কারনে_অকারনে_ভালোবাসি পর্ব:2

0
2302

কারনে_অকারনে_ভালোবাসি
পর্ব:2
Suraiya_Aayat

” সাইয়ানে দেখা এসে মে পানি পানি হো গায়ি…
ওই হোই মে তো পুরা পানি পানি পানি হো গায়ি !”

হোম থিয়েটারে গানটা বাজতে বাজতে হঠাৎ এক বেসুরে কন্ঠস্বর গানের তালে মিলে গানের মেলবন্ধনে বিকৃতি সৃষ্টি করছে ৷ হঠাৎ যেন তালটা এদিক ওদিক হয়ে যেতেই আরু ওর তীব্র ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলো
” আমার বাসায় আবার দ্বিতীয় বাদশাহ কোথা থেকে চলে এলো, এতো রাতে কার এমন কর্কশ কন্ঠ আমাকে শুনতে হচ্ছে ৷”
নাচতে নাচতে খাট থেকে নেমে আঙুল উচিয়ে কথা গুলো বলছিলো আরু ৷ তখনই দেখলো দরজায় কারোর হাতের বা পায়ের তীব্র আওয়াজে দরজাটা কাঁপছে আর নড়ছে যার অর্থ কেউ দরজাটা খুলতে বলছে ৷ আরু বিরক্ত সহকারে দরজাটা খুলতেই একপ্রকার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পিছিয়ে এলো ৷ রাত 9.30 টা বাজে আর এই মুহূর্তে আরিশকে এই বাড়িতে আশা করেনি আরু ৷
আরিশকে দেখে দুকদম পিছিয়ে এলো আরু ৷ মনের ভিতর অজানা ভয় জানান দিচ্ছে তাহলে মানুষটা কি কোনভাবে বুঝে গেল যে ও নাটক করেছে ৷
কথাগুলো মনে আসতেই পেটে হাত দিয়ে আগের মতো নাটক শুরু করলো
” উইইই মা গো, বাবাগো, দাদীগো, খালাগো, ফুপিগো, মরে গেলাম গো ! কি পেট ব্যাথা ৷ আআআআ !”

আরিশ আরুর মাথা থেকে পা অবধি একবার তাকিয়ে তারপর হাব ভাব বুঝে রুমে ঢুকতেই আরু গিয়ে বিছানায় শুয়ে পেটে হাত দিয়ে চেপে ওর গোষ্ঠীজপ শুরু করলো ‌,,,বাবা গো ,মা গো, ফুপি গো…
আরুর মা আফসানা বেগম আরিশকে আলতো স্বরে ডেকে বলল
” আরিশ তুমি অসুস্থ, তুমি না হয় গেষ্ট রুমে গিয়ে রেস্ট নাও ৷”

আরিশ ওনার কাছে গিয়ে ওনার হাত থেকে খাবারের প্যাকেট গুলো নিয়ে বলল
” মামী তুমি চিন্তা করো না, আমি ঠিক আছি, জ্বর জ্বর লাগছিলো ওষুধ খেয়ে নিয়েছি ‌৷”
উনি জানেন যে আরিশ এক কথার মানুষ তাই উনি হাজারো পরামর্শ দিলেও আরিশ নেবে না তাই হার মেনে বলল
” আচ্ছা, কিন্তু তোমার কোন অসুবিধা হলে আরুকে বা আমাকে বলো ৷”

আরিশ মুচকি হেসে বলল
” জ্বি মামী ৷”
উনি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই আরিশ দরজাটা ঠেলে দিলো, আরু চোখ পিটপিট করে দেখছে, আরিশের অসুস্থতার কথাটা ওর কানে গেছে তাই আরিশকে আর বেশি প্যাচাবে না ৷
আবার নিজেই ওর আগের বুলি আওড়াতে লাগলো ৷ আরিশ খাবারের প্যাকেট গুলো আরুর বিছানার উপর রেখে বলল
” কি হয়েছে আরুপাখি ?”

আরু এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি দিতে দিতে বলল
” আআআআ বলতেই হবে?”

আরিশ রাগী চোখে আরুর দিকে তাকালো যা দেখে আরু আর বেশি কিছু না ভেবে বলল
” বোঝেন না নাকি কিছু ? মেয়েলি সমস্যা ৷”

আরিশ ভ্রু উচিয়ে বলল
” কিন্তু মামী যে তখন বলল তুমি নাকি কলেজের ক্যান্টিনের খাবার খেয়ে অসুস্থ তাই তো তোমার জন্য খাবার আনলাম ৷”

খাবার এনেছে কথাটা শুনে আরূ বেশ খুশিখুশি মুখ করে বলল
” রেস্টুরেন্টে থেকে এনেছেন?”
আরিশ মাথা নাড়িতে বলল
” হমম,ফুড প্লাজা থেকে এনেছি , খাবে না ?”

আরূ ভাবলো আরিশ হয়তো কাচ্চি এনেছে তাই আর লোভ সামলাতে না পেরে উঠে বসে বাচ্চাদের মতো করে বলল
“খাবো না কেন,আর আমার তো ক্যান্টিনের খাবার খেয়েই পেট ব্যাথা ৷”

আরিশ খাবারের ঢাকনা গুলো ওপেন করতে করতে বলল
“পরের দিন থেকে ক্যান্টিনের খাবার খেলে খবর আছে ৷”

আরূ একগাল হাসলো আরিশের দিকে তাকিয়ে ৷ তবে খাবারের ঢাকনা গুলো খুলতেই আরূ ওয়াক করে পিছিয়ে গেল ৷ আরূ তাকিয়ে বলল
” কি হলো ৷”

“ইস আমি এসব খাবো না, আমি তো ভাবলাম কোথায় ভালোবেসে কাচ্চি আনবেন আর এসব কি এনেছেন হু, ভেজিটেবল সু্্্যপ….তারপর মাশরূম…ইয়াক…”

আরিশ সু্্যপটা মুখের সামনে ধরে বলল
” অভিনয়টা ভালো করে শিখে উঠতে পারোনি এখনো আরুপাখি….প্যাকটিস করো ঠিক হয়ে যাবে ৷”

আরু মাথা নীচু করে নিলো লজ্জায়, ধরা খেয়ে গেছে আর আরিশ ইচ্ছা করে যে এই ধরনের খাবার এনেছে সেটাও বুঝতে পেরেছে আরু কিন্তু ও যে এগুলো খাবেনা ৷
আরু বহু চেষ্টা করে চোখ পিটপিট করে চোখে জল আনার চেষ্টা করলো ,মনের মাঝে অনেক ইমোশনাল কথাবার্তা ভাবতে লাগলো, যে যে মুভিগুলো দেখে ও কান্না করেছে সেগুলোর কথা ভাবতে লাগলো তাতে যদি ওর চোখে জল চলে আসে…..টানা এক মিনিটের অবিরাম চেষ্টার পর আরু আরিশের দিকে ছলছল চোখ করে তাকিয়ে বলল
” সরি, ৷ আর আমি এগুলো খাবো না প্লিজ ৷”

আরুর চোখের দিকে তাকিয়ে আরিশ বুকে হাত দিয়ে একটা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে বলল
” উফফ আবার সেই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল….বলেছি না আমার সামনে কাঁদবে না আমার সহ্য হয় না ‌৷”

আরু বিজয়ীর মতো অনুভব করতে লাগলো তারপর আরও চেষ্টা করে এবার চোখ থেকে জল ঝরালো আর ঠোঁট ফুলিয়ে বলল
” আমি সরি, আসলে আমি ওই ছেলেটার হাতে ঘড়ি বাধাতে চাইনি, ওরাই তো আমাকে ডেয়ার দিয়েছিলো তাই তো অমন করলাম ৷”

আরিশের শরীরের মাঝে এক অসস্তি হচ্ছে, জ্বরের ওষুধ ও খাইনি, বাসা থেকে বলে এসেছিলো যে পথে ওষুধ কিনে খেয়ে নেবে কিন্তু আরুর জন্য খাবার কিনতে হবে সেটা মনে থাকলেও ওষুধ কেনার কথা মনে নেই ৷ আরিশ কপালটা চেপে ধরলো একটু, চোখ মুখ আঁধার হয়ে আসছে তবুও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বলল
“গানটা বন্ধ করো ৷”

আরু মুখ ভাঙচি দিয়ে বলল
” কি সুন্দর হচ্ছিল কিন্তু আপনার জন্য আর শুনতেই পারলাম না ! হাহ !”

গানটা বন্ধ করতে গেলেই আরিশ আরুর বিছানায় শুয়ে পড়লো ৷ আরু গান বন্ধ করে এসে দেখে আরিশ ওর বিছানায় শুয়ে আছে দেখে আরিশের পাশে বসে বলল
” এই যে মিস্টার আপনার গেস্টরুমে শোয়ার কথা এখানে শুয়েছেন কেন?”

আরিশ আরুর হাতটা টেনে ওর নিজের ওপর আরুকে ফেলে দিয়ে ,আরিশ নিজের বুকের মাঝে আরুকে জড়িয়ে ধরে নিতেই আরূ ছঠফটিয়ে উঠলো ৷
আরিশ খানিকটা রূক্ষ গলায় বলল
“একদম শান্ত বাচ্চাদের মতো হয়ে থাকবে, কোন নড়াচড়া না ৷”
আরূর হৃদগতি বাড়ছে, আরিশের কাছে বেশিখন থাকলে আরিশের মোহে হারিয়ে যাবে তাই দ্রুত আরিশের বাহুডোর থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আগের তুলনায় আরও বেশি ছটফটিয়ে উঠলে আরিশ আরুকে নীচে ফেলে আরুর দিকে নীচু হয়ে ঝুকে লাল লাল চোখে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
“আমার ভালোবাসাটাকে কি বড্ড প্যারা লাগে ? কাছে আসতে চাইলে দুরে ঠেলে দাও কেন ! তুমি কি জানো না যে এসব করেও লাভ নেই ৷”

আরু আরিশের দিকে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে, আরিশের মুখে রাগের আভা স্পষ্ট , চোখ জোড়া লাল তার কারনটা হয়তো আরুর কাছে খুব সংক্ষিপ্ত….উনি অসুস্থ ৷ কিন্তু আরিশের যে এক্সিডেন্ট হয়েছে সেটা আরুর কাছে অজানা ৷ আরিশ আরুর দিকে খানিকটা ঝুকে গেল, আরুর ঠোঁট জোড়া কাঁপছে এদিকে আরিশের জ্বরের ঘোরের গরম নিশ্বাস আরুর মুখে ছেয়ে যাচ্ছে যাতে আরুর মাঝে নারভাসনেসটা বাড়ছে ৷ এমনটা আজ নতুন নয় যে আরিশ ওর এতো কাছে আসেনি, এসেছে তবে কখনো গভীরভাবে আরুকে স্পর্শ করে দেখেনি তবে আজ কি ? কথাটা ভেবে আরু হাত দিয়ে বিছানার চাদর খামছি মেরে ধরলো ৷ আরিশকে চাইলেও ধাক্কা দিতে পারবে না, সুস্থ থাকলে না হয় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতো কিন্তু আরিশ অসুস্থ ৷ আরু অসুস্থ হলে আরিশ পুরো বাড়ি মাথায় করে রাখে, এমন কোন রাত নেই যখন আরু অসুস্থ হয়েছে আর আরিশ সারারাত ওর পাশে থাকেনি ৷
আরিশ আরুর ঠোঁটের কাছে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ করে আরুর ওপর যেন একপ্রকার নেতিয়ে পড়লো , হঠাৎ করে এমন হওয়াতে আরুর প্রান যায় যায় অবস্থা ৷ আরিশের সমস্ত দেহের ভার ওর ওপর, আরিশের শরীরের তাপমাত্রা ওর শরীরে এসে মিশছে ৷ আরুর নিশ্বাস আটকে আসছে ৷ আরু ওঠার চেষ্টা করলো অনেক , পারছে না কিন্তু এই অবস্থায় কাউকে ডাকাও যাইনা, ডাকলে এমন ভাবে দেখে এক খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে ৷ আরু অনেক চেষ্টার পর উঠে তারপর আরিশকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে গলা ছেড়ে ডাক দিলো
” আম্মু আম্মু !”

_____

ভোররাতে হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরছে আরু,সারারাত আরিশের পাশে পাশে ছিলো, আরিশকে ছেড়ে বাসায় ফিরতে চাইনি কিন্তু ওই যে ও আগে থেকেই নিজের পায়ে কুড়াল মেরে রেখেছে যে ও অসুস্থ তাই বাধ্য হয়ে পারে আসতে হয়েছে ৷ বাসায় এসেই ধপ করে বিছানার ওপর শুয়ে পড়লো আরু, চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়লো কিছুখন আগে আরিশ ওর ওপর নেতিয়ে ছিলো ৷ কথাটা ভেবে আবার উঠে গেল, ঘড়ির দিকে তাকালো তারপর দেখলো ভোর 5.45 বাজে ৷ সকালে আরিশকে দেখে তারপর ভার্সিটি যবে তাই আরিশের জন্য নিজের হাতে রান্না করে নিয়ে যাবে তাই কিচেনে গেল হালকা কিছু খাবার রান্নার জন্য ৷ রান্না শেষ হতে হতে প্রায় 7.30 বেজে গেল ৷ আরু তাড়াতাড়ি করে গোসল সেরে নিলো হসপিটার যাবে তারপর ভার্সিটি ৷ ঠিক 9টার দিকে বেরিয়ে গেল হসপিটালের উদ্দেশ্যে ৷
রিকশায় উঠতেই সানা ফোন করলো কিন্তু রাস্তার গাড়ির আওয়াজে আরু শুনতে পাইনি তাই ফোন ধরেনি ৷ হসপিটালের সামনে নেমে গেল আরু ৷ দ্রুত পায়ে আরিশের রুমের দিকে হেটে গেল তারপর গিয়ে দেখলো আরিশ নেই ৷ আরিশকে সেখানে না দেখে প্রথমে ভাবলো রুম চেন্জ করা হয়েছে কিন্তু পরে রিসেপশনিস্টের কাছে গিয়ে জানতে পারলো যে আরিশের ছুটি হয়ে গেছে 8টার সময় ৷ শুনে আরুর মেজাজটাই বিগড়ে গেল ৷ ভাবলো যে আজকে বাসায় গিয়ে সবাইকে ঝাড়বে ঝড়ের গতিতে যে কেন কেউ ওকে ফোন করে কিছু বলেনি ৷ সোজা ভার্সিটি গেল আরু ৷ সেখানেও কাউকে না পেয়ে রেগে নিজের ক্লাসরুমে যেতে গেলেই হঠাৎ কেউ দরজার পাশ থেকে ওর হাতটা টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে নিলো ৷

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here