তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী,পর্ব ০৫

0
1068

তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী,পর্ব ০৫
লাবিবা_ওয়াহিদ

ফারিশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার মুখমন্ডলে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস। ফারিশ পিটপিট করে তাকাতেই দেখলো ধবধবে ফর্সা গলা। গলার বামপাশের লাল তিলটাও স্পষ্ট চোখে লাগছে। ফারিশ ঘটনা না বুঝে চোখ বড় বড় করে তাকালো অতঃপর তার সামনে থাকা মানুষটি তার সামনে থেকে চট করে সরে গেলো। সবকিছু এতো দ্রুত ঘটলো যার কিছুই ফারিশ বুঝে উঠতে পারেনি। যতক্ষণে বুঝলো ততক্ষণে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। ফারিশকে এমন আচমকা উঠতে দেখে সানাম অল্প না অনেকটা ভয় পেলো। সানাম বুকে থু থু দিয়ে কপট সুরে বলে উঠে,

-“ভূতে ধরেছে নাকি আপনাকে? এভাবে কেউ লাফ দেয়?”

ফারিশ সানামের দিকে তাকালো। সানামকে দেখে চোখ-মুখ কুচকে ফেললো কারণ, সানামের গেটাপ। সানাম ওড়নাকে এমনভাবে পেঁচিয়েছে যেন সে কাজ করছে।

-“তুমি আমার ঘরে এই সাত-সকালে কি করো? আর তুমি আমার কাছে কে ঝুকেই-বা কেন ছিলে?”

-“কই আপনার দিকে ঝুকেছি? আপনিই তো ঘুমের মধ্যে আমার ওড়না ধরে টান দিসেন। আচ্ছা আপনি কী খান বলেন তো? ঘুমের মধ্যে আপনার গায়ে ষাড়ের মতো শক্তি কোথা থেকে আসে?”

-“প্রশ্নটা আগে আমি করেছি আর তুমি আমাকেই পাল্টা প্রশ্ন করছো? তুমি আমার রুমে কি করো সেইটা আগে বলো। তোমার কোনো কু-মতলব নেই তো?”

এবার সানাম তার হাতে থাকা ঝাড়ুটা চট করে ফেলে দিয়ে কোমড়ে দুই হাত রেখে নাক ফুলিয়ে বলে উঠে,

-“আমি আপনাদের ছেলে জাতি নই যে আমার আপনাদের মতো কুমতলব থাকবে! আমি আসছি আপনার নানীর জ্বালায়! এই মহিলা আমাকে ফজরের পর থেকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। এখন আপনার রুমে ঝাড়ু নিয়ে আমায় জোর করে পাঠাইসে! এখন দোষ আমি কার দিবো?”

ফারিশ ঝাড়ু দেখে এতক্ষণে বুঝলো আসল কেসটা আসলে কি। তবে সানামের লুকটা ফারিশকে হাসিয়ে তুললো। ফারিশ ফিক করে হেসে দেয়। সানাম ফারিশের হাসি দেখে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। কী সুন্দর হাসি তার। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির মাঝে টোলটা অস্পষ্ট। কোনো ছেলের হাসিও বুঝি এতোটা সুন্দর হতে পারে? সানাম কিছুটা আনমনে হলে জলদি ধ্যান ভাঙ্গায় এবং আপনমনে বলতে লাগে,

-“ছিহ সানাম! ইট’স ব্যাড সানাম, এগুলা ভালো না। তুই তোদের লেভেল এন্ড অবস্থান চিন্তা কর। সে আমাকে সাহায্য করছে, নাথিং এলস। কান্ট্রোল ইওরসেল্ফ সানাম।”

পরমুহূর্তে ফারিশ হাসি থামিয়ে বলে,
-“তোমাকে পুরো কাজের মহিলা রহিমা, জরিনা, সখিনা লাগছে। নামগুলো খুব সুন্দর তাইনা?”

ফারিশের এরূপ কথায় সানাম ভিষণরকম চটে গেলো। কিছুক্ষণ আগে মনের লাড্ডু ফোটা নিমিষেই জানালা দিয়ে পালিয়েছে। সানাম নাক, মুখ ফুলিয়ে আবার বলে উঠে,

-“আপনার মাঝে ঠাডা পরবে ঠাডা! সাথে আমাকে কাজের মহিলার বলার শাস্তি হিসেবে এই জরিনা, রহিমা, সখিনাই আপনার ভবিষ্যৎ বউ হবে। অতঃপর দিনরাত ঝাড়ু আর উষ্টা দিবে আপনার বউ, কথাটা মিলিয়ে নিয়েন্। বেদ্দপ ফানুস!”

বলেই ঝাড়ুটা নিয়ে সানাম হনহন করে বেরিয়ে গেলো। আর ফারিশ হা হয়ে সানামের যাওয়া দেখছে।

-“মেয়েটার এতো সাহস আসে কোথা থেকে? মুখের উপর এতোগুলা কথা বলে গেলো আর আমি কিনা চুপচাপ শুনলাম?” পরের কথা বলতে নিবে তার আগেই তার দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর গেলো। ৮ঃ০৬ মিনিট।

-“অফিস ন’টায়। তাড়াতাড়ি উঠতে পেরেছি সো মিস সখিনার বাকি অপরাধ মাফ করে দিলাম।”

বলেই ফারিশ হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমের দিলে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে সুন্দরভাবে রেডি হয়ে ফারিশ ডাইনিং এ চলে আসলো। নানী পানের ডাব্বা থেকে পানে মশলা করতে ব্যস্ত। অন্তু আন্টি রান্নাঘরে রান্না করতে ব্যস্ত। বুয়া তাকে হাতে হাতে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে। ডাইনিং এর পাশেই একটা ছোট করে বেলকনি আছে। সেখানে ইকরাম ফরিদ চেয়ার পেতে আয়েশ করে বসে পত্রিকা পড়ছেন এবং ফাঁকে ফাঁকে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। সকালের মিষ্টি রোদ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বারংবার। ফারিশ তার ব্যাগ হাতে নিয়ে ডাইনিং এ চেয়ার টেনে বসে পরলো। অন্তু ফারিশের দিকে তাকিয়ে তরকারি চুলা থেকে নামিয়ে খাবার বাড়লো। ফারিশ একবার এদিক সেদিক তাকালো কিন্তু কোথাও সানামকে পেলো না। অন্তু ফারিশের সামনে খাবারের প্লেট রাখতেই ফারিশ তার মায়ের দিকে তাকালো।

-“খেয়েছো তুমি? আর বাকিরা..!!”

-“তোর বাবা ওষুধ নিয়েছে, খেতে খেতে আটটা পয়তাল্লিশ বাজবে। তখন একসাথেই খাবো। তুই আগে খেয়ে নে, আর আজ তো শুক্রবার। আজকে তোর আবার কিসের অফিস ফারিশ!”

-“আজ আমার প্রথম জয়েন মা। শুক্রবার বলো আর ইদ বলো, কোনোটাই প্রথমদিনে মানে না। আর আমি একদমই মিস করতে চাই না! আর শুনেছি শুক্রবারে কয়েক ঘন্টার জন্য বস অফিসে আসে। এখন যদি প্রথমদিনই না যাই, তাহলে বস আমার সম্পর্কে খারাপ ধারণা করতে পারে।”

অন্তু কিছু বললো না। পরম যত্নে নিজ হাতে ছেলেকে খাইয়ে দিতে লাগলেন। ফারিশও তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। ফারিশ অনেকক্ষণ সানামকে আশেপাশে দেখলো না তাই তার মাকে জিজ্ঞেস করলো,

-“মা সানাম কী খেয়েছে?”

-“হ্যাঁ।”

-“এখন কোথায়?”

-“আর বলিস না, মা সেই সকাল থেকে বেচারী মেয়েটাকে খাটিয়েছে। এখন মাকে বুঝিয়ে মেয়েটাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার জানিস ভিষণ খারাপ লাগছে। মেয়েটা কী ভাববে বল তো? মাকেও তো কিছু বলা যাবে না, যদি জানে আমাদের খরচে মেয়েটা চলছে তাহলে তো একেবারে বাড়িছাড়া করবে।” খুবই নিচু স্বরে কথাগুলো বললেন অন্তু। ফারিশ চুপচাপ শুনলো। হঠাৎ তার মাথায় এলো সানামের টিউশনির কথা। সানামকে দ্রুত টিউশনু খুঁজে দিতে পারলেই নানী আর সানামকে হাতের নাগালে পাবে না। খেতে খেতে ফারিশ একটা পরিকল্পনা করলো। খাওয়া শেষে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো তার নতুন যাত্রায়। ফারিশ সুট বলতে নেভিব্লি কালারের শার্ট আর একটা চিকন টাই বেঁধেছে। শার্ট ইন করা। ব্ল্যাক পেন্ট, ব্ল্যাক শু, ব্ল্যাক বেল্ট আর বামহাতে কালো বেল্টের ব্রান্ডের ঘড়ি। চুলগুলো জেল দিয়ে একপাশে খুব স্টাইল করে আনা,চোখে সানগ্লাসও আছে বটে। ব্যাস! এতেই তাকে অসফারিশ ব্লেজার পছন্দ করে না, তাই সে কখনো ব্লেজার পড়েনি। পার্কিং থেকে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেলো। অফিসে যেতে প্রায় আধঘন্টা লাগে। আধঘন্টার মাঝেই ফারিশ অফিস চলে আসলো। বাইক পার্ক করে কিছুক্ষণ অফিসের দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে অফিসের ভেতর ঢুকে পরলো। রিসিপশনে যেতেই একটা মেয়ে বললো আগে যেন স্যার মানে বসের সাথেদেখা করে। ফারিশ ওকে বলে চলে গেলো। এদিকে রিসিপশনে বসা মেয়ে দু’টো এখনো হা করে তাকিয়ে আছে ফারিশের দিকে। কমবেশি সকল মেয়ে স্টাফই বারংবার ফারিশের দিকে তাকাচ্ছে। ফারিশ এসব ঘটনার সাথে পূর্ব পরিচিত তাই এসবে তার কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ নেই। সে একমনে তার আগামীদিনের কাজ নিয়ে চিন্তিত। ফারিশ বসের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর কেবিনের ডোরে নক করে বললো,

-“মে আই কাম ইন স্যার?”

-“কাম ইন।”

ফারিশ দরজা খুলে ভেতরে চলে গেলো। বস ফারিশকে দেখে হালকা মুচকি হাসলেন। সাখাওয়াত সরকার বিনয়ের স্বরে বললেন,

-“ওয়েলকাম ইয়াংম্যান। আমি তো ভাবতেই পারিনি তুমি আসবে। যাক আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।”

ফারিশ হাসলো, বসের কথায়। এরকম কিছুক্ষণ কথা বলে দুজন। একসময় ফারিশ তাকে জানায় আজ সে কয়েক ঘন্টার জন্যে হলেও কাজ করতে আগ্রহী। বস আর না করেনি। তিনি ম্যানেজারকে ডেকে পাঠান, ফারিশকে সব কাজ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। ম্যানেজার বসের হুকুম পেয়ে ফারিশকে সব বুঝিয়ে দিলো এবং ফারিশের ডেক্সও দেখিয়ে দেয়। আজ শুক্রবার তাই অনেকেই আসেনি। একমাত্র যারা ওভারটাইম করতে চায় তারাই এসেছে। মেয়ে স্টাফ হাতে গোণা কয়েকজন আছে। তারা বারংবার ফারিশকে দেখছে। ফারিশ তার চেয়ার কিছুক্ষণ স্পর্শ করে বসে পরলো। অতঃপর ম্যানেজারের বলা কাজগুলো ধীরে ধীরে করতে শুরু করলো। ফারিশ কাজ করছিলো তখনই তার পাশের ডেক্স থেকে একটা ছেলে বলে উঠে,

-“নিউ?”

ফারিশ পাশে তাকায়। ছেলেটি মুচকি হেসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ফারিশ তার ঠোঁট দুটি প্রসারিত করে মাথা নাড়ায়। ছেলেটি হাত বাড়িয়ে বলে,

-“হাই আমি রাতুল। তুমি?”

-“ফারিশ।” হাত মিলিয়ে বললো ফারিশ।

-“ইউনিক নেম।”

-“থ্যাংকস।” এরকম দুজন কথা বলতে বলতে কাজ করতে লাগলো।
.
সানাম গোসল সেরে বিছানায় বসতেই রিংটোনের শব্দ শুনতে পেলো। সানাম ভ্রু কুচকে এদিক সেদিক তার বাটন ফোনটা খুঁজতে লাগলো কিন্তু পাচ্ছে না। শেষে জামা-কাপড়ের মাঝে পেলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো তার বান্ধুবি নদী কল করেছে যে কি না সেদিন বাসা থেকে পালিয়েছিলো। সানামের রাগ হলেও সেটা দমিয়ে রেখে কল রিসিভ করলো। রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,

-“বান্ধুবী কী অবস্থা তোর?”

-“রাখ তোর অবস্থা! আমাকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় মনে ছিলো না?”

-“ওহ বান্ধুবি! কিসব বলছিস! জানিস তো আমি আর হাসিব একে অপরকে ভালোবাসি। আমি হাসিবকে ছেড়ে বিয়ে করতাম ওই টাকলুকে! কোনোদিনও না। ওরে বিয়ে করার চেয়ে মরাও ব্যাটার ছিলো আমার জন্য।”

-“তাহলে মরতি! তুই মরলে তো তোর বাবা-মা আমাকে ফাঁসাতে আসতো না। দেখ বইন তুই আমার সাথে একদম যোগাযোগ করবি না। আমি এতিম বলে বারংবার তোরা আমাকে নিয়ে খেলবি তা হবে না। ভালো থাকিস, আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই কট করে কল কেটে দিলো সানাম। যা সহ্য করেছে তা একদমই ভুলতে পারবে না সানাম। ছোট থেকেই লাঞ্ছনা সহ্য করে গেছে, শুধুমাত্র সে এতিম বলে। মানুষ প্রয়োজনেই তাকে কাছে ডেকেছে, প্রিয়জন হিসেবে নয়। কাজ ফুরালে আবার ধাক্কা করে ফেলে দিয়েছে। এমন ধাক্কা খেতে খেতে সানামের সবকিছুর প্রতি বিরক্তি ধরে গেছে, তাই সে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। নিজের মতো করে বাঁচতে চায় সে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here