“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৬২

0
2580

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬২
(নূর নাফিসা)
.
.
গেইটে তালা দিয়ে তিনজন একসাথেই এসেছে বড় ঘরে। ইমরান সোফায় বসে পড়লো জিহানের সাথে কার্টুন দেখতে আর নাফিসা কিচেনে এসে বাটি নিলো ভাত বেড়ে নেওয়ার জন্য। নাফিসাদের আসতে দেখে বড় মা-ও রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। নাফিসাকে দেখলো বাটিতে ভাত নিচ্ছে আর মুখ চেপে হাসছে। বড়মা জিজ্ঞেস করলো,
– হাসছিস কেন?
নাফিসা আবিদা বেগমের দিকে তাকিয়ে আবার বড়মার দিকে তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। আবিদা বেগম তরকারির বাটি নিয়ে বেরিয়ে গেলে নাফিসা হাসতে হাসতে বললো,
– বড়মা, এখানেও দেখি ভাতের পাতিলে মুরগী ডিম পাড়ে!
বড় মা এবার বুঝতে পেরে হেসে উঠলো এবং বললো,
– দরকার কি আলাদা হাড়ি বসানোর! এজন্য ভাতের সাথেই ডিম সিদ্ধ করে ফেলে। হাড়িও বাচলো, গ্যাসও বাচলো, পানিও বেচে গেলো।
– হুম, আমার মায়ের মতো মিতব্যয়ী! ভাত তুলতে গেলে আলাদীনের প্রদীপ হয়ে ডিম বেরিয়ে আসে! লুকানো প্রদীপের কথা না জেনে মাঝে মাঝে তো চামচ দিয়ে নেড়ে ফাটিয়েই ফেলি! এরপর হয়ে যায় ডিম বিরিয়ানি!
নাফিসা ও বড়মা দুজনেই হেসে উঠলো। জেরিন এসে বললো,
– কি হইছে তোমাদের!
নাফিসা বললো,
– মুরগির ডিম হইছে।
জেরিন কিছু বুঝতে না পেরে ব্রু সামান্য কুচকে তাকালো। কিন্তু নাফিসা আর তাকে স্পষ্টভাবে কিছু বললো না। নিজের কাজ করতে ব্যস্ত।
টেবিলে সবকিছু এনে নাফিসা জেরিনের আগেই ইমরান ও বড়মার খাবার প্লেটে নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এলো। আরমান জিহানকে ডাকলো ডিম খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু জিহান গেলো না। জেরিন আবার তরকারির বাটি নিয়ে গেছে ড্রয়িং রুমে। নাফিসা টেবিলে খাবার গুছিয়ে দিয়ে দেখলো জেরিন তার খাবার নিয়ে ড্রয়িংরুমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত! তাই নাফিসা জিহানের জন্য ডিম হাতে নিয়ে বললো,
– ভাবি, আমি জিহানকে ডিম খায়িয়ে আসি। আপনি এখানেই বসুন। এখানেও তো কিছুর প্রয়োজন হতে পারে।
– জিহানকে তোমার খাওয়াতে হবে না। আমি পরে খাওয়াবো।
কথাটা বলে জেরিন প্লেট নিয়ে চলে গেলো। নাফিসা লক্ষ্য করলো আরমান কিছুই বললো না। দেখতেই বুঝা যায় অতি সহজ সরল লোক! কিন্তু এভাবে সরলতা দেখালে চলবে, বউটা যে প্রচন্ড ঠকিয়ে যাচ্ছে তাকে!
নাফিসা ডিম রেখে নিজের জন্য খাবার নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে ইমরানের পাশে বসতে বসতে বললো,
– আরে, ভাবি। ভাইয়া টেবিলে আর আপনি এখানে বসেছেন যে! ভাইয়ার তো কোনো প্রয়োজনও হতে পারে!
একই কথা এমন ভঙিতে আবার বলায় জেরিন চোখমুখ কাচুমাচু করে তাকালো। বড়মা বললো,
– ঠিকই তো! জেরিন, তুই এখানে কেন! নাফিসা ইমরানের সাথে বসেছে তোরও উচিৎ আরমানের সাথে বসার। টেবিলে না খেলে আগেও তো খেয়ে নিতে পারতি!
নাফিসার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জেরিন চলে গেলো প্লেট নিয়ে। নাফিসার মুখে অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠেছে যেটা ইমরানের চোখে স্পষ্ট ধরা দিয়েছে। খাওয়ার মাঝে নাফিসা আবার ফিক করে হেসে উঠলো! বড়মা আর ইমরান উভয়েই তার দিকে তাকালো। বড়মা জিজ্ঞেস করলো,
– কি হইছে?
– ভাতে মুরগী ডিম পারছে!
কথাটা বলে নাফিসা আরও বেশি হাসতে লাগলো। বড়মা মিটিমিটি হাসছেন আর ইমরান কিছুই না বুঝতে পেরে বললো,
– মানে!
– মানে আবার কি! ক্লিয়ার কথা বললাম! জিহান, তোমার জন্য ভাতে তিতি ডিম পাড়ছে। খাবে না?
জিহান কার্টুন থেকে মনযোগ সরিয়ে নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কি?
– ভাতের পাতিলে তিতি ডিম পাড়ছে তোমার জন্য।
– কই?
– টেবিলে।
জিহান সোফা থেকে নেমে দৌড়ে চলে গেলো। আর একটু পর শুরু হলো চিৎকার চেচামেচি। ইমরান জিহানকে ডাকলো কিন্তু জিহান এলো না। এতোক্ষণে নাফিসার খাওয়া শেষ। টেবিলের কাছে এসে বুঝতে পারলো জিহান প্লেটে রাখা ডিম খাবে না, সে ভাতের পাতিলের ডিম খাবে। জেরিন বারবার বলছে এটাই ভাতের পাতিলের ডিম। কিন্তু সে মানতে রাজি না! বিরক্ত করে যাচ্ছে সবাইকে! কারো মাথায়ই কিছু ঢুকছে না। কি করে ঢুকবে! নাফিসা ছাড়া যে কেউই জানে না কি শুনে এসেছে সে! আর কি ই বা বলছে!
নাফিসার মজা লাগলো জিহান নামক নাছোড়বান্দাকে দেখে। সে ডিম নিয়ে কিচেনে গেলো। ভাতের পাতিলে ডিম রেখে তারপর পাতিল নিয়ে এসে বললো,
– জিহান, এই যে নাও।
– তিতি কই?
– এ! আবার তিতিও! তিতি তো চলে গেছে!
– ডাকো।
– আচ্ছা, কাল ডাকবো। এখন এটা খাও তুমি।
জিহান ডিম হাতে নিয়ে আবার পাতিলে আছড়ে ফেললো। নাফিসা বললো,
– আরে, কি করে!
– ভাঙি?
– না, এটা ভাঙা-ই। কামড়ে খেয়ে ফেলো।
জিহান ডিম হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে দৌড়ে এলো। নাফিসা পিছু পিছু এসে দেখলো টিভিতে ডিম ঠেলে দিয়ে অগি’কে বলছে, “নেও, ডিম খাও। নেও!”
জিহানের দুষ্টুমিতে নাফিসা চরম অবাক সাথে হাসিও পাচ্ছে খুব! ইমরান বললো,
– হু, ডিম খাও অগি। আর বেশি বেশি শক্তি করে জিহানকে বক্সিং দাও।
জিহান হেসে লাফিয়ে উঠলো। নাফিসা ডিম হাতে নিয়ে জিহানকে খায়িয়ে দিলো। খাওয়াদাওয়ার পর যখন তিনজন বেরিয়ে আসছিলো ইমরান জেরিনকে বললো,
– গেইটটা লাগিয়ে দিয়ে যান, ভাবি।
নিশাত ইমরানের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো আর নাফিসা মিটিমিটি! ইমরান জেরিনের দিকে না তাকালেও নাফিসা তার মুখভঙ্গি দেখে নিয়েছে। জেরিনের চেহারা দেখার মতো হয়েছে! অত:পর নিশাতের সাথে কথা বলতে বলতে ইমরানের পিছু পিছু ঘরে চলে এসেছে। নাফিসা নিশাতের রুমে চলে গেলে ইমরান তার বই নিয়ে এসে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– পড়াশোনা ইগনোর করে খুব বড় ভুল করছো। ধরো এবং পড়। নিশাত পড়তে বস।
ইমরানের কথায় নাফিসা আজ পড়লো নিশাতের রুমে। সাড়ে দশটা বেজে গেলে নাফিসা তাদের রুমে এসে দেখলো ইমরান পড়ছে। সে বই রেখে বিছানা গুছাতে লাগলো। নাফিসা ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বিধায় ইমরানও বই রেখে দিতে দিতে বললো,
– জেরিনের রিয়েকশন কেমন ছিলো?
নাফিসা মুখ টিপে হেসে বললো,
– জেরিন কে?
– হা হা হা! ভাবির রিয়েকশন কেমন ছিলো?
– লাইক এন আউল!
ইমরান আবারও হেসে বললো,
– আচ্ছা! প্যাঁচা দেখেছো কখনো?
– না, আমি তো জিহান। যে এখনো প্যাঁচার দর্শন পাইনি!
– জিহানও তো দেখেছে! আমাদের মেহগনি গাছে প্রায়ই আসে। আর ভোরে ডাকে হুতোম প্যাঁচা।
নাফিসা মশারী টানিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ বিপরীত মুখী শুয়ে আবার সমমুখী হয়ে চোখ বুজে আছে। ইমরান কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। পরক্ষণে চিত করে রাখা হাতের উপর হাত রেখে আঙুলের ভাজে আঙুল রাখলো। নাফিসা চোখ খুলে তাকিয়ে ইমরানের ঠোঁটের কোনে অস্পষ্ট হাসির রেখা দেখতে পেল। হাতের দিকে তাকিয়ে যখন হাতটা টেনে সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, ইমরান মুঠোয় ধরে বললো,
– সমস্যা কি?
নাফিসা হেচকা টান দিয়ে হাত ছুটিয়ে কম্বলের নিচে গুটিয়ে বললো,
– লাইট অফ করুন।
ইমরান লাইট অফ করে নাফিসাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– তুমি ওদিকে ভাবিকে ঠিক করো আর আমি না হয় আমার বউকে ঠিক করি। কি বলো?
নাফিসা ছোটার জন্য জোরাজোরি করতে লাগলো। ইমরান বললো,
– আরে! এতে সমস্যা কোথায়?
নাফিসা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মশারী ফাঁক করে বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো। নিশ্বাসের সাথে তার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে! ইমরান উঠে বসে লাইট জ্বালিয়ে দেখলো নাফিসা দাড়িয়ে চোখ মুছছে! সে বিছানায় থেকেই বিষ্ময়ের সাথে বললো,
– নাফিসা!
নাফিসার কান্না যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে! সে বিছানা ছেড়ে নেমে কাছে আসতেই নাফিসা আরও পিছিয়ে গেলো! ইমরান বললো,
– কি হয়েছে, তোমার? কাদছো কেন?
– আমি আপনার সাথে ঘুমাবো না।
– সমস্যা কি তোমার! এভাবে না কেদে বলো আমাকে।
নাফিসা কিছু না বলে কেদেই যাচ্ছে! ইমরান আবার বললো,
– আমি তোমাকে স্পর্শ করেছি বলে কি সমস্যা? আমরা তো হাসব্যান্ড ওয়াইফ। এতে এমন রিয়েক্ট করার কি আছে?
– আপনি কাছে এলে আমার ভয় লাগে!
ইমরান নাফিসার মাঝে ভয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। নাফিসা কাপা কাপা হাতে বারবার চোখ মুছে যাচ্ছে। এটাও বেশ বুঝতে পারছে নাফিসা এমনিতে চঞ্চল ও স্বাভাবিক হলেও নিজেকে তার সংস্পর্শে আনতেও একেবারেই অপ্রস্তুত! হয়তো বিয়ে মেনেছে কিন্তু স্বামী মানতে পারেনি। তাকে মেনে নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া উচিত। ইমরান বললো,
– ঘুমাও গিয়ে। আমি স্পর্শ করবো না তোমাকে।
– আমি এখানে ঘুমাবো না। নিশাতের রুমে চলে যাবো।
– বললাম তো স্পর্শও করবো না। যাও।
নাফিসা ইমরানের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বিছানায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো। ইমরান কিছুক্ষণ বারান্দায় পায়চারি করে আবার রুমে চলে এলো।
.
.
[গত পাচ দিন ধরে সর্দি জ্বরে আক্রান্ত আমি। তাই এতোটা লিখতেও পারছি না, কারো পোস্ট বা কমেন্টে তেমন রিপ্লাইও করতে পারছি না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here