আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-১৫,১৬
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-১৫
রুহি অবাক হয়ে গেলো। ওদের বাসায় কেন নিয়ে এসেছে? এখানে রুহির কী কাজ? তাছাড়া বিভোরের মা-বাবা সবাই তো ইভার ওখানে। তাহলে খালি বাসায় কেন নিয়ে এলো ওকে? বিভোরের মতলব ভালো ঠেকছেনা রুহির। বিভোর বলল,
‘ নামো গাড়ি থেকে।’
‘ নামবো না। আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন।’
বিভোর ধমক দিয়ে বলল,
‘ নামতে বলছি নামো।’
রুহি থম মেরে বসে রইলো। কিছুতেই নামবেনা ও। বিভোর রেগে গেলো। দরজা খুলে টেনে বের করলো গাড়ি থেকে। তারপর হাত ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলো। দারোয়ানকে গাড়ির চাবি দিয়ে বলল গাড়িটা পার্ক করে দিতে।
রুহি বলল,
‘ পার্ক করবে কেন? আমি বাসায় যাবো কখন?’
মুচকি হেসে বিভোর বলল,
‘ যাবেনা।’
‘ যাবোনা মানে?’
বিভোর গম্ভীরমুখে উত্তর দিলো,
‘ তোমার বর কী ভিক্ষুক? তার কী বাড়িঘর নেই?’
‘ জানিনা।’
‘ শুনো তোমার বর যথেষ্ট এস্টাবলিষ্ট। ওর যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে নিজের বউয়ের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। তাহলে তুমি কেন আরেকজনের বাড়িতে থাকবে?’
রুহিকে কোনোকিছু বলার অবকাশ না দিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাসার ভেতরে ঢুকলো। রুহিকে ছেড়ে দরজা বন্ধ করে ওকে বসতে বললো। ডাক্তারের হিংস্র চাহনি দেখে রুহি ভয় পেয়ে বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লো। ওর সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিভোর ঘরে গেলো ফ্রেশ হতে। ওদিকে রুহি অবাকের পর অবাক হচ্ছে। ডাক্তার বউয়ের দায়িত্ব নিতে চাইছে? সত্যিই নাকি ছলনা? বিভোর তো সবসময় ভনিতা করতে পছন্দ করে। এই পাঁচদিনে রুহি লোকটাকে মোটামুটি বুঝতে পেরে গিয়েছে। এমন তো আবার নয় যে, এখন দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলে পরে রুহিকে আবার ছেড়ে দিলো? শুধু স্বপ্ন দেখাচ্ছে? হতেই পারে। কিছু কিছু পুরুষ স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসে, তবে পূরণ করতে নয়। কে জানে বিভোর কেমন!
ফ্রেশ হয়ে আসতে বিভোর বেশ সময় নিলো। ঘড়ির কাটা দশের ঘরে। নিঝুম রাত। পাতার শনশন শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঝড় হবে বোধহয়। বিভোর মাকে ফোন করলো। নাসিমা রেগে আগুন হয়ে আছে। রুহি কোথায়, ওরা কোথায়, কী করছে, কী খেয়েছে, কখন বাসায় ফিরবে এসব প্রশ্ন করতে লাগলো। বিভোর শুধু বলল,
‘ আজ ফিরতে পারবোনা। মেয়েটা ঠিকই আছে। চিন্তা করোনা।’
‘ ফিরতে পারবিনা মানে কী?’
‘ মানেটা পরে বুঝিয়ে বলবো। আই হোপ তোমরা বুঝতে পারবে।’
‘ তোর মাথায় যে কী চলে, বুঝিনা।’
‘ তোমরা বাসায় চলে গিয়েছো?’
‘ হ্যাঁ। ওদেরকে নিয়ে এসেছি।’
‘ ভালোই হলো।’
‘ এই, তোরা কী ও-বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছিস?’
‘ সময় পাইনি।’
‘ তাহলে খাবি কী? আছিস কোথায় সেটাতো বল।’
‘ খাওয়া নিয়ে চিন্তা করোনা। পরে সব বলবো!’
‘ আচ্ছা।’
বিভোর আরও টুকটাক কথা বলে ফোন রেখে দিলো। খাওয়া নিয়ে সমস্যা নেই, রুহিকে দিয়ে রাঁধিয়ে নিবে। আবার এটাও ভাবলো, ওর বউ কেন রাঁধবে? ওর কী হাত-পা নেই? ওর বউ থাকবে রাজরানির মতো। শুধু বিভোরকে ভালোবাসলে, ওর পরিবারকে ভালোবাসলেই হবে। খুব সাধারণ একটা জীবন, কিন্তু চমৎকার হতে হবে। তাছাড়া বিভোর নিজেও রাঁধতে পারে। একেবারে অখাদ্য যে হয়, তা নয়।
বিভোর ড্রইংরুমে এসে দেখলো রুহি ঘুমাচ্ছে। বোধহয় হঠাৎ চোখ লেগে গিয়েছে। ওর ওড়না এলোমেলো হয়ে আছে। বিভোর দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। ভাবলো ডাকবে কিনা! পরে নিজেই মনে মনে বলল,
‘ রক্তজবা তো আমারই বউ। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?’
বিভোর নিজেই রুহির ওড়না ঠিক করে ওকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিলো। বাইরে বাতাস আছে বিধায় জানালাটা ফাঁক করে দিলো। জানালার ওপাশে আছে বিরাটাকার হিজল গাছ। গাছটাতে ফুটে আছে লালচে ফুল। রাতেরবেলা দেখতে অদ্ভুত লাগে। বিভোর চলে গেলো রান্নাঘরে। ফ্রিজ থেকে ডিম নিলো, মুরগীর মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখলো। ডাল রাঁধবে কিনা ভাবলো, যদিও এটা রাঁধতে পারে না। রুহি আজ প্রথম ওর রান্না খাবে, ভালো মতোই করতে হবে সবকিছু। বিভোর একবার ইউটিউবে সবকিছু দেখে নিলো। চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে রান্নায় মনোযোগ দিলো।
ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটায়। তখনই টিকটিক করে ঘড়িটা শব্দ করতে লাগলো। ঘুম ভেঙে গেলো রুহির। কোথায় আছে প্রথমে বুঝতে পারলো না। ঘোর নিয়েই পিটপিট করে চারপাশে চোখ বুলালো। বিভোরের বাসায় আছে, হুম। রুহি ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় ঠেস দিয়ে বসলো। ঘুমের মাঝখানে বাঁধা পড়লে সারারাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হয় রুহির। তার উপর আজ জায়গা বদল হয়েছে। কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছেনা। তবে এটা নিশ্চিত আজ ওকে এখানেই থাকতে হবে। কিন্তু লোকটা কই?
খালি বাসায় কেমন গা ছমছম করছে ওর। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। পা টিপে টিপে রুহি সেদিকে গেলো। বিভোর রান্না করছে। এখন সে পেঁয়াজ কাটায় ব্যস্ত। রুহিকে দেখতে পেয়ে মিষ্টি করে হাসলো। বলল,
‘ ঘুম ভেঙেছে মহারানির?’
‘ দেখতেই তো পাচ্ছেন। আর আমি কোনো মহারানি নই, আমিতো দাসী।’
‘ কে বলেছে এই কথা?’
রুহি একটা হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ সবাই পদে পদে বুঝিয়ে দেয়।’
বিভোর ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
‘ যেমন?’
‘ সত্যিই শুনতে চাইছেন?’
‘ ডেফিনেটলি!’
‘ আমার কথা শোনার সময় আপনার আছে নাকি!’
বিভোর মুখ টিপে হাসলো। পেঁয়াজ কাটায় আবারও মনোযোগ দিয়ে বলল,
‘ বলেই দেখোনা, শুনি কিনা।’
রুহি ইতস্তত করে বলল,
‘ এই যেমন আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, সেটাও ভেঙ্গে যাবে। সেদিন ইশতিয়াক ভাই সুযোগ নিতে চাইলো। ইভা আপুর বন্ধু নিরব সাহেবও সেই লিস্টে আছে। যদিও ওনি খারাপ মানুষ নন, ফ্রি মাইন্ডের। কিন্তু তাও, সবাই আমাকে দয়াই করে।’
বিভোর নিরবের কথা শুনে রেগে গেলো। হাতের ছুড়িটা দিয়ে শক্ত করে টেবিলের উপর আঘাত করলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ বিশ্রি ঘটনাটা ভুলে যাও, দ্যান ওই নিরবের কথা আমার সামনে কখনো তুলবেনা। গট ইট!’
‘ কেন?’
‘ লোকটাকে আমার সহ্য হয়না।’
‘ কিন্তু আমি তো আর আপনার মতো নই।’
বিভোর রেগে গেলো। বলল,
‘ তুমি কী মিন করতে চাইছো?’
‘ ওনি সবার চেয়ে আলাদা। ফ্রি মাইন্ডেড!’
বিভোর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
‘ হি ইজ আ বাস্টার্ড।’
‘ আপনার ভাষা ঠিক করুন। এগুলো আপনার সাথে যায়না!’
‘ তুমিও তাহলে এর কথা বলবেনা।’
‘ সেটা আমার ব্যাপার।’
‘ নেভার। আমার সাথেও জড়িয়ে আছে কজ ইউ আর মাই ওয়াইফ!’
রুহি অস্বস্তিবোধ করলো। চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আছে। হাতমুখ ধুতে পারলে ভালো হতো। বিভোরের প্রত্যেকটি কথায় কেমন আজব আজব। বুঝতে পারেনা রুহি। কোনো কথার মর্মার্থ উদ্ধার করা সম্ভব নয়। এতোই যদি বউ হিসেবে মানে তাহলে সমাজের কাছে পরিচয় দিতে চায়না কেন? ছাড়তে চায় কেন? জিজ্ঞেস করবে নাকি ডাক্তারকে?
রুহিকে অন্যমনস্ক দেখে বিভোর হালকা কাশি দিয়ে বলল,
‘ কিছু বলবেন মনে হচ্ছে বিবি সাহেবা?’
‘ আপনি রান্না করছেন?’
‘ জি বিবি সাহেবা।’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘ কে বিবি সাহেবা? আমি কারো বিবি নই।’
‘ সেটা তোমাকে বলতে হবেন। যাও টেবিলে , খাবার নিয়ে আসছি।’
‘ আমি খাবোনা!’
বিভোর রেগে বলল,
‘ বললেই হলো? আমি এতো কষ্ট করে রাঁধলাম আপনার জন্য, আর আপনি এতো সহজে না করে দিলেন? বরের কথা না শুনলে কী হয় জানো তো? যাও বলছি এক্ষুণি।’
রুহি আমতা-আমতা করে বলল,
‘ আপনাদের ওয়াশরুমটা কোথায়?’
‘ বলো আমাদের!’
‘ যা-ই হোক, কোথায়?’
‘ ড্রয়িংরুমের টাতে একটা সমস্যা আছে, তুমি বাঁ দিকে গিয়ে ডান পাশের করিডোর ধরে এগিয়ে যাও। দ্যান আমার ঘর পাবে, ওখানে ওয়াশরুমটা ফাঁকা আছে।’
রুহির মাথা চক্কর মারলো। এতো প্যাঁচালো কথাবার্তা কেন বলে বিভোর! তা-ও ধীরেধীরে সেদিকে গেলো। বিভোরের ঘরটা অতি সহজেই চিনতে পারলো রুহি। ওর হাসিমুখে তোলা অনেক ফটো দেয়ালের ফ্রেমে ঝুলানো। সারা ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাপড়-চোপড়। খাতা-পত্র, বই, ফাইল সবকিছু এদিকওদিক পড়ে আছে। রুহি ওয়াশরুমে গেলো। বিশাল বড় ওয়াশরুম। বাথটাবও আছে, বড়লোকের বিরাট কারবার। রুহি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তারপর যেইনা বেরুতে যাবে তখনোই সাবানের ফেনায় পা পিছলিয়ে পড়ে গেলো। কোমড়ে ব্যথা পেয়ে চিল্লিয়ে উঠলো। ডাইনিংয়ে খাবার সাজাচ্ছিলো বিভোর। রুহির চিল্লানি শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো। ভেতর থেকে দরজা খোলাই ছিলো, ও ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো রুহি পা পিছলে পড়ে গিয়েছে। বিভোর ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করলো, কিন্তু রুহি দাঁড়াতেই পারলো না। বাধ্য হয়ে রুহিকে একপ্রকার কোলে তুলে রুমে নিয়ে এলো বিভোর। রুহি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আপনি এতো অলস? ফ্লোরে সাবানের ফেনা ফেলেছেন সেটা ধুলেননা কেন? নোংরা লোক একটা!’
বিভোর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো রুহির দিকে।
মন্তব্য জানাবেন আশা করি। আপনারা অপেক্ষা করবেন বিধায় মাঝারি করে হলেও দিয়েছি। রোজা তো, সেজন্য এরকম হচ্ছে।
ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৬
ঝড়ো হাওয়া বইছে। বাতাসের দাপুটে শক্তির কাছে হার মেনে ধুলোবালি উড়ুউড়ি করছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন শহর। মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে। কাঁঠাল গাছের কয়েকটা পাতা জানালা দিয়ে উড়ে এসে বিভোরের ঘরের মেঝেতে পড়েছে। রুহি চুপচাপ বসে ডাক্তারের কর্মকাণ্ড দেখছে। এই মুহূর্তে বিভোর নিজেকে গোছালো প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সোফার কুশন তুলে রেখেছে, খাতাপত্র, ফাইল ডেস্কে রেখেছে। অতিরিক্ত বালিশগুলো ওয়ারড্রোবে ঢুকিয়েছে। ধোয়ার জন্য কাপড়গুলো বাস্কেটে রেখেছে। সবকিছু গুছিয়ে ঘরটা ভালো করে ঝাড়ু দিয়ে ফ্লোরটাকে মুছেছে। অতঃপর ওয়াশরুমের ফ্লোরের সাবানের ফেনা ধুয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় এসে বসলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ এবার বুঝলে, আমি নিজের কাজ নিজেই করতে পারি।’
রুহি কিছু বললো না। বিভোর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে বলল,
‘ খাবে চলো।’
‘ একবার বললাম না খাবোনা আমি!’
বিভোর চোখগুলো ছোট ছোট করে রুহির দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ওর হাতটা নিজের কোলে টেনে নিলো। তারপর পার্লস রেট চেক করলো, চোখগুলো টেনে টেনে দেখলো। তারপর কিছু হাবিজাবি প্রশ্ন করলো। রুহি অবাক হয়ে বললো,
‘ এসব আপনি কী করছেন?’
‘ তোমাকে চেক করছি।’
‘ চেক করার কী আছে?’
‘ তোমার না জানলেও চলবে।’
রুহি বলল,
‘ এতো ডাক্তারি দেখাবেন না, ওকে? আপনি যে একজন ডাক্তার সেটা মিনিটে মিনিটে প্রুফ করার দরকার নেই।’
বিভোর রেগে গিয়ে বলল,
‘ তোমার ফালতু কথাবার্তা বন্ধ করো।’
‘হুহ!’
বিভোর রুহির হাতটাতে মুচড়ে ধরে বলল,
‘ কী খাও তুমি? কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছে তোমাকে। হাড্ডি ভেসে উঠেছে। শরীরে তো একদম পুষ্টি নেই, তার উপর বড়বড় বুলি ফুটছে মুখ দিয়ে। এই, তোমার ওজন কতো?’
বিভোরের ধমক শুনে রুহি গড়গড় করে বলল,
‘ ৪৫।’
বিভোর চোখ বড়বড় করে বলল,
‘ হোয়াটটট?’
‘ অবাক হওয়ার মতো কিছু তো হয়নি!’
‘ শুনো একদম বড়দের মতো কথা বলবেনা। তোমার জন্মের পাঁচ বছর আগে আমার জন্ম হয়েছে। মুখে মুখে তর্ক করা একদম সাজেনা তোমার। একদম মুখ বন্ধ করে থাকো।’
‘ আমিতো তর্ক করিনি।’
‘ আবার কথা বলছো? এতো বেয়াদব কবে থেকে হলে তুমি? দেখতে তো আলাভোলা মনে হয়।’
‘ আপনাকে দেখেও তো মনে হয় দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মানুষ আপনি।’
‘ কোনো ডাউট আছে?’
‘ জি। আপনি উপরে যেরকম সুন্দর দেখতে, ভেতর দিয়ে ততোটাই বিশ্রি।’
বিভোর রুহির মুখে নিজের সম্বন্ধে নিন্দা শুনে প্রচন্ড রাগলো। কী এমন করেছে ও!
‘ শুনো, তুমি বেশি কথা বলবেনা।’
‘ অবশ্যই বলবো। আপনি আমার কে যে আপনার কথা শুনবো? কিছু হন নাকি আপনি!’
রুহির কথায় স্পষ্ট অভিমান, অভিযোগ, রাগ ছিলো। যে কেউ তা টের পাবে। বিভোর বুঝতে পেরে আড়ালে মুখ টিপে হাসলো। তারপর উঠে অন্যপাশ দিয়ে ঘুরে একদম রুহির কাছে গিয়ে বসলো। সামনাসামনি বসে রুহির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এবার রুহিকে অস্বস্তি ঘিরে ধরলো। মানুষটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? যেন ধারালো কোনো সূঁচ। রুহি কেন বিভোরের চোখের ভাষা বুঝতে পারছেনা? এতো কঠিন কেন ওই চোখের ভাষা? রুহি মাথা নিচু করে ফেললো। ওর চোখগুলো ভিজে উঠেছে। ওড়নার কোণা দিয়ে মুছে নিলো। রুহিকে আচমকা অবাক করে দিয়ে বিভোর ওকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রুহির মাথা বিভোরের উন্মুক্ত বুকের উপর সীমাবদ্ধ। ডাক্তারের হার্টবিটের জোরালো শব্দ রুহির কানে বাজছিলো। এই জড়িয়ে ধরাতে যেন কোনো গভীর অনুভূতি লুকোনো ছিলো। বিভোর রুহির কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালো। রুহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বিভোরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো রুহি। আর যদি সুযোগ না আসে!
বিভোর ওর কপালে নাক ঘষে নরম গলায় বলল,
‘ এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে!’
আরও কিছু বলতে যাবার আগেই চুপ করে গেলো। মহারানি এখন কাঁদছে। বিরক্ত না করাই শ্রেয়। কাঁদুক, অভিমান না কমলেও কষ্ট তো কমবে। বিভোর হাসলো শুধু। যতোটা লুকোতে চায় মেয়েটা তারও বেশি ধরা পড়ে যায়। সবকিছু বুঝেও বিভোরের কিছুই বুঝেনা মেয়েটা। একপর্যায়ে রুহির হাত আলগা হয়ে এলো। ঝট করে উঠে বসলো। এতোক্ষণ কী করছিলো মাথায় আসতেই নিজের উপর রাগ হলো। এত শক্ত থাকার পরেও মানুষটার বুকে একটু আশ্রয় পেয়ে গলে আইসক্রিম হয়ে গেলো! ভালোবাসার কাঙাল বোধহয় একেই বলে।
ওকে এই অস্বস্তি থেকে সহজ করার জন্য বিভোর বলল,
‘ খেতে চলো। ব্যথা কমেছে? যেতে পারবে?’
রুহি মাথা নাড়িয়ে না করলো। পিঠে চিনচিনে ব্যথা করছে। বিভোর বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। কিছুক্ষণ পর হাতে করে সব খাবার-দাবার নিয়ে এলো। সবকিছু টি-টেবিলের ওপর রেখে একটা প্লেটে খাবার তুলে নিলো। সেটাকে মাখিয়ে এক লোকমা ভাত তুলে ধরলো রুহির সামনে। রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘ কী করছেন?’
‘ বেশি কথা না বলে খাও। নইলে এখন তোমার হাতে আমি খাবো।’
‘ না না, খাচ্ছি আমি।’
বিভোরের হাতে খেতে গিয়ে রুহি দেখলো এই ডাক্তার ওকে লজ্জ্বায় ফেলার সকল ট্রিকস ট্রাই করছে। খাবার মুখের সামনে ধরে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে, আবার দাঁত কেলিয়ে হাসছে। বলছে,
‘ তোমার যে মুরগী খাবার প্রতি এতো শখ বললেই হতো। আমি সব মুরগী ভেজে দিতাম। শুধু শুধু মাছ-ডাল রান্না করালে।’
‘ আমি কোথায় মুরগী খাচ্ছি, আপনিই তো দিচ্ছেন।’
‘ ছিঃ। মোরগ জাতির প্রতি সমবেদনা রইলো। ওদের সাথে দেখা হলে মুখ দেখানোর জো থাকবেনা।’
রুহি বলল,
‘ কেন?’
‘ মোরগের বউকে তুলে নিয়ে এসেছি না তোমার জন্য, তাকেই কষা করে তোমাকে খাওয়াচ্ছি। সে ব্যাটা আমাকে দেখলেই তো জিজ্ঞেস করবে বেচারার বউ কোথায়। তখন আমি কী বলবো, কীভাবে মুখ দেখাবো ভাবতে পারছো!’
রুহি হেসে ফেললো। তারপর খাওয়াদাওয়া শেষ করলো। বিভোর সবকিছু ধুয়েমুছে সেলফে রেখে দিলো। গুছানোর কাজ শেষ করে নিজের ঘরে গেলো। রুহি আগের মতোই বসে আছে। ওকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আমি ঘুমাবো কোথায়?’
বিভোর বলল,
‘ এখানে।’
রুহি চোখ বড়বড় করে বলল,
‘ এখানে মানে? এটাতো আপনার ঘর। আমি এখানে থাকবো না।’
‘ রিল্যাক্স হও। আমরা দুজনেই এখানে থাকবো।’
রুহি বলল,
‘ কখনোই না।’
‘ শুনো, এটাতে অবাক হওয়ার কিছুই হয়নি। ইট’স নরমাল কজ আমরা দুজনেই জানি আমাদের মধ্যে সম্পর্ক কী।’
রুহি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
‘ জানলেই হয়না, মানতেও হয়। আপনি তো কিছু মানেনই না। আমাকে অন্য একটা ঘর ঠিক করে দিন। আমি কিছুতেই আপনার সঙ্গে থাকবোনা।’
রুহিকে রেগে যেতে দেখে বিভোর বলল,
‘ওকে ওকে। পাশের ঘরটাতে থাকতে পারো। তুমি কী ভাবছো আমি সুযোগ নেবো? কখনোই না। আমি এতোটাও খারাপ নয়।’
রুহি কিছু বললো না। রাত প্রায় সাড়ে বারোটার উপরে। রুহির ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে নিরবের নাম। রুহি কেটে দিলো। আবার ফোন দিলো নিরব। বিভোর সবটাই দেখেছে, তাকিয়ে দেখছে নিরবের কর্মকান্ড। রাগে গা কেঁপে উঠলো। এ তো আস্ত বেয়াদব। এতো রাতে একটা মেয়েকে কীভাবে কেউ ফোন দিতে পারে? মিনিমাম সেন্স নেই নাকি। তার উপর বিভোর ওকে সহ্য করতে পারেনা। ওদিকে চারবার কল কাটার পরেও যখন নিরব ফোন দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে বাধ্য হয়ে রুহি ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে নিরব হাসিমুখে বলল,
‘ কী করো রুহি?’
দাঁতে দাঁত চেপে রুহি বলল,
‘ কিছুনা। ঘুমাবো।’
‘ ওহহ। আচ্ছা তুমি তখন বিভোরের সাথে কোথায় গেলে?’
রুহি মনে মনে বলল তোকে বলবো কেন? কিন্তু উত্তর দিলো,
‘ কাজ ছিলো ওনার সাথে।’
নিরব আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
‘ কিন্তু এভাবে কেউ কারো হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নাকি? জানো, এটা দেখে কিন্তু আমি রেগে গিয়েছি। মনে হচ্ছিলো তোমার ওপর কত জনমের অধিকার আছে বিভোরের। পরবর্তীতে কাউকে নিজের হাত ধরতে দেবেনা।’
রুহি ওর কথায় বিরক্ত হয়ে গেলো। কত বড় সাহস! বিভোরকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে। রুহি ঠিক করলো ভদ্রভাবে কথা বলে ফোনটা রেখে দিয়ে ওকে ব্লক করে দিবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রুহি হেসে বলল,
‘ ঘুমাবো এখন। রাখি!’
নিরব বলল,
‘ এখনই না। চলো আজ ফোনে ফোনে গল্প করে রাত কাটিয়ে দিই। দুজ…!’
এরপর আর কোনো কথা শোনা গেলোনা। রুহির হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বিভোর ফ্লোরে আছাড় দিলো। দু’ টুকরো হয়ে গেলো ফোন। বিভোর রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে বলল,
‘ এতদূর? ওই বাস্টার্ডের সাথে তুমি সারারাত গল্প করবে? সেজন্যই আমার সাথে থাকতে চাচ্ছোনা? তুমি এতো আস্কারা দিয়েছো একে! ওকে, তুমি অন্যঘরে থাকতে চেয়েছিলে তাইতো? কিন্তু আমি এখন তোমাকে কোথাও যেতে দিচ্ছিনা। এখানেই, এই ঘরে, আমার সাথে এক বিছানায় থাকবে।’
রুহিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো বিভোর। রুহি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ ছাড়ুন আমাকে।’
‘ নড়াচড়া করলে কিন্তু কিছু একটা করে ফেলবো৷ তারপর আমার দোষ দিতে পারবেনা।’
রুহি আর নড়লো না। কেঁদে দিলো। বিভোর ধমকে উঠতেই আবার চুপ করে গেলো।
বিভোর শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ একটা গল্প শুনবে?’
রুহি ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,
‘ কার গল্প?’
‘ শুনলেই বুঝবে৷ এই গল্প তো তুমি জানো। গল্পটা একটা বিশাল অঙ্কের মতো। আমার কষতে বারণ আছে। তুমি এটা কষে ফল বের করবে।’
বিভোরের কথায় কিছুই বোঝা গেলোনা প্রায়। রুহি চুপ করে রইলো। ঝড়ো বাতাস এবার ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে। মাঝেমধ্যে বাজ পড়ার শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যেই বিভোর রুহির চুলে হাত বুলাতে বুলাতে গল্প বলা শুরু করলো।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!