মন পাজড়ে শুধু তুমি আছো?,পর্ব_২
লেখিকা_মাইসারাহ_আরোহি?
ভোর ৫টা বেজে ৩ মিনিট কারো জোরে জোরে লাফানোর আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় অর্থের।ধীরে ধীরে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় সে। কিন্তু চোখ মেলে যা দেখলো সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না অর্থ।কারণ লাফালাফি টা আর কেউ নয় আয়ানা করছে। সকাল সকাল এমন কাজকর্ম দেখে অর্থ বিরক্ত হয়ে বললো,
— “এই মেয়ে কি সমস্যা তোমার,সকাল সকাল এভাবে লাফাচ্ছো কেনো?একটু কি শান্তিতে ঘুমোতে দেবে না?”
আয়ানা অর্থের দিকে তেড়ে এসে বললো,
— “এটাকে লাফানো বলে না,এটাকে বলে শারীরিক কসরত।কিছুই তো জানেন না দেখছি।আর সকাল সকাল বলছেন কি,পাঁচটা বেজে গেছে!”
— “তো আমি কি করবো? এখন আমাকে বিরক্ত করো না তো একটু ঘুমাতে দাও।” (অর্থ)
— “কিহ আরো ঘুমাবেন? নাহ আপনার দেখছি হেল্থ ঠিক রাখার ইচ্ছেই নেই।কোথায় সকালে একটু জগিং করবেন, ব্যায়াম করবেন তা না পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন।” (আয়ানা)
— “একটু পরে তো ক্লাবে যাবো তখন এসব করা যাবে।আর তাছাড়া আমি দুইবেলা জিম করি।সো সকাল সকাল দৌড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।” (অর্থ)
— “হুহ ওইজন্যই তো ভুড়ির এই অবস্থা!কিন্তু আপনি তো একজন ফুটবলার।আমি যতদূর জানি আপনাদের রোজ দৌড় প্র্যাকটিস করতে হয়।তাহলে আপনি না দৌড়ে এভাবে ঘুমাচ্ছেন কি করে?” (আয়ানা)
— “উফ বললাম না তোমায় একটু পরে ক্লাবে যাবো,তখন দৌড়,জাম্পিং,এক্সারসাইজ,প্র্যাকটিস সব করবো।এখন দয়া করে একটু থামো, এমনিতেই এই ফ্লোরে শুয়ে মশার কামড়ে আমার একটুও ঘুম হয় নি।” (অর্থ)
আয়ানা মুখ ভেংচি কেটে বললো,
— “সে রাতে মশারি অথবা কয়েল জ্বালিয়ে নিলেই তো হয়!”
— “মশারিতে আমি ঘুমাতে পারি না,আর কয়েলের গন্ধ আমার সহ্য হয় না।” (অর্থ)
— “তাহলে গুড নাইট অন করে নেবেন। আচ্ছা শুনুন আজকের মতো আপনাকে ছেড়ে দিলাম তবে কাল থেকে রোজ ভোরে আমার সাথে জগিংয়ে যাবেন আর ব্যায়াম করবেন।” (আয়ানা)
আয়ানা কথাটা বললো ঠিকই কিন্তু অর্থের কানে সেটা পৌঁছালো না।সে অর্ধেক কথা শুনেই আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
অর্থের বাবা মিস্টার নিয়াজ ইন্তেহাব এবং ওর আম্মু আরজিয়া ইন্তেহাব ঘুম থেকে উঠে বাইরে এলেন।উনারা এসে দেখেন আয়ানা ডাইনিং টেবিলে সব খাবার-দাবার,প্লেট,গ্লাস সবকিছু ঠিকভাবে রাখছে।
— “আয়ানা মা এসব কি করছিস তুই? আর এই ব্রেকফাস্ট কে বানালো?” (অর্থের বাবা)
— “আমি বানিয়েছি। আজকে সবার জন্য ব্রেকফাস্ট আমার স্পেশাল পরোটা,সবজি আর অমলেট।” (আয়ানা)
— “কিন্তু এসব কাজ তুই কেনো করতে গেলি? এসবের জন্য তো অন্যরা আছে তাই না।তোকে এসব করতে হবে না মা।” (অর্থের বাবা)
— “কিন্তু শশুড় বাবা কালকে তো আপনিই আমার বাবাকে বললেন যে আমি এখন থেকে আপনাদের বাড়ির বউ,আমার সকল দায়িত্ব আপনাদের।তাহলে আপনাদের দায়িত্বও তো আমার তাই না!” (আয়ানা)
— “সে ঠিক আছে কিন্তু…” (অর্থের বাবা)
— “কোনো কিন্তু নয়। হাতমুখ ধুয়ে খেতে আসুন আজকে আমি সবাইকে পরিবেশন করবো।আর এই যে আমার শাশুড়ি মা এভাবে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন?যান হাতমুখ ধুয়ে আসুন।” (আয়ানা)
— “এভাবে শাশুড়ি মা বলছো কেনো? হয় শুধু মা ডাকো নাহয় আম্মু কিংবা অন্যকিছু ডাকো।” (অর্থের আম্মু)
— “না অন্য ডাক ঠিক আমার পোষায় না শুধু মা ডাকটাই ভালো।” (আয়ানা)
আয়ানার কথা শেষ হতেই অর্থ রেডি হয়ে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাজির।
— “আম্মু আজ সকালে তো কেউ আমায় বেড টি দিলো না,শেফরা বাসায় নেই নাকি?” (অর্থ)
— “সবাই আছে কিন্তু আপনাকে বেড টি আমিই দিতে দেই নি।” (আয়ানা)
— “কেনো?” (ভ্রু কুঁচকে অর্থ)
— “ইচ্ছে হয়েছে তাই।” (আয়ানা)
— “আম্মু দেখো এই মেয়েটাকে নিষেধ করো ও যেনো আমার ব্যাপারে নাক না গলায়।আমার কিন্তু এসব একদম ভালো লাগে না।যাই হোক ব্রেকফাস্ট রেডি হয়েছে?আমাকে তো আবার একাডেমিতে যেতে হবে, পরশু একটা ম্যাচ আছে,অনেক কাজ বাকি।” (অর্থ)
— “চেয়ারে এসে বসুন আপনার খাবার দিচ্ছি।” (আয়ানা)
— “তুমি কেনো? সার্ভেন্টরা কোথায়?” (অর্থ)
— “তারা নিজেদের কাজ করছে। আপনি এতো প্রশ্ন না করে বসুন তো আগে।” (আয়ানা)
আয়ানা প্লেটে একটা পরোটা,অমলেট আর সবজি দিয়ে অর্থকে খেতে দিলো।পরোটা দেখে অর্থ চিল্লিয়ে বললো,
— “এসব কি? পরোটা কে বানিয়েছে? আমি পরোটা খাই না।এতো তেল,ফাইবার এসব আমি খাই না। আম্মু তুমি তো জানো আমি সকালে কি খাই তাহলে এগুলো কেনো করেছো?”
— “আমি কিছু করি নি।এসব কিছু আয়ানা করেছে।” (অর্থের আম্মু)
— “কিহ, এই মেয়েটা এসব করেছে!!এই মেয়ে তোমাকে এসব মাতব্বরি কে করতে বলেছে হ্যাঁ? এসব কি বানিয়েছো, আমি এসব খাই না।আমি সকালে কনফ্লেক্স,বাটার ব্রেড,জুস এসব খাই।আর তুমি এতো তেলচিপচিপে কি বানিয়েছো!!” (অর্থ)
— “এই যে শুনুন আমায় এতো হাই লেভেল দেখাতে আসবেন না। চুপচাপ যেটা দিয়েছি সেটা খেয়ে নিন।এতে এমন কিছু নেই যে আপনার হেল্থের প্রবলেম হবে।আর তাছাড়া রোজ রোজ ওসব খেতে ভালো লাগে নাকি? মাঝেমাঝে তো একটু অন্যরকম কিছুও ট্রাই করতে পারেন।” (আয়ানা)
অর্থ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,
— “আমি এসব খাবো না।আমি বের হচ্ছি।আমি বাইরে খেয়ে নেবো”
— “এক পাও নড়বেন না, চুপচাপ বসুন।বসুন বলছি।” (ধমক দিয়ে আয়ানা)
ধমক শুনে অর্থ বসে পড়লো। অর্থ সামান্য ঘাবড়ে গিয়ে বললো,
— “তুমি আমাকে এভাবে চোখ রাঙাচ্ছো কেনো? আমি কিছুতেই এসব খাবো না।”
— “আপনি খাবেন না আপনার বাবা খাবে।কি শশুড় বাবা আপনি খাবেন না?” (আয়ানা)
— “হুম খাবো তো। অর্থ তুইও খেয়ে নে বাবা, বেশ ভালো লাগবে।” (অর্থের বাবা)
— “বাবা তুমিও,উফ দিস ইজ টু মাচ।” (বিরক্ত হয়ে অর্থ)
— “ওসব মাচ টাচ বাদ দিয়ে খেয়ে নিন। শশুড় বাবা আপনিও বসুন।মা আপনিও বসুন।” (আয়ানা)
আয়ানা সবাইকে খাবার পরিবেশন করে দিলো।অর্থের বাবা খেতে খেতে অর্থকে বললো,
— “আজকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরবি,আয়ানাদের বাসা থেকে লোকজন আসবে।আমি চাই না কোনো সমস্যা হোক।আর আমি আশা করবো তুই আমার সম্মান রক্ষা করবি।”
অর্থ কিছু বললো না একবার আয়ানার দিকে তাকিয়ে হাতটা ধুয়ে বেরিয়ে গেলো।
— “আচ্ছা অর্থি কোথায়?ও কি এখনো ঘুমাচ্ছে?” (অর্থের বাবা)
অর্থি হচ্ছে অর্থের একমাত্র বড় বোন।
— “হয়তো, একবারো তো ঘর থেকে বের হতে দেখি নি।” (অর্থের আম্মু)
— “আচ্ছা আমি তো একটু অফিসে যাচ্ছি, অর্থি ঘুম থেকে উঠলে বলো আয়ানা মাকে একটু সাজিয়ে দিতে।আমি অনেককেই ইনভাইট করেছি।” (অর্থের বাবা)
— “হুম ঠিক আছে।” (অর্থের আম্মু)
এদিকে আয়ানা ঘরে এসে নিজের মোবাইলটা অন করলো। মোবাইল অন করতেই সাথে সাথে একটা কল এলো।আয়ানা ফোনটা রিসিভ করতেই।অপর পাশ থেকে বললো,
— “হ্যালো আনানইয়া!!”
— “হ্যাঁ এশা বল।” (আয়ানা)
— “বলছি তুই এখন কোথায়? তুই কি আজ আসবি না? এদিকে স্যার তো তোর খোঁজ করছে।” (এশা,আয়ানার বান্ধবী)
— “আমি এখন আমার সো কল্ড শশুড়বাড়িতে আছি।তুই তো জানিস আমার অবস্থা,স্যারকে একটু বুঝিয়ে বল যে আজ আমি যেতে পারবো না।আমি কালকে যাবো।” (আয়ানা)
— “কিন্তু আনানইয়া তোর যে সিচুয়েশন আজ না তুই তো কালকেও আসতে পারবি না।তোর তো কোনো না কোনো প্রবলেম হবেই।” (এশা)
— “ও আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো। আজকেও যেতে পারতাম কিন্তু আমার শশুড় মশাই আমার বাবা-মাকে আসতে বলেছে। এজন্য আজকে বেরোতে পারবো না।তবে কালকে ঠিক যাবো।তুই স্যারকে বলিস।” (আয়ানা)
— “আচ্ছা ঠিক আছে।এখন রাখছি।আর বাকি খবরাখবর তোকে পরে জানাবো।” (এশা)
— “হুম ঠিক আছে এশা।” (আয়ানা)
কিছুক্ষণ পরে অর্থি আয়ানার ঘরে এলো।আয়ানা তখন জানালার ধারে বসে ছিলো,ঘরে কারো প্রবেশের আওয়াজ পেয়ে ও পেছনে ঘুরলো এবং অর্থিকে দেখতে পেয়ে বললো,
— “অর্থি আপু কিছু বলবে আমায়?”
— “হুম আয়ানা,আজ তো বাসায় সবাই আসবে তাই বাবা বলেছে তোমাকে সাজিয়ে দিতে। তুমি এসো আর এই শাড়িটা পরো,তারপর বাকিটা আমি ঠিক করে দিচ্ছি।” (অর্থি)
— “আচ্ছা ঠিক আছে।” (আয়ানা)
আয়ানা শাড়িটা পরে এলো,অর্থি ওর শাড়ি সুন্দর করে পিনআপ করে দিয়ে আয়ানাকে হালকা মেকআপ দিয়ে সাজিয়ে দিলো।মেরুন রঙের শাড়ির মাঝে গোল্ডেন সুতা দিয়ে কাজ করা,তার সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি,হালকা সাজ আয়ানাকে পুরোই নতুন বউ লাগছে।
— “তুমি এখানে থাকো,আমি রেডি হয়ে এসে তোমায় নিচে নিয়ে যাবো।” (অর্থি)
— “আচ্ছা ঠিক আছে।” (আয়ানা)
অল্প সময়ের মধ্যেই আয়ানাদের বাসা থেকে সবাই এবং কিছু আমন্ত্রিত অতিথিরা চলে আসেন।অর্থি এসে আয়ানাকে নিচে নিয়ে যায়।নিজের পরিবারের সবাইকে দেখতে পেয়ে আয়ানা খুব খুশি।আয়ানাদের বাসার সবাই উনাদের জামাই মানে অর্থের খোঁজ করছে।কিন্তু অর্থ এখনো বাসায় না আসায় অর্থের বাবা ভীষণ চিন্তিত!
চলবে