“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৫৬

0
2800

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৬
(নূর নাফিসা)
.
.
খাওয়ার পর খুঁজে খুঁজে পিনগুলো ফ্লোর থেকে উঠিয়ে নিলো নাফিসা। ইমরান প্লেট রাখতে গেছে। বড়মা এসেছে এখানে।
– ভার্সিটি গেছোস নাকি?
– না, ঘরেই ছিলাম।
– গেইট না তালা দেওয়া দেখলাম!
– উনি তালা দিয়ে গেছে।
– কে?
এই কেন এর উত্তর কিভাবে দিবে! ঘরে যাইহোক বাইরে কিছু না জানানোই ভালো। তাছাড়া দোষ খুজতে গেলে তার দোষটাই বেশি বের হয়ে আসবে! কেন জানি গত কয়েকদিন ধরে কাউকেই সহ্য হয় না তার! বড়মা উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে তাই নাফিসা বললো,
– আমি ঘুমাচ্ছিলাম তাই।
– ওহ্। বাবা মায়ের উপর রাগ কমছে?
– বড় মা, আমি বাড়িতে যাবো আজ।
– হু, ইমরান বলছে। আবিদার কাছে বলে যা। এমন ধাচের বিয়ে হওয়ায় রাগ করছে একটু ছেলের আর ছেলের বউয়ের উপর। তুই মানিয়ে নিলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। পারবি না?
নাফিসা এখনো কাউকে তেমন চিনলোই না, মানাবে কি করে! তবুও সে পারবে সেই আশ্বাস দিয়ে মাথা নাড়লো বড়মার সামনে। বড় মা মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাফিসা বোরকা পড়ে তৈরি হচ্ছে। জিহানকে সাথে নিয়ে ইমরান এসে বললো,
– এতো তারাতাড়ি রেডি হয়ে গেছো। আরও পরে যাবো।
নাফিসা আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গম্ভীরমুখে ইমরানকে বললো,
– এখনই যাবো।
– কাজ আছে একটুখানি।
– বলার আগে কাজের কথা মনে ছিলো না!
– হুম, মনে ছিলো। বাট বুঝতে পারিনি এতো দ্রুত রেডি হয়ে যাবে! যাইহোক, রেডি হয়েছো ভালো হয়েছে। এবার আগে কাজটা করে নাও, তারপর যাই।
ইমরান জিহানকে খাটে বসিয়ে দিয়ে প্যাকেট থেকে কেকটা বের করলো। ছুরিটা সামনে রেখে নাফিসাকে বললো,
– কেক কাটো বেগম সাহেবা।
– আমি এসব কেক টেক কাটবো না।
– টেক বাদ রাখো, কেক কাটো। শুভদিনে মুড খারাপ রাখতে নেই।
– বেশি বারাবাড়ি করবেন না বলে দিলাম। আমি কেক কাটি না।
– জিহান পিচ্চিটা বসে আছে কেক খাওয়ার জন্য আর তুমি এমন অবহেলা করছো!
– তো আপনি কেটে খায়িয়ে দিন। আমাকে ডাকছেন কেন!
– তোমার বার্থডে আর কেক কাটবো আমি! সেটা কি করে হয়! অন্তত একটা পোচ দাও! বাকিটা আমিই কাটি। দাও, দাও তারাতাড়ি।
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে ছুরিটা হাতের মুঠোয় ধরে কেকের মাঝামাঝিতে এক কোপ বসিয়ে দিয়ে বললো,
– হয়েছে এবার?
– এটা কি করলে তুমি! এমন একটা শুভক্ষণে তুমি অশুভ কাজ করলে! বলা নেই, কওয়া নেই ডিরেক্টলি কেকটাকে খুন করে ফেললে!
বলে নিজেই হাসতে লাগলো ইমরান। নাফিসা খাটে বসে পড়লো এবং বললো,
– এখন কি নিয়ে যাবেন না?
– কেকটা কাটো আগে। তারপর আমি রেডি হব। দেড়ি কিন্তু তুমিই করছো। যত তারাতাড়ি কেক কাটবে তত তারাতাড়ি আমিও রেডি হতে পারবো।
জিহান শুধু তাদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। নাফিসা বসা থেকে উঠে আবার ছুরি হাতে নিয়ে বললো,
– এইবার রেডি না হলে কেকের ন্যায় আপনাকে কাটবো!
এই বলে নাফিসা সম্পূর্ণ কেকে ছুরি চালিয়ে কুচিকুচি করে ফেললো। যেন আজকের সকল রাগ জেদ সব কেকের উপর ঢেলে দিয়েছে! এদিকে তার কেক কাটার স্টাইল দেখে ইমরান হেসে ভিডিও করতে করতে বলছে “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে টু বার্থডে গার্ল নাফিসা!” জিহান তাদের কান্ড দেখে হাত তালি দিয়ে হেসে উঠলো। জিহানের হাসি দেখে নাফিসাও হাসি মুখে জিহানের দিকে তাকালো। অত:পর একটুখানি কেক নিয়ে জিহানের মুখে দিলো। ইমরান ফোন রেখে তার কাছে এসে একটুকরোতে যতটুকু উঠে এসেছে ততটুকু হাতে নিয়ে নাফিসার মুখের সামনে ধরলো। নাফিসা তার হাত ইমরানের মুখের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,
– আপনি খান বেশি করে।
– যার জন্যে আনা সে না খেলে কিভাবে। তুমি খাও আগে, পরে আমি খাবো।
নাফিসা মুখ ফিরিয়ে নিলো। তাই ইমরান বললো,
– হা করো নয়তো গাল, নাক, মুখ সব খাবে।
এই লোকের সাথে বিশ্বাস নেই। এতোক্ষণ ধরে সে রেডি হয়েছে এখন গালে মেখে দিলে আবার রেডি হতে হবে। তাই নাফিসা মুখে নিয়ে নিলো। ইমরান ইশারা করতেই নাফিসা নিজে এক টুকরো হাতে নিয়ে ইমরানের মুখে দিতে বাধ্য হলো। অত:পর হাতে লেগে থাকা ক্রিম মুছে নিলো ইমরানের নাকে। ইমরান একটুও রাগ করলো না। ঠোঁটের এক কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– রেডি হয়ে গেছো বিধায় বেচে গেলে। নতুবা কেকের সবটুকু ক্রিম তোমার ফেসে মাখামাখি হতো!
– হুহ্! আমি ছেড়ে দিতাম নাকি!
– হা হা হা…কে বলেছে ছেড়ে দিতে। সারাজীবন আকড়ে ধরে রাখো না। সেটাই তো চাই।
– আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো। একটু পর সন্ধ্যাই হয়ে যাবে!
– তোমার এটুকুতে হলেও আমার এটুকুতে কিছুই হয়নি। সবটা জ্বিভেই আটকে আছে। গলা পর্যন্তও নামেনি।
এই বলে ইমরান জিহানের হাতে কেক দিয়ে সেও কাটা চামচ ন্যায় ছুরিতে আটকে খেতে লাগলো। নাফিসা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– তাহলে হাতে নিয়ে নিন। খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে যাবেন।
– হু, আমার পেট খারাপ করার আর আইডিয়া পাওনা! না? ওয়েট, পাচ মিনিট লাগবে আমার। খাবে আরও?
– না।
– নিশাতের রুমে রেখে আসি।
নাফিসা জিহানকে দেখিয়ে বললো,
– ওকে আরেকটু দিন।
– না, এখন এতো খেলে ভাত খাবে না। নিশাত খাওয়ার সময় আবার ডেকে খাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইমরান রেডি হয়ে গেছে। যাওয়ার সময় আবিদা বেগমের কাছে বলেছিলো নাফিসা। বড়মা পাশে থাকায় বড়মার দিকে তাকিয়ে আবিদা বেগম গম্ভীরমুখে শুধু এইটুকু শব্দ করলো, “যাও।” ইমরান নাফিসাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাসায় এসে সালাম দিয়ে মায়ের আগে বাবার সাথে কথা বললো নাফিসা,
– কেমন আছো বাবা?
– এইতো, আলহামদুলিল্লাহ। এখন অনেক ভালো আছি। ছোট মা কেমন আছে?
সেই জবাব না দিয়ে নাফিসা কাদো কাদো গলায় ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– এতো চিন্তা কিসের তোমার? কি নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা করো! নিজের ক্ষতি করতে খুব ভাল্লাগে তোমার!
– না, ভাল্লাগেনা তো! আমি কোথায় দুশ্চিন্তা করি!
– একদম কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবে না! তুমি দুশ্চিন্তা করো বলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছো! এতো দুশ্চিন্তা কেন থাকে তোমাদের?
নিয়াজ উদ্দিন মেয়ের চোখ মুছে দিয়ে বললো,
– কে বলেছে আমি দুশ্চিন্তা করি! তোমরা ভালো ও হাসিখুশি থাকলেই তো আমি আর কোনো চিন্তাই করি না।
– আমরা ভালো আছি। আর কোনো টেনশন করবে না তোমরা।
– বাবার উপর রেগে ছোট মা চারদিন ধরে কোনো কথা বলে না, কিভাবে বুঝবো ভালো আছে!
– এই যে, এখন বলছিতো! আর প্রতিদিন বলবো।
– আরে! জন্মদিনে কেউ কাদে! একদম পচা পঁচা দেখায়!
নাফিসা চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। মায়ের সাথেও প্রথমে অভিমান নিয়ে কথা বলে পরে আবার অভিমান ভেঙে ফেললো। নাজিয়া আছে বাসায়। নাহিদা বিয়ের পরদিন সকালেই চলে গেছে মেহেদীর সাথে।
নাফিসা ফ্রেশ হয়ে নিলে নাজিয়া তাকে বার্থডে উইশ করলো। আপাতত দেওয়ার মতো কিছু নেই বলে গিফট বাকি রাখলো। বোরকা হিজাব গুছিয়ে রাখতে নাফিসা তার রুমে এসেছিলো। নাজিয়ার হাসির শব্দ শুনে পাশের রুমে এসে দেখলো তার বাবা মা আর নাজিয়া ফোনে কিছু দেখছে। ইমরান খাটে বসে আছে। সবার মুখেই হাসি লেগে আছে। ফোনটা দেখে মনে হচ্ছে ইমরানের। কি দেখছে তারা!
নাফিসাকে এই রুমে আসতে দেখে নিয়াজ উদ্দিন বললেন,
– আম্মা, তুমি কি কেক কেটেকুটে রান্না করছো?
নাজিয়া হাসতে হাসতে বললো,
– না বাবা। কেক কুরবানি দিছে!
নাফিসা বুঝতে না পেরে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইমরান দুপুরের কান্ড ভিডিও করে রেখেছে! সে লজ্জা ও বিরক্ত নিয়ে ভিডিও ডিলিট করে দিলো। এতেও রেহাই নেই! সন্ধ্যায় নাহিদা কল করে বললো,
– কিরে বার্থডে কুইন। তুই নাকি বার্থডে স্পেশাল করতে কেক কুরবানি দিছোস!
নাফিসা রেফে আগুন! লোকটাকে পাটা পুতোয় পিষতে পারলে এখন খুব ভালো লাগতো তার! সে নাহিদাকে বললো,
– এতো কথা না বলে আমার গিফট দাও।
– এখন কিভাবে দিব! বকেয়া থাক।
– সবাই শুধু বকেয়াই রাখছে, বাবা ছাড়া কারো কাছেই নগদ পেলাম না! আজ কি আমার বকেয়া বার্থডে!
.
নাফিসাকে রেখে জরুরি প্রয়োজনে ইমরান সন্ধ্যায় খাওয়াদাওয়া করে চলে গেছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় নাফিসা নাজিয়াকে বললো,
– আপু?
– হু?
– ভাইয়া আসে না এখানে?
– হ্যাঁ। গতপরশুও না এলো।
– কথা হয় তোমার সাথে?
নাজিয়া একটু চিন্তিত হয়ে নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
– মাথায় কি ঘুরছে, খুলে বল তো?
– তুমি যে সেদিন ভাইয়াকে বলে দিয়েছো আরেকটা বিয়ে করে নিতে। ভাইয়া কি এখনো রেগে আছে?
নাজিয়া ঠোঁটের এক কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ডানেবামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– আজ বিকেলে বাবা আর তোর ভাইয়া নিতে আসতো। তুই আসবি বলে তোর ভাইয়া বলেছে কাল নিয়ে যাবে।
– ওহ্।
– ওবাড়িতে কেমন কেটেছে সময়?
– ভালো না।
– কেন?
– এমনি। কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার।
– নিজে একটু ইজি হয়ে যা, দেখবি সব ভালো লাগবে।
– জানো, ওর মা তো পুরো উনার দজ্জাল বোনের মতো মুখ ফোলা! যেমন চেহারা তেমনই মেডাম ফুলি!
– হেপ! এসব বলে না।
– ওদের পরিবারে তেমন কাউকে দেখলাম না। আই মিন, বাবা তো নেই ই। চাচা বা চাচাতো ভাইবোনও দেখলাম না। তাছাড়া বড়মা ডাকে যে, উনি কি বড় চাচি না?
নাজিয়া একটু বড় বড় চোখ করেই নাফিসাকে বললো,
– তুই এসব নিয়ে কাউকে উল্টাপাল্টা ভাবে জিজ্ঞাসা করিস নি তো?
– না। কেন?
– কথার ভঙ্গিতে কষ্ট পেতে পারে। তাই বললাম। বড়মা যাকে ডাকে উনি চাচী না। ইমরানের বাবার প্রথম স্ত্রী। আর ইমরানের মা হচ্ছে দ্বিতীয় স্ত্রী। উনারা আবার মামাতো ফুপাতো বোন। বড় আন্টির কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি তাই তিনিই বিয়ে করিয়েছেন ছোট আন্টিকে। ছোট আন্টি একটু বদমেজাজি টাইপের হলেও কখনো ঝগড়া হয়নি তাদের মাঝে। বড় আন্টি হতে দেয়নি সেটা। খুব আপনভাবেই মানিয়ে নিয়েছেন তিনি। আর আংকেলের নাকি খুব প্রিয় ছিলেন বড় আন্টি। তবে ছোট আন্টিকেও অধিকার বঞ্চিত করেননি তিনি। কিন্তু ভাগ্যে সন্তান থাকলেও সন্তানদের সংসার দেখার সুযোগ হলো না। তবে তিন ছেলেমেয়ে বড়মাকেও খুব ভালোবাসে। আপন মায়ের মতোই। ওসব নিয়ে কখনো কথা না বলাই ভালো। বলিস না তুই কখনো।
– আচ্ছা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here