“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬১
(নূর নাফিসা)
.
.
– আপনার ভাবি মনে হয় আপনাকে পছন্দ করে!
হঠাৎই নাফিসা এমন কথা বলায় ইমরানের মুখে হাসির রেশ কমে গেছে। সে একটু নেড়েচেড়ে বসে বললো,
– এতো তারাতাড়ি বুঝে গেলে! আমি ভেবেছি আরও অনেক দীর্ঘ সময় লাগবে তোমার বুঝতে। এখন দেখলাম সপ্তাহ খানেক যেতেই বুঝে গেছো! যাইহোক, এখন কি আমাকে নিয়ে সন্দেহে আছো না?
– না।
– কেন?
– আই থিংক, আপনার কোনো ইন্টারেস্ট নেই তার প্রতি।
– এতো বিশ্বাস আমার উপর!
– হুহ্ ! কচুর বিশ্বাস! বিয়ের প্রথম রাতেই আপনাদের কথপোকথন শুনেছি আমি। আর সে থেকেই পরপর কর্মকাণ্ডে বুঝেছি যতটুকু বুঝার!
– বিয়ের প্রথম রাতেই শুনেছো মানে! বুঝলাম না!
– ঘুমানোর পূর্বে আপনি ঘরে প্রবেশ করার সময় আপনার ভাবি বলছিলো না, “তুমি যাবে না এই ঘরে! সব জেনেশুনে আমাকে এভাবে ঠকাতে পারো না তুমি। তুমি শুধুই আমার, আর কারো না!” আর আপনি তখন বলেছিলেন, “আজ থেকে আমি ম্যারিড। এই ঘরে আমার বউ। দয়া করে এসব পাগলামি বন্ধ করে দে। আর নিজের অবস্থান বুঝে নে। বাড়াবাড়ি করলে পরিবারে জানাজানি হবে, যেটা তোর জন্য অমঙ্গলজনক হয়ে উঠবে!” এটুকু শোনার পর ভেবেছি নিশ্চয়ই আপনার সাথে কারো গিট্টু লেগে আছে। কিন্তু কে সে, তা বুঝতে পারিনি। পরক্ষণে আপনার ভাবির আচার-ব্যবহার দেখে বুঝে গেছি তিনিই সে! কিন্তু এটা কেমন হলো! আপনার গার্লফ্রেন্ড আবার আপনারই বড় ভাবি! অথচ নেশা এখনো আপনার প্রতিই!
ইমরান বিছানা ছেড়ে নেমে এসে দরজাটা লক করে দিলো। অত:পর আবার খাটে এসে বসে বললো,
– ও আমার গার্লফ্রেন্ড না। আমার মামাতো বোন। ও আমাকে পছন্দ করে কিন্তু আমি না। মা এবং মামা দুজনেই ঠিক করে ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিবে জেরিনকে। কিন্তু জেরিন আমাকে পছন্দ করতো সেটা আমিও জানতাম না, জেনেছি ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর। সে বিয়ের আরও অনেক আগে থেকেই আমার একটু বেশিই কেয়ার করতো, দুষ্টুমি ফাজলামোতেও আমার সাথে বেশি লেগে থাকতো। কিন্তু তখন আমি সেটা কাজিনদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক হিসেবেই ধরে নিয়েছি। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর যখন সে সামনাসামনি এসে বলে আমাকে ভালোবাসে আর আমি যেন তাকে বিয়ে করি, তখন আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হয়নি! আমি কখনো ভাবতেও পারিনি আমার প্রতি তার এমন ফিলিংস আছে তার মাঝে! আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি আমি এসব ফিলিংস থেকে একশো হাত দূরে! সে মানছিলো না! সে বলেছে পরিবারের কাছে না বলতে পারলে যেন আমি তাকে নিয়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু পালিয়ে যাবো কোথায় তা নিয়েও কত রকম বুঝ দিয়েছি, কোনো কাজ হয়নি। তখন আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। একে তো আমি এতো স্বল্প বয়সে বিয়ে করবো না তার উপর ভাইয়ার সাথে বিয়ে পাকা তাও আবার ও আমার মামাতো বোন! অনেক ভেবে আমি তার সামনেই যাইনি বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত। ভাইয়াকে যেহেতু পছন্দ নয়, তখন ভেবেছিলাম সে বিয়ে ভেঙে দিবে কিন্তু তা করেনি। তখন সেই ভেবে হাফ ছেড়েছি যে, সে হয়তো বুঝতে পেরেছে আর ভাইয়ার সাথেই খুশিমনে বিয়েতে রাজি হয়েছে। বিয়ের পর থেকে দিনের পর দিন তার কাণ্ডে আমি হাজার বোল্ডেজ শকড! দেবর হওয়া সূত্রে ভাইয়া বলা ছেড়েছে, নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে আরও রসিকতার সম্পর্কে! পরিবারের সবার সামনে আদর্শ বউ হওয়ার নাটক আর গোপনে আমার সাথে ভিন্ন সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার ষড়যন্ত্র! ভেবেছি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু বিয়ের তিন বছর পেরিয়ে গেছে তবুও তার চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেনি৷ বরং আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে গেছে! সুযোগ পেলেই তুলে ধরে আমি একবার বললেই সে ভাইয়াকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। এদিকে আমি নিরুপায়! যদি কাউকে জানতে দেই তাহলে সংসার এবং কয়েকটি সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরবে। আবার যদি চুপচাপ বসে থেকে তাকে প্রশ্রয় দেই তাহলেও সে, দিনের পর দিন চেষ্টা করেই যাবে আমার সংস্পর্শে আসার। অনেক ভেবেচিন্তে এবার সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ে করেই ফেলবো। হোক বয়স ছাব্বিশ, না বালক তো আর নয়! এবং সেই সিদ্ধান্তে সাপোর্ট করলেন বড়মা। কোনো না কোনো ভাবে তিনিও জেনে গেছেন জেরিন আমার প্রতি দুর্বল। তাই মেয়ে দেখা শুরু করলাম।
– আপনার বড়মা জেনেছে আর মা, ভাই জানতে পারেনি?
– জানলে তো নিশ্চয়ই কোনো গন্ডগোল বেধে যেতো। হয়তো তারা আমাদের কাজিনদের সম্পর্ক হিসেবে মেনে নিয়েছে। নতুবা জেরিন এমনভাবে ম্যানেজ করে রাখে যাতে কেউ না বুঝে! বিয়ের জন্য তোমার আগে তিনটা মেয়েকে দেখেছি। বারবারই মাকে ফুসলিয়ে সে গিয়েছে সাথে। আর মায়ের কাছে এসে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দোষ খুঁজে বলেছে মেয়ে ভালো না, পছন্দ হয়নি। তোমাকে দেখার পর ভালো লেগেছে কেননা তুমি স্পষ্টবাদী। তুমি নিশ্চয়ই তার বাধ্য হয়ে থাকবে না, চঞ্চলতার সাথে তার দুর্বলতার রেশটা কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু আরাফ ভাই বললো তোমাকে বিয়ে দিবে না। এরপর আবার আরও একটা মেয়ে দেখেছিলাম। তাকে পছন্দ হয়েছিলো কিন্তু একটু বেশিই শান্তশিষ্ট স্বভাবের। তাই ওটা বাদ দিলাম। এরপর আমার ভাগ্য টেনে নিয়ে গেলো আবার সেই তোমার কাছেই!
– বাহ! বাহ! কি সুন্দর পিরিতের কিচ্ছা! মাঝখানে টেনেহিঁচড়ে আনার জন্য আমাকেই চোখে এটে গেলো! মা যা বলে ঠিকই বলে! এ জন্যই লোকের সামনে এতো চঞ্চলতা দেখাতে নেই! কিন্তু চোখের সামনে উল্টাপাল্টা কিছু দেখলে যে আর চুপ থাকতে পারি না!
– খুব বেশি বিপদে ফেলে দিলাম তোমাকে!
– আবার জিজ্ঞেস করেন! এসব ধারালো অস্ত্র দেখলে গা জ্বলে উঠে! আমি কাউকে কটু কথা শুনাইও না, অন্যের মুখে শুনতেও পারি না!
– সরি ফর দ্যাট, বাট এছাড়া উপায় খুজে পাই নি।
– খবরদার, অপরাধ করে করে সরি যপেছেন তো! শুনতে শুনতে এখন বড্ড অসহ্য লাগে এই শব্দটা! উনিশ থেকে বিশ হলেই সরি, সরি আর সরি!
– ওক, চেষ্টা করবো না বলার। তবে এটা প্রত্যাশা করছি, এবার আমাদের দাম্পত্য জীবন দেখে সে তার উদ্দেশ্যের মোর ঘুরিয়ে নিবে। কি বলো?
– জীবনেও না।
– কেন! এখনো কি মানতে পারছো না আমাকে ও আমাদের বিয়ে! বিয়ে তো একদিন হতোই কারো না কারো সাথে। মানছি তো নিজ স্বার্থ ও পরিবারকে ভেবে তোমাকে ঘরে তুলেছি, এখন এতে আপত্তি কোথায়!
– চুপ থাকুন। আর দু চার লাইন বেশি বুঝা বন্ধ করুন। এতো বেশি প্যাচাল আমার ভালো লাগে না। আপনার ওই ভাবি মোটেও উদ্দেশ্যের মোর ঘুরাবে না এই জন্য, কারণ আপনারা তাকে আস্কারা দিয়ে রেখেছেন।
– আমি কিন্তু মোটেও না।
– মোটেও না? কম কিসে আপনি শুনি! এর জন্য তো আপনি আরও বেশি দায়ী!
– আমার দোষ এখানে কিভাবে হতে পারে!
– ও সম্পর্কে আপনার কি হয়?
– মামাতো বোন।
– এর বাইরে..
– বড় ভাইয়ের বউ।
– আশ্চর্য! ভাইয়ের বউকে কি “ভাইয়ের বউ” বলে ডাকে!
– না, “ভাবি”।
– তো, এক বাক্যে বলা যেতো না “ভাবি”! আমাকে তিনটা প্রশ্ন কেন করালেন!
ইমরান তার দিকে তাকিয়েই খাটে পা তুলে বালিশ কোলে নিতে নিতে বললো,
– কে, জানতো এতো প্যাচিয়ে নিবে!
নাফিসা ব্রু কুচকে বললো,
– কি! আমি কথা প্যাচাই!
– না, মানে তোমার কথার ধরনে আমার মাথায় প্যাচিয়ে গেছে!
– তো সেটা বলুন না, যে আপনার মাথার দোষ।
নিশব্দে শরীর কাপিয়ে হেসে ইমরান বললো,
– ওহ্, আচ্ছা। এবার বলো, কি যেন বলছিলে ভাবি নিয়ে!
– ও বয়সে যেমন তেমন হোক, সম্পর্কে তো আপনার ভাবি তাই না?
– হুম।
– তো আপনি ভাবি ডাকেন না কেন?
– আগেই তো বললাম, ও আমার মামাতো বোন। আর আগে থেকে নাম ধরে ডেকে অভ্যস্ত।
– এজন্যই তো সে-ও তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে অভ্যস্ত! আপনি ভাবি ডাকলে সম্মাননার জন্য হলেও সে কিছুটা লজ্জাবোধ করতো! কিন্তু তা নয়! আপনিও আগের মতো, সে-ও আগের মতো। তাহলে চলছে চলুক!
ইমরান খাটে হেলান দিয়ে কোলে বালিশ নিয়ে তাকিয়ে আছে নাফিসার চোখের দিকে। এখন তার মনোভাব ইতিবাচক। খুব দ্রুতই নাফিসার কথার মর্মার্থ গেথে গেছে তার মস্তিষ্কে আর খুব সহজেই তার একটা দোষও চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলেছে নাফিসা। তার চোখের সামনে বসা মেয়েটা তো সেই পাগলটা না, যে নাকি দুদিন আগেও কান্নাকাটি করতো, রাগ করতো, জেদ করে উল্টাপাল্টা বলতো! নাহ! সে পাগল কেন হতে যাবে! এ তো এক পাগলী, যার মাঝে যেমন রাগ আছে, তেমন জেদ, যেমন বুদ্ধিমতী আর তেমনই ভেজালমুক্ত! যার ভিন্ন রূপ আর ভিন্ন গুন বরাবর করে যাচ্ছে তাকে মুগ্ধ!
নাফিসা চুল বিনুনি করে উঠে পড়লো ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে। ইমরানের দিকে চোখ পড়লে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
– আমার দিকে কি দেখেন?
– দেখি না, ভাবি।
– কিহ! ভাইয়ের বউকে ভাবি না ডেকে এখন নিজের বউকে ভাবি ডাকা হচ্ছে!
ইমরান জ্বিভ কেটে বললো,
– আমি তেমন কিছু বুঝাতে চাই নি। বলতে চেয়েছি তোমার দিকে দেখছি না শুধু, ভাবছিও।
– তো, সেটা না বলবেন। যাইহোক, কি ভাবছেন শুনি?
– এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না।
– তো কিভাবে চালাবেন? থেমে থেমে নাকি এবার দৌড়ানো শেখাবেন?
– এগজ্যাক্টলী, এখন থেকে দৌড়াবে তা-ও আবার তোমার মাধ্যমেই।
– আবারও আমাকে টানছেন!
ইমরান বিছানা ছেড়ে নেমে হঠাৎই একহাতে নাফিসাকে কাছে টেনে বললো,
– টানবো আর কি! শক্তিশালী বন্ধনেই তো বেধে ফেলেছি।
নাফিসা ইমরানের পেটে গুতো দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে বললো,
– হুহ্! সরুন! কি ভেবেছেন টা কি! সকালে কিছু বলিনি তাই এখনো চুপ থাকবো!
ইমরান তার পেটে হাত বুলাতে বুলাতে হাসিমুখে বললো,
– আচ্ছা! কি বলবে শুনি?
– বলবো না, করবো।
– তা কি ই বা করবে?
নাফিসা দরজার কাছে এসে বললো,
– এই মুহূর্তে রুম থেকে পালাবো!
সামনের দাতগুলো বের করে একটা হাসি দিয়ে যেই দ্রুত দরজা খুললো, অমনি পাচ আঙুল ওয়ালা এক হাত এগিয়ে এলো তার মুখ বরাবর! নাফিসা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। ইমরানও চমকে উঠেছে তার চিৎকারে! অত:পর তাকিয়ে দেখলো নিশাত দরজার ওপাশে দাড়িয়ে বুকে থু থু দিচ্ছে! নাফিসা ভয়ে চিৎকার দিয়ে হাপিয়ে উঠেছে! নিশাত বললো,
– ভাবি! এভাবে কেউ চিৎকার করে! আমি ভয় পেয়ে গেছি!
– তুমি ভয় পেয়েছো, নাকি আমাকে ভয় দেখাতে এসেছো! আমি তো ৯৯% ভয় পেয়ে ১% কম এর জন্য বেচে আছি! এভাবে কেউ ভয় দেখায়!
– আরে! আমি তোমাকে ভয় দেখাতে আসছি নাকি! আমি ডিনারের জন্য তোমাদের ডাকতে এসেছিলাম! মাত্র হাত বাড়িয়েছি দরজায় টোকা দিবো, অমনি হাজির তোমার মুখ! আমি কি জানতাম নাকি তুমি এখন দরজা খুলতে এসেছো!
নাফিসা বুকে হাত রেখে লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– আর জীবনেও এভাবে ডাকতে এসো না! জ্ঞান হারানোর অভ্যাস নেই বলে আমি এখনো দাড়িয়ে আছি গো! প্রয়োজনে এক মিটার দূর থেকে হাক ছেড়ে দিও তবুও এভাবে নিশ্চুপ নক দিও না!
নিশাত হাসতে হাসতে বললো “ওকে”, ওদিকে ইমরান এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এখন হা হা করে হেসে উঠলো এবং বললো,
– যাও, পালাও আরও বেশি বেশি!