“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৫৯

0
2357

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৯
(নূর নাফিসা)
.
.
নাফিসা চলে যাওয়ার পর ইমরান নিশাতকে বললো,
– বেশি খারাপ লাগলে খেয়ে ঘুমিয়ে থাক।
নিশাত ভেঙচি কেটে বললো,
– উউউউউউউহহহহহ! ভাবির কথায় মানে লেগেছে বুঝি! এখন যে আবার দরদ উতলে পড়ছে!
ইমরান আবারও এক ধমকের সাথে বললো,
– চুপচাপ পড়! এগারোটার আগে উঠবি না পড়া থেকে!
নিশাত বই বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো,
– সেই কখন ক্ষুধা লাগছে! আর থাকা যাবে না! ঘুমও পাচ্ছে প্রচুর।
কথাটা বলে নিশাত ঘুমের ভান করে হাই তুলতে তুলতে বেরিয়ে যাচ্ছে ইমরানের পিছু পিছু। ইমরান বললো,
– অভিনয় আর কম জানোস না! অভিনেত্রী হিসেবে ফার্স্ট প্রাইজ পাবি!
– সেই সুযোগ টা তো আর দিলে না! তোমার জন্য একটা প্রোগ্রামেও পার্টিসিপ্যান্ট করতে পারলাম না!
– প্রোগ্রামে পার্টিসিপ্যান্ট করতে হবে না। পড়াশোনায় পার্টিসিপ্যান্ট কর। দরজা লাগিয়ে যা।
– তুমি খেতে যাবে না?
– পরে।
– এখনই চলো। সবাই একসাথে খেয়ে চলে আসবে। ঝামেলা কম হবে।
– যা, আসছি।
নিশাত চলে গেলো ইমরান নাফিসাকে সাথে নিয়ে তারপর বড় ঘরে চলে এলো। নাফিসার ইচ্ছে ছিলো না খেতে আসার। তা-ও ইমরান তাকে সাথে এনেছে ঘরে একা রেখে যাবে না বলে। নাফিসা খায়নি তবুও ড্রয়িং রুমে বসে ছিলো। এদিকে নিশাতও না খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়েছে বড় মায়ের রুমে।
নাফিসা রিমোর্ট হাতে নিয়ে একের পর এক চ্যানেল পাল্টে যাচ্ছে। ইমরান বললো,
– খাবারের প্লেট এখানে নিয়ে এসো।
– বললাম না, আমার খেতে ভালো লাগছে না। বিকেলে খেয়েছি আমি
– তাহলে আমারটা নিয়ে এসো।
– টেবিলে গিয়ে খেলে কি হয়! একজনের জন্য প্লেট নিয়ে টানাটানি!
– চেয়ার টেবিলে খাওয়া ভালো না। আরাম আয়েশে খাওয়া সুন্নাত। এখানে খাটে বসে আরাম করে খাওয়া যায়।
ইতোমধ্যে বড়মা ভাতের প্লেট নিয়ে হাজির। নাফিসা এবার উঠে চলে গেলো থালাবাটি এনে দেওয়ার জন্য। পানির জগ গ্লাস নিতে গেলে জেরিন তার হাত থেকে জগ গ্লাস নিয়ে টেবিলের খালি প্লেট গুলো দেখিয়ে বললো,
– নতুন বউ এবার সংসারের কাজে নতুন হাত লাগিয়ে পুরাতন হও। এখানে প্লেটে খাবার বেড়ে দাও। আমি এগুলো দিয়ে আসছি।
নাফিসা চুপচাপ খাবার বেড়ে দিতে লাগলো। আর জেরিন বড়মা আর ইমরানের জন্য খাবারের বাটি নিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সে-ও প্লেট নিয়ে চলে গেলো সেখানে। টেবিলের দিকটা নাফিসাই সামলে নিচ্ছে। আরমান নিজেও খাচ্ছে, জিহানকেও খাওয়াচ্ছে। কতটা নির্বোধ মহিলা! ওদিকে সে আরামে খাচ্ছে আর বাচ্চাকে রেখে গেছে হাসব্যান্ড এর ভরসায়! নাফিসার ইচ্ছে করছিলো সে-ই খায়িয়ে দিক। কিন্তু বাচ্চা বাবার হাতে খাচ্ছে তাই সে আর কিছু বললো না। দাড়িয়ে দাড়িয়ে জিহানের খাওয়া দেখছে। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে প্লেট হাতে নিয়ে ইমরান বেরিয়ে এলো ড্রয়িং রুম থেকে। নাফিসা ইমরানের দৃষ্টি স্বাভাবিক দেখলো না! সে কি তার উপর বিরক্ত নাকি সেটা ভাবছে নাফিসা! বিরক্ত হওয়ার মতো কোনো কাজ তো সে করেনি! বেশি ভাবলো না এ নিয়ে।
খাওয়া শেষে টুকটাক গুছিয়ে ইমরানের সাথে তাদের ঘরে চলে এলো। ইমরান গেইটের তালা খুলে প্রবেশ করে আবার লাগিয়ে দিচ্ছে। নাফিসা বললো,
– নিশাত আসবে না?
– নিশাত ঘুমিয়ে পড়েছে বড়মার রুমে। আজ আর আসবে না।
– আপনারা ভাইবোন আলাদা থাকেন কেন? ঝগড়াঝাটি আছে নাকি?
– কোথায় আলাদা?
– এইযে, উনারা সবাই এক বিল্ডিংয়ে আর আপনারা দুজন টিন শেডে।
ইমরান মুচকি হেসে রুমে প্রবেশ করতে করতে বললো,
– তোমার কি বিল্ডিংয়ে একটা রুম লাগবে?
– রুম আছে না-কি! সব তো ফুলফিলই।
– লাগলে বলো, ব্যবস্থা করে দিবো। ড্রয়িং রুমটা তোমার হয়ে যাবে।
– তাহলে ড্রয়িং রুম কোথায় যাবে?
– এই ঘরে শিফট করে দিব।
– প্রয়োজন নেই। আমি শুধু জানতে চাইলাম আলাদা থাকেন কেন। তাছাড়া এই ঘরটা নতুন মনে হয়। এটা না করে ওটাতেই দোতলা করে নিতে পারতেন।
– ওটা ফাউন্ডেশন দেওয়া না। বিধায় ওটাতে দোতলা সম্ভব না। আর আমরা আলাদা থাকি না। সবারই আলাদা রুম দরকার তাই এটা তুলে নিয়েছি। নিশাতের এই ঘর পছন্দ হয়েছে তাই এখানে তার রুম আলাদাভাবে নিয়েছে। তবে বেশিরভাগ সময় সে মা অথবা বড়মার সাথেই থাকে। মাঝে মাঝে এখানে। বাবার ইচ্ছে যৌথ পরিবার হবে আমাদের। ইনশাল্লাহ সেটাও সফল হবে। সবাই মিলেমিশে যৌথ পরিবার হয়ে থাকলে ভালো হবে না?
– আমার তো ভালোই লাগে। কিন্তু তেমন পাওয়া যায় না, এমনকি থাকেও না এরকম পরিবার। দ্বন্দ লেগে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
– নিজেরা ঠিক থাকলে দ্বন্দের সম্ভাবনা থাকে না। যাক, পড়তে বসবে এখন?
– না।
– তাহলে আপাতত কষ্ট করে ঘুমাও। লাইট পরে বন্ধ করবো আমি।
নাফিসা গিয়ে শুয়ে পড়লো আর ইমরানকে দেখলো বুক সেল্ফ থেকে বই নিয়ে পড়ছে! সে কি তাহলে এখনো স্টুডেন্ট! হতে পারে। এজন্যই তো ভার্সিটিতে দেখেছিলো তাকে! সে কি ও-ই ভার্সিটিরই স্টুডেন্ট! কিসে পড়ে সে! নাফিসা মাথাটা একটু উঠিয়ে বইয়ের নাম দেখতে গেলে ইমরান তার দিকে তাকালো। নাফিসা সাথে সাথে আবার শুয়ে পড়লো। ইমরান বললো,
– প্রব্লেম হচ্ছে লাইট অন থাকায়?
নাফিসা মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে চোখের পাতা বন্ধ করে রইলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে ইমরানকে কুরআন পড়তে দেখলো নাফিসা। সাধারণত পুরুষদের কুরআন পড়তে দেখাই যায় না। ইমরানকে দেখে ভালো লাগলো নাফিসার। ইমরানের পড়া হলে আবার সে কুরআন হাতে নিলো পড়ার জন্য। ইমরান টুপি রাখতে রাখতে বললো,
– তুমি কুরআন পড়বে আগে বলনি কেন, নিশাতের রুমে কুরআন শরীফ ছিলো।
– এটাতেই হবে।
নাফিসা কিছুক্ষণ পড়ে রেখে দিলো। আজ প্রথম শ্বশুর বাড়িতে কাজে হাত লাগিয়েছে। নিজের রুমসহ নিশাতের রুম ঝাড়ু দিয়েছে। অত:পর বড় ঘরে এসে দেখলো রান্নার কাজকর্ম মাঝামাঝিতে আছে। নাফিসা আবিদা বেগমকে বললো,
– আম্মা, কিছু করতে হবে?
আবিদা বেগমের পরিবর্তে জেরিন জবাব দিলো,
– না, কিছু করা লাগবো না। কাথা মুড়ে ঘুমিয়ে থাকো। কাজকর্ম শেষ, এহন আসছে কিছু করা লাগবো কি-না জিজ্ঞেস করতে!
নাফিসার প্রচুর রাগ হলো! এ ধরনের প্যাচানো বাকা কথা তার মোটেও পছন্দ না। তবুও কোনো রাগ দেখালো না। বাবা-মা কাল বারবার বলে দিছে যাতে সকলের বাধ্য হয়ে থাকে আর কারো সাথে কোনো তর্ক না করে। তাই সে রাগ ঢেকে স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– এতো প্রয়োজন হলে ডাকতে পারতেন। আমি তো আর আপনাদের পরিবারের কাজকর্মের রুটিন জানি না!
এবার জেরিন বললো,
– জানার চেষ্টা থাকলে না জানবে। থাক আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই। থালাবাসন মেজে ফেলো। সংসারের কাজ শেষ হয় না কখনো। সারাদিনই একের পর এক কাজ হাজির থাকে।
নাফিসা আর কিছু না বলে বাসনকোসন মেজে ফেললো। তবে এটাই খারাপ লাগলো আবিদা বেগম কোনো উক্তি রাখলেন না। এরপর জেরিন আবার উঠুন ঝাড়ু দিতে বললো। নাফিসা উঠুন ঝাড়ু দেওয়ার সময় দুজন মহিলা এসেছে। একজন একটু বয়স্ক অন্যজন যুবতী। বয়স্ক মহিলাটি বললো,
– এইডা ইমরানের বউ গো?
নাফিসা কি বলবে বুঝতে পারছে না। নতুন বউ হয়ে নিজের পরিচয় কি নিজে দেওয়া ঠিক হবে! তাই সে চুপচাপ তার কাজ করে যাচ্ছে। নিশাত ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললো,
– হ্যাঁ, দাদু। ছোট ভাবি।
– বউ দেহি কতা কয় না! বোবা নাকি!
নাফিসার একদম সহ্য হয় না এ ধরনের কথাবার্তা। তবুও সে চুপ। পাশের যুবতী বললো,
– আম্মা, জোর কইরা ঘরে উঠছে না। এইজন্যে লজ্জা পাইতাছে।
নিশাত জবাব দিলো,
– কাকি, কি বলেন এসব! জোর করে আবার ঘরে উঠে কিভাবে!
বয়স্ক মহিলাটি বললো,
– হইছে তুই চুপ থাক। ভাবির লাইগা কি পিরিত! শয়তানি করন যায় না। কি গো বউ, এতো শরম পাও কে! এদিক ঘুইরা খাড়াও দেহি একটু।
নাফিসা জেদ নিয়ে ঝাড়ুটা মাটিতে আছাড়ে ফেলে ঘোমটা মাথার অর্ধেক পর্যন্ত নামিয়ে জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– কি, দাদি? ভালো আছেন?
– এতোক্ষণে!
– হু, এতোক্ষণেই। আমি তো চিনিই না, তাই জিজ্ঞাসাও করিনি। এবার বলেন।
– হ, ভালাই। দেখতে তো ডকসুন্দর, লম্বাচূড়া অই! নাকমুখ খাড়া।
– হ্যাঁ, খাড়া নাক দিয়ে একেবারে কোটার মতো ব্যবহার করে বরই পারতে পারবেন। হইছে এবার নাতবউ দেখা?
নিশাত খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সাথে বাকি দুজনও। মহিলাটি বললো,
– নাতবউ দেহি ভালা মস্করা জানে! দেখছি, দেখছি, বাকিটুক নাতিরে দেহাইয়ো। আরমানের মায় কই, এহনই বউরে উডান ঝাড়ু দেওয়ায়।
বলতে বলতে দুজন বড় ঘরের দিকে চলে গেলো। উঠুন থেকে বল কুড়িয়ে নিয়ে নিশাত জিহানকে ডাকতে ডাকতে চলে গেলো। লোকমুখের কটুক্তিতে নাফিসা মনে মনে ফুসতে ফুসতে ঝাড়ু হাতে নিয়ে আবার নিজের কাজে মনযোগ দিলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here