মধুরেণ_সমাপয়েৎ ৯ম_পর্ব

0
910

মধুরেণ_সমাপয়েৎ
৯ম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

মনের অজান্তেই মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেলো আয়াতের,
– বাবা, তুমি এখানে?

রামিম সাহেব কড়া নজরে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তার চোখে কৌতুহলের ছাপ ফুটে উঠেছে। এতো মেহমানের মাঝে নিজের রাগ ও প্রকাশ করতে পারছেন না। শারমিন বেগম দৌড়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন, এক সপ্তাহ মেয়েকে না দেখে অস্থির মনটা আজ শান্ত করছেন। আয়াত ও মাকে কাছে পেয়ে পাগলের মতো কাঁদছেন। মা-মেয়ের এমন মিলন সবার চোখ এড়ালো না। সাফওয়ানের পরিবারের লোকেরা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু অনুষ্ঠান বিধায় কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছেন না। রামিম সাহেব উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– তুমি এখানে কি করছো? আমি তো ভেবেছিলাম ওই লাফাঙ্গার সাথে পালিয়ে আমার মুখে চুন কালি লেপে দিতে বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছো। কিন্তু এখানে তোমাকে দেখবো তা আশা করি নি। তা কোথায় তোমার গুনধর বয়ফ্রেন্ড কাম হাসবেন্ড।

আয়াতের মুখে যেন তালা পড়ে গেলো, কি বলবে বুঝেই পাচ্ছিলো না, অমনি পেছন থেকে সাফওয়ান আয়াতের নাম ধরে ডেকে উঠে। কাছে এসে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,
– স্টেজের কাছে যাও, মা তোমাকে খুজছে।
– ওহ তাহলে এই সেই ছেলে?

কড়া কন্ঠে প্রশ্নটি ছুড়ে দেন রামিম সাহেব। সাফওয়ান হতবাক দৃষ্টিতে রামিম সাহেবের দিকে একবার, আরেকবার আয়াতের দিকে তাকাচ্ছে। মনে হাজারো প্রশ্নরা ভিড় করছে। আয়াতকে ইশারা করলে আয়াত ইশারাতেই জানায় বাবা-মা। সাফওয়ান পারলে সেখান থেকে দৌড় মারে, কিন্তু আয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। রামিম সাহেব এগিয়ে এসে সাফওয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে ধীর কন্ঠে বললেন,
– তোমাকে দেখে ভদ্র বাড়ির ছেলে মনে হচ্ছে, কিন্তু তুমি এমন একটি কাজ করার আগে একবারো এটা ভাবলে না একটা পরিবারের কতোটা অসম্মান হয় যখন বিয়ের কনে বিয়ে থেকে পালিয়ে যায়। যাক গে, আমার মেয়ে তো আমার কথা একবার ভাবলোও না পালিয়ে আসলো তোমার সাথে, তা সুখে রাখতে পারছো তো তাকে। না কি এখনো তোমার বাবার টাকাতেই খায়াচ্ছো তাকে?
– আংকেল আমার কথা একটি বার শুনুন।
– কি শুনবো? সেদিন তোমার মেয়ে তোমার মুখে চুনকালি মেখে এমন চলে যাবে তারপর আমি তোমার কথা শুনবো। শারমিন চলো, আমি নিজামকে পরে সব বুঝিয়ে বলবো।
– …………

রামিম সাহেবের চোখ ছলছল করছে, শারমিন বেগমের হাত ধরে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন নিজাম সাহেবের মুখোমুখি হন তিনি। সাফওয়ানের যা ভয় ছিলো সেটাই হয়েছিলো, একে তার কোনো কথা রামিম সাহেব শুনতে রাজি নন। উপরে তিনি নিজাম সাহেবের বন্ধু মহলের একজন। যদি নিজাম সাহেবের কানে একবার যায় যে সে তার বন্ধুর মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে খুব বড় ঝামেলা হয়ে যাবে। উপরে রামিম সাহেব ভাবছেন সাফওয়ান ই সে যার জন্য তার মেয়ে পালিয়েছে। কপালে ঘাম জমতে শুরু হয়েছে তার। এখন কি করবে তার জানা নেই। আয়াতের দিকে তাকালে দেখতে পায় তার চোখে অশ্রুরা ভিড় করেছে, ছলছল নয়নে দাঁড়িয়ে আছে সে। সাফওয়ান শিওর সে সামনের আসন্ন বিপদকে দেখতে পাচ্ছে না। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে আয়াতের হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিলো সে। যা হয়ে যাক এই মেয়েটাকে আর কষ্ট পেতে নিবে না সে।

রাত ১২টা,
বসার রুমে মুখ শক্ত করে বসে আছেন নিজাম সাহেব। অন্য সোফায় রামিম সাহেব এবং শারমিন বেগম বসা, সেলিনা বেগম একেই মেয়েকে বিদায় দিয়ে দুঃখের ভেতরে আছেন। এক কোনায় সাফওয়ান আয়াতের হাত নিজ হাতে মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে। রামিম সাহেব যখন নিজাম সাহেবকে সবখুলে বলেন তখন অনুষ্ঠানের খাতিরে ওই মূহুর্তে তিনি মৌনতা বজায় রাখেন। আর রামিম সাহেবের কাছে অনুরোধ করেন যাতে তিনি আজ রাত এখানেই থাকেন। ব্যাপারটার খোলসা না হওয়া অবধি রামিম সাহেবের যাওয়াটা ঠিক দেখাবে না। আয়াত এর মাঝে রামিম সাহেব এবং শারমিন বেগমের সাথে হাজারো বার কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল শুন্য। নিজাম সাহেব এবার একটু নড়েচড়ে বসে সাফওয়াঙ্কে জিজ্ঞেস করেন,
– তুমি কি এই মেয়েকে পার্লার থেকে নিয়ে পালিয়েছিলে?
– জ………জ্বী বাবা
– তোমরা কি বিয়ে করেছো?
– বাবা, আগে আমাদের পুরো কথা টা শুনেন
– বিয়ে করেছো কি না? (চিৎকার করে)
– না
– অথচ একসাথেই থাকতে
– জ্বী
– ছি ছি এই শিক্ষা আমি তোমাকে দিয়েছি? ঢাকায় যেয়ে এই উন্নতি হয়েছে তোমার?
– আংকেল সাফওয়ান ভাই এর দোষ নেই। ওর সাথে আমি পালিয়েছি কিন্তু ও আমার সাথে পালায় নি।(আয়াত)
– এই মেয়ে তুমি চুপ থাকো আমি আমার ছেলের সাথে কথা বলছি। আর কি আবল তাবল বলছো তুমি?
– আপনি আমার উপর চিল্লান, ওকে বকছেন কেন? ও কি করেছে?
– তুমি একে দোষ করেছো উপরে সাফাই গাইছো।

রামিম সাহেব নিজাম সাহেবকে শান্ত করতে বললেন,
– শান্ত হ। তোর ছেলের প্রতি আমার কোন আপত্তি ছিলো না, শুধু বেকার বিধায়।
– কে বেকার? আমার ব্যবসায় যোগ দিবে না বলে ঘর ছেড়েছে ৪ বছর। আর্টিস্ট হবে। সামান্য একটা চাকরি করে ঢাকায়। আর আর্ট করে ছবি বেঁচে খায়।
– তাহলে আয়াত যে বলতো সে কাজকাম করে না
– হয়তো এসব আমার মতো তার ও চোখে কাজের পর্যায়ে পড়ে নি।
– তাহলে তো কথাই নেই। দেখো ওরা একে অপরকে যেহেতু ভালোবাসে, এক সাথে এক সপ্তাহ আছে। তাই ওদের বিয়েটা করে দেওয়াই বেটার।

রামিম সাহেবের ৩৬০ ডিগ্রি এংগেলের পল্টি আয়াত এবং সাফওয়ানের বজ্রপাত ঘটালো। নিজাম সাহেব আমতা আমতা করে বললেন,
– কিন্তু তোর তো ওকে অপছন্দ।
– ছিলো, এখন নেই। ছেলে স্বাবলম্বী, আমার মেয়েকে ভালোবাসে আর কি চাই আমার?
– দুই পরিবারের সম্মানের ব্যাপার, ঠিক আছে তাহলে সামনের শুক্রবার এদের বিয়ের আয়োজন করি?
– এতো দ্রুত? আমি তো
– আরে একটা বিয়ের লোকজন তো আছেন ই আর তুই ও লোকজন ডেকে নে। পরে ঢাকা আবার অনুষ্ঠান করে নিস।

সাফওয়ান তাদের গাড়ি থামাতে বাধ সাধলেও লাভের লাভ কিছুই হয় না। এখন সব উপর ওয়ালার উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। রামিম সাহেব আয়াতের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আদর করেলেন, পরে সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরলেন। দুই পরিবার বিয়ের কথায় খুব খুশী। আয়াতের নিজের চুল ছিড়তে মন চাইছে, কেনো সাফওয়ানের সাথেই বডিগার্ডদের সামনে পালাতে হলো। আর এখন যদি তারা বলে কাহিনী আসলে ঠিক তার উলটো তাহলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না।

রাত ৩.৩০টা,
ছাদে একমাথা হতে অপর মাথা পায়চারী করে যাচ্ছে আয়াত, সাফওয়ানের আসার কথা অথচ সে এখনো আসছে না; ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে লাফ দিতে। এমন ডেড এন্ডে এসে পৌছেসে যে এর আগের পথের কোনো হদিস তার কাছে নেই। কাধে কারোর স্পর্শ পেতেই লাফিয়ে উঠে সে। পেছনে ফিরে দেখে মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাফওয়ান। রাগী কন্ঠে বলে উঠে,
– এই আপনার আসার সময় হলো?
– কি করতাম? কাজিনরা ছাড়ার নাম নিচ্ছিলো না
– জানি জানি, আপনার অন্না তো মরা কান্না লাগিয়েছে। এখন মেইন পয়েন্টে আসি, কি প্লান?
– কিসের?
– এই বিয়ে ভাঙার?
– আই ডোন্ট নো।
– মানে? আপনি না জানলে কে জানবে? কি দরকার ছিলো ওই সময়ে বাবার সামনে আসার?
– এটা মোটেও আমার দোষ না। আমি তো নাহয় বাবাকে কি বলবো বুঝছিলাম না, কিন্তু তোমার? তুমি কেনো তোমার বাবাকে বুঝালে না?
– আপনার কি দরকার ছিলো ঢাকায় যেয়ে স্বাবলম্বী হবার?
– ও এখন দোষ আমার? ওকে ফাইন যা একটু ভেবেছিলাম বিয়েটাকে কেচিয়ে দেবার চেষ্টা করবো এখন মনে হচ্ছে অযথা
– না না, যাবেন না। সরি সরি এবার বলুন কি প্লান?
– প্লান আপাতত এইটাই যে আমাদের বিয়ে করতে হবে
– কিহহহ
– হুম, তারপর ছয়মাস পর আমরা ডিভোর্স আপিল করবো। দেখো বিয়ে আমাদের এমনেও করতে হবে ওমনেও। তাই অহেতুক কষ্ট না করে ট্রায়াল ম্যারেজ করে নেই। আর দেখো এই উপায়ে আমাদের পরিবারের মানুষগুলো ও খুশী। কতোদিন পর তোমার বাবা-মা তোয়াকে কাছে টেনে নিয়েছে বলো
– পরে ডিভোর্সে ফ্যামিলি রাজি না হলে?
– আরে ছয়াস বহুত সময়, কিছু একটা প্লান করে নিবো নো টেনশন। বিয়েতে চিল করো
– এটাই এখন সবচেয়ে বড় টেনশন। আপনার ফুপু পারলে আমাকে চিবিয়ে খায় আর অন্না ও তো বিয়ের দিন না বিশ খাইয়ে দেয়। উফফফফ
– আয়াত সত্যি সত্যি বিয়েটা করলে কি খুব খারাপ হবে?
– মানে?

সাফওয়ান তখন আয়াতের কাছে এসে ওর মুখটা হাত দিয়ে আলতো করে ধরে। তারপর ধীর গলায় বলে,
– দেখো তোমায় কোন আচ লাগতে দিবো জীবনে, সুখে রাখার সব রকম চেষ্টা আমি করবো। একটাবার বিশ্বাস করে দেখো।

আয়াত হা করে সাফওয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, লোকটা সত্যি বলছে? কি হচ্ছে এসব? ঠিক তখন ই পিছন থেকে………………….

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here