আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-২০,২১

0
1849

আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-২০,২১
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-২০

রাতটা এভাবেই কেটে গেলো। সকালবেলা কড়া রোদের আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকছিলো। রুহির চোখে সে আলো লাগতেই ধরফড়িয়ে উঠে বসলো। তাকিয়ে দেখলো ওর কোলে বিভোরের মাথা হলেও পা দুটো চিৎপটাং অবস্থায় এদিক-ওদিক রাখা।মনে হচ্ছে কোনো সঙ বুঝি সার্কাস দেখাচ্ছে। রুহি হাসি চাপাতে পারছিলোনা। বিভোরের মাথাটা ডিভানে রেখে অতি সাবধানে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ঠিক করে শুইয়ে দিলো। মনে হচ্ছে ড্রিংকসের প্রভাব এখনো কাটেনি। রুহি ওয়াশরুম খুঁজে ফ্রেশ হয়ে নিলো। পেটে ক্ষিধেয় ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। আশ্চর্য, কোনোদিন তো এতো ক্ষিধে পায়নি। কিন্তু এখন খাবেটা কী?

রান্নাঘর খুঁজতে খুঁজতে দেখলো করিডোরের ওপাশে ছোট্ট একটা রান্নাঘর আছে। ফ্রিজ খুলে দেখলো তাতে কয়েকটা ডিম, আলু, বেগুন মশলাপাতি পড়ে আছে। রুহি সেগুলো নামিয়ে নিলো। চা’য়ের পাতাও পেলো একটা বক্সে। তড়িঘড়ি করে চুলাতে আগুন দিয়ে চা বসালো। অন্য একটা কড়াইয়ে ডিম ভাজলো। কিন্তু ভাত? কোথায় পাবে চাল! রান্নাঘর যেহেতু কোথাও না কোথাও চাল তো পাওয়া যাবে ভেবে রুহি খুঁজাখুঁজি করে চালও পেয়ে গেলো। তারপর মনোযোগ দিয়ে ভাত রান্না করে, ডিম আর বেগুন ভাজা রেডি করে ডাইনিংয়ে নিয়ে রাখলো। বিভোরকে কীভাবে চমকানো যায় ভেবে একটা বুদ্ধি আঁটলো।

চা-নাস্তা নিয়ে রুহি বিভোরের রুমে ঢুকলো। ইতস্তত করে আস্তে করে ডাকলো,

‘শুনছেন?’

বিভোর ঘুমে মগ্ন। কপাল ঘেমে আছে। রুহি আলতো করে ওড়ানার কোণা দিয়ে মুছে দিয়ে আবারও ডাকল্প,

‘ডাক্তারবাবু, আহা উঠুন না। আর কত ঘুমাবেন? এবার তো একটু ক্ষান্ত হোন।’

ঘুমের মধ্যেই মেয়েলি গলার বকবক শুনে বিভোর চোখ খুলে তাকালো। ঘোলাটে দৃষ্টি গিয়ে আটকালো টকটকে লাল গালের অধিকারীনির চোখে। রক্তজবা! সে ডাকছিলো নাকি এতোক্ষণ? বিভোর ধীরে ধীরে উঠে বসলো। ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘ডাকছিলে?’

রুহি বিরস মুখে বলল,

‘হুম। নেশা করে যেভাবে ঘুমিয়েছেন, না ডাকলে বোধহয় আজ সারাদিন ঘুমিয়েই কাটাতেন।’

‘চুপ।’

‘আচ্ছা। চা-টা খেয়ে নিন।’

বিভোর অবাক হয়ে বলল,

‘তুমি বানিয়েছো?’

‘হ্যাঁ! অবাক হওয়ার কী আছে?’

‘না এমনিই।’

বিভোর চায়ের কাপে চুমুক দিলো। মাথা ভার হয়ে আছে, গা ম্যাজম্যাজ করছে। রুহি বলল,

‘ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি রান্না করেছি। একসাথে খাবো।’

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রুহির আচরণগুলো অস্বাভাবিক। রাতের বেশিরভাগ কথাই বিভোরের মনে নেই। চিন্তিতমুখে চা খেয়ে বিভোর ডাইনিংয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো তার রক্তজবা থালাবাসন রেডি করছে। বিভোর মুচকি হাসলো। তারপর চুপচাপ ফ্রেশ হতে গেলো। রুহি কী ওকে আর মেনেই নিবেনা? অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবে? বিভোরের ভালোবাসা বুঝবেনা! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। ভালোবাসা বোধহয় অসংখ্য উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসের সমন্বয়ে আবিষ্কৃত একটা ধোঁয়াশা।

খাবার টেবিলে বিভোর আবারও চমকিত হলো। কারণ রুহি নিজ হাতে ওকে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। এতো স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গি রুহির, যে বিভোরের মনে হচ্ছে দুজনে অনেক পুরোনো সংসারী। কিন্তু তা নয়। একপর্যায়ে বিভোরের হিঁচকি উঠে গেলো। রুহি তড়িঘড়ি করে পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘এতো কী ভাবেন খাওয়ার সময়?’

‘কিছুনা।’

‘মিথ্যে বলার প্রয়োজন নেই। আপনার চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে আপনি চিন্তিত!’

বিভোর কিছু বললোনা। পরবর্তী লোকমা তুলে দিলো রুহি ওর মুখে। তারপর দেখতে লাগলো স্বামী নামক এই মানুষটাকে। তাঁর অল্প বয়সের আবেগ, প্রেম, ভালোবাসা সবকিছু ঘিরে আছে এই লোকটাকে ঘিরে। ভালোবাসা কী সেটা যখন বুঝতে শিখেছিলো তখন থেকেই এই মানুষটা ওর হৃদয়ের সমস্ত জায়গাটা দখল করে আছে। আজ পর্যন্ত কোনো নড়চড় হয়নি।

রুহিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিভোর থতমত খেয়ে বলল,

‘আমি কী দেখতে বেশি সুন্দর?’

ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে রুহি ব্যস্তভঙ্গিতে বলল,

‘সেটা বলার আর অপেক্ষা রাখেনা।’

‘তুমিও সুন্দর।’

‘জানি। তবে আমি ছ্যাছড়া নই।’

‘যেমন?’

‘আপনি জান্নাহ নামক মহিলার প্রেমে পড়েছেন, যেটা আমি করিনি কোনো পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে!’

বিভোর গম্ভীর গলায় বলল,

‘এই টপিক বাদ দাও। আমার মাথা ধরে যায়।’

‘আচ্ছা। খেয়ে নিন।’

‘তুমি খেয়েছো?’

‘জ্বি।’

বিভোর প্রশ্ন করলো,

‘রক্তজবা তুমি জানো, তোমার বিয়ের কথাবার্তা কার সাথে চলছে।’

এমন প্রশ্ন শোনার জন্য রুহি প্রস্তুত ছিলোনা। অবাক হয়ে বলল,

‘না তো।’

‘নিরবের সাথে।’

রুহির মুখটা ”হা” হয়ে গেলো।

‘নিরব মানে? নিরব ভাই? ইভা আপুদের ফ্রেন্ড?’

‘হুম।’

রুহি ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। বলল,

‘ওনার কী খেয়েদেয়ে কাজ নেই? আমি তো ওনাকে বড় ভাইয়ের মতো দেখি।’

‘সে দেখেনা। এটা আমি প্রথম দেখেই বুঝেছি।’

‘ছাই বুঝেছেন।’

বিভোর গম্ভীর গলায় বলল,

‘এখন কী করবে?’

‘রিফিউজ।’

বিভোরের মনটা কেমন যেন নেচে উঠলো। ওকে আরও একদফা অবাক করে দিয়ে রুহি বলল,

‘আপনি ওনাকে জানিয়ে দিয়েন আমি আপনার বউ। তাহলে আর সামনে এগুবেনা। বউকে বাঁচাতে এই কাজটা তো করতেই পারেন। তাইনা?’

বিভোরের চোখজোড়া যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দুইগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেলো। রুহি আজ ওকে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করে ছাড়াবে। মেয়েটা এতো রহস্য করছে কেন? কাল রাতেই বলল নিজেকে বিভোরের বউ ভাবতে চায়না, লজ্জ্বা হয়৷ আর আজ হুট করেই নিজেকে ওর বউয়ের পরিচয় দিয়ে দিলো। মেয়েটার কী কোনো মানসিক সমস্যা আছে নাকি? এতো তাড়াতাড়ি একটা মানুষ পরিবর্তন হয়ে যায় নাকি! দেখো আবার কীভাবে হাসছে। আহা, মেয়েটা মনে হচ্ছে এবার ওকে সত্যিই হার্ট অ্যাটাক করিয়ে মেরে ফেলবে। বিভোর বুকের বাঁ-পাশে হাত রেখে রুহির দিকে তাকালো। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,

‘সত্যি? এটাই বলবো?’

‘অফকোর্স।’

______

রুহি অসময়ে বাসায় ফেরায় নাদিরা একটু অবাকই হলেন। রুহি মাঝেমাঝেই তার অফিস মেয়ে কলিগ বা ফ্রেন্ডদের বাসায় রাত কাটায়। এই নিয়ে প্রশ্ন করাটা নাদিরা পছন্দ করেন না। কিন্তু বেলা বারোটায় রুহি অফিসেই থাকে। আজ বাসায় চলে এসেছে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হয়েছে রে মা? শরীর খারাপ?’

রুহি ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,

‘নাহ।’

‘অফিস নেই?’

‘আছে। যাইনি।’

‘ওহহ।’

রুহি বলল,

‘নিরব ভাই নাকি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে?’

নাদিরা বললেন,

‘হ্যাঁ। কাল এসেছিলো ওদের ফ্যামিলির লোকজন। তুই না করে দিলি তাই আমি আর কথা বাড়াইনি। তাও খুব করে অনুরোধ করে গিয়েছে যেন তোর সাথে একটু কথা বলি।’

‘কীসের কথা?’

‘তুই আরেকবার ভেবে দেখ।’

রুহি সরাসরি নাদিরাকে জানিয়ে দিলো এখানে ভাবার কিছু নেই। নিরবকে ও বড় ভাইয়ের মতো দেখে। একটু ফ্রেন্ডলি কথাবার্তা বললেই যে কাউকে বিয়ে করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। নাদিরা আর কথা বাড়ালোনা। রুহিকে নিজের মেয়ের চেয়ে কম কিছু ভাবেনা। তাহলে কেন নিজের সিদ্ধান্ত ওর উপর চাপিয়ে দিবে! যদিও নাদিরা চেয়েছিলো রুহি এ বিয়েতে রাজি হোক। নিরব ছেলেটা দেখতে-শুনতে ভালোই। চাকরিটাও ভালো। রুহিকে নিজে থেকে পছন্দ করেছে। তবে যা হয় সেটা ভালোর জন্যই হয়।

সারাদিন এভাবেই কেটে গেলো। রাতেরবেলা ঘুমুতে যাওয়ার সময় রুহির ফোন বেজে উঠলো। বিরক্ত হয়ে রুহি ফোনটা রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলো,

‘কে বলছেন?’

‘আমি।’

‘কে আমি?’

‘শিট ম্যান। আমি বিভোর।’

রুহি ধমক শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। পরমুহূর্তেই রেগে বলল,

‘পাগল নাকি। এভাবে কেউ ধমকি দেয়?’

বিভোর বলল,

‘তুমি আমাকে চিনতে পারলেনা কেন?’

‘আমিতো কখনো আপনার সাথে ফোনে কথা বলিনি। তাহলে বুঝবো কীভাবে এটা আপনি? আর আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?’

বিভোর ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,

‘এ যুগে এটা কোনো ব্যাপারই নয়।’

রুহি প্রশ্ন করলো,

‘কীজন্যে ফোন দিয়েছেন?’

‘কী করছো?’

‘এতোরাতে এটা জানার জন্য ফোন দিয়েছেন? রাখুন তো! যত্তসব বিরক্তিকর।’

রুহি ফোন কেটে দিলো। মানে কী এসবের! বিভোর চটে গেলো। মেয়েটা তো আচ্ছা ত্যাড়া। রেগেমেগে বিভোর ফোন দিতেই থাকলো। বারবার ফোন বেজে উঠায় বিরক্ত হয়ে রুহি ফোনটাই অফ করে দিলো। ভালো করে কথা না বলে এসব ন্যাকামি কথাবার্তা আর ফোনে বকবক করাটা রুহির মোটেও পছন্দ নয়। তারপর শুয়ে পড়লো কাথামুড়ি দিয়ে। রুহি ঠিক করেছে বিভোরের সাথে এবার চুটিয়ে প্রেম করবে। ওকে তাক লাগিয়ে দেবে। তবে ফোনে কোনো প্রেমালাপ করা যাবেনা। হুট করে, যখন-তখন বিভোরের হসপিটালে গিয়ে চমকে দেবে। বিয়ে? সেটা না হয় পরে দেখা যাবে!

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২১

নিরব কখনো ভাবেনি যে রুহি ওকে বিয়ে করতে রাজি হবেনা। সে খুব অবাক হলো। মেয়েটাকে গত দুইবছর যাবৎ দেখছে। প্রথম দেখায়ই ভালো লেগেছে ওকে। এই কথাটা আর রুহি যে নাদিরার বাসায় থাকে এটা জেনেও ওর বাবা-মা আপত্তি করেনি। মেয়ে ভালো হলেই সব ভালো। অফিসে বসে এই কথাগুলো ভাবছিলো নিরব। খুব বিধস্ত দেখাচ্ছে ওকে। কপালের ভাঁজগুলোতে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তপ্ত দুপুরের হাওয়ায় অব্যক্ত মনের কথাগুলো কেমন বিষাদহীনতায় ছেয়ে আছে। রুহির মুখ থেকে কথাটা শুনতে চায় ও, তাই ফোন লাগালো নিরব। মিনিট গড়াতেই পাওয়া গেলো রুহিকে। সেই মিষ্টি সুরেলা কন্ঠে রুহি সালাম দিলো। নিরব হালকা কেশে উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘তুমি বিয়েটা সত্যিই ভেঙ্গে দিলে!’

‘হুম।’

আহত গলায় বলল নিরব,

‘কেন জানতে পারি?’

রুহি একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘নিরব ভাই, কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়না। একদিন হয়তো বুঝতে পারবেন।’

নিরব অনুরোধের সহিত বলল,

‘আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি রুহি। তোমাকে খুব ভালো রাখবো।’

রুহি গম্ভীর গলায় বলল,

‘কিছু মনে করবেন না। আমি আপনাকে বড় ভাইয়ের মতোই দেখেছি এতোদিন। আপনি আমাকে জোর করবেন না, বিনিময়ে কিছুই দিতে পারবোনা আপনাকে।’

নিরব নির্লপ্ত ভঙ্গিতে বলল,

‘এটাই তোমার ফাইনাল ডিসিশন রুহি?’

রুহি বলল,

‘হুম। আপনি নিশ্চয়ই একটা ভালো জীবনসঙ্গী পাবেন। আর আমাকে ভুল বুঝবেন না।’

নিরবের বুক থেকে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। তারপর হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ভুল বোঝার প্রশ্নই ওঠেনা। আমি বুঝতে পেরেছি। আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই বন্ধুত্ব থাকবে!’

রুহি বলল,

‘ইনশাল্লাহ!’

নিরব বিষয়টা মেনে নিলো। কিন্তু খুব দুঃখও পেলো। রাজকন্যাকে পেয়েও পেলোনা। তবুও নিরব চায় মেয়েটা সুখী হোক, ভালো থাকুক। কেননা ওর জানামতে রুহির কেউ নেই। ওর নিশ্চয়ই খুব দুঃখ! কোনো এক রাজকুমার এসে যেন মেয়েটার দুঃখগুলো ঘুচিয়ে দেয়। সে তো হতে চেয়েছিলো রাজকুমার। কিন্তু ভাগ্য সেসুযোগ দেয়নি। দূর থেকেই না-হয় ভালোবাসবে মেয়েটাকে! ওই গানের মতো,

“আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে
সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে,
ময়ূরপঙ্খী ভিড়িয়ে দিয়ে সেথায়
রেখে এলেম তারে।”

ফোন রেখে রুহি দেখলো লাঞ্চের সময় হয়ে গিয়েছে। অফিসে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় পাওয়া যায় লাঞ্চ সারার জন্য। এখান থেকে বাস ধরলে বিভোরের সাথে লাঞ্চ সারতে পারবে ভেবেই রুহি টিফিন বক্সগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আজ নিজ হাতে খাবার রান্না করেছে বিভোরের জন্য। এখন যদি বিভোর হসপিটালে রুহিকে দেখতে পায় তাহলে নিশ্চয়ই অবাক হবে। বাসে খুব বেশি মানুষজন নেই। রুহি একটা সিটে ধীরেসুস্থে বসলো। জানালা দিয়ে তপ্ত বাতাস ঢুকছে। রাস্তার দুপাশের ঝোপগুলোতে কাশফুল দেখা যাচ্ছে। সাদায় মোড়ানো নীলাভ আকাশ। জ্যামের শহর ঢাকা। অচেনা এই শহরটা ওকে কতকিছু দিয়েছে। আবার কত ঘটনাও ঘটে গিয়েছে ওর জীবনে। সেই দিনগুলো কতোটা কষ্টের ছিলো ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে রুহির। মায়ের মতো সুন্দরী হওয়াটা ওর জন্য ভালো না খারাপ রুহি জানেনা। মনে পড়ে যায় অতীতের কিছু ঘটনা।

ষোলোকলায় পূর্ণ হয়ে গেলো রুপসার আঠারো বছর। গ্রামগঞ্জে মেয়েদের আঠারো হয়েছে মানেই বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ তো এককাঠি উপরে। ষোলোতেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়, আর আঠারো মানেই বুড়ি।

রুপসা ছিলো খুবই সুন্দরী। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান। তার জন্য বড় বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ আসতে লাগলো। কিন্তু ওর বাবা রহমত আলীর কোনোটাই পছন্দ হচ্ছিলো না। হঠাৎ একদিন কোথা থেকে ফিরে রহমত আলী এসে জানালেন রুপসার বিয়ে তিনি ঠিক করে ফেলেছেন। সবাই তো অবাক। কার সাথে বিয়ে তিনি সেটা কাউকে জানালেন না। অতঃপর চৈত্র মাসের কাঠফাটা এক রৌদ্রতপ্ত দিনে সাত্তার পাটোয়ারীর সাথে বিয়ে হয়ে যায় রুপসার।

বিয়ের দিন রাতে জানা গেলো রুপসা সাত্তার পাটোয়ারীর দ্বিতীয় স্ত্রী। আগের ঘরে এগারো বছর বয়সী একটি ছেলে আছে। ছেলেটির নাম মাহিম। মূলত মাহিমকে মায়ের আদর-স্নেহ দেওয়ার জন্যই রুপসাকে বিয়ে করেছে সাত্তার পাটোয়ারী। এই খবরটা রুপসার জন্য ছিলো পায়ের তলায় মাটি সরে যাওয়ার মতোন। যখন জানতে পারলো তার পিতা সবকিছু জেনেই ওকে বিয়ে দিয়েছে তেত্রিশ বছর বয়সী একটা লোকের সাথে তখন রুপসা প্রচন্ড শকড হলো। কেমন যেন হয়ে গেল। সে এক অন্যরকম জীবন। অথচ তার জীবন হতে পারতো সুন্দর, বসন্তের নতুন ফুলের মতো সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ যেখানে ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো সেইসময় তাকে হতে হলো কারো ঘরের দ্বিতীয় স্ত্রী। সাত্তার পাটোয়ারী রুপসাকে খুব সুখে রাখলেও নিজেকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারছিলো না ও। সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে বসে থাকতো, কাঁদতো, খেতো না, ঘুমাতে পারতো না। তার জীবন থেকে হাসি নামক জিনিসটা কর্পূরের মতো উবে গেলো। বাবা হয়ে কীভাবে মেয়ের এমন সর্বনাশ করলো রহমত আলী? অবশ্য সাত্তার পাটোয়ারী খুব খেয়াল রাখতো ওর। কোনোদিন কোনো কষ্ট দেয়নি, ভালোবাসতো রুপসাকে।

নিজে অসুখী হয়েও মাহিমের প্রতি মায়ের দায়িত্ব পালন করতো রুপসা। আদর-স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলতে লাগলো। কিন্তু মাহিম মা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি রুপসাকে। কোনোদিন মা বলেও ডাকেনি। এভাবেই চলতে লাগলো রুপসার জীবন। হঠাৎ একদিন এই রুপসীর ঘর আলো করে এলো একটি কন্যাসন্তান। রুপসার মেয়ে রুপসী হয়েই জন্ম নিলো। তবু্ও রুপসা খুশি হতে পারলো না, বিষন্ন ভাবটা গেলো না। মেয়ে বড় হতে লাগলো, মা বলে ডাকে তবুও রুপসা স্বাভাবিক হতে পারলো না। মাহিমের মুখে মা ডাক শোনার আশায় অধীর আগ্রহে বসে থাকতো। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো, আগলে রাখতো মাহিমকে। শুধু ভালোবাসতে পারলো না নিজের স্বামী-সন্তান। রুপসা নিজের মেয়েকেও ঠিকমতো পালন করতে পারছেনা, সেটা দেখে সাত্তার পাটোয়ারী রুহানিকে একটু বেশিই প্রাধান্য দিতে লাগলেন। মেয়ে পেয়েছে তার মায়ের রুপ। রুহানি হাসলে যেন পৃথিবীটাই হেসে উঠতো। সারা গাঁ’য়ে এমন সৌন্দর্য কারোর ছিলো না। বাবা ছিলো রুহানির সব, মাকে এতোটা কাছে পেতোনা। পাহাড় সমান অভিমান জমলো মায়ের উপর। রুহানির চৌদ্দ বছর যেদিন পূর্ণ হলো সেদিন রুপসা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। কারণ মাহিম রুপসাকে অনেক অপমান করেছিলো, সেটা মানতে পারেনি ও। এতো ভালো করে লালনপালন করেও মাহিম ওকে পতিতা বলে সম্বোধন করেছিলো। রুপসা সেদিন কিছু বলতে পারেনি। চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। মেয়েকে তখন খুব আপন মনে হলো। রুহানির কাছে নিজের দুঃখের কথা বলে নিজেকে হালকা করেছিলো। আসলেই মেয়েরা কখনো তাঁর পিতা-মাতাকে ফেলে দেয়না। রুহিও মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে এতোদিনের অভিমান ভুলে গেলো। সেইদিন প্রথম হাসলো রুপসা। সেই শুরু একটু সুখের দেখা পাওয়া।

কিন্তু এই সুখও বেশিদিন টেকেনি রুহির। বছর ঘুরে আসতেই একদিন ডাক্তার দেখাতে শহরে গিয়েছিল দুজন। ফেরার পথে ভয়ংকর এক্সিডেন্টে মারা গেলো রুপসা আর সাত্তার পাটোয়ারী। গ্রামে নিয়ে আসা হলো ওদের লাশ। বাবা-মায়ের বিকৃত লাশ দেখে রুহানি মূর্ছা গেলো। জ্ঞান ফিরলো চারদিন পর , পাশে কেউ ছিলো না। নিজের ঘরে বসে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো, কিন্তু কেউ ফিরে এলো না। তখন ওর বয়স পনেরো।

কোথাও যখন জায়গা নেই, রুহানির তখন জায়গা হলো মাহিমের ঘরে। কয়েকমাসের মধ্যেই মাহিম বিয়ে করে নিয়ে এলো ফাহিমাকে। ব্যস, ফ্রি-তে কাজের বুয়া পেলো ওরা। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে কলুর বলদের মতো খাটাতো ওকে। সেসবও সয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু রুহির পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হলো। যা সে একদমই চায়নি। তারপরও রুহি দমে যায়নি। স্কুলের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে অনেক লুকিয়ে-চুরিয়ে কোনোমতে পরীক্ষা দিতো। নিজের যোগ্যতা দিয়ে যাতে অনেক বড় কিছু করতে পারে সেটারই স্বপ্ন দেখতো রুহি।

গ্রামের মাতোব্বরের ছেলে সজীব ছিলো বখাটে। নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিলো। রুহিকে সে পছন্দ করতো বললে ভুল হবে। সুযোগ খুঁজতো কী করে মেয়েদের সর্বনাশ করবে। মাতোব্বর মাহিমকে টাকার লোভ দেখিয়ে রুহিকে নিজের পুত্রবধূ করে নিতে চাইলো। আর এর পেছনেও অন্য একটা কারণ ছিলো। যে কারণটার জন্যই রুহি সেইরাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলো। সজীবের সাথে বিয়ে দেওয়ার নাম করে রুহিকে ঢাকায় কোনো এক ডিলারের কাছে বেচে দেওয়া হতো। করানো হতো হোটেল ব্যবসা। সোজা বাংলায় যাকে বলে বেশ্যাবৃত্তি। রুহি অত্যধিক সুন্দরী হওয়ায় ওকে দিয়ে এই কাজ করালে অনেক টাকা ইনকাম হবে ভেবেই রুহিকে ঠিক করে ওরা। মাহিম আর তার বউ এই বিষয়টা জানতো, তবুও তারা মাতোব্বর আর তার ছেলের প্রস্তাবে রাজি হয়। এই কথা শোনার পরই রুহি বাড়ি থেকে পালায় আর ভাগ্যক্রমে দেখা হয় বিভোরের সাথে। বাবা-মা না থাকলে ধনীর দুলালিরও দাম নেই বোধহয়। গ্রামগঞ্জের মেয়েরা সুন্দরী হলে তো আরো দোষ। তাদের বেশিদিন ঘরে রাখা যায়না। কী অদ্ভুত, তাইনা?

রুহির মায়ের বিয়েও আঠারো বছর বয়সে হয়েছিলো। মা-মেয়ে দুজনেরই জীবনের খাতায় অনেকটা মিল!
মায়ের মতো নিজের জীবনটাও কেমন রঙহীন, অগোছালো। কিন্তু ওর মা রুপসা বাবাকে মেনে নিতে না পেরে যে ভুলটা করেছিলো রুহি এবার আর সেই ভুল করবেনা। অনেক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ওর জীবনের পাঁচ-পাঁচটা বছর নষ্ট হয়েছে। এবার সময় এসেছে জীবনকে একটা সুযোগ দেওয়ার, গুছিয়ে নেওয়ার।

ভরদুপুরে রুহিকে নিজের কেবিনে দেখে বিভোর সত্যিই অবাক হলো।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here