সে_আমার_পৌষমাস,পর্ব-৩

0
1510

সে_আমার_পৌষমাস,পর্ব-৩
লেখিকা-সোনালী_আহমেদ

ফ্লোর ঘেঁষে বসে পড়লো নবনী। মাথাটা এলোমেলো লাগছে। গাঢ় বিষণ্ণতা ঝাঁকবাঁধা মৌমাছির মতো উড়ে এসে ঝাপটে ধরেছে তাকে। ভয়ংকর ভারী বিষাদে মন ভরাক্রান্ত হয়ে উঠছে তার। একটু পূর্বের স্নিগ্ধ আবেশমাখা পৃথিবীটা হারিয়ে গেছে চোখের পলকে। মন খারাপের গাঢ় সমুদ্রে ডুবে গেলো সে। এত মন খারাপ তার বহুদিন হয়নি। বহুদিন! সাইফুল তার থেকে বেশি অন্য কাউকে গুরুত্ব দিচ্ছে এটাই কি তার কারণ? একজন আইনের কর্মকর্তা হিসেবে ভিক্টিমের প্রতি কনসার্ন থাকাটা স্বাভাবিক, দোষের নয়। কিন্তু এটা কি স্বাভাবিকের থেকেও বেশি নয়? তাহলে সে কি বদলে যাচ্ছে? নবনী খেয়াল করলো, সাইফুল কেবিনের টেবিল থেকে তার ফোনটি তুলে হাতে নিয়েছে। কাউকে ফোন দিয়েই বললো,

-“হ্যালো সোহেল,কেবিনে আসো। কুইক।” সাইফুল ফোন কেটে দিতেই সোহেল হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলো।

-“স্লামালাইকুম,স্যার। কেমন আছেন?”

-” ওয়ালাইকুম সালাম। রায়হানকে ফোন দাও। বলো এক্ষুণি ল্যাপটপ নিয়ে হাজির হতে। চেক করো, ডেস্কের কম্পিউটার কাজ করছে কি না। কাজ করলে বলো, মিস নিরার লোকেশন ট্রেস করতে। ফোর্সদের রেডি করো, আধঘন্টার মধ্যেই বের হবো।”

-” ওকে,স্যার।” সোহেল মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতেই নবনী উঠে দাড়ালো। সহসা গলায় বললো, -” কোথায় যাচ্ছেন আপনি? এখনো আপনার শরীর উইক। আপনার যাওয়ার দরকার নেই। আমি বাবাকে বলে দিয়েছি, এ কেস অন্য কাউকে হ্যান্ডেল করতে দিতে। আপনি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রেস্ট নিন।”

-” অন্য কাউকে মানে? তুমি কি বলতে চাইছো? মন্ত্রী স্যারের মৃত্যুর পর থেকে এ কেস আমি সামলাচ্ছি। কেসের এ টু জেড আমি ইনভেস্টিগেট করে আসছি। মিস নিরাকে কথা দিয়েছি আমি। আর তুমি বলছো অন্য কাউকে টেক ওভার করে দিতে?”

-” হ্যা, বলেছি। বাবাকে ম্যানেজ করা হয়ে গিয়েছে। আপনার কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।”

সাইফুল বিষ্মিত কন্ঠে বললো,
-” আই কান্ট বিলিভ দিস নব! তুমি এমনটা কীভাবে করতে পারলে? এ কেস আমি সামলাচ্ছি।” নবনী চুপ করে রইলো। বাবাকে বলেছে মিস নিরার কেইসে সাইফুল যেনো কোনোভাবে ইনভলভ না হয়। তার বাবা মেনেও নিয়েছেন। নবনীর বাবা পুলিশের বড় কর্মকর্তা। নবনীর কথায় তিনি সাইফুলকে নিয়োগ করেছিলেন ইনভেস্টিগেশন টিমে। তার জন্য তিনি সব করতে পারেন। মা মরা একমাত্র মেয়ে বলে কোনো আবদার ফেলতে পারেন না। নবনীর ক্ষীণ সন্দেহ সাইফুলের মনে নিরার জন্য কোনো ফিলিংস রয়েছে। তার ধারনা, নিরা দেখতে তার চেয়েও বেশি রুপবতী, মন্ত্রীর মেয়ে, পাশাপাশি অঢেল সম্পত্তি আছে। এগুলোই এর কারণ। গত একুশ দিন নিরার কাছে ছিলো তার স্বামী। সাইফুল কারো প্রতি তিল পরিমাণ অত্যাচার দেখতে পারে না। নবনীর এখনো মনে আছে, একবার একটা ছেলে তার বাবাকে ধাক্কা দিয়েছিলো দেখে কত আঘাত করেছিলো ওই ছেলেকে। তাই হয়তো নিরার কষ্ট দেখে দূর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে। পুরুষ মানুষের আবার বিশ্বাস আছে নাকি? ভয় হচ্ছে তার। প্রচন্ড ভয়। সাপের মতো বিষধর ভয়টা মষ্তিষ্কের কোষে কোষে ছোবল মারতে লাগলো ক্রমাগত। চেতনা বুঝি প্রায় লুপ্ত হবার পথে। নবনী দেখতে পেলো সাইফুল আবারো ফোন হাতে নিয়েছে। একবার তাকিয়ে ফোনটি কানে লাগিয়ে নিয়েছে। অস্পষ্ট আধো চেতনার মধ্যেও সে বুঝতে পারছে পরিস্থিতি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু সাইফুল কি শুনবে তার কথা?

-” হ্যালো,সোহেল! ”

-” স্যার, মিস নিরার লোকেশন ট্রেস করতে পেরেছি। ফোর্সদের এখনো জানাতে পারি নি। মাত্রই বলতে নিচ্ছিলাম দেখি আপনার ফোন। আপনি কাটার পরপর ই বলছি।”

-“কাউকে বলার দরকার নেই। তুমি ফোন বন্ধ করে এক্ষুণি আমায় পিক করতে আসো। আমি হ্যান্ডেল করবো নিজের মতো। ”

-“মাফ করবেন স্যার, পাহাড়ী রাস্তায় আপনার এ অবস্থায় ট্রাভেল করাটা কষ্টকর হয়ে পড়বে। ”

সাইফুল বললো,-” যত কষ্ট হোক, আমি যাবো। পাহাড়ের বাগান বাড়ী কেনো চূড়ায় হলেও আমি যাবো। ”

নবনী নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো সাইফুলের দিকে।উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় শরীর অসাড় হয়ে আসছে।যতটুকু সন্দেহ করেছিলো সম্পর্ক তার থেকেও গভীর বের হচ্ছে। তার বারণ অগ্রাহ্য করে সাইফুল সেদিকে যাচ্ছে। সে মেয়ের কাছে। এ দিকটা ভীষণ ভাবাচ্ছে নবনীকে।

-” এখনো বলবেন আমি মুদ্রার এপিঠ দেখছি,ওপিঠ দেখছি না? অস্বীকার করবেন নিরার জন্য কি আপনার ফিলিংস নেই?” নবনীর কন্ঠস্বর কাঁপলো।

-“হ্যা,হ্যা, স্বীকার করছি ফিলিংস আছে।” সাইফুল অধৈর্য গলায় বললো। একটুখানি বিচলিত দেখালো না তাকে। নবনীর জন্য শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি হয়ে উঠলো। সাইফুল একবারও সেদিকে না তাকিয়ে বের হয়ে গেলো। মাথাটা শূন্য শূন্য লাগছে। অপমান, অবহেলা শরীরে সুক্ষ সুচের মতো ফুটতে লাগলো। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। নবনী যখন যা চেয়েছে তা পেয়েছে। যা পায়নি তা কাড়াকাড়ি করে হলেও নিজের করে নিয়েছে। তার জিনিস সে কিছুতেই অন্য কাউকে দিবে না। কখনো না।

হঠাৎ করেই আকাশ জুড়ে মেঘ মেঘ করছে। ধূলোর গন্ধ নিয়ে বইছে ঝড়ো বাতাস। বছরের শেষের দিকে এরকম ধূলো ধূলো গন্ধ হয়। সোহেল খেয়াল করলো বারবার গাড়ীর চাকা থেমে যাচ্ছে। প্রতিবছর শীতের সময় ঠান্ডায় গাড়ীর তেল জমে যায়। অনেক কসরত করতে হয় তখন। প্রয়োজনীয় সময় থেকে একটু বেশি সময় লেগে গেলো পৌঁছাতে। সাবধানতার সাথে যতোই এগোলো ততই অবাক হলো সোহেল। দূরদূরান্তে কাউকে নজরে পড়ছে না। কিন্তু সে ভেবেছিলো অনেক গার্ড থাকবে, তাদের সাথে মারামারি করে ভেতরে ডুকতে হবে। সেজন্য কতকগুলো অস্ত্রও নিয়ে এসেছিলো। অথচ এখানে কেউ নেই। বিষয়টা তাকে ভাবাচ্ছে। আড়চোখে সাইফুলের দিকে তাকাতেই দেখলো সে ও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

-“স্যার, এখানে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ”

-” তাইতো দেখছি। লোকেশন তো এখানে বলছে। ভুল তো হবার কথা নয়। আমি নিজে মাইক্রোচিপ এটাচ করেছিলাম মিস নিরার গলার লকেটে।”

-“কিন্তু স্যার, লোকেট তো খুলেও ফেলা যায়।”

-” আমি জানি। কিন্তু মিস নিরা এ লকেট খুলেন না। এটা উনার বাবার শেষ গিফ্ট। আর এজন্য ওই আ্যাসহোলের বাচ্চাও ওটা খুলে না।”

সোহেল কথার মাঝে অমনোযোগী হয়ে অন্যদিকে তাকাতেই দেখতে পেলো কালো মার্সিডিজ। গাড়ীর নেমপ্লেট দেখতে পেতেই সে চট করে চিনে ফেললো গাড়ীর মালিককে। সাথে সাথে গাড়ীর দিকে আঙ্গুল তাক করে বললো,
-” স্যার, স্যার,এদিকে দেখুন। নবনী ম্যাডামের গাড়ী। ”

সেদিকে তাকাতেই সাইফুলের চোখেমুখে বিষ্ময়ের রেখা ফুটে উঠলো। অবাক হয়ে বললো,

-“হ্যা,তাই তো।” দ্রুত ঘোর ভেঙ্গে সামনের দিকে হাটা দিলো। সোহেল অলরেডি ভেতরে ডুকে গিয়েছে। সাইফুল বাহিরে থাকতে থাকতেই সে অনেকটা চিৎকার স্বরে হেঁকে উঠলো,
-“স্যার…”

হতভম্ভ হয়ে গেলো সাইফুল। ভেতরে প্রবেশ করতেই জানতে চাইলো ,-” কি হয়েছে?” চোখেমুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ।
উত্তরে সে বললো,
“স্যার, একটু ওইদিকে দেখুন।”

ঝুপড়ির ভেতরের ডানদিকে ইশারা করলো। নজর ঘুরিয়ে সেদিকে তাকতেই ভড়কে গেলো সাইফুল। নিরার সাথে ধস্তাধস্তি করছে নবনী। ইতোমধ্যে, নিরার শরীরের বেশ খানেক স্থান থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে। সাইফুল বললো, -” আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেনো?স্টুপিড! গো,কুইক।”

নবনীর হাতে ছুঁরি বেশি লম্বা নয়, মাঝারি আকারের। সোহেল আটকাবার পূর্বেই নবনী সেই ছুরি দিয়ে নিরার হাতের কব্জির বেশ খানেকটা উপরে রেখে টান মেরে দিলো। সাথে সাথে ছলাৎ করে রক্ত ছিঁটকে বেরিয়ে আসলো। গলগল করে রক্তের ফোয়ারা বের হতে শুরু করলো। সাইফুল, “নিরা” বলে এগিয়ে যেতেই নবনীর বাবা এসে উপস্থিত হলেন। তিনি হতভম্ভ হয়ে নবনীর দিকে তাকালেন। নবনী দৌড়ে এসে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সাইফুল তখন নিরাকে ধরে মেঝেতে বসে পড়েছে।

-” নবনী,আর ইউ ম্যাড। তুমি এটা কি করলে? আমি তোমাকে বলেছি না,আমি আসা পর্যন্ত উল্টাপাল্টা কিছু করবে না।” নবনীর বাবা ধমক দিয়ে বললেন। সাথে সাথে সে কেঁদে উঠলো। সে নিজেও জানে না, কীভাবে এসব করে ফেলেছে।
নিরার বাম হাতের রগ কেটে গেছে। সেজন্যই সাইফুল চেষ্টা করেও রক্ত বন্ধ করতে পারছিলো না। অবস্থা হাতের বাহিরে চলে যাচ্ছিলো। সাইফুল সোহেলের সাহায্যে তাকে ঝুপড়ীর বাহিরে নিয়ে আসলো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য। নবনীর বাবা তাদের বললেন,
” সাইফুল, বাহিরে আমার ঘাড়ী আছে। ড্রাইভারকে বললে সে তোমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আমি সব সামলে নিবো। চিন্তা করো না। তুমি শুধু ব্যাপারটা একটু দেখো।কেউ যেনো কিছু জানতে না পারে।”
সাইফুল কিছু বললো না। সোহেল ও কিছু বললো না। যদিও তার মাথায় এ মুহূর্তে অনেক অনেক প্রশ্ন নড়াচড়া করছে। কিন্তু সে জানে এ মুহূর্তে প্রশ্ন করাটা বোকামি হবে আর এর কোনো জবাব ও পাবে না। সাইফুল সেন্সলেস নিরার সাথে অনবরত কথা বলে চলছে। যেনো অন্যদিকে তার খেয়াল ই নেই। হঠাৎ চিৎকারের স্বরে হেঁকে উঠলো সোহেল,

-“স্যার,মিডিয়া….”

সাইফুল সামনে তাকাতেই হতভম্ভ। গোটা ত্রিশ-পঁচিশেক সাংবাদিক এদিকে এগিয়ে আসছে। তাদের পেছনেই পুলিশের দু-তিন টা জিপ এসে থেমেছে। নবনীর বাবাও পেছন পেছন বেরিয়ে এসেছিলেন। সাংবাদিকদের দেখতে পেয়েই দিশেহারা হয়ে গেলেন। তিনি চারদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার দেখলেন……

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here