তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী,শেষাংশ

0
2340

তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী,শেষাংশ
লাবিবা_ওয়াহিদ

সূর্যের মধুময় কিরণ জানালা ভেদ করে সানামের চোখে পরতেই পিটপিট করে চোখ সে। চোখ মেলতেই উপরে নানান ফুলের বেড়াজাল দেখতে পেলো, সাথে অমায়িক ফুলের সুঘ্রাণ তো আছেই। সানাম বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। অতঃপর গতকাল বিয়ের কথা মনে হতেই সানাম লজ্জায় দৃষ্টি নুইয়ে ফেলে। এখনো কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে বিবাহিত, তার ভালোবাসার মানুষটার সাথেই সে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। সানাম ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। ফারিশ এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার পাশে যে একজন শুয়ে আছে সেদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই। গতরাতে দুজনের মাঝে কোনোরকম কথাই হয়নি৷ আনন্দে দুজনই তাদের কথাগুলো হারিয়ে ফেলেছিলো। ফারিশ যখন বিছানায় বসে সানাম পেছন দিয়ে বেড থেকে নেমে যায়। এক অজানা অস্বস্তি কাজ করছিলো তার মাঝে। ফারিশ তার লাল টুকটুকে বউয়ের দিকে কিছুক্ষণ একপলক তাকিয়ে ছিলো। সে বুঝেছে তার বউয়ের অবস্থা। তাই সে সোজা হয়ে শুয়ে অপরদিকে ফিরে বলেছিলো,

-“কেউ চাইলে আমার পাশে শুতে পারে, আমি মাইন্ড করবো না।”

বলেই ফারিশ চোখ বুজে। সানাম তখনো দাঁড়িয়ে ছিলো। ঘন্টাখানেক পর যখন সে নিজেও ক্লান্ত হয়ে যায় এবং ভাবে ফারিশ ঘুমিয়ে পরেছে তখনই সে বিছানায় একপাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পরে। কিন্তু ফারিশ তখনো ঘুমায়নি। সে যে তৃষ্ণার্ত তার প্রেয়সীকে দেখার জন্য। যখন বুঝলো সানাম ঘুমিয়ে কাত, তখন ফারিশ মুচকি হেসে সানামের দিকে ফিরে শুয়ে পরলো। সানামের ঘুমের কারণে তার কোনো হুঁশ নেই। ফারিশ তৃপ্তি নিয়ে দেখলো সানামকে। কিন্তু যতোই দেখুক না কেন তার দৃষ্টি তৃষ্ণার্তই রয়ে যায়। সানামকে দেখতে দেখতে নানান চিন্তা করে একেবারে ৪টার দিকে সে ঘুমিয়েছে, যা সানামের অজানা। সানাম দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে চটজলদি উঠে পরে। এই বেনারসি নিয়ে এখন তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। জলদি রুম থেকে বেরিয়ে তার ঘর থেকে একটা শাড়ি নিয়ে আবার ফারিশের রুমে চলে এলো। ফারিশ তখনো ঘুম। সানাম ফারিশের দিকে একপলক তাকিয়ে ওয়াশরুম ঢুকে গেলো। এখন মোটামুটি সে শাড়ি পরতে জানে।

ফারিশের মুখে পানির ছিটা পরায় তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই তার মুখমন্ডলে বিরক্তি প্রকাশ পেলো। ফারিশ চোখ খুলে সামনে তাকাতেই থমকে গেলো। সানাম ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি ঝাড়ছে। নাকে নথ, দু’হাতে চুড়ি, শাড়ি যেন পারফেক্টলি ফারিশের বউ। ফারিশ মুগ্ধ হয়ে তার প্রেয়সীকে দেখছে। ইচ্ছা করছে তার ভালোবাসার স্পর্শে তার প্রেয়সীকে মুড়িয়ে দিতে। তার দীঘল কালো কেশের সুঘ্রাণ নিতে। কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরণ হলে তো। তখনই দুই রামছাগল ফারিশের চিন্তায় বাগড়া দিয়েছে। সেজান, সামি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ওদের ডাকছে এবং দরজায় নক করছে।

-“কী বেলা তো গড়িয়ে গেলো, এতো কিয়ের বাসর করিস তোরা? এদিকে আন্টি আমাদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে তোদের ডাকার জন্য? এখন বেরিয়ে আসবি নাকি দরজা ভেঙ্গে তোদের বাসরে হাড্ডি হবো?”

ওদের লাগামহীন কথাবার্তায় সানাম লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। তখনই তার চোখ পরে বিছানায় বসে থাকা ফারিশের দিকে যে কিনা বর্তমানে তেলে-বেগুনে জ্বলছে৷ সানাম সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেললো। ফারিশ চেঁচিয়ে বললো,

-“বাসর মাই ফুট!! তোদের জন্য বাসর কী হানিমুনও আমার পক্ষে সম্ভব না। এখন তোরা যাবি নাকি জুতা দিয়ে বাইরাইতে বাইরাইতে বাসা থেকে বের করবো?”

ওপার থেকে কোনোরকম সাড়াশব্দ আসলো না। এর মানে বোঝা গেলো ওরা আর এদিকে নেই, বাতাসের তাকে হারিয়ে গেছে। ফারিশ রাগে গজগজ করতে করতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আর সানাম, সে তো থম মেরে দাঁড়িয়েই রইলো। ফারিশের কথাগুলো যেন তার মাথার উপর দিয়ে গেছে।

ফারিশ কফি খাচ্ছে আর দুই বান্দার সাথে আড্ডা দিচ্ছে৷ ফারিশের মনে একটা প্রশ্ন আসতেই ফারিশ বলে উঠে,

-“আচ্ছা তোরা কীভাবে রাতুলকে লাইন থেকে ক্লিয়ার করলি?”

সেজান হাসলো। সামি, সেজান একে অপরের দিকে তাকিয়ে সেজান বলে উঠে,

-“স্লিপিং পিল!”

-“হোয়াট!!”

সেজান হাসতে হাসতে বললো,
-“হ্যাঁ। রাতুলের এক ফ্রেন্ডরে হাত করসিলাম। ওই ছেলে রাতুলের জুসে হাই ডোজের স্লিপিং পিল দিয়ে দিয়েছিলো। রাতুল বার থেকে হেঁটে আসতে আসতেই রাস্তাতেই ঘুমিয়ে গেলো। সন্ধি, সামি, আলিফ মিলে ওই হালারে টানতে টানতে এক পরিত্যক্ত গোডাউনে ফেলে আসে। শুনেছি ওই গোডাউনে ভূতূড়ে কিছু আছে৷ তাই আমি আরও বড় প্ল্যান করলাম। ভূতের সিডি, প্রোজেক্টর দিয়ে ওদের বললাম ঠিক জায়গায় কোপ মারতে। রাতুল ঘুম থেকে জাগলেও ভয় পাইতে পাইতে বারবার অজ্ঞান হয়েছে। আজ বা কালজের মধ্যে দেখিস ওর ফ্যামিলি ওরে পাগলাগারদ পাঠাবে!”

সেজানের এমন প্ল্যানে ফারিশ কিটকিটিয়ে হেসে দিলো৷ কেটে গেলো কয়েকমাস। সানাম নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করলেও এখনো ফারিশের সাথে সে স্বাভাবিক হতে পারেনি। সেজান সানামকে জানিয়েছে ফারিশ বুশরার সাথে নাটক করেছিলো। বুশরার কাছে একটা মেয়ের ভিডিওক্লিপ ছিলো যা বুশরা খারাপভাবে ব্যবহার করতে গেছিলো। ফারিশের কাছে বলতেই ফারিশ এসব করেছে। একটা মেয়ের সম্মান বাঁচিয়েছে ফারিশ, ভেবে সানামের ফারিশের প্রতি সম্মান আরও বেড়ে যায়। ফারিশ প্রতিদিন সানামকে ভার্সিটি পৌঁছে দেয় এবং বাসায় নিয়ে আসে। সানামের জব করার অনুমতি দেয়নি ফারিশ কারণ, সানাম এখন একার উপর নির্ভরশীল নয়। তার নিজের একটা পরিবার আছে৷ স্বামী আছে, সংসার আছে। তাই সানাম আপাতত নিজের পড়াশোনা এবং পরিবারের উপর সবদিক ফোকাস রেখেছে৷ সানাম এখ ফারিশের প্রতিটা কাজ করে দেয়। হয়তো দুজনের কথা বলায় সমস্যা, তবে মন থেকে দুজন দুজনের পাশে ছায়ার মতো থাকে। দুজন জানে, দুজনের অনুভূতি একইরকম, তাও কোথায় যেন কথাপাখি গুলো আটকে থাকে, বের হতে চায় না।

ফারিশ সানামকে নিয়ে ভার্সিটি থেকে ফিরছিলো তখন সানাম অস্ফুট সুরে বলে উঠে,

-“কোথায় যাচ্ছেন? বাসার রাস্তা তো এটা নয়!”

ফারিশ কিছু বললো না, হাসলো। পুরো রাস্তায় সানামের একটা প্রশ্নেরও উত্তর দেয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফারিশ একটা রিসোর্টের সামনে এসে দাঁড়ালো। এতো সুন্দর রিসোর্ট সানাম মুগ্ধ হয়ে দেখছে। সানাম বাইক থেকে নামতেই ফারিশ সানামের চোখে লাল কাপড় বেঁধে বললো,

-“চুপ! কোনো কথা নয়, আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চুপচাপ আসবে।”

বলেই ফারিশ সানামের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। পাক্কা১০ মিনিট পর সানামের চোখের বাঁধন ফারিশ খুলে দিলো। সানাম সামনে তাকিয়ে হা হয়ে গেলো। কী সুন্দর ডেকোরেশন। চারপাশে নানান লাভ বেলুন, ক্যান্ডেল দিয়ে সাজানো। এটা একটা বড় বেডরুম। একপাশে বসার জায়গা রয়েছে। সানাম মুগ্ধ হয়ে সব দেখেই যাচ্ছিলো তখনই তার সামনে প্রজেক্টরের মাধ্যমে একটা বাক্য ফুটে উঠলো,

-“ভালোবাসি আমার তৃষ্ণার্ত প্রেয়সীকে।”

বাক্যটির পরপর সানামের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠলো। ফারিশের এমন প্রপোজে সানামের চোখ দিয়ে অটোমেটিক জল গড়িয়ে পরলো। ফারিশ সানামের কানের কাছে শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“ভালোবাসি, আমার এই রাগি বোমটাকে। কতোদিন ঝগড়া করি না, খুব মিস করছি। তবে আজ কোনো ঝগড়া নয় বুঝলে? এখন বলো ভালোবাসো?”

সানাম মাথা নিচু করে হাসলো। সানাম মাথা নাড়িয়ে বললো,

-“হুম, বাসি। আমার ফানুসকে।”

সানামের দেয়া নিকনেম শুনে ফারিশ হাসলো। অতঃপর সানামের সামনে এসে সানামের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

-“মে আই..?”

সানাম লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। ফারিশ ঠিক কী চাইছে সানাম ফারিশের নেশাভরা চাহনিতেই বুঝতে পেরেছে। তবে আজ সে বাঁধা দিবে না। অনেক বাঁধা-বিপত্তি পার করেছে আর নয়। সানাম কাঁপা হাত বাড়িয়ে ফারিশের হাতে রাখলো। ফারিশের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। সে যে সম্মতি পেয়েছে তার প্রেয়সীকে আপন করার।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here