কুহকিনী,পর্ব: ২
Tuhina pakira
-” হ্যাঁ আসবে তো। মা বলছিল পরশু সকালের মধ্যে চলে আসবে। ”
-” পুচকে দুটোকে তো আগে দিয়ে যেতে পারতো, তাহলে বাড়িতে একেবারে আনন্দের ঝড় বয়ে যেতো। আর তুইও কিছুটা জব্দ হতে পারতি।”
-” তোর আমাকে জব্দ করতে কেনো এতো মন চায় রে! ”
কুহকিনী কিছু না বুঝে বললো, ” বাচ্চা দুটো তোমাকে কি করে জব্দ করবে?”
অহন একবার তার স্ত্রীর প্রশ্ন বোধক মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ” কীকরে আবার, ওরা বিনি পয়সাকে পেলে আর কিছুই বোঝে না। রিনি দির ছেলে ঋষি আর জিনি দি এর মেয়ে রীতি ওর সঙ্গেই থাকে, আর ওকে জ্বালায়। সেই সুযোগে আমাদের দুই দিদি নিজেদের বরের সঙ্গে ঘুরতে চলে যায়। ”
অহনের কথায় কুহকিনী হেসে উঠলো, আর অহন তাকিয়ে রইল ওর হাসি মাখা মুখের দিকে। বিনি অহনকে ভেংচি কেটে কুহকিনী কে নিয়ে চলে যায় ঠাকুর মণ্ডপের দিকে।
বিশাল উঠোনের শেষ মাথায় রয়েছে ঠাকুর দালান। দূর থেকেই এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল প্রতিমাকে। উঠোনের বাকি তিনদিক জুড়ে রয়েছে ঘর গুলো। কুহকিনী দালানের সিঁড়িতে ঝুঁকে এক হাত দিয়ে তা মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করলো। তারপর চলে গেলো বহু প্রতীক্ষিত মূর্তির নিকটে। দেবীর অপরূপ সাজে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো ওর। অপরূপ ডাকের সাজের মূর্তি, অনেকে আবার ঢাকের সাজ ও বলে থাকে।
চৌধুরী বাড়ির দীর্ঘ ৬৩ বছর আগেকার এই পুজো চলে আসছে অহনের ঠাকুরদা তার ঠাকুরদার আমল থেকে। এই দালানেই দেবীর মূর্তি তৈরি হয়।
মূর্তি তৈরি হয়ে গেছে এখন দেবীর কপালে নকশা আঁকা হচ্ছে।
কুহকিনী প্রাণ ভরে দেবীকে দেখে পাশে তাকালো, দালানের পাশেই বসে রয়েছে পাঁচজন ঢাকি। পুজোর কটা দিন তারা এই বাড়িতেই থাকবে।
কুহকিনী এগিয়ে গেলো অহনের কাছে। অহন তখন রমি কাকার সঙ্গে কথা বলছে। নিজের শাশুড়ির মুখে শুনেছে অহনের ঠাকুরদা তাকে রাস্তা থেকে পেয়েছিলেন। তারপর থেকে এইখানেই রয়েছেন তিনি। বাড়ির ছেলের মতোই তাকে সকলে ভালোবাসে। বিয়ে করেননি, তবে তিনি শিক্ষিত খুব। এই বাড়িতে উনি একটা বিশাল বড়ো লাইব্রেরী করেছেন। এলাকার বহু ছেলে মেয়ে সেই লাইব্রেরীতে আসে। তাদের নিয়েই রমি কাকার সময় চলে যায়।
কুহকিনী কে দেখে অহন বলে উঠলো, ” এই তোমাদের ছোটো বৌমা। বিয়েতে তো গেলে না এবার দেখে নাও।”
কুহকিনী গিয়ে রমি কাকাকে প্রণাম করলো। তিনি প্রাণ ভরে বাড়ির ছোটো বৌমাকে আশীর্বাদ করলেন।
-” কী করবো বলো বৌমা, এই বাড়ি ছেড়ে যেতে মন চায় না। সেই ছোটো বেলায় অহনের ঠাকুরদার হাত ধরে এই বাড়িতে এসেছিলাম। তারপর থেকে এখানেই আছি। নিজের পরিচয় তো জানি না, তবে এই বাড়ি আমার মা, আমার ভালোবাসা।”
কুহকিনী কিছু বললো না, কেবল হাসলো। বিনি রমি কাকার হাত ধরে বললো, ” তবে তুমি যাই বলো মামা। আমি একটা বিষয় বুঝি না , যে তুমি দিনদিন এতো ইয়ং কী করে হচ্ছো?”
-” বাটার লাগাচ্ছিস!”
রমি কাকার কথার মাঝেই অহন বললো, ” তোমরা কথা বলো আমরা ফ্রেশ হয়ে আসছি। ”
অহন একবার কুহকিনীর দিকে তাকিয়ে দালানের সিঁড়ি বেয়ে নেমে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো, কুহকিনী গেলো তার পিছনে।
নীচের বারান্দার বড়ো বড়ো থাম গুলো পেরোতেই চোখে পড়লো, দেওয়ালে টাঙানো হরিণের মাথার সিং। কুহকিনী সেই দিক থেকে চোখ সরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললো, ” আপনার বাড়ির পূর্বপুরুষেরা শিকারি ছিলেন?”
-” না, ওই শিংটা কেনা তখনকার দিনের।”
-“ও। ”
উপরে বিশাল বড়ো একটা বারান্দা, যা গোটা বাড়ি জুড়ে রয়েছে। পুরো বারান্দা জুড়ে সিলিংয়ে লাগানো ছোটো ছোটো ঝাড়বাতি। কুহকিনী উপর থেকে একবার নীচটা দেখে সামনে পা বাড়ালো। কিছুটা যেতেই হঠাত করেই সারা বাড়ি আঁধারে ছেয়ে গেলো। নীচ থেকে সকলে হইহই শুরু করে দিয়েছে। বিশেষ করে বিনির গলার আওয়াজ তীব্র পাওয়া যাচ্ছে।
হঠাৎই করেই চারিদিক অন্ধকার হতে কুহকিনী ভয় পেয়ে গেল। সামনে অহন কে পিছন থেকে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরলো।
-” বাঁচাও। ”
কুহকিনী কে জড়িয়ে ধরতে দেখে অহন ওর হাত ধরে বললো, ” কী হলো ব্যাপারটা!”
কুহকিনী ওকে জড়িয়ে ধরেই বললো, ” ব্যাপার টা কি আমি জানি নাকি? কারেন্ট গেলো কেনো? বাপরে কী অন্ধকার। ”
-” আমি সেই ব্যাপারের কথা বলি নি। তুমি হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরলে, সেই ব্যাপারের কথা বললাম।”
কুহকিনী চোখ বন্ধ করেই বললো, ” বেশি না বকে আলো আমার চেষ্টা করলে তো পারেন।”
-” সে তো অবশ্যই চাই, কিন্তু আপনার এইরূপ দৃঢ় আলিঙ্গনের জন্যে আমার ফোনটাও বের করতে পারছি না। ”
অহনের কথার মাঝেই কারেন্ট চলে এলো। কুহকিনী অহনকে ছেড়ে ওর থেকে সড়ে দাঁড়ালো। নীচে তখন সকলের গলার আওয়াজ বন্ধ হলো, কিন্তু আবারও হুট করেই সারাবাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। কুহকিনী পাশে অহনের হাতটা শক্ত করে ধরে ওর কাঁধে মাথা রাখলো।
-” এই এতো বার কারেন্ট যাচ্ছে কেনো? আমার এবার ভয় করছে।”
– ” তুমি একজন ডক্টর হয়ে ভূতের ভয় পাচ্ছো, সিরিয়াসলি!”
-” কোন বইয়ে লেখা আছে ডাক্তাররা ভূতে ভয় পায় না। আর আমি ভূতে না অন্ধকারে ভয় পাচ্ছি। ”
ওদের কথার মাঝেই আবার সারাবাড়ি আলোকিত হয়ে গেলো। অহন আলো আসতেই কুহকিনী কে বললো, ” চোখ খোলো।”
কুহকিনী মাথা নাড়লো, যার অর্থ না।
-” আরে চোখ খোলো বলছি।”
অহন একপ্রকার ধমক দিতেই ও চোখ খুলে অহনের
মুখের দিকে তাকালো,
-” এতো চিৎকার করেন কেনো?”
কুহকিনী কে পাত্তা না দিয়ে অহন রেলিঙের ধারে গিয়ে নীচে তাকালো,
-” কী হলো, এতবার কারেন্ট যাচ্ছে কেনো?”
নীচ থেকে রবি বললো, ” আরে বাইরে লাইট গুলো ঠিক করতে গিয়ে প্রবলেম হচ্ছিল, এখন ঠিক আছে। ”
♣
অহন, একবার কুহকিনী কে দেখে নিলো। এই মেয়ে নির্ঘাত ভীতু। নাহলে কেউ আর ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকায়।
-” এই যে কি দেখছো, চারিদিকে?”
-” কী, কিছু না তো। ”
-” চলো আমার সঙ্গে।”
দুজনে ঘরে প্রবেশ করলো। ঘরের একদিকের দেওয়ালের মাঝবরাবর একটা খাট, তার একদিকে ছোটো পুরোনো যুগের টেবিল, তাতে জলের জগ রাখা। তাছাড়াও একটা আলমারি, ড্রেসিং টেবিল ও রয়েছে।
বিছানার উপর রাখা ওদের ব্যাগ থেকে কুহকিনী একটা শাড়ি বের করলো। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে, ফ্রেশ হতে হবে।
অহন বাইরের দিকে অগ্রসর হতেই, কুহকিনী গিয়ে ওর হাত ধরে টানলো, ” কোথায় যাচ্ছেন?”
অহন একবার হাতের দিকে গভীর রেখাপাত করে বললো, ” তুমি চেঞ্জ করবে তাই বাইরে যাচ্ছি।”
-” না আপনি কোথাও যাবেন না। এখানেই থাকুন।”
-” তাহলে তুমি চেঞ্জ করবে কী করে?”
-” আমি ওয়াশ রুমে ম্যানেজ করে নেব। কিন্তু আপনি যাবেন না।”
অহন একবার কপাল চাপড়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। ইশারায় কুহকিনী কে যেতে বললো।
কুহকিনী নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে গিয়ে থেমে গেলো। কী মনে করে পিছন ফিরে অহনের কাছে এলো।
কুহকিনী কে ফিরে আসতে দেখে অহন ভ্রু কুঁচকে বললো, ” কী হলো চলে এলে যে?”
-” এই আপনি সিওর এখানে বসে থাকবেন তো?”
-” বসে থাকবো মানে কি? বসেই তো আছি।”
-” কিন্তু আমার কেনো যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
কথাটা বলেই কুহকিনী ওদের ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি বের করে, শাড়িটার একটা প্রান্ত নিয়ে খাটের গায়ের শক্ত কাঠের উপর অহনের হাতটা বেঁধে দিলো।
-” এই তুমি এটা কী করলে!”
-” দেখুন পাঁচ মিনিট চুপ করে বসুন, আমি এসেই খুলে দেব।
(চলবে)
বিঃ : কুহকিনী নামটা আমি না জেনে লিখিনি, জেনেই লিখেছি। কুহক এর অর্থ মায়াবী, ভ্রম। আমি স্ত্রী লিঙ্গ হিসেবে এখানে মায়াবিনী অর্থাৎ কুহকিনী লিখেছি। এটা হয়তো কারোর নাম হয় না কিন্তু আমি আমার প্রতিটা লেখায় প্রধান চরিত্রের নামগুলি ইউনিক দিই। এটাও ব্যতিক্রম না।