সরবো না। তোর রাগ আমার জানা আছে।

নোরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো। সবকিছু অসহ্য লাগছে। সবকিছু!

গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পালা। গাড়ি স্টার্ট করেছে মাত্র, এমন মুহূর্তে নিবিড় আর মহিমা এসে হাজির। তারা কোথাও জায়গা না পেয়ে ইশরাক আর ইশমাম ভাইয়াকে পেছনে বসতে বলে তাদের জায়গায় মানে নোরিনদের সামনের সিটে বসলো। নোরিন জানলার পাশে, নোরিনের পাশে জেরু, তারপর ইশরাক ভাইয়া এবং অপর জানালার পাশে ইশমাম ভাইয়া। নিবিড় নোরিনের বরাবরে জানালার পাশে বসেছে। মহিমা তার পাশে। সামান্য এই একটা কারণেও নোরিনের দুনিয়া ভেঙে কান্না পেলো। না পারছে সইতে, না পারছে কিছু বলতে। যা হয় হোক, দরকার পড়লে মরে যাক তবুও নোরিন কিছুতেই মনের কথা বলবে না। কিছুতেই না। নিজের সম্মান, নিজের দুর্বলতা কিছুতেই প্রকাশ করবে না। নিবিড়ের মতো ছেলেরা তার পেছনে চরকির মতো ঘোরে। এতোদিন কলেজে না দেখে অনেকে তাকে চোখে হারাচ্ছে। এইতো গতকাল রাতেই একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। পরিচয় দেওয়ার পর জানতে পারলো ছেলেটা তার কলেজের সিনিয়র ভাই। এতো কিছুর পর সে যাবে নিবিড়কে মনের কথা বলতে? ইম্পসিবল। দরকার হয়তো সে আসুক! নোরিন না ফেরাতেও পারে।

— এই বুড়ি তুই কি আমাকে সবসময় ফলো করিস নাকি?

নিবিড়ের কথা নোরিন শোনেও না শোনার ভান করলো। তার কানে হেডফোন গোঁজা । হেডফোনে কোনো গান বাজছে না, এমনিই দিয়ে রেখেছে, দৃষ্টিও বাইরে। আপাতত এই অশান্ত ছেলেটার কথা শোনার কোনোরুপ ইচ্ছে নেই তার।

নিবির এবার নোরিনের কান থেকে হেডফোন খুলে কথাটা আবার রিপিট করলো।

নোরিন উত্তর না শান্ত চোখে তাকালো।

—- বেয়াদবি করছিস কিন্তু তুই!!

— ভাইয়া কি করেছি আমি?

—- কি করেছিস মানে? কি করিস নি সেটা বল। আমি যেখানে যাই, সেখানে তুই কেনো চলে আসিস? তোর মতলব কি?

নোরিন আচমকা মিষ্টি করে হাসলো। দু গালে দুটো নিখুঁত গভীর সৃষ্টি হলো।
— লাইন মারতে চাইছি ভাইয়া। একটু সেটিং করিয়ে দিননা প্লিজ! অনেকদিন যাবৎ সিংগেল আছি। তাই আপনার পেছনে ট্রাই করছি।

নিবির বিস্ময়মাখা চোখে থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলো,
—- ফাজিল একটা। ভাইকে এসব কেউ বলে? চরম বেয়াদব হয়েছিস তুই।

নিবিড় তড়িঘড়ি করে সামনে ফিরলো। ভুলেও আর পেছনে তাকালো না। নোরিন দাঁত কিড়মিড় করে আবার কানে হেডফোন গোঁজলো। মনে মনে নিবিড়কে বললো,
—- ভাই! কীসের ভাই! আপনি আমার রক্ত সম্পর্কের কেউ না। আপনাকে তো চিনতামও না। সৎ মামাতো ভাই আপনি!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here