“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৫
(নূর নাফিসা)
.
.
নিশাত আজ বাসায়ই আছে। ইমরান বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই এক মেয়ে এসে নিশাতকে ডাকতে লাগলো। নিশাত বারান্দায় এসে বললো,
– রেখা আপু! বেড়ানো শেষ হইছে তোমার!
– হু।
বলেই দুজনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। নাফিসা বাইরে এলে নিশাত বললো,
– এই যে, নতুন ভাবি।
– কেমন আছেন ভাবি?
মেয়েটি জিজ্ঞেস করতেই নাফিসা বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ। তবে আমি কিন্তু আপনার ননদ। আমাকে তুমি অথবা তুই করে বলবেন। নিশাত আমার খুব পছন্দ হইছে ভাবি কে! ইমরান ভাইয়ার পছন্দ আছে বলতে হয়।
– উহ! নজর দিও না, ভাবি তুমি কাজল দিয়েছো তো?
নাফিসা মৃদু হাসলো নিশাতের মস্করায়। অত:পর নিশাত পরিচয় করিয়ে দিলো রেখার সাথে। পাশের বাড়ির মেয়ে সে। বয়সে একটু বড় হলেও চাচাতো বোন হিসেবে নিশাতের সাথেই চলাফেরা। বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তার। পাশের দুতিন বাড়ি জুরে কিশোরী মেয়ে বলতে তারা দুজনই আছে আপাতত। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে নাফিসা বুঝতে পারলো মেয়েটি ভালোই। সহজ সরল ও মিশুকও বটে। নাস্তার পর তারা তাদের বাড়ির এক কোনে এলো বরই পারতে। দুইটা বরই গাছ আছে তাদের বাড়িতে। একটা ইমরানের ঘরের কোনে আরেকটা রাস্তার দিকে গেইটের পাশেই। এছাড়াও বেশ কিছু ফলের গাছ আছে এখানে। বরই পারার সময় নিশাত বললো,
– ভাবি, কোটার দরকার আছে নাকি! তোমার নাক-ই তো বেশ লম্বা!
রেখা ও নিশাত হেসে উঠলো। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে নাফিসাও বললো,
– সর্দি লাগছে আমার। নাকে পারলে কি খেতে পারবে? তার চেয়ে ভালো হাতে ঝাকা দেই।
মাঝারি আকৃতির গাছ হওয়ায় নাফিসা ঝাকা দিয়েই বড়ই পারলো আর ওদিকে আবিদা বেগম দেখে বললেন,
– দেখ খালি কি আন্দাজ যে! এমনে পারা লাগবো! হাতে কিছু নিয়া পারলা না! কতগুলা কাটা পড়ছে, সারাদিন জিহান দৌড়ায় উঠানে, সেই খেয়াল নাই!
ওদিকে জেরিনের উক্তি,
– হাতে পায়ে বাড়ছে ফুপি, বুদ্ধিতে বয়স হয় নাই। নাবালিকা।
নাফিসা তাকে ইগনোর করে আবিদা বেগমকে বললো,
– আম্মা, ঝাড়ু দিয়ে দিবো একটু পর। বরই তো পেকে যাচ্ছে, পেরে ফেলবো পাকা গুলো?
– যা খাইবা তা পারো। ঘরে রাইখা পচানোর দরকার নাই।
– পচবে কেন! পাকা গুলো শুকাতে পারবেন।
– সব পারতে পারবা?
– হুম।
– তাইলে পারো।
নাফিসার ভালোই লাগলো আবিদার সাথে কথা বলে। কিন্তু জেরিনকে দেখে মনে হয়েছে তার খুব হিংসে হচ্ছে তাদের বউ শ্বাশুড়িকে কথা বলতে দেখে! নাফিসা গাছ ঝাকা দিয়ে পাকা বরই ফেললো। আবিদা বেগম সহ নিশাত ও রেখা কুড়িয়ে নিলো। ঘরের কোনেরটা পারলেও রাস্তার ধারেরটা নিষেধ করলেন আবিদা বেগম। কেননা একে তো সেটা বড় গাছ, অন্যথায় রাস্তার পাশে। অর্ধেক বাড়ির ভেতরে পড়লে বাকি অর্ধেক পড়বে রাস্তায়। আর মেয়েদের তিনি রাস্তায় পাঠাবেন না বড়ই কুড়াতে!
বরই পারা শেষে নাফিসা টমেটোর সাথে কাচা বরই ভর্তা করে খেয়েছে নিশাত ও রেখার সাথে। জেরিনকে ডাকা হয়েছিলো কিন্তু আসেনি। বড় মা একটু নিয়েছে আর আবিদা বেগমের তেমন ঝাল খাওয়া নিষেধ বিধায় ভর্তা থেকে দূরেই থাকে। গোসলের পূর্বে আনাচে-কানাচ সহ পুরো বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে ঝকঝকে করতে পেরে হাপিয়ে যাওয়া নাফিসার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। অত:পর নিশাত আর সে, দুজন একই বাথরুমে গোসলের জন্য দুষ্টুমিতে মাখা দন্দ্ব লেগে গেছে! বুঝে আর না বুঝে জিহানও তাদের সাথে ভিজে গেছে পানি ছিটিয়ে! জেরিন তাকে মাইর দিতে আসছিলো। তার আগেই নাফিসা বাথরুমের দরজা লাগিয়ে জিহানকে গোসল করিয়ে দিলো। জেরিন বাইরে থেকেই তাদের উভয়কেই বকে গেছে যদিও জেদ ছিলো কেবল নাফিসার উপর! কিন্তু তারা সেদিকে কান দিলো না। সব মিলিয়ে শ্বশুর বাড়িতে এই প্রথম খুব আনন্দে দিন কাটলো আজ। সারাদিনের আমেজে মনটাও ফুরফুরে আজ। ইমরান অফিস থেকে ফিরে তাকে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে শুকানো কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখতে দেখে বললো,
– কি গো? এতো খুশি লাগছে কেন?
– তাহলে কান্না করি? ভ্যায়ায়ায়া…
ইমরান হেসে বললো,
– কি আর বলবো, তোমাকে কাদতে দেখলেও ভালো লাগে।
– হু, লাগবেই তো! আপনার তো কাদাতেও ভালো লাগে।
ইমরান ঘড়ি খুলে টেবিলে রেখে বললো,
– আমার কোনো ইচ্ছে ছিলো না সেদিন তোমার গায়ে হাত তোলার! বারবার তোমার জেদের কারণে একটু বেশিই রেগে গিয়েছিলাম।
নাফিসা কাপড় ভাজ করা রেখে ইমরানের মুখের দিকে তাকালো। তার চেহারায় অপরাধী ভাব স্পষ্ট! নাফিসা তেমন কিছু বলতে চায়নি। ইমরানের কথার প্রেক্ষিতে শুধু জবাব দিয়ে যাচ্ছিলো এতোক্ষণ। তার তো সেদিনের কথা মনেও ছিলো না। কিন্তু ইমরান যে সেটাই ভেবে আবার মুড অফ হয়ে গেলো! এখন নাফিসার কাছেই খারাপ লাগছে! বারবার তার জন্য লোকটা অপরাধী মনোভাবে চলে যায়! পরশু রাতেও এমন অপরাধবোধ করছিলো আবার আজও! মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য এখন কি করা যায় সেটাই ভাবছে নাফিসা!
ইমরান হাতমুখ ধুয়ে এলে নাফিসা হাত মুঠ করে তার সামনে ধরে বললো,
– নিন।
– কি?
– নিয়ে দেখুন।
ইমরান তার হাতের নিচে হাত রাখতেই নাফিসা মুঠো ছেড়ে দিলো। কিন্তু ইমরান তার হাতে কিছুই অনুভব করতে পারলো না! তাই বললো,
– এটা কি হলো?
– কি আর হলো! আপনাকে বোকা বানানো হলো।
ইমরান মৃদু হেসে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
– অফিস থেকে বাসায় ফিরতে না ফিরতেই এতো বড় ছ্যাকা দিলে!
নাফিসার মন এখন আরও খারাপ হয়ে গেলো! কোথায় একটু মজা করতে এলো! তা আর হলো না! ছ্যাকা দিয়ে ভোলাভালা লোকটাকে ব্যাকা বানিয়ে দিলো! ধুর! এটা না করলেই পারতো!
ইমরান ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ালে নাফিসা আবার তার কাছে এসে দাড়ালো। এবং অন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– এটা নিন।
– বারবার ছ্যাকা খেতে কে চায়!
– ছ্যাকা না, কিছু আছে। নিন।
– থাক, লাগবে না কিছু।
– না, নিন।
– বললাম তো লাগবে না।
– আরে নিন তো।
– উহুম।
– আপনি এখন নিবেন না?
নাফিসার রাগান্বিত চেহারা দেখে ইমরান হাত বাড়িয়ে নিয়ে দেখলো দুইটা বরই! মুচকি হেসে সে একটা নিজের মুখে দিয়ে অন্যটা নাফিসার মুখের সামনে ধরলো। নাফিসা হাতে নিতে গেলে ইমরান হাত সরিয়ে দিয়ে মুখে নেওয়ার জন্য ইশারা করলো। নাফিসা মুখে নিতেই ইমরান বললো,
– হয়ে গেছে!
– কি হয়ে গেছে?
ইমরান নাফিসার দিকে একটু ঝুকে বললো,
– বুঝো না?
নাফিসা একটু পেছনে হেলে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– না!
ইমরান আরেকটু ঝুকে বললো,
– সত্যিই বুঝো না?
নাফিসা আরও একটু পেছনে হেলে বললো,
– না তো!
ইমরান হাহা করে হেসে উঠলো এবং চিরুনী নিয়ে মাথা আঁচড়ে নিলো। নাফিসা পাশেই দাড়িয়ে ছিলো। ইমরান যখন রুম থেকে বের হতে যাবে তখন সে বললো,
– বললেন না, কি হয়ে গেছে?
ইমরান ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে তার কাছে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– সূচনা হয়েছে। প্রেমের সূচনা। অবশেষে প্রেমটা হয়েই গেছে!
নাফিসা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো,
– ঘোড়ার ডিম হয়ে গেছে! যত্তসব ফালতু কর্মকাণ্ড!
কথাটা বলে নাফিসাই তার আগে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। উঠুনে এসে পেছনে তাকিয়ে দেখলো ইমরান দরজা লাগিয়ে বের হতে হতে এখনো হাসছে। তার হাসিতে নাফিসারও হাসি পেল। কেন হাসি পাচ্ছে জানে না সে। অথচ হাসিমুখেই সে আরও দ্রুত পা চালিয়ে বড় ঘরে চলে গেলো।
এঘরে এসে দেখলো ড্রয়িং রুমে বড়মা সোফায় আর আবিদা বেগম মেঝেতে বসে আছে। বড়মা তেল লাগিয়ে দিচ্ছে আবিদা বেগমের মাথায়। নাফিসা এদের দেখে সত্যিই অবাক! মনেই হয়না এরা সতীন! যেন এরা দুজন আপনের চেয়েও আপন বোন অথবা মা-মেয়ের সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে। নাফিসার ধারণা মতে বড় মার জায়গায় যদি আয়েশা বেগম থাকতো কখনো এতোটা মহব্বত খুজে পাওয়া যেতো না। যদি কিছু দেখার থাকতো তাহলে তা কেবল চুলাচুলি ছাড়া আর কিছুই না! যেখানে প্রকৃত সতীনের সংসারের রূপ দেখা যেতো!
নাফিসা তাদের কাছে এসে বললো,
– বড়মা, রান্নার জন্য কি কি ব্যবস্থা করবো?
– মুরগী না রান্না করা আছে! এখন ভাত আর একটু টক হলেই হয়।
– আচ্ছা।
জেরিন নিজ রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় নাফিসাকে দেখে বললো,
– ওফ্ফ! মাথাটা ব্যাথা করছে! শোনো, এখন আমি কিছু করতে পারবো না। আজ তুমি সামলে নাও রান্নাবান্না।
নাফিসা তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে চুপচাপ কিচেনে চলে গেলো আর কাজকর্ম সে একাই করে নিলো। বড়মা এসে দেখলো, ভাত এবং টক রান্না প্রায় শেষ দিকেই।
– ভালোই তো পাকা দেখছি! তবে সবাই নাফিসাকে আলসে বলে কেন, হুম?
– যে বলে সে আরও বড় আলসে, বুঝলে!
– এহেম! তোর মা ই কিন্তু বলেছে!
নাফিসা জ্বিভ কেটে বললো,
– মা তো একটু বেশি বেশিই বলে!
– হু, এখন মা বেশি বেশিই বলে। তাই না! তা লবন চিনি ঠিকমতো দিয়েছিস তো?
– টকে চিনি দিবো!
– নাহ, মনযোগ সহকারেই রান্না বসিয়েছিস তাহলে। আমাদের আরেক ফুলি আছে তো! মাঝে মাঝে লবনের জায়গা দখল করে ফেলে চিনি!
নাফিসা হেসে উঠলো এবং বললো,
– বড়মা, আপনি দাদীকে দেখেছিলেন না?
– হ্যাঁ, কেন?
– দাদী কেমন স্বভাবের ছিলেন?
– পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা বলতেন না। ধার্মিকও ছিলেন বটে।
– আপনাকে নিশ্চয়ই খুব আদর করতেন?
বড় মা মুচকি হেসে বললো,
– তুই কিভাবে বুঝলি?
– যে একজন শ্বাশুড়ি হিসেবে ভালো সে নিশ্চয়ই একজন বউ হিসেবেও ভালো ছিলো! আর ভালো বউ হলে তো আদর করবেই।
– পাকা বুড়ি! যা, আযান পড়েছে। নামাজ পড়ে নে।
আজ রাতে ইচ্ছে করেই ইমরান নাফিসার বেশ কিছুক্ষণ আগে শুয়ে পড়েছে। হাত গতরাতের মতোই রেখেছে। নাফিসা আজও একই কান্ড করলো। তার হাত মুঠোয় ধরে তারপর চোখ বুজে রইলো। ইমরান চোখ খুলে দেখলো আজ লাইট অফ। সে অন্ধকারে নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
– এভাবে হাতে হাত রেখে ঘুমানোর মানে কি?
নাফিসার কোনো সাড়া পেল না! ইমরান তার হাতটা টেনে নিজের বুকের বা পাশে শার্টের নিচে রেখে বললো,
– সাহস থাকলে স্বেচ্ছায় এখানে হাত রেখে দেখ।
ইমরানের হৃদস্পন্দনের সাথে নাফিসার ভেতরের ধুকপুক বেড়েই চলেছে! এমন ঢিপঢিপ কম্পন উপলব্ধি করতে পেরে নাফিসা তার হাত গুটিয়ে নিয়েছে। টানের সাথে সাথে ইমরানও ছেড়ে দিয়েছে তার হাত। সবটাই এখন নিশ্চুপ! কারো কোনো সাড়া নেই শব্দও নেই। একই ঘরে একই বিছানায় নিস্তব্ধ দুটি প্রান দু’প্রান্তে! মন ডাকে মনকে, কে জানে পৌছেছে কি-না সেই হাক সীমান্তে!