আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-৯,১০
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-৯
বিভোর একমনে গাড়ি ড্রাইভ করছে। ওর মনে হাজারো প্রশ্ন। সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে গাড়ি থামালো ইভাদের বাড়ির গেইটে। ইভাকে নিয়ে রুহি নামলো গাড়ি থেকে। অন্যান্য মহিলারা এসে ইভাকে নিয়ে গেলো। পার্সটা গাড়ির ভেতর ফেলে আসায় রুহি ওটা নিতে গেলো, বেরুবার সময় আঁচল আটকে গেলো গাড়ির লকে।
‘ স্টপ। টেনো না, আমি ছাড়িয়ে দিচ্ছি।’
গা জ্বলে গেলো রুহির। ডাক্তারের আদিক্ষেতা সহ্য করার মতো নয়। ওর মুখও দেখতে চাইছেনা রুহি। রুহির আঁচলে হাত দিতে গেলে ও সরে গেলো। বিভোর ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ প্রবলেম কী তোমার? ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারোনা?’
‘ পারিনা। আপনি আমার পোশাকে হাত দেবেন না।’
‘ মানে কী?’
‘ পরপুরুষ হয়ে কেন আমার পোশাকে হাত দিবেন? যান না এখান থেকে।’
ধাক্কা খেলো বিভোর। রুহি নিজেই ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, সুতো আটকে গিয়ে ফেঁসে গেলো পুরো নকশাটা। রাগের চোটে একটানে শাড়ি ছাড়িয়ে ফেললো রুহি। কিছুটা ছিঁড়েও গিয়েছে।
বিভোর বলল,
‘ আমি ছাড়িয়ে দিলে সমস্যাটা কি হতো?’
‘ বলতে বাধ্য নই।’
‘ অভিয়াসলি বাধ্য।’
‘ কেন বাধ্য? কিসের বাধ্য? আমি আপনার কে? কিছু হই? কিচ্ছু না! তাহলে কেন আমি বাধ্য?’
বিভোর রেগে গেলো। মুখে মুখে তর্ক সেদিনের পুচকির? কড়া গলায় বলল,
‘ আমার বিয়ে করা বউ হও।’
রুহি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
‘ আমি? আপনার বউ? কখন আর কীভাবে বিয়ে হলো আমাদের?’
‘ ভুলে গেলে? কিছু জানোনা এমন ভাব কেন করছো?’
‘ কিচ্ছু জানিনা। আমার জীবনে আপনার কোনো জায়গা নেই। আপনি না আমাকে ছেড়ে দিবেন, তাহলে দিন আর শান্তিতে থাকুন। অযথা এই বোঝা মেয়েটাকে সাহায্য করতে যাবেন কেন আপনি!’
রুহি এই কথা বলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলো।
বিভোরও রেগে আছে। মেয়েটাকে সাহায্য করতে যাওয়াটাই ওর ভুল হয়েছে। বাড়ির ভেতর ঢুকতে যাবে তখনই মোবাইল বেজে ওঠলো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সেলফোন বের করে দেখলো হসপিটাল থেকে ফোন আসছে।
‘ হ্যালো মিতু?’
‘ জ্বি স্যার। ইমার্জেন্সি একটা সার্জারি করতে হবে।’
বিভোর বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ আজ আমি ছুটি নিয়েছি।’
‘ আপনি ছাড়া আর কেউ নেই স্যার!’
‘ পেশেন্টের কন্ডিশন কেমন আছে?’
‘ বুঝতে পারছিনা স্যার। আপনি এলে বোধহয় ভালো হয়।’
‘ আচ্ছা, সব রেডি করো। আমি বেরুচ্ছি।’
‘ স্যার একটা কথা!’
‘ বলে ফেলো।’
‘ পেশেন্টের সামর্থ্য নেই এতো খরচ করার। ওরা বলছে যদি কমের মধ্যে কিছু করা যায়।’
‘ ঠিক আছে, আমি বলে দেবো। মোটামুটি একটা অংশ তো দিতেই হবে।’
‘ জ্বি স্যার। বলে দিচ্ছি ওদের।’
‘ শুনো আমার চার্জটা কেটে দাও, ওটা দিতে হবেনা।আমি আসছি!’
‘ ওকে স্যার।’
ফোন রেখে বিভোর গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দেশে আসার পরের দিনই কাজে যোগদান করতে হয়েছে ওর। এই একমাসে কোথাও যাওয়া হয়নি, যা-ও বিয়ে খেতে এসেছে এখানেও ফুরসত নেই। অন্যসব ডাক্তাররা কি করে বিভোর ভেবে পায়না। যদি লোকের কাছ থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকাই খাবি তাহলে ডাক্তার হয়েছিস কেন!
কাউকে কিছু না জানিয়ে দারোয়ানকে বলে হসপিটালে চলে গেলো বিভোর। এদিকে ইভার বর এসে পড়েছে, সবাই হাসিখুশিতে মগ্ন। রুহি মেহমানদের আপায়্যন করছে। বিয়ে হবে বিকেল পাঁচটায়, আরও ঘন্টা খানিক বাকি। ইভার বর রাতুল। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালোই। ইভার সঙ্গে সেলফি নিচ্ছে। দুজনের চেহারায় সুখী সুখী ভাব। রুহি সেদিকে তাকিয়ে ভাবলো, ওর বিয়ের দিন ও জানতেই পারেনি যে আজ ওর বিয়ে। অচেনা একটা ছেলের সাথে কিছু লোক রুহির বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ে জিনিসটা তখন ভালো করে বুঝতোই না রুহি। একদিনের পরিচয়েই বিভোরকে ওর খুব ভালো লেগে গেলো। আর বিভোর! সে রুহিকে ফেলে সেই যে গেলো আজ তিনবছর পর তাদের দেখা। না হলো বিয়ের ছবি, না হলো সংসার, না পেলো বিভোরকে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো শুধু।
নাদিরা ইসলাম , নাসিমা চৌধুরী সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। রাতুলদের বাড়ি থেকে যারা এসেছে তারা খুবই ভালো মানুষ। অনেকক্ষণ যাবৎ রুহি লক্ষ্য করছে রাতুলের বন্ধু ওর দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। ওর অস্বস্তি হতে লাগলো। রুহির সাথে চোখাচোখি হতেই ছেলেটা হাসলো। বিরক্ত হয়ে রুহি অন্যদিকে চলে গেলো। এদিকটায় বেশি মানুষ নেই।
সারাবাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। নেটের পর্দার উপর অর্কিড দিয়ে দারুণ কম্বিনেশন। লাইটিং করা হয়েছে বাড়ির সদর দরজা থেকে শুরু করে পেছনের বাগান পর্যন্ত। সবকিছু ইভা নিজের পছন্দে করেছে। রুহি শাড়ি আগলিয়ে ছাদে উঠে এলো। ঘরে দমবন্ধকর পরিস্থিতি। এখানে নির্মল বাতাস। মৃদু ঠান্ডা হাওয়া। দোলনায় বসে রুহির চোখ গেলো দড়ির উপর। একী! বিভোর ওর কাপড়চোপড় এভাবে রেখে গিয়েছে, পাগল নাকি লোকটা? ভেজা একগাদা কাপড় না নিংড়ে কি পচাতে চায়? আজব! কোনো খেয়াল নেই এই ডাক্তারের। কিন্তু গেলো কোথায় বিভোর? অনেকক্ষণ যাবৎ দেখতে পাচ্ছেনা তো। আবার ভাবলো, যেখানেই যাক রুহির কী! আই ডোন্ট কেয়ার।
অনিচ্ছাবশত বিভোরের কাপড়গুলো নেড়ে দিলো রুহি।
‘ এক্সকিউজ মি!’
রুহি তাকিয়ে দেখলো ওই রাতুলের বন্ধুটা।
‘ জ্বি বলুন।’
‘ আসলে পরিচিত হতে এলাম আপনার সাথে।’
রুহি মনে মনে একগাদা গালি দিয়ে হাসিমুখে বলল,
‘ ওহহ।’
‘ আপনার নামটা জানতে পারি কি?’
‘ রুহি।’
‘ আমি নিরব। আপনি ইভা’র কী হন?’
‘ বোন।’
‘ আমি রাতুলের বন্ধু। চিনবেন নিশ্চয়ই!’
‘ হ্যাঁ চিনেছি।’
নিরব বলল,
‘ আপনি বোধহয় আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন না? বিরক্ত হচ্ছেন কী?’
ভদ্রতার খাতিরে রুহি বলল,
‘ না না। আসলে অনেক গরম লাগছে তো, তাই এমন মনে হচ্ছে।’
নিরব একটা ব্যস্ত ভঙ্গি করে বলল,
‘ এদিকে আসুন। বাতাস আছে।’
না চাইতেও রুহি সেদিকে গেলো। বাগানে একটা কদম গাছ আছে, সেটা বেড়ে ওঠে ছাদের একপাশে ছড়িয়ে গিয়েছে। তাই এদিকটায় সবসময় বাতাস থাকে, সেখানেই টেবিল-চেয়ারের ব্যবস্থা আছে। বর্ষাকালে গাছটাতে অনেক কদম ধরে। তখন ইভা, রুহি, নাদিরা ইসলাম মিলে এখানে বসে চা খায় আর কদম ফুলের সুঘ্রাণ নেয়। পূর্ণিমার মায়াবী আলোয় করে কদমবিলাস!
বিভোর হসপিটাল থেকে ফিরেছে। ওটি শেষ করতে ঘন্টা দেড়েক লেগেছে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে এক পল্টন মেহমান থেকে মাকে খুঁজে নিয়ে বলল,
‘ একটু স্পেস কোথায় পাবো? ওটি করে এসেছি, ভাল্লাগছে না।’
নাসিমা চৌধুরী অবাক হয়ে বলল,
‘ কখন গেলি? ছুটি নিসনি? বোনটার বিয়ে তা-ও তুই ওকে টাইম দিসনি? এমন কেন তুই বিভোর!’
‘ রিল্যাক্স আম্মু। সব প্রশ্নের উত্তর একসাথে দিতে পারবোনা। গেলাম দেড়ঘন্টা আগে, বোনকে গাড়িতে টাইম দিয়েছি পার্লার থেকে আসার সময়। আর আমি এমনই। বাউন্ডুলে!’
‘ খুব শ্রীঘ্রই তোকে বিয়ে দিয়ে বাউন্ডুলে গিরি ছোটাবো। ডাক্তার হয়েছো বলে কি মাথা কিনে নিয়েছো সবার?’
বিভোরের বাবা বাবর চৌধুরী। ওনি ছেলের ডাক্তারি পেশায় ভীষণ বিরক্ত। ছেলের এইরকম উদাসীনতা ওনার একদম পছন্দ নয়। ইতিমধ্যে প্রায় সতেরোটি মেয়ে দেখে এসেছেন, কোনোটিই পুত্রের জন্য পছন্দ হয়নি। তাই আরও রাগ ছেলের উপর। বিভোরকে বিয়ে দেওয়ার ভূত চেপেছে ওনার মাথায়। এদিকে ছেলে এখনোই বিয়ে করতে চাচ্ছেনা। বাপে-ছেলেতে একপ্রকার যুদ্ধ। যাইহোক, বিভোর বাবার মুখ ঝামটা খেয়ে মাকে বলল,
‘ আমাকে পানি দাও তো। এই বুড়ো আমাকে শান্তি দিবেনা।’
‘ চাপকিয়ে তোমার পিঠের ছাল তুলবো। ভেড়ার খাদ্য বানাবো। গাধাও তোমার চেয়ে ভালো। এতোবড় দামড়া হয়েছো এখনো বিয়ে করছেনা, বলি আমরা নাতি-নাতনির মুখ দেখবো কখন? তুমি কী বুড়ো হয়ে বিয়ে করবে? পরে তোমার সন্তানসন্ততিরা আমাদেরকে দাদা-দাদী না ডেকে তোমাকেই ডাকবে। ছোটবোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, আর সে এখনো ডাক্তারি করে বেড়ায়৷ অসহ্য!’
বিভোর বাবার কথা শুনে মুখ কালো করে ফেললো। ঘরভরা মেহমান, কেউ যদি শুনে নেয় তাহলে ওর মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়বে। নাসিমা ছেলের জন্য পানি আর সাথে কিছু মিষ্টি নিয়ে আসলেন। হেলথের জন্য ভালো নয় বলে বিভোর মিষ্টি পছন্দ করে না। কিন্তু মায়ের জোড়াজুড়িতে খেতে বাধ্য হলো।
ইভা আর রাতুলের সঙ্গে দেখা করে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললো বিভোর। বিয়ের বাকি আধঘন্টা। কাজি এখনো এসে পৌঁছায়নি। মানুষের হট্টগোলে বেহাল অবস্থা বিভোরের। মাথা দপদপ করছে বিধায় খালি জায়গা খুঁজতে লাগলো। ঘুমাতে পারলে বেশ হতো। কোথাও কোনো রুম খালি না পেয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। ছাদে মানুষজন নেই। দক্ষিণ দিকের কদম গাছটা উত্তাল হাওয়া দিচ্ছে বিধায় বিভোর সেদিকে পা বাড়ালো। দেখলো, রুহি এবং একটা ছেলে হেসে হেসে কথা বলছে। দুজনের কি এতো কথা যে এভাবে হাসছে, বিভোর বুঝতে পারলো না। আর এই ছেলে কে?
ছেলেটির চোখমুখ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে ও রুহির হাসিতে মুগ্ধ! বিভোর নোটিশ করলো এটা। আর তখনই কেমন রাগ লাগলো। আর মেয়েটাও কেমন হাসছে দেখো, মাথা ধরে গেলো বিভোরের। অন্য কোনো ছেলে কেন এই মেয়েটার প্রতি এতো মুগ্ধতা প্রকাশ করে? কই! বিভোর তো পারেনা। ভালোবাসা নেই বলেই কী? আচ্ছা, ভালোবাসা কিভাবে তৈরি হয়? তাহলে বিভোর একটা চান্স নিয়ে দেখতো। হঠাৎ করে মাথায় এই ভাবনা আসায় বিভোর হতবিহ্বল হয়ে গেলো। এটা কি হচ্ছে ওর সাথে? মনে হচ্ছে রুহির হাসি দেখার অধিকার একমাত্র ওর থাকা উচিৎ, আর কারোর নয়। তিন বছর আগের ছোট্ট বউয়ের প্রতি হঠাৎ ভীষণ দুর্বলতা অনুভব করলো বিভোর।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০
বিভোরকে সবার আগে দেখতে পেলো নিরব। চেয়ার ছেড়ে ওঠে এসে হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপনি বিভোর? রাইট?’
খুশি হবার ভান করে বলল,
‘ জ্বি। কিন্তু আপনি?’
‘ আমি রাতুলের বন্ধু।’
‘ ওহহ। আমাকে চিনলেন কী করে?’
‘ ছবিতে দেখেছি, ইভা আপনার অনেক গল্পও শেয়ার করেছে। তাই চিনতে অসুবিধে হয়নি।’
‘ ওহহ! আপনি ওকে চিনেন?’
বিভোর রুহির দিকে ইশারা করলো। নিরব বলল,
‘ নাহ, পরিচিত হলাম এখুনি। ইভার বোন।’
বিভোর মনে মনে ভাবে দু’মিনিটের দেখায় কেউ কারো সাথে কীভাবে হাসাহাসি করতে পারে। যেন কতোদিনের পরিচয়। রুহিও ওদেরকে দেখছে। বিভোরকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। অতি দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এলো। আসার সময় শাড়িতে পা বেঁধে পড়ে যেতে নিয়েছিলো, সেসময় নিরব এসে রুহিকে ধরলো। সাহায্যের বদৌলতে ধন্যবাদ জানিয়ে রুহি চলে গেলো, নিরবও। বিভোরের ছাদে একা আর ভালো লাগছেনা, তাই নিচে নেমে এলো।
কাজি এলো সাড়ে পাঁচটায়। দেখতে দেখতে ইভার বিয়েও শেষ হয়ে গেলো। মেয়েটা খুব খুশি। বিদায়ের সময় কেঁদে দিলো একদম। রুহি হেসে বললো,
‘ কাঁদছো কেন? তোমার শ্বশুরবাড়ি এখান থেকে পাঁচ মিনিটের পথ!’
‘ কাঁদবো না? তোদের ছেড়ে থাকতে হবে!’
‘ না কাঁদবে না। আমরা তো আছিই। তোমাকে দেখে আসবো প্রতিদিন।’
‘ আম্মুর খেয়াল রাখিস বোন।’
‘ অবশ্যই। সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা।’
‘ নিজের খেয়াল রাখিস।’
‘ তুমিও।’
নাদিরা ইসলাম কাঁদছেন, বিভোরের মা, ইভা এমনকি রুহিও কাঁদছে। কান্নাকাটির শব্দে বিরক্ত হয়ে গেলো বিভোর। এখানে কান্নার কি আছে? মেয়েদের সবকিছুতে কান্না জিনিসটা না থাকলে যেনো ষোলোকলা পূর্ণ হয়না। এতো এতো মানুষের ভিড়ে একদম চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে ডাক্তারবাবু।
ইভাকে বিদায় করে মেহমানরাও একে একে চলে গেলো। কাল বাদে পরশু রিসেপশন। নাদিরা ইসলাম পইপই করে সবাইকে আসতে বলে দিলেন। নাসিমা চৌধুরী বোনের বাসায় ক’দিন কাটাবেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একেবারে একা হয়ে গেছেন নাদিরা। রুহি ছাড়া আর কেউ রইলো না। অবশ্য রুহির বিয়ে হয়ে গেলে কিভাবে থাকবে সেটাও একটা চিন্তার বিষয়।
বিভোর এতোক্ষণে একটা ফাঁকা রুম পেলো। ঘরে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো মাথা চেপে। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গায়ে। চোখ দুটো জ্বালা করছে। এর কারণ, ওই নিরব ছেলেটা যাবার সময় রুহির সাথে কিসব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিলো, আবার ওর সেলফোনের নাম্বারও নিয়েছে। ওরা দুজন কি প্রেম করবে? ভাবতেই রাগে ফেটে পড়লো ওর শরীর। দরজায় টোকা পড়েছে। বিরক্ত হয়ে দরজা খুললো বিভোর। রুহি হাতে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘ আপনার জন্য খাবার নিয়ে এলাম।’
‘ আমিতো খাবার চাইনি।’
‘ আপনার আম্মু পাঠিয়েছে।’
গম্ভীরমুখে প্রশ্ন করলো,
‘ তুমি নিয়ে এলে কেন?’
‘ আপনার আম্মুর কথা ফেলতে পারিনি। ছেলে না খেয়ে আছে তাই পাঠিয়েছে।’
‘ আমি খাবো না।’
‘ সেটা আপনার ব্যাপার। পৌঁছে দেওয়া দায়িত্ব ছিলো, দিয়ে গেলাম।’
‘ তুমি খুব বড় হয়ে গেছো তাইনা?’
‘ সবসময় তো আর ছোট থাকা যায়না। সময়, পরিস্থিতি বড় বানিয়ে দিতে বাধ্য করেছে।’
বিভোর চুপ করে রইলো। মেয়েটা চটাং চটাং কথা বলা শিখেছে। রুহি ট্রে’টা টেবিলে রেখে পুরো ঘরটা ঝেড়েমুছে দিলো। জানালা খুলে দিলো। ফরফর করে উত্তুরে হাওয়ারা ঢুকে পড়লো ঘরে। বিভোর মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে অনেক মায়াবী লাগছে।
‘ রুহি।’
‘ বলুন।’
‘ তুমি কি আমাকে এড়িয়ে চলছো?’
‘ জানিনা।’
বলেই রুহি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বিয়েবাড়িতে অনেক কাজ, সবকিছু শেষ করলো নাদিরা ইসলাম, নাসিমা চৌধুরী আর রুহি। বাড়তি খাবারগুলো আত্মীয়দের বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। কাজ করতে করতে প্রায় দশটা বেজে গেলো। রুহি গোসল করে বারান্দায় গিয়ে বসলো। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত, রাতে খাবার খেতেও ইচ্ছে করেনি। এদিকে পুরো সন্ধ্যাটা বিভোর ঘুমিয়ে কাটিয়েছে, ফ্রেশ ঘুম।
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এলেই দেখতে পায় বিপরীত দিকের বারান্দায় রুহি বসে আছে। বারবার চোখ মুছছে। কাঁদছে নাকি রুহি? কেন? কান্নার মতো কি হলো? বিভোর কি হলো জানেনা, হঠাৎ করেই রুহিকে জোরে ডাক দিলো। হকচকিয়ে উঠলো রুহি।
‘ হেই রক্তজবা, তুমি কি কাঁদছো?’
বিভোরের গলা শুনেই পায়ের রক্ত মাথায় চড়লো রুহির। শান্তিতে বসে কাঁদতেও দেবেনা। ঘরে ঢুকে শব্দ করে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলো। বিভোর ব্যক্কল বনে গেলো।
প্রথম দেখায় বিভোরকে যেমন মনে হয়েছিলো লোকটা আসলে তেমন নয়। অদ্ভুত, মেয়েদের মন বোঝার ক্ষমতা কম। সবসময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে। নিজের জীবন নিয়ে সিরিয়াস নয়। সংক্ষেপে এটাই বিভোর। এর বেশিকিছু ভাবতে পারছেনা রুহি। কিন্তু তাই বলে তো বিয়েটা ছেলেখেলা নয়,রুহি যখন মানতে পেরেছে তখন ওর মানতে সমস্যা কোথায়? একবার তো রুহির ইচ্ছের কথাটা জানতে চাইলো না, নিজের দিকটাই দেখলো। তাহলে রুহি কেন কাঁদবে পাষাণ লোকটার জন্য?
ফোন অন করতেই দেখলো ম্যাসেঞ্জারে কেউ নক করেছে। অপরিচিত আইডি। রুহি ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো এটা ওই রাতুলের বন্ধু নিরব। রুহি রিপ্লাই করতেই সেকেন্ডের মাঝে নিরবের ম্যাসেজ আসলো।
‘ হ্যালো রুহি?’
‘ জি ভাইয়া।’
‘ কি করো?’
‘ কিছুনা। আপনি?’
‘ এইতো তোমার সাথে চ্যাট করছি।’
‘ ওহহ! আপনি আমার আইডি পেলেন কোথায়?’
‘ রাতুলের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি।’
রুহি কিছু লিখলো না। মানেটা কি? যে সে এসে ওর আইডি চাইবে আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস না করে দিয়ে দেবে। মানে কমনসেন্সের অভাব আছে নাকি। এই নিরবটাকে যে কিভাবে সহ্য করছে তা শুধু রুহিই জানে। দেখতে অভদ্র নয়, কিন্তু হাবভাবে বোঝা যায় রুহির প্রতি ইন্টারেস্টেড। কিছু বলতেও পারেনা রুহি। ইভা আর রাতুল দুজনেরই খুব ক্লোজ নিরব। খারাপ ব্যবহার করতে চেয়েও পারছেনা। এমন সময়ই নিরব লিখলো,
‘ তোমাকে আজকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিলো।’
ব্যস। পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো রুহির। সাথে সাথে ফোন বন্ধ করে রেখে দিলো। এই বিভোরটাকে দেখার পর থেকেই রুহি কেমন খিটখিটে মেজাজের হয়ে গিয়েছে। তার উপর আবার এই নিরব উল্লুক যুক্ত হয়েছে। ওদিকে ইশতিয়াকের কি হলো কে জানে, সামনে পেলে এবার উচিৎ শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে।একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো রুহি।
সকালবেলা ডাইনিং টেবিলে ওই ডাক্তার শয়তানটার মুখোমুখি পড়তে হলো রুহির। কি সুন্দর আয়েশ করে কফি খাচ্ছে দেখো। মগের ভেতর চুবিয়ে মারতে ইচ্ছে হচ্ছে। নাদিরা ইসলাম রুহিকে খাবারের প্রতি উদাসীন দেখে বললেন,
‘ তুই খাচ্ছিস না কেন?’
‘ খাই।’
নাদিরা ইসলাম ধমক দিয়ে বললেন,
‘ দিনদিন কি হাল করছিস চেহারার?’
‘ খাচ্ছি তো।’
‘ এদিকওদিক তাকিয়ে কি দেখছিস? খাবারের প্রতি মনোযোগ নেই তোর।’
‘ তা না! আসলে পেট ভরে গিয়েছে।’
নাদিরা আকাশ থেকে পড়ে যাওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলল,
‘ কি বলছিস রুহি? দু’ চামচ খেয়ে তোর পেট ভরেছে। আমাকে বোকা ভাবিস তুই? এক্ষুনি খা, পুরো সব্জিটা শেষ না করলে তোর কি হাল করি দেখিস।’
নাসিমা চৌধুরীও খাওয়ার জন্য রুহিকে জোড়াজুড়ি করলো। বাধ্য হয়ে খাচ্ছে রুহি, মুখে অসহায় ভঙ্গি। দৃষ্টি এড়ালো না বিভোরের।
বাবর খান পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিতে দিতে রুহিকে বললেন,
‘ জানো মা, খাবার হলো দুনিয়ার সবকিছু। খেলে লাভ, না খেলে লস। যতো পারো খেয়ে মোটাতাজা হও। যা সামনে পাবে গপগপিয়ে খাবে।’
বিভোর বাবার এসব কথায় প্রচন্ড বিরক্ত হয়। বলল,
‘ খাবার পরিমিত খেতে হয় বুঝলে আব্বু। অবশ্য তোমাকে বলে কি লাভ? দিনে এক হাঁড়ি মিষ্টি আর কষা মাংস ছাড়া তোমার পেট তো চলেই না।’
খোঁটা খেয়ে বাবর চৌধুরী রেগে গেলেন। বললেন,
‘ তোর সংসারে আমি হয়েছি নাকি আমার সংসারে তুই? বাপের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটাই জানিস না আবার ডাক্তারগিরি ফলাতে আসছিস। বেয়াদব, এক থাপ্পড়ে তোর দাঁত ফালিয়ে গরুর খাদ্য বানাবো। অসভ্য!’
বিভোর রুহির দিকে তাকিয়ে দেখলো মিটিমিটি হাসছে। মানসম্মানের চৌদ্দটা বাজাতে এক্সপার্ট বাবর চৌধুরী। জোর গলায় বলল,
‘ পরিশেষে এই ডাক্তারের কাছেই তো আসতে হয়। পেটব্যথা, হাই প্রেসার সব নিয়েই তো আসো।’
‘ জানি জানি। গরুর ডাক্তারও তোর থেকে ভালো চিকিৎসা করাতে পারে। ইডিয়ট। তোর মতো চামচিকা আমার পুত্র আমি ভাবতেও পারিনা। কই বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করবি, আমরা নাতিপুতির সাথে খেলবো তা না, গরুগিরি ফলাতে আসে।’
মুখচোখ লাল হয়ে গেলো বিভোরের। নাদিরা, নাসিমা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন। রুহিও মুখ টিপে হাসছে। রাগ করে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো বিভোর। পেটে ক্ষিধে নিয়েই হসপিটালে রওয়ানা হলো। নাসিমা চৌধুরী অনেক করে বুঝালেন, ডাকলেন তাও খেলো না। সবার মুখ কালো হয়ে গেলো। বাবর চৌধুরী বললেন,
‘ যেতে দাও। খাবার না খেয়ে থাকতে পারে নাকি, ঠিকই আসবে।’
আজকে একটু গঠনমূলক মন্তব্য জানাবেন? অনেকটা অগোছালো হয়ে গিয়েছে গল্পটা!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!