“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৭
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে ইমরান কল করেছে নাফিসার ফোনে। নাফিসা রিসিভ করে সালাম দিলো। ইমরান সালামের জবাব দিলো এবং বললো,
– কি করছো?
– ফোন কি আমার প্রেত রিসিভ করেছে যে আপনার জানা নেই কি করছি আমি!
ইমরান হেসে বললো,
– সত্যিই জানি না আমি।
– আপনার সাথে কথা বলছে কে?
– আমার বউ।
– তো কাকে জিজ্ঞাসা করেছেন কি করছে?
– আমার বউকে।
– তাহলে বুঝতে পারছেন না আপনার সাথে ফোনে কথা বলছি!
– এ…ই…টুকু উত্তর এতো পেচিয়ে পেচিয়ে বললে!
– আপনি তো কচি খোকা, তাই ভেঙে ভেঙে বুঝিয়ে দিলাম!
ইমরান আবারও হেসে বললো,
– যাক, এখন বলো বুড়িটার কি আজ এক্সাম নেই?
– কিসের এক্সাম?
– তোমার না ইনকোর্স এক্সাম চলছে?
– তো?
– যাবে না ভার্সিটিতে?
– না।
– কেন?
– এমনি।
– আজ এক্সাম নেই?
– আছে।
– তাহলে যাবে না কেন?
– এক্সাম দিয়ে কি হবে! পড়াশোনা করবো না।
– কেন?
– সব কিছুতে কেন খুজেন কেন! ইচ্ছে হয়েছে আমার, তাই করবো না।
– বোকামি করো না। এক্সাম দিতে যাও।
– দিবো না।
– নাফিসা, এখন জেদ করছো পরে কিন্তু আফসোস করবে। আর তখন সুযোগ থাকবে না। সুযোগ হাতছাড়া করো না।
– করবো না আফসোস।
– তবুও, পড়াশোনা করতে হবে। আমার বউ অবশ্যই প্রকৃত এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষিত হতে হবে।
– তো করতেন শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে। আমার মতো এমন মূর্খকে বিয়ে করেছেন কেন!
– কথার মোর অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছো কেন! তুমি এখনো শিক্ষিত, তবে আমি চাই নিজের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করো। আমি নিতে আসবো ভার্সিটি পৌছে দেওয়ার জন্য?
– না। দেবো না এক্সাম। রাখি এখন। আল্লাহ হাফেজ।
ইমরানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নাফিসা কল কেটে দিলো। ইমরান আবার কল করলো তবুও সে কেটে দিলো। ফোন সাইলেন্ট করে তারপর বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। রুমানা বেগম রান্না করছে। নাফিসা তার বাস্তবায়নকৃত প্রথম উদ্যোগের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চলে গেলো। খামারের মুরগি প্রায় অনেকটা বড় হয়েছে। তিন-চার দিন পরে বেচে দেওয়া যাবে। নাজিয়া ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে বললো,
– নাফিসা?
– কি?
– তোর নাকি এক্সাম আছে? ভার্সিটি যাবি না?
– না।
– কেন?
– এমনি। এক্সাম দিবো না।
– পাগল হয়ে গেছিস! রেডি হয়ে ভার্সিটি যা।
– পড়াশোনা শেষ আমার। অনেক হয়েছে, আর লাগবে না।
– একটা মাইর দিবো! যাস না?
নাফিসা তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না। নাজিয়া ফোনে কাউকে নাফিসার বলা কথাগুলো বলতে বলতে আবার ঘরের ভেতরে চলে গেলো। নাফিসা নিশ্চিত ইমরান নাজিয়ার কাছে কল করেছে! এতে লাভ হবে নাকি! বলেছে তো বলেছেই! যাবে না সে এক্সাম দিতে!
.
নিয়াজ উদ্দিন বাজার থেকে ফিরেছে। নাফিসা নাস্তা দেওয়ার জন্য প্লেট ধুয়ে ঘরে যাচ্ছিলো। এমন সময় ইমরান উপস্থিত। নাফিসা বিড়বিড় করে বললো, “আরেকটু আগে এলে তো আরেকটা প্লেট বেশি নিয়ে বের হতাম!”
ইমরান তার বিড়বিড় শুনে ব্রু হালকা কুচকে হাসিমুখে বললো,
– থাক, আর কষ্ট করতে হবে না। খেয়ে এসেছি আমি।
– তো এসেছেন কেন?
– তোমাকে নিয়ে যেতে।
– আজ যাবো না আমি।
– বাসায় না, ভার্সিটিতে নিয়ে যেতে এসেছি।
– কোথাও যাবো না।
– চুপচাপ রেডি হও গিয়ে।
কথা বলতে বলতে ঘরে প্রবেশ করে রুমানা, নিয়াজ উদ্দিন ও নাজিয়ার দেখা পেয়ে সালাম দিলো ইমরান। নিয়াজ উদ্দিন বললেন,
– আরে, ইমরান যে! সঠিক সময়ে এসেছো। আরেকটু দেড়ি হলে আফসোস করতাম। এসো একসাথে খাই।
– বাবা, আমি খেয়ে এসেছি।
– এ কেমন কথা! এমন সময় কেউ খেয়ে আসে!
ইমরান মৃদু হেসে বললো,
– এখন আসতাম না। কিন্তু এসেছি একটু বিশেষ প্রয়োজনে। নাফিসাকে নিয়ে যাবো।
নিয়াজ উদ্দিন একটু বিস্মিত হয়ে বললো,
– এখন!
– বাসায় না, ভার্সিটিতে তার এক্সাম চলছে।
তাদের কথার মাঝখানে নাফিসা বলে উঠলো,
– আমি যাবো না।
ইমরান বললো,
– নাফিসা এটা ইনকোর্স এক্সাম। না দিলে সমস্যা হবে।
– কিসের সমস্যা হবে! আমি ভার্সিটিতেই যাবো না আর!
নিয়াজ উদ্দিন বললেন,
– এটা কেমন কথা নাফিসা! এক্সাম দিবে না কেন! তাছাড়া তুমি কি ইমরানের কথা অমান্য করো?
বাবার কথায় কিছুটা অসম্মানিত বোধ করে নাফিসা নতস্বরে কথার মোড় ঘুরিয়ে বললো,
– বাবা, আমি কোনো প্রিপারেশন নিতে পারিনি এক্সামের জন্য! গতদিন গুলোতে কিছুই পড়িনি। আগে যা পড়েছি সব ভুলে গেছি। তাহলে এক্সাম দিবো কি করে!
ইমরান তার চালাকি ধরতে পেরে বললো,
– প্রিপারেশন লাগবে না। এক্সাম হলে এটেন্ডেসটা দাও অন্তত। পরে ফাইনালের জন্য প্রিপেয়ার হবে। এখন এটেন্ডেস না দিলে ফাইনাল এক্সাম দিতে পারবে না।
নাফিসা বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইমরানের দিকে! নিয়াজ উদ্দিন একটু কড়াভাবে বললেন,
– নাফিসা, তোমার বড় দুইবোনের বাড়ি থেকে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নালিশ আসেনি যে তারা কারো কথা অমান্য করেছে। ভবিষ্যতে যদি তোমার নামে ইমরান ও তার পরিবার থেকে কোনো নালিশ আসে তাহলে কিন্তু খুব রেগে যাবে তোমার বাবা। ইমরান যা বলছে তা করো। নাস্তা করে ভার্সিটি যাও।
নাফিসা গোমড়া মুখু হয়ে প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে লাগলো। নিয়াজ উদ্দিন ইমরানকে বললেন,
– ইমরান, এরপর যদি কখনো বাড়ি থেকে খেয়ে আসো তাহলে কিন্তু অবশ্যই রাগ করবো।
ইমরান মৃদু হেসে বললো,
– বাবা, আমি জানতামই না এখানে আসবো। নাস্তা করে অফিসের জন্য রেডি হয়েছিলাম তখন নাফিসাকে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বললাম। সে জেদ করছিলো এক্সাম দিবে না, তাই আমাকেই আসতে হলো নেওয়ার জন্য।
– আচ্ছা, ভালো করেছো। তা কেমন এগিয়ে আছে তোমাদের স্কয়ার?
– ওটাতো দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠান, ভালোই চলছে সবকিছু।
– ভালো হলেই ভালো। বেশি খেলে তো বদহজম হবে। তা এক টুকরো মুরগির রান তো খেতেই পারো তাই না? এতটুকুর জায়গা হবে না পেটে?
বাবার কথায় কিছু মনে হতেই ওদিকে নাফিসা বললো,
– হুহ্! মুরগির রান খেয়ে কি হবে বাবা! নিজের নামের শেষেই তো রান লেগে আছে!
কথা বলে নিজেই হেসে উঠলো। নাজিয়াও শব্দহীন হেসে তার মাথায় হালকা ঠুসি দিলো ইমরানকে এভাবে লজ্জায় ফেলায়! রুমানা নাফিসাকে ছোটখাটো এক ধমক দিয়ে ইমরানকে বসতে বললো। নাস্তা করে নাফিসা বোরকা হিজাব পড়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেলো ইমরানের সাথে। রিকিশায় করে যাচ্ছে দুজন। মাঝপথে ইমরান বললো,
– নাফিসা?
নাফিসা অন্যদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে তাকালো। ইমরান বললো,
– এ সপ্তাহের পরের সপ্তাহে বিয়ের প্রোগ্রামটা সেড়ে ফেলি?
– কেন, এক বিয়েতে স্বাদ মেটেনি?
– কি ধরনের কথাবার্তা বলছো! আমি আমাদের বিয়ের প্রোগ্রামের কথা বলছি।
– কোনো প্রোগ্রাম হবে না।
– মাথা এখনো ঠান্ডা হয়নি! একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো, আমাদের আশেপাশের কিন্তু কেউ জানেই না বিয়ের কথা। এমন প্রোগ্রাম ছাড়া চুপিচুপি বিয়ে শুনলে লোকে কি বলবে৷ তাছাড়া বাবারও কিন্তু ইচ্ছে প্রোগ্রাম করে তোমাকে আমার বাড়ি পাঠানোর।
– রাখেন আপনার লোকের কথা! এতো লোকের চিন্তা মাথায় ঘুরে কেন! আপনার সংসার কি লোকে করবে! আসছে এখানে প্রোগ্রাম করে লোকের মুখ বন্ধ করতে! তাছাড়া কে বলছে কেউ জানে না চুপিচুপি বিয়ের কথা? দেয়ালেরও কান আছে, বুঝলেন! কোনো ঘটনা সংঘটিত হলে ঘন্টার মধ্যে ছড়িয়ে যায় আর সেখানে আজ পাচ দিন! প্রোগ্রাম করলে একে তো আযব লোকের আযব কটুক্তি শুনবেন অন্যথায় পাপ কামাই করবেন! ঘরোয়াভাবে বিয়েই ভালো। কোনো গানবাজনা নেই, কোনো কোলাহল নেই, প্রোগ্রামে কোন গ্যাঞ্জামও নেই! সব নিরবতা শান্তি আর শান্তি।
ইমরান মনে মনে বললো,
“কথা তো ঠিকই বলেছো৷ কিন্তু শান্তি আর আছো কোথায়! যখন পাগলামো শুরু করো, মনে হয় একটা পাগলকে বিয়ে করেছি। কি হয় সবসময় এমন শান্ত থাকলে!
নাফিসাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে সে আবার উল্টো পথে বাসে করে চলে গেলো তার কর্মস্থলে।