কারনে_অকারনে_ভালোবাসি? পর্ব:13,14

0
1823

কারনে_অকারনে_ভালোবাসি?
পর্ব:13,14
Suraiya_Aayat?
পর্ব:13

বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা, আজান দিয়ে দিয়েছে প্রায় 30 মিনিট আগে ৷ আরিশ আগের লুঙ্গিটাই পরে আছে আর ওপরে শুধু একটা ব্লু কালারের শার্ট পরেছে ,আয়নাতে নিজেকে পরিপাটি করে দেখছে আর আরুর দিকে তাকাচ্ছে ৷ আরু বসে বসে পা নাড়াচ্ছে, যখন ও খুব চিন্তা করে তখন বসে বসে পা নাড়ায়, ওর হাত পা স্থির থাকে না ৷আরিশ আয়নাতে নিজেকে একবার দেখে নিয়ে বলল
” রেডি হওনি যে এখনো, কি ব্যাপার !”

আরু আরিশের দিকে বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো ৷পুনরায় পা দোলাতে লাগলে আরিশ বলল
” এই যে আরু পাখি কি হলো,যাবে না? ওদের না 7.30টার দিকে গুলশান 1 এ লেক পার্কের কাছে আসার কথা ৷”

আরু এবার আরিশের দিকে 45 ডিগ্রি কোনে তাকিয়ে বলল
” কোন রেস্টুরেন্টে সিট বুক করেছেন? ওদেরকে তো বলতে হবে ৷”

আরিশ পারফিউমটা দিতে দিতে বলল
” khana Khazana ” তে ৷ওদেরকে ওখানে আসতে বলো ৷”

পারফিউমের গন্ধ সারা রুম ময় ছড়িয়ে গেল, আরু হাত নাড়িয়ে গন্ধ দূর করতে করতে বলল
” ইয়াক, কি বিদঘুটে গন্ধ ‌৷ এই পারফিউম দিয়ে আপনি রেস্টুরেন্টে যাবেন ?”
আরিশ এদিক ওদিক আয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল
” তুমি তো জনো যে কতো মেয়ে আমার জন্য পাগল ৷ জানো না?”

আরু মুখ ভাঙচি দিয়ে বিড়বিড় করে বলল
” ওনার জন্য আমাকে সারাজীবনে কেউ প্রপোস করার সাহস অবধি পেলো না আর এদিকে উনি ওনার লেডি গোপীয়া দের কথা শোনায় হাহ !”

আরিশ আরুর কাছে ঘেষে বসে বলল
” কি বড়বিড় করছো আরু পাখি? হিংসা হয় তোমাকে কেউ প্রপোস করে না বলে?”

আরু ভ্রু কুঁচকে আরিশের দিকে তাকিয়ে বলল
” সিরিয়াসলি ! আমাকে কেউ প্রপোজ করে না তাই হিংসা হবে? আর প্রপোজ করবে কি করে, আপনি কখনও তাদের আমার আশেপাশে ঘেষতে দেওয়ার সুযোগ দিতেন ?”

আরিশ হো হো করে হাসতেই আরু বলল
” ইস, এই স্মেলটা কেমন,নতুন পারফিউম ?”

আরিশ মুচকি হেসে বলল
” হম,,নতুন ৷ আর তুমি এমন বলছো ! এই পারফিউমের গন্ধে কতো মধুরমা পাগল হয়ে যবে তুমি জানো !”

আরু মুখ ভাঙচি দিলো ৷ হঠাৎ করে আরিশ বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলো
” ওয়েট , মধু ! মধু তো এই বাসাতে আছে , আমাদের তো ওকে একা ফেলে রেখে যাওয়া উচিত না তাইনা?”

আরিশের কথা শেষ হতে না হতেই আরু টেবিল থেকে ফলের চাকুটা নিয়ে আরিশের গলায় ধরে বলল
” ওই ইরিটেটিং পোকাটার নাম ও যদি নিয়েছেন তো আপনার খবর আছে ৷”

আরিশ খানিকটা লাফ দেওয়ার মতো উঁচু হয়ে এক নিমেষে আরুর ঠোঁটে চুমু দিয়ে সরে আসতেই আরু ছিটকে সরে এলো ৷ হাত থেকে চাকুটা পড়ে গেল ৷ আরিশ আরুর দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে, আরু বেশ ঘাবড়ে গেল আর লজ্জা পেল,,তাই আর কিছু না বলে জলদি জামা নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেল ৷

আরু ওয়াশরুম গেছে তখনই হঠাৎ মধু আর আফসানা বেগম রুমে ঢুকলেন বেশ হন্তদন্ত হয়ে,,উনি ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললেন
” আরিশ আমার অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে বাবা তুমি কিছু মনে করো না ৷”
মধুর মুখ সিরিয়াসনেস এ ভরা, আরিশ মধুর দিকে একবার তাকিয়ে আফসানা বেগমকে বললেন
” কোন সমস্যা হয়েছে মামী?”

উনি বেশ নিন্দিত সুরে বললেন
” আরু যে ফাজলামি করে আমার কাছ থেকে লুঙ্গি নিয়েছে এটা আমার আগেই মনে হয়েছিল তবুও কি ভেবে যে আমি ওর হাতে লুঙ্গি তুলে দিলাম ৷ ইশ তুমি নতুন জামাই আর তুমি কি না লুঙ্গি পরে ঘুরছো, মধু না বললে জানতেই পারতাম না ৷ আরুটা দিনদিন ফাজিল হয়ে যাচ্ছে বড্ড ৷”

আরিশ মধুর মুখের দিকে তাকালো , বুঝতে পারলো যে ব্যাপারটা কি, আরুকে বকার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মধুর ঘাড়ে তো বন্দুক রাখতেই হবে ,কথাটা ভেবে আরিশ বলে উঠলো
” কই না তো, আমিই তো আরুকে বলেছিলাম লুঙ্গি আনতে , আসলে কখনও পরিনি তো তাছাড়া মামাকে পরতে দেখি তাই আমার ও এই অদ্ভুত ইচ্ছা জেগেছিলো ৷আরু মিথ্যা কিছু তো বলেনি ৷”

কথাটা শুনে উনি মধুর দিকে তাকালেন
” এই যে মধু বলল যে তুমি নাকি বলেছো তুমি নাকি পরতে চাওনা ৷”

আরিশ সন্দেহের সুরে বলল
” মধু আমি তোমাকে একথা বলেছিলাম ‌৷”

মধু মাথা নাড়িয়ে বলল
” হমম ৷”

আফসানা বেগম কনফিউজড হয়ে গেলেন, কোন তাল না পেয়ে বললেন
” আচ্ছা যাই হোক, তোমাকে এতখন অনেক অসস্তি সহ্য করতে হয়েছে, আমি এখুনি তোমার জন্য শার্ট আর প্যান্ট আনছি ৷”

আরিশ বলল
” নাহ ,আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি ৷রাতে ডিনার বাইরে থেকে করে আসবো ৷”

মধু বলে উঠলো
” আমিও যাবো তোমাদের সাথে ৷ ‌‌”

আরিশ প্যারা বুঝে বলল
” একচুয়ালি আরুপাখির মেডিসিন আনতে আর ডক্টর দেখাতে যাচ্ছি, ফিরতে অনেক লেট হবে ৷”

কথাটা শুনে মধুর মন খারাপ হয়ে গেল ৷ আরিশ জানে মধু গেলে আরু যাবে না তাই ৷ আর এমনিতেও ফেরার পথে আরুকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবে আরিশ ৷

আফসানা বেগম বললেন
” মধু তুই নীচে তোর দাদুভাইয়ের কাছে যা আমি একটু পর আসছি ৷”

মধু বেরিয়ে গেল ৷ মধু বেরিয়ে যেতেই আফসানা বেগম এদিক ওদিক তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললেন
” আরু কোথায় ৷”

আরিশ ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে বলল
” ওয়াশরুমে, ড্রেস আপ করতে গেছে ৷”

উনি এবার ভাঙা কন্ঠে একটু নিম্নস্বরে বললেন
” একটা কথা বলভো বলবো ভাবছি কিন্তু বলা হয়নি ৷”

আরিশ ওনার কাধে হাত রেখে বলল
” আমাকে বলতে দ্বিধা বোধ করছো ?”

উনি ছলছল চোখে তাকিয়ে বললেন
” না না আরিশ তেমনটা না আসলে যা বলবো তোমার আর আরুকে নিয়েই ৷”

আরিশ মুচকি হেসে বলল
” তো বলো, দেরি কিসের !”

” বলছিলাম কি , তুমি কেন বাবা যেচে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে গেলে বলো ! তুমি তো সবই জানো ৷ আরু কখনও মা হতে পারবে না, তোমাদের দুজনের ভবিষ্যৎ বলতে শুধু তোমরাই ৷ তাছাড়া তোমার মতো ছেলের পিছনে হাজার হাজার মেয়ের লাইন থাকবে বিয়ে করার জন্য ৷ আমি বলছিনা আমার আরু খারাপ বা,,,,”

আরিশ গম্ভীর কন্ঠে বলল
” বা ? তারপর কি?”

উনি এবার কেঁদে ফেললেন, আরিশ চোয়াল শক্ত করে আছে ৷
” আমরা আরুর আরও ট্রিটমেন্ট করাতাম বা সব বলে কয়ে না হয় ওর জীবনের একটা গতানুগতি ঘটাতাম ৷”

উনি এটুকু বলতেই আরিশ ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
” ব্যাস,নো মোর ওয়ার্ড ৷ বিয়ে করে সন্তানসুখ লাভ করবো বলে আমি আরু পাখিকে বিয়ে করিনি, আমি ওকে বিয়ে করেছি কারন আমি ওকে ভালোবাসি , ওর বেবি হলো কি হলো না আই ডোন্ট কেয়ার ৷ তাছাড়া আমার তো আমার ফিউচার নিয়ে চিন্তা হয়না তাহলে আপনারা এত ভাবেন কেন বলুন তো ৷ আমার কোন বেবি লাগবে না, আমার যাকে প্রয়োজন ছিলো তাকে আমি পেয়ে গেছি , আর সত্যি বলতে আরুর এই পরিস্থিতি তো শুধুমাত্র আমরা জন্যই, আমার কারনেই ও অক্ষম ৷ যাই হোক আমি আরুকে নিয়ে অনেক হ্যাপি আছি,আর আপনারাও নিশ্চিন্তে থাকুন শুধু খেয়াল রাখবেন কথাগুলো যেন আরুর কান অবধি কখনও না যায় ৷”

উনি এবার আবেগে কেঁদেই ফেললেন, চোখের জল মুছে বললেন.
” বিশ্বাস করো আরু অনেক সৌভাগ্যবতী যে ও তোমার মতো স্বামী পেয়েছে ৷ আমার মেয়েটা অনেক ভালো, একটু অবুঝ কিন্তু তোমাকে অনেক ভালোবাসে তাই কষ্ট হলেও মানিয়ে নিও ৷”

.আরিশ হাসির রেখা প্রশস্ত করে বলল
” চিন্তা করো না মামী, আরু পাখিকে ভালোবাসার দায়িত্ব আমার আর ভালোরাখার ও ৷”

উনি মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন ৷ আরিশ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বসলো ৷

অনেকখন হয়ে গেল আরু ওয়াশরুণ থেকে বার হচ্ছে না দেখে আরিশ ডেকে উঠলো
” আরু পাখি, এই আরু পাখি, আর কতখন? ওয়াশরুমেই কি সারাটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দিবা নাকি?”
ওপর পাশ থেকে আরুর কোন সাড়াশব্দ নেই,,অন্যদিন হলে আরু রেগে থাকলেও সাড়া দেই ৷ আরিশ আবার বলে উঠলো
” কি হলো, আর কতক্ষন?”

তবুও কোন সাড়া নেই দেখে আরিশ দরজার কাছে গিয়ে বললো
” হয়েছে? রেগে আছো আমার ওপর?”

আরুর গলার আওয়াজ তো দূর ,ভিতর থেকে কোন টু শব্দ অবধি পাওয়া যাচ্ছে না দেখে আরিশ দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো,,উপায় না পেরে বেশ জোরে দরজাটা ধাক্কা দিতেই দেখলো আরু মেঝেতে পড়ে আছে,আর ফ্লোরে রক্ত ভাসছে,ব্লিডিং হচ্ছে ৷ আরিশ দেখে চেঁচিয়ে উঠলো
” আরু পাখি !”

____

রাত 1.30 টা বাজে, আরুর O- গ্রূপের রক্ত,,সারা হসপিটালে কোথাও O- নেগেটিভ রক্ত নেই, আরিশ খুঁজে খুঁজে হয়রান,এদিকে রক্ত না পেলে অপারেশন করাও সম্ভব না,অত্যাধিক মাত্রায় ব্লিডিং হওয়াই শরীরে রক্ত কমে গেছে তাছাড়া অপারেশনেও রক্তের প্রয়োজন ৷ রেকলেস ড্রাইভিং করছে আরিশ, কোন ট্রাফিক মানছে না, ঢাকা মেডিকেলে কোথাও রক্ত পাইনি,,এমারজেন্সি কাউন্টারেও কোথাও পাইনি , স্যার সালিমুল্লাম মেডিকেলে রওনা দিয়েছে অনেক আগেই, ফিরছে এখন ঢাকা মেডিকেলে, সিটে রয়েছে 2 ব্যাগ রক্ত ৷ রক্তের ব্যাগদুটোর দিকে তাকালো আরিশ , আপনা আপনিই চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো ৷ ফোনে ফোন আসছে, সানা ফোন করছে, ইতিমধ্যেই গোটা দশেক মিসড কল চলে এসেছে ফোন এ, সবার মুখে আতঙ্ক, মেয়েটার কিছু হয়ে না যাই রক্তের অভাবে ৷ আরিশ চোখের জলটা মুছে ঝটপট ড্রাইভ করলো,,চোখে ভাসছে আরুর সেই বিরক্তিমাখা মুখ যেখানেও আরিশ ভালোবাসা খুঁজে পেতো , কানে ভাসছে একটা কথা
” আচ্ছা আমরা একটা বেবি নিবো হ্যাঁ? আমি তার সাথে সারাদিন খেলা করবো ৷”

আরিশের গলা ধরে এলো, আজকের অপারেশনে ওর একটা টিউব কেটে ফেলা হবে যাতে করে প্রেগনেন্সির আশা খুব ক্ষীন ৷ আরুর বলা কথাগুলো কানে এসে বাজছে ৷ আরিশের কাউকে চাইনা আরু ছাড়া…কথাটা ভেবে গাড়ি থামিয়ে রক্তের ব্যাগদুটো নিয়ে ছুটলো আরিশ ওটির দিকে ৷

চলবে,,,,,,

#কারনে_অকারণে_ভালোবাসি
#পর্ব:14
#Suraiya_Aayat

রক্তের ব্যাগদুটো নিয়ে ছুটলো আরিশ, ওটির সামনে লাল বাতি জ্বলছে, অপারেশন শুরু হয়ে গেছে ৷ আরিশকে যেতে দেখেই আরিশের বাবা আফজাল খান আর আরুর বাবা আরমান সাহেব ছুটে এলেন ৷ আরুর বা উনি রিতিমতো কাঁদতে কাঁদতে নেতিয়ে পড়েছেন , আফসানা বেগম উনিও কাঁদছেন আর আরুর মা কে সামলানোর চেষ্টা করছেন ৷ সানা পাশের চেয়ারে বসে কাঁদছে,মধু সানার পাশে বসে সানাকে থামানোর চেষ্টা করছে ৷
আরিশের হাতে রক্তের ব্যাগদুটো দেখে আরমান সাহেব বলে উঠলেন
” আরিশ তাড়াতাড়ি যাও,,,,,নার্স অলরেডি দুবার ব্লাড নিতে এসেও ফিরে গেছেন ৷ আর বেশি দেরি করো না ৷”
আরিশের চোখটা ছলছল করছে, কথায় আছে পুরুষ মানুষের কাঁদতে মানা, তাদেরকে হতে হবে পাথরের মতো শক্ত, আরিশের গলা ধরে আসছে ওটিতে ঢোকার সাহস পাচ্ছে না ৷
আরমান সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই আরুর নানাভাই তিনি তীক্ষ কন্ঠে গর্জে উঠলেন আর কড়া কড়া কথা শোনাতে লাগলেন আরিশকে
” এক্কেরে মাইয়াডার জীবন ডা খাইয়া লইসে এই পোলা, হের লাইগা আমার দিদিভাইয়ের আজ অপারেশন হইতাছে ৷ মাইয়াডার কি খেতি যে করসে এই পোলা আর কতো খেতি যে করবে উপরঅল্লাহ জানে ৷ আমি এর লাইগাই দিদিভাইয়ের সাথে এই পোলার বিয়ে দিতে চাইনাই…..”

আরিশ ওনার দিকে ঘুরে তাকালো, আজ আর ওনার কথাগুলো আরিশের গায়ে লাগছে না বরং মনে হচ্ছে উনি যেন ঠিক কথায় বলেছেন , সত্যিই তো আজ আরিশের জন্য আরুর এই অবস্থা……এই কথাগুলো আরিশ নিজেই নিজের সাথে বলছে মনে মনে ৷ আরিশের গলা ধরে আসছে,জীবনে এতোটা লো ফিল হয়নি কখনো,আজ আরু ওর পাশে নেই ,মেয়েটা হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে যুদ্ধ চালাচ্ছে সেই যন্ত্রগুলোর সাথে ৷ হঠাৎ ওটি রুমের দরজা খুলে নার্স এসে বললেন
” স্যার আপনাকে ডাকছে তাড়াতাড়ি আসুন ৷ আর ব্লাড এর ব্যাগ গুলো আমাকে দিন ৷”

আরিশ ব্যাগ দুটো ওনার হাতে ধরিয়ে দিলেন, নার্স তা নিয়ে ভিতরে চলে গেল ৷ আরমান সাহেব বিরক্ত হয়ে গেলেন তার শ্বশুরের এমন লাগামছাড়া কথা বাত্রায় , আফজাল সাহেব চুপ করে আছেন, উনি মুরব্বি তাই ওনার বিরুদ্ধে কথা বলে তাকে অসম্মান করতে চাইছেন না ৷ আরিশ আরমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন
” আমি আসছি , আর পারলে আমাকে ক্ষমা করো ৷”

কথাটা বলে আরিশ ওটিতে ঢুকে গেল ৷ আরমান সাহেব রেগে গিয়ে আরুর নানাভাইকে বললেন
” এটা হসপিটাল আপনার বাসা না,আর ছেলেটা কি ইচ্ছা করে এসব করেছে ? ও আরুকে কতোটা ভালোবাসে তা হয়তো আপনার ধারনাতে নেই,যাই হোক আপনাকে এসব বলে আর কি হবে , বয়সে বড়ো বলে যা খুশি বলবেন সেটা কিন্তু হবে না , সবার ই ধৈর্যের একটা সীমা থাকে ৷ ওখানে চুপ করে বসে থাকুন আর একটাও কথা বলবেন না, নাহলে আপনাকে এক্ষুনি বাসায় পাঠিয়ে দেবো ৷”

কথাটা শুনে আরুর নানভাই একটু বেশ দমে গেলেন, মধু ওনাকে ফিসফিসিয়ে বলল
“দাদান আরিশের কোন দোষ নেই তুমি খামোখা ওনার ওপর রাগ করো ৷ সে অরিও কে অনেক ভালোবাসে, অনেক তাই তাকে আর কথা শুনিওনা ৷”

কথাটা বলে সানার পাশে বসলো আবার ৷ উনিও বাইরের দিকে চেয়ে রইলেন ৷ উনি অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলেন, ওনার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে ৷ এতো ভালোবাসার সমীকরন উনি বোঝেন না , আপনজনদের ভালোবাসেন তাই তাদের জন্য চিন্তা হয় ৷ 24 বছর আগে যখন ওনার স্ত্রী মারা যান তখন আরুর জন্মই হয়নি , তাই নাতনিকে দেখার সৌভাগ্য আরুর নানুর হয়নি তা নিয়ে ওনার মাঝে আক্ষেপ কাজ করে , আরুকে উনি অনেক ভালোবাসেন আর উনি সবসময় চাইতেন যে আরু ওনার কাছে পিঠেই থাকুক তাই আরুর বিয়ে ওনার গ্রামের কোন উচ্চ বংশের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আরিশ যখন বিয়ে ভেঙে আরুর সাথে এনগেজমেন্ট ঠিক করে রাখে তখন থেকেই ওনার আরিশের প্রতি রাগ ৷ এতো ভালোবাসার মায়াজাল উনি বোঝেন না আর এই বয়সে তা আর বোঝার চেষ্টাও করেন না তাই কিছু হলেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন তবে আরিশকে যে তিনি ঘৃনা করেন তেমনটা নয়, আরিশ আরুকে কেড়ে নিয়েছে সেই বিষয়ে ওনার রাগ তাছাড়া ছোট বেলায় আরুর সাথে যে দুঃঘটনা টা হয় সে বিষয়েও উনি জানেন কিন্তু আর সকলের মতো উনিও কথাটা কখনও আরুকে জানতে দেননি ৷চোখের জল লুকাতে উনি লাঠি হাতে টলতে টলতে বাইরের দিকে চলে গেলেন ৷ আরমান সাহেব বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়েও চোখ ফিরিয়ে নিলেন আর যাই হোক এই মূহুর্তে আরিশকে কথাগুলো না শোনালেও পারতো ৷

কাঁপা কাঁপা হাতে ওটি রুমের দরজা খুললো আরিশ, ভিতরকার মহল থমথমে , চোখের জলে সবটা কেমন ঘোলা ঘোলা দেখাচ্ছে, চলছে যন্ত্রপাতির কারসাজি, ছুরি গুলোতে রক্ত মাখা , আরুকে ঘিরে আছে সকলেই ৷ মেয়েটার মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া , জ্ঞান নেই থাকলে হয়তো তিড়িং করে লাফিয়ে উঠতো ৷অরিশকে আসতে দেখেই ডঃ মিত্র বলে উঠলেন
” কাম ফাস্ট , ওখানে দঁড়িয়ে কি করছো?”

আরিশ ওর কন্ঠস্বরটা খানিকটা স্বাভাবিক করে আনার চেষ্টা করে বলল
” নো স্যার আমি এখানেই ঠিক আছি, আপনারা আপনাদের কাজ করুন ‌৷”
উনি খানিকটা তীক্ষ কন্ঠে বললেন
” কাম অন আরিশ, আসো তাড়াতাড়ি ৷ আর প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে ৷”
আরিশ মাথা নাঁড়ালো, ওর মুখ থেকে আর কোন কথা বার হচ্ছে না,কি বলবে তাও বুঝতে পারছে না, আরিশ ধীর পায়ে গেল, জীবনে অনেক কাটা ছেঁড়া, অনেক অপারেশন দেখেছে, ওরা প্র্যাকটিস ও করেছে তবুও কখনো এতো ভয় লাগেনি যতোটা না আজে লাগছে,আরুর থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়ালো আরিশ , খচ করে উনি এক দিকের টিউবটা কেটে ফেললেন, আরিশের সমগ্র শরীর কেঁপে উঠলো , আর একটা টিউব মোটামুটি ডেমেজ তবুও তা বাদ দেওয়ার দরকার পড়লো না ৷
কতো কাটা ছেঁড়া হচ্ছে, অপরদিকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে আরূর শরীরে ,শরীরে কতো সূচ ফোটানোর দাগ ,কতো রক্তের ছড়াছড়ি আর সবকিছুর মাঝে ওর নিথর আরু পাখি ৷

……..

অপারেশন শেষ হয়েছে 2 ঘন্টা হলো ,আরূকে বেডে দেওয়া হয়েছে ৷ আরুর জ্ঞান ফিরবে আরও 5 কি6 ঘন্টা পর , আর বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে 7 দিন পর তবে অতোদিন আরূ হসপিটালে থাকবে কি তা নিয়েই সকলের চিন্তা ৷ সানা, আরূর নানাভাই, মধু আর আফসানা বেগমকে বাসায় পাঠানো হয়েছে যদিও আফসানা বেগম যেতে চাননি শুধু ওনার প্রেশার লো হয়ে গেছে তাই উনিও যেতে বাধ্য হয়েছেন ৷ আরিশ ডক্টরের সাথে কথা বলতে গেছে, ঘড়ির কাটা রাত 10 টা ছোব ছোব ৷ সবাই একটু ক্যান্টিনে কিছু খেতে গেছে ৷

ডঃ মিত্র সাথে কথা বলছে আরিশ…

” তা আরিশ হঠাৎ করে ওর এমনটা হলো কিভাবে ?”

আরিশের চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখে মুখে একবার হাত বুলিয়ে বলল
” ডোন্ট নো sir, আমাদের আজকে বাইরে যাওয়ার কথা ছিলো আর আপনার কাছে ওকে নিয়ে আসতাম ট্রিটমেন্টের জন্য , ও ওয়াশরুম গেল, কিছুখন পর দরজা খুলছিলোনা দেখে দরজা ভাঙলাম তার পর দেখি ফ্লোরে পড়ে আছে আর ব্লিডিং হচ্ছে ৷”

উনি একটু ভেবে বললেন
” মে বি বা আমার ধারনাতে হঠাৎ করে ওর প্রেশার লো হয়ে যায় আর তারপর হয়তো মাথাটা ঘুরে যায় ,পড়ে যায় কিছুর ওপর তারপর ভীষন ভাবে পেটে আঘাত পায় তাছাড়া তুমি তো বলছিলে যে এই কদিনে ওর পেটের পেইন টা বেড়েছে , তারপর হয় ব্লিডিং৷”

আরিশ চুপ করে আছে, কিছু বলছে না, একটা জিনিসের ভয়টা ভীষনভাবে পাচ্ছে যে আরু যদি জানতে পারে তখন কি করবে !
আরিশ হঠাৎ করে বলল
” স্যার আমি একটু আসছি ৷”

” ওকে ৷”

আরিশ রূম থেকে বেরিয়ে এলো, আরূর রূমের দিকে যেতে গেলেই দেখলো ওনারা সবাই আসছেন ৷ অনিকা খান আরিশকে থামিয়ে বলে উঠলো
” আরিশ তুই কিছু খেয়ে আই বাবা ৷”

আরিশ মুচকি হেসে বলল
” ক্ষিদে নেই আম্মু ,ক্ষিদে পেলে খেয়ে নেবো চিন্তা করোনা আর তোমরা বাসায় যাও আমি আছি ৷”
আরিশের কথা উপেক্ষা করে অনিকা খান বললেন
” আরুর জ্ঞান ফিরলে কি বলবো ওকে? আমার তো ভেবেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ৷”

আরিশ সাবলীল ভাবেই বললো
” বলবে যে ওর পেটে পেইন হতো তাই ছোট একটা অপারেশন হয়েছে, আর এরপর পেটে আর পেইন হবে না ৷ এটুকু বলবে আর বাকি দায়িত্ব আমার৷”

কথাটা ফলে আরিশ ভিতরে যেতে নিলেই আরমান সাহেব বললেন
” আরিশ একটা কথা বলবো বাবা ?”

আরিশ পিছন ঘুরে বলল
” হমম মামু বলো ৷”

উনি একটু দ্বিধা গ্রস্থ হয়ে বললেন
” আরুর অপারেশন হয়েছে , হয়তো ওর আর বেবি হবে না, ওর জীবনে সুখ বলতে আর কিছুই রইলো না, কিন্তু তুমি তো ক্ষুতহীন, তাই তোমাদের ফিউচার নিয়ে কিছু ভাবলে? মানে তুমি চাইলে আবার বিয়ে করতে পারো তাতে আমরা পরিবার বা আরুর তরফ থেকে কোন অভিযোগ থাকবে না ৷”

আরিশ ভ্রু কুঁচকে বলল
” ফিউচার ? বিয়ে?কার ?”

উনি থতমত খেয়ে বললেন
” তোমার ৷”

আরিশ এবার রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল
” নেক্সট নাইম এই কথাটা আর বলবে না মামু, আমার ফিউচার মানে আমার আরু পাখি ব্যাস , যখন জানতাম যে বেবি হবে না তখন ও ভালোবেসেছিলাম আর এখন যখন হবে না তখনও ভালোবাসি৷ আর আমার ফিউচার নিয়ে আমিই ভাবতে পারবো ৷ আর আরু পাখি যদি না থাকতে চাই তো সেটা ওর প্রবলেম আমার না, যতদিন ও বাঁচবে ওকে আমার সাথেই থাকতে হবে ৷ আর আমি ডিসিশান নিয়েই ফেলেছি আরু পাখি সুস্থ হলে আমি ওকে নিয়ে চলে যাবো ৷ ও আমার সাথে থাকবে ৷ নো মোর ওয়ার্ডস ৷”

কথাটা বলে আরিশ আরুর রুমে ঢুকে গেল ৷ ওরা সবাই থ হয়ে রইলো ৷অনিকা খান ও আরমান সাহেবের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন
“তুই ও না ভাইয়া ৷ ছেলেটাকে এসব কথা বলিস কেন ?জানিস তো এসব কথা ও পছন্দ করে না ৷ আর আমিও আরিশের সাথে একমত , আরু সুস্থ হলে আরুকে আমাদের বাসাতে নিয়ে যাবো ৷”

আরমান সাহেব কাচুমাচু মুখ করে বললেন
” ভাবনা হয় রে ৷ মেয়েটার তো যা হওয়ার হলো ছেলেটার ভবিষ্যৎ টাও এভাবে নষ্ট হবে ? সেই কথা ভেবেই তো বলেছি ৷”

অনিকা খান রেগে বললেন
” থাক থাক, অনেক ভেবেছিস এখন বসবি চল ৷”

……

আরুর কেবিনে ঢুকে দেখলো আরু শুয়ে অছে, এখনো জ্ঞান ফেরেনি ৷আরিশ ফোন বার করে আরুর একটা ছবি তুলে নিলো তারপর মুচকি হেসে বলল
” এই ছবিটা তোমাকে আমি আরও 20 বছর পর দেখাবো আর দেখিয়ে বলবো,’ এই দেখো আরু পাখি আমার ছোট্ট বেবিটা সেদিন কতো ছোট ছিলো আর আজ কতো বড়ো হয়ে গেছে ৷”

কথাটা বলে ফোনটা পকেটে রেখে আরুর একহাত ধরে অপর হাত দিয়ে আরুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল
” আচ্ছা একটা কথা বলো তো তুমি তোমার আর আমার মাঝে সবাই ভিলেনের রোল কেন প্লে করতে চায় ? কিছু না শুধু বলবে আরুর সাথে কি তুমি থাকতে চাও ?’ ইউ ডোন্ট নো হাও মাচ আই হেট দিস কোয়েশ্চেন ৷ ভালো যখন বেসেছি তখন তো ছেড়ে দেওয়ার জন্য বাসিনি তাইনা ? ওরা বোঝেনা,হোয়াটএভার ‌ ৷ তোমার একটা টিউব কেটা, আর একটা অনেটাই ডেমেজ ,বেবি হবে না হয়তো কখনও কিন্তু আমার তো বেবি লাগবে না কারন আমার ছোট্ট বেবি আছে, আমার আরু পাখি…..আর পুতুল বউ আমার লিটিল প্রিনসেস ‌৷ তুমি কি জানো যে আমি তামাকে কতোটা ভালোবাসি ৷ তুমি ভাবো যে না বললে হয়তো ভালোবাসা যাইনা , কিন্তু এটা তো ঠিক না বলো , আমি প্রকাশ করিনা কখনও তবুও তো ভালোবাসি তাইনা ! যাই হোক তুমি সুস্থ হও তারপর তোমাকে আমার কাছে রেখে দেবো ৷ কেউ কেড়ে নিতে পারবে না কখনও ওপরওয়ালা ব্যাতিত ৷ আই লাভ ইউ….তুমি সেন্সলেস আছো তাই বললাম জেগে থাকলে বলতাম না নাহলে তুমি তো এটা নিয়ে সারা হসপিটাল মাথায় করতে তাইনা……”
যাই হোক নাও ইউ আর স্লিপি, ঘুমাও, আমার বাসায় গেলে তোমাকে ঘুমাতে দেবো না কোন রাত ঠিকঠাক…প্রমিস ৷ ”

কথাটা বলে আরুর হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরিশ….ওর লিটিল বেবিটার টেক কেয়ার করছে….ক্ষতি কি ? ভালো তো বাসে তাইনা !

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here