“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৬০

0
2462

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬০
(নূর নাফিসা)
.
.
ইমরান ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে। নাফিসাকে উঠুন ঝাড়ু দিতে দেখে রাস্তার দিকের টিনের গেইটটা চাপিয়ে বললো,
– উঠুন ঝাড়ু দিচ্ছো, গেইট লাগিয়ে নিবে না! আর এটা এভাবে খুলেই বা রাখছে কে!
নাফিসা বললো,
– আমি কি জানি! আমি কি রাস্তায় বেরিয়েছি নাকি!
– যাইহোক, খোলা দেখলে লাগিয়ে রাখবে।
ইমরান চলে গেলো। নাফিসার ঝাড়ু দেওয়া শেষ হতেই দেখলো ইমরান বড় ঘর থেকে প্রায় দৌড়ে যাচ্ছে তাদের ঘরের দিকে। যেতে যেতে ফোনে সময় দেখে বললো, “ওফ্ফ! লেট হয়ে যাচ্ছে!”
ইমরান ঘরে এসে দ্রুত গোসল করতে চলে গেলো। উঠুন ঝাড়ু দিয়ে হাপিয়ে উঠেছে নাফিসা, তাই ভাবলো সকাল সকাল গোসল সেড়ে নিলে ভালো হবে। সে-ও কাপড়চোপড় নিয়ে তৈরি হলো। সাথে বোরকাটাও নিলো ধোয়ার জন্য। দরজা খোলার শব্দে নাফিসা বাথরুমে এসে দেখলো ইমরান তার জামা কাচার ব্যবস্থা করছে। নাফিসা ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
– আপনি যান, আমি ধুয়ে দেই।
ইমরান মুচকি হেসে বললো,
– আমিও কাপড় কাচতে জানি। নিজের কাজ নিজে করতে ভালো লাগে।
নাফিসা তার বোরকা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– তাহলে আমারটাও কেচে দিন।
ইমরান হাসিমুখেই হাত বাড়িয়ে বললো,
– দাও।
নাফিসা আবার বোরকা গুটিয়ে নিয়ে বললো,
– আপনার না লেট হয়ে যাচ্ছে। আপনি যান।
– এতোটা সময় লাগবে না এতে।
– এতোই যেহেতু নিজের কাজ নিজে করতে জানেন তাহলে বিয়ে করে বউ এনেছেন কেন?
ইমরান শরীর কাপিয়ে হেসে বললো,
– বউকে কাজের বুয়া হিসেবে রাখার জন্য বিয়ে করিনি। বিয়ে ফরজ কাজ। তাই করেছি। এছাড়া এতো দ্রুত বিয়ে করার আরও একটা কারণ আছে, আশা করি শীঘ্রই জেনে যাবে। এখন তুমি বরং নিজেকে গুছিয়ে রেখো তাহলেই হবে।
– উঠুন, পুরুষদের এমন মেয়েলি কাজ করতে দেখতে আমার ভালো লাগে না।
– ওকে, উঠে পড়লাম। তবে কিছু কিছু কাজে স্ত্রী পুরুষের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই। নিজের কাজ নিজে করাই উত্তম মনে করি।
ইমরান চলে গেলো আর নাফিসা কাপড় কেচে শুকাতে দিলো উঠুনে।
ইমরান দ্রুত তৈরি হয়ে খাওয়ার জন্য বড় ঘরে চলে গেলো। নাফিসা ভাবলো যেহেতু লেট হয়ে গেছে, ইমরানের খাবার এগিয়ে দিয়ে তারপর গোসল করতে যাওয়া যাক। তাই সে বড় ঘরে এলো। আরমান নাস্তা করে তৈরি হচ্ছে। ইমরান নিজেই খাবার নেওয়ার জন্য টেবিলের কাছে এসেছিলো। নাফিসা বললো, “আমি এনে দিচ্ছি।”
তাই ইমরান চলে গেলো। নাফিসা খাবার প্লেটে নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে যাবে এমন সময় জেরিন এসে তার হাত থেকে প্লেট নিয়ে বললো,
– বাটিতে ডাল দাও।
এভাবে প্লেট কেড়ে নেওয়ায় নাফিসা কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবাক হয়ে গেছে! অত:পর বাটিতে ডাল নিলে জেরিন এসে আবার সেটাও নিয়ে গেলো। নাফিসা কিছু না বলে টেবিলের আসবাব গুছাতে লাগলো। জিহান ঘরের ভেতরই খেলা করছে আর নাফিসা কাজের সাথে জিহানকে তার রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। এমনি ইমরানের ডাক পড়লো। নাফিসা সেখানে গিয়ে বললো,
– কি?
– বসো এখানে।
– কেন?
– বসতে বলেছি, বসো।
ইমরানের বিরক্তিকর মনোভাব দেখে নাফিসা তার পাশে এসে বসলো। জেরিনের মুখটা একদম কালচে ভাব ধারণ করেছে। জেরিনের খোজে জিহানকে জিজ্ঞাসাস্বরূপ আরমানের কণ্ঠ শুনে ইমরান বললো,
– জেরিন, ভাইয়া তোকে ডাকছে। যা।
জেরিন টিভির রিমোটটা খাটে থিতলে রেখে বেরিয়ে গেলো। জেরিন যাওয়ার পরপরই ইমরান নাফিসাকে বললো,
– আমি যখন খাবো, তখন আমার পাশে বসে থাকবে। এমনকি একা এখানে টিভি দেখার সময়ও বসে থাকবে। আর যদি মুরুব্বিরা কেউ থাকে তাহলে তোমাকে থাকতে হবে না। মনে থাকবে?
নাফিসা শুধু তার দিকে তাকালো কিন্তু কোনো জবাব দিলো না। ইমরানের খাওয়া শেষ হতেই নাফিসা সব গুছিয়ে রাখছে। ইমরান বড় মা ও তার মায়ের কাছে বলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,
– এসো তো একটু।
নাফিসা হাতের কাজ রেখেই তার পিছু পিছু বেরিয়ে এলো। তাদের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
– আপনারা দুই ভাই কি একসাথেই কাজ করেন? ভাইয়া যে আপনার জন্য বসে আছে।
– হুম, ভাইয়ার সূত্রেই আমার চাকরি। কিন্তু পদ আলাদা।
– কোথায় চাকরি করেন?
– বরের কাজকর্মের খবর না জেনেই বিবাহিতা বউ আমার ঘরে!
– হুহ্! বউ কি আবার অবিবাহিতা হয়!
– হয়না? নবীন প্রেমিকরা তাদের প্রেমিকাকে তো বিয়ে ছাড়া বউ হিসেবেই মানে!
– ফালতু।
ইমরান হেসে বললো,
– ওহ্ ! তোমারও না বয়ফ্রেন্ড আছে! কোথায় সে?
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে একবার তাকালো শুধু তার দিকে। ইনরান আবার হেসে বললো,
– আমরা স্কয়ার গ্রুপে কর্মরত আছি। আমি স্টোক একাউন্টার হিসেবে আর ভাইয়া ম্যানেজার হিসেবে।
– ওহ্।
রুমে এসে ইমরান ঠিক করা শার্টের কলারটাই আবার নেড়েচেড়ে ঠিক করে ঘড়িটা হাতে পড়লো। নাফিসা দাড়িয়ে থেকে বললো,
– আমাকে ডেকেছেন কেন?
– এমনি।
– এমনি মানে!
– এমনি মানে এমনি! আমি রেডি হবো, অত:পর অফিসের জন্য বের হবো। আর তুমি ভালোবেসে বিদায় জানাবে। এবার বুঝতে পেরেছো?
– আযব লোক একটা! এসব অকর্মণ্য লোকদের দেখলে রাগে গা ঝিমঝিম করে!
– আচ্ছা! তাহলে তো কর্মঠ লোক হওয়ার জন্য কিছু একটা কাজ করতেই হয়!
অকর্মণ্য নয় তা প্রমাণ করতে ইমরান কিছু একটা করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো আর নাফিসা রেগে আগুন! মুখ মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে সে থু থু ফেললো এবং বললো,
– ওয়াক থু! খাচ্চোর লোক! পিশাচ! বমি বমি লাগতাছে! ছি!
ইমরান যেতে যেতে উঠুন থেকে পেছনে ফিরে ঠোঁট নাড়িয়ে শব্দহীনভাবে বললো, “সরি”। নাফিসার ইচ্ছে করছে মাটি থেকে ইট তুলে নিয়ে তার দিকে ছুড়ে মারতে! বাইরে বেরিয়ে গেছে তাই কিছু বললো না! একা পেলে সত্যিই কিছু একটা করতো! উঠুনের রশিতে কম্বল মেলে দিতে দিতে জেরিন দেখছিলো তাদের। নাফিসাকে থু থু ফেলতে দেখে বললো,
– কি হইছে?
বদ আচরণের কারণে এই জেরিনকে দেখলেই নাফিসার রাগ উঠে। তাই সে-ও এবার একটু কটুবাক্য বললো,
– হাসব্যান্ড ওয়াইফের মধ্যে তো কত কিছুই হতে পারে। সেটা আপনাকে কেন বলতে যাবো, ভাবি?
নাফিসার জবাবে জেরিনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। নাফিসাও আর দাড়িয়ে নেই তার ফ্যাকাসে মুখ দেখার জন্য। সে গোসল করতে চলে গেলো।
আজ নাস্তার পর বড়মার সাথে গল্প করলো কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ আবার জিহানের সাথে খেলাধুলা আলাপ। পরক্ষণে চলে এলো নিজ কক্ষে। সময় যেন কাটছেই না। নিশাতও বাসায় নেই যে একটু আড্ডা দিবে। ফোন নিয়ে দেখে ব্যালেন্স নেই, যে বাবা-মা ও আপুদের সাথে কথা বলবে! ইমারজেন্সি ব্যালেন্স তো আগেই শেষ ছিলো, এখন সেটা নেওয়ারও সুযোগ নেই! বই নিলো পড়ার জন্য, পড়তেও ভালো লাগছে না। সে দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। হৈচৈ শুনে ঘুম ভাঙলো দুপুরে। নাফিসা শোয়া থেকে উঠে বসে জানালা দিয়ে দেখলো পাশের বাড়িতে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে। এমন ভরদুপুরে তাদের খেলতে হয়! হঠাৎ করে ঘুম ভাঙায় যেন মাথাটা ঝিম ধরে আছে! কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর আযান পড়লে নামাজ আদায় করে নিলো। বিকেলটা কাটলো নিশাতের সাথে। সন্ধ্যা কাটলো রান্নাঘরে টুকটাক কাজকর্ম করে। অত:পর কাজ সেড়ে রুমে এসে ইমরানকে দেখে এখন আবার মনে হলো সকালের কথা। ইচ্ছে করছে মাথাটা ফাটিয়ে দিতে কিন্তু সেই মনোবলটা আপাতত নেই। সময়ের সাথে সাথে সেটা মজে গেছে! ইমরান খুব মনযোগ সহকারে পড়ছে। নাফিসা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথা আঁচড়ে নিচ্ছে। ইমরান বললো,
– পড়তে বসো না কেন তুমি?
– পড়াশোনা করে কি লাভ! একদিন তো মরেই যাবো!
– তুমি তো দেখছি সাধকদের মতো সাধনায় বসেছো! কিসের সাধনা করছো?
– সংসার সাধন!
গম্ভীরভাবে কথাটুকু বলে নাফিসা নিজেই হেসে উঠলো। ইমরানও নিচু শব্দে হেসে বললো,
– সব সাধনা বাদ রেখে এবার পাঠ্যবই সাধন করো৷
– আপনি কিসে পড়েন?
প্রশ্ন করে নাফিসা আয়নায় ইমরানের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। ইমরানও বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আয়নায় নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
– নাই ক্লাসে।
– নাই ক্লাস! এটা আবার কোন কোর্স!
– প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পর যদি আর কোনো কোর্স অর্জন করার ইচ্ছা না থাকে তাহলে বাকি ক্লাস গুলোকে বলে নাই ক্লাস।
ইমরানের এমন কথা সম্পূর্ণটাই নাফিসার মাথার উপর দিয়ে গেলো! মগজে ভালোভাবে আঁটানোর জন্য সে বললো,
– আপনি বই পড়ছেন অথচ বলছেন নাই ক্লাস! বুঝলাম না আপনার কথা৷ আবার বলুন।
এবার ইমরান তুলনামূলক জোরে হেসে উঠলো এবং বললো,
– আরে বোকা, নাই ক্লাস বলতে আবার কোনো ক্লাস আছে!
– আরে বলদ! সেজন্যই তো আবার বলতে বললাম। তাছাড়া, মেয়েরা আবার বোকা হয় নাকি!
– হা হা হা! তাহলে কি হবে, বোকি?
– বোকি বলতে কোন শব্দ আছে কিনা আমার অজানা। তবে বোকার ক্ষেত্রে মেয়েরা হবে বোকা মেয়ে।
– ওহ্, আচ্ছা! মেয়ে শব্দটা বাদ পড়েছিলো, তাই না! আচ্ছা, যাও। বোকা বউ আমার! সবচেয়ে বেশি অবাক তো লাগছে এটা ভেবে, আমার বউ আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না! কিছু না জেনেই বসে গেছে বিয়ের পীড়িতে!
– হুহ্, পন্ডিত! আপনি আমার সম্পর্কে জানেন নাকি!
– হুম, জানিতো।
– কি জানেন?
– আগে আমারটা শুনো। এবছর আমার মাস্টার্স কমপ্লিট হলো। খুব ইচ্ছে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। আপাতত সেই চেষ্টাই করছি। আর সেজন্যই সময় পেলে বই নিয়ে বসে থাকি।
– ইচ্ছা নাকি স্বপ্ন?
– দুটোই।
– আচ্ছা, এবার বলুন আমার সম্পর্কে কি জানেন। আমিও দেখি আপনি কত পন্ডিত!
– তুমি, আমার একমাত্র শ্বশুরের তৃ-তনয়া’র মাঝে ছোট্ট তনয়া নূর নাফিসা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে এখন একাউন্টিং- এ অনার্স করছো। কিছুদিন আগে আত্মকর্মসংস্থানমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করে তুমি এখন নবীন উদ্যোক্তা। নিয়মিত নামাজ ও কুরআন পড়। বেশ চতুর মেয়ে যে কি-না চাতুর্যের সাথে স্পষ্টবাদী একজনও বটে। সর্বদা সুশৃঙ্খল, মার্জিত ও শালীনতার সাথে চলাফেরা করে। অন্যকে ভালো উপদেশ দিতে জানে আর একটু বেশিই রাগ অভিমান করতে জানে।
ইমরান থামতেই নাফিসা বললো,
– এটুকুই?
– এখানে এটুকু বললাম!
– হু, আপনি অনেক কিছুই জানেন না!
– যেমন?
– যেমন আমি বাইরে যতটা সুশৃঙ্খল, ভেতরে ততটাই উশৃংখল! বাইরে বের হই বোরকা হিজাব, মাঝে মাঝে নিকাব। আর বাসায় থাকি তো উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুল, ফ্যাকাসে মুখ, নো অয়েল, নো ক্রিম আর নো সাজুগুজু! নিজেকে বাদে বাকিসব থাকবে গোছানো। পড়তে বসি তো চেয়ার টেবিল ছেড়ে কখনো খাটে শুয়ে-বসে, কোলে এক বালিশ রেখে, পিঠের নিচে আরেক বালিশ! কখনো মেঝেতে আমি আর বইখাতা টুল অথবা খাটে! সোফায় বসি তো পা উঠে যায় টেবিলে! খেতে বসি তো হাড়িপাতিল সব একসাথে সামনে নিয়ে। যাতে বারবার আসা-যাওয়া না করতে হয়। চুলার ধারে কাছে যাওয়া আমার মনের এলার্জি! বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কিচেনে নো যাওয়া-যাওয়ি! ঘর গুছানো বাদে সকল কাজ থেকে একশো হাত দূরেই থাকি! তবে বাবামায়ের আদেশ হলে ভিন্ন ব্যাপার আরকি!
ইমরান প্রায় হা করে তার কথা শুনছিলো। নাফিসা হঠাৎ করেই কথা থামিয়ে দিয়ে বললো,
– আপনি তো আস্ত একটা গাধা! নিজে না পড়ে বই খুলে রেখে শয়তানকে বিসিএস ক্যাডার বানাতে চাইছেন!
ইমরান এবার বই বন্ধ করে হাসতে লাগলো এবং হাসির সাথেই বললো,
– অদ্ভুত একটা মেয়ে তুমি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here