আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-২২,২৩

0
1925

আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-২২,২৩
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-২২

রুহির একটু অস্বস্তি লাগছিলো। বিভোর ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় অবাকই হয়েছে। অফিস ফেলে এই ভরদুপুরে কেন এসেছে মেয়েটা? ওর এই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পাত্তা না দিয়ে রুহি বলল,

‘ভেতরে আসতে বলছেন না কেন? দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি?’

বিভোর থতমত খেয়ে বলল,

‘হ্যাঁ..হ্যাঁ আসো। ভেতরে আসো।’

রুহি একটা হাসি দিয়ে ভেতরে আসলো। বিভোর জিজ্ঞেস করলো,

‘কেন এসেছো?’

‘দরকারে।’

‘আমার কাছে কীসের দরকার?’

‘আপনি এতো প্রশ্ন কেন করুন বলুনতো। চুপ থাকন।’

হঠাৎ যেন মনে পড়েছে এমন একটা ভঙ্গিতে তাচ্ছিল্য করে বিভোর বলল,

‘সেদিন রাতে ফোনটা কেন কেটে দিলে?’

‘তাহলে কী করতাম? আপনার আজগুবি প্রশ্ন শুনতাম?’

‘তা নয়, তবুও ভদ্রতা দেখানো উচিৎ ছিলো।’

‘আমি ভদ্র নই৷ সেটা দেখাতেও পারিনা।’

‘আজব তো!’

‘আপনি কী এখন বিজি? কোনো কাজ বা ওটি আছে? এপয়েনমেন্ট আছে?’

‘না তো। কেন?’

‘এমনি।’

বিভোর হতাশ হয়ে বলল,

‘বাই দ্যা ওয়ে, কেন এসেছো?’

‘আপনার সাথে লাঞ্চ করতে।’

বিভোর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মতলব কী মেয়ের? সেদিনের পর থেকে অন্যরকম আচরণ করছে। অদ্ভুত!

রুহির মধ্যে আজ কোনো জড়তা নেই। সে খাবার বেড়ে দিলো। সময় নিয়ে দুজনে লাঞ্চ সারলো। সবকিছু গুছিয়ে ঘড়ির দিকে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। রুহির অফিসের সময় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখান থেকে যেতে অনেকটা সময় লাগবে। ধুর এখানে আসাই উচিৎ হয়নি। ভালোবাসা দেখাতে গিয়েছিলো। এখন বুঝ ঠ্যালা। এজন্যই বলে, অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালোনা।

রুহি ক্ষোভ নিয়ে বিভোরের উদ্দেশ্য বলল,

‘সব আপনার জন্য।’

‘আমি কী বলেছি এখানে আসতে? নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে খুবই মজা লাগে, তাইনা?’

‘এখন আমার চাকরিটা যাবে।’

‘একদিনের জন্য কিছু হবেনা।’

রুহি তেজ নিয়ে বলল,

‘নিজে ডাক্তার বলেই এত বড়াই দেখাচ্ছে। আমিতো ডাক্তার না। অন্যের অফিসে কলুর বলদের মতো খাটি। আপনার বাবা ঠিকই বলে। আপনি গরুর ডাক্তার হওয়ারও যোগ্যতা রাখেন না।’

বিভোর আশ্চর্য হয়ে গেলো। নিজে সময়মতো যেতে পারেনি এখন ওর দোষ? এজন্যই সবাই বলে মেয়েমানুষ মানেই ঝামেলা। যেখানে যায় ঝামেলা বাঁধায়। সময়ের ব্যাপারে একদম পার্টিকুলার নয় তারা।
রুহিকে বলল,

‘এসব বাদ দাও। আরেকটু বসো।’

‘কেন?’

‘অনেকদিন বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি।’

‘তাই আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চান? তাইনা?’

‘ইন্টিলিজেন্ট গার্ল। খুব বড় হয়ে গিয়েছো দেখছি!’

রুহি আফসোসের মতো একটা ভঙ্গি করে বলল,

‘বড় তো হয়েছিই। সেই কবে বিয়ে হয়েছে আমার। ছোট তো আর থাকা যায়না।’

বিভোর মজা করে বলল,

‘ট্রেনে তোমাকে দেখে আমি “আপনি আপনি” করছিলাম তোমায়, মনে আছে?’

‘হুম। আপনি কী এখনো সবার সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে যান?’

বিভোর শক্ত গলায় বলল,

‘না। মজার ব্যাপার কি জানো, ওই ঘটনার পর আমি আর কখনো টেনে চড়িনি। বলতে গেলে সেই সুযোগ হয়নি।’

‘তাই নাকি। বেশ তো!’

এরকম টুকটাক আরও কথা হলো ওদের। তারপর বিভোরের অফিস আওয়ার আবার শুরু হলো,এবার রাউন্ডে যেতে হবে। রুহিকে কেবিনে বসতে বললো। ওকে রেখে পেশেন্টদের দেখতে গেলো, প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আধঘন্টা পরই আবার ফিরে এলো। দেখলো রুহি থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছে?’

‘কিছুনা।’

‘আচ্ছা বসো। আমাকে একটা কাজ সারতে হবে।’

বলেই ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। রুহি ওকে আর ডিস্টার্ব করলোনা। অফিসটা মিস হওয়ায় খারাপই লাগছে। ম্যানেজারের কাছ থেকে কথা শুনতে হবে। বেশি পাকনামির এ-ই উপযুক্ত শাস্তি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুহি বাইরে দৃষ্টি মেললো। তখন চারদিকে কমলা রঙের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। মিষ্টি রোদে আকাশখানি তার বুকে ঢেলে দিয়েছে বিশাল বিশাল মেঘকুঞ্জ। ওখানে একটা মেঘবাড়ি থাকলে কেমন হতো? সবকিছু খুব চমৎকার লাগছে। আচ্ছা, বিভোর কোথায় যাবে রুহিকে নিয়ে!

থমথমে নীরবতা চারদিকে। শুভ্র সাদা মেঘেরা দুলছে, উড়ছে আসমানে। কোথা থেকে যেন দল বেঁধে উড়ে আসে সাদা বকের দল। হসপিটালের বিশাল বড় কাচের জানালার ওপাশটাতে আবাসিক এলাকা। সেখানে বিশাল একটা বাগান আর মাঝারি আকারের জঙ্গল আছে। দুপুরের শেষভাগ আর বিকেলের শুরুতে হাজার হাজার পাখিরা দল বেঁধে এখানে আসে। কিচিরমিচির শব্দে ভরিয়ে দেয় পুরো এলাকাটা। নিরব-নিরিবিলি পরিবেশটাতে এলেই মন ভালো হয়ে যায়।

শুভ্র সাদা মেঘ, সাদা বকের দল, পাখিদের হুল্লোড়, বাতাসে কেমন শরৎ শরৎ গন্ধ। রুহি বিভোরকে জিজ্ঞেস করলো,

‘এখন কী শরৎকাল?’

‘তাইতো মনে হচ্ছে!’

‘আপনি ওই কবিতাটা জানেন?’

‘কোনটা?’

রুহি কবিতার প্রথম লাইনটা বলতেই বিভোর মাথা নাড়িয়ে বললো আমি জানি। অনেকবার পড়া হয়েছে।

তারপর নিজেই কবিতাটা আওড়ালো,
‘শুভ্রতার প্রতীক ভাদ্র ও আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল,
নেই বর্ষার বিষন্নতা শুধু স্নিগ্ধতা প্রকৃতি শান্ত নির্মল।
সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে শুভ্র কাশের আঁচল উড়িয়ে,
শরৎ আসে প্রকৃতি হাসে শেফালিফুলের মালা দুলিয়ে।’

পরের পঙক্তি ধরলো রুহি,

‘নীল আকাশে চলছে ভেসে সাদা মেঘের ভেলা,
আপন মনে মেঘের সনে করছে লুকচুরি খেলা।
এমন পরিবেশে ঝিরঝির বাতাসে দোলে কাশবন,
প্রকৃতির ছন্দে শিউলি ফুলের গন্ধে ভরে যায় মন।’

এবার বিভোর বললো,

‘ঝিলমিলি রোদ শান্ত শরৎ স্নিগ্ধ রূপে প্রশান্তি আনে,
মন মাতোয়ারা ধবধবে রাতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার টানে।
সাদা কাশফুল শিউলি বকুল জ্যোৎস্না আলোছায়ায়,
নদীর তীরে বনের প্রান্ত জুড়ে অপরূপ শোভা ছড়ায়।’

রুহি বিমোহিত হয়ে শেষ পঙক্তিটা আবৃত্তি করলো,

সোনালী আলোয় মেঘের জড়াজড়ি মৃদুমন্দ বাতাসে,
চিরসবুজ মাঠে প্রকৃতি হেসে ওঠে মুকুল ধানের শীষে।
চারপাশের শুভ্রতা বৃষ্টির ফোঁটায় ভেজায় ফুলের রেণু,
দিগন্তজুড়ে আঁকা সাতরঙা হাসিমাখা ফুটে ওঠে রংধনু।

কবিতা আবৃত্তি শেষ হতেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। বিভোর অনুমতি দিলো ভেতরে আসার জন্য। সিস্টার কিয়ারা এসেছে। রুহির দিকে তাকিয়ে ওনি মিষ্টি করে হাসলো। প্রতুত্তরে রুহিও হাসলো। বিভোরের সাথে পেসক্রিপশন আর কিছু ফাইল নিয়ে কথাবার্তা বলে চলে গেলেন। রুহি মনোযোগ দিয়ে কিয়ারাকে লক্ষ্য করলো। কি সুন্দর করে শাড়ি পরেছে ওনি। মধ্যবয়সী মহিলা, কিন্তু রুপে অনন্য। গুণেও কম নয়। পেশেন্টদেরকে নিজের বাড়ির লোক মনে করে। আনন্দের সহিত সেবা প্রদান করে। আশ্চর্যের ব্যাপার এত বয়স হবার পরেও বিয়ে করেননি। ওনি খৃষ্টধর্মের অনুসারী। বিভোর ওনাকে খুব সম্মানের চোখে দেখে।

ল্যাপটপের কাজ শেষ করে বিভোর রুহির দিকে তাকালো। টকটকে কমলা বিকেলে রক্তজবাকে হলদে পরী মনে হচ্ছে। মেয়েটা আশ্চর্য মায়াবতী। আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখছে ও? বিভোর কবি কালিদাসের বিখ্যাত পঙক্তি আওড়ালো।

‘প্রিয়তমা আমার, ঐ চেয়ে দেখ
নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’

সব কাজ শেষ করে রুহিকে নিয়ে বেরুতে বেরুতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলো। ওরা একটা পার্কে এসেছে। নরম ঘাসের ওপর বসতেই কোথা থেকে মিষ্টি এক সুগন্ধ ভেসে এলো। এক-আধটু কথা হলো ওদের। হঠাৎই রুহি চুপ করে গেলো। তারপর দীর্ঘক্ষণ নীরবতা। লেকের পানিতে অস্তমান সূর্যের শেষ আলোর ছটা হাজারো কিরণমালা সৃষ্টি করছিলো। সেদিকে তাকিয়ে বিভোরের জানতে ইচ্ছে হলো রুহি ওকে ভালোবাসে কিনা?

রুহির হাতে হাত রাখলো বিভোর। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। রুহি ওকে যদি না করে দেয়, তাহলে? কিন্তু এতকিছুই বা করছে কেন? কাউকে না ভালোবাসলে এতকিছু করার মানে হয়না। কিন্তু বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া উচিৎ। রুহির উত্তর যদি না হয়, তাহলে আর কখনোই ওর সামনে আসবেনা বিভোর। অনেকটা কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘Can’t you love me?’

বিভোরের কথায় খুব বেশি অবাক হলোনা রুহি। আস্তে করে হাসলো। রুহির হাতটা ছেড়ে দিলো বিভোর। ভাবলো, রক্তজবা ওকে ক্ষমা করেনি এখনো। নাহ, আর বোধহয় ওদের এক হওয়া হলোনা। কিন্তু তারপরই! গোধূলির লালচে আকাশের উদাসী রঙের খেলা দেখতে দেখতে যখন নীরবতা জেঁকে ধরলো, শরৎের মেঘেরা স্বপ্নলোক তৈরি করেছিলো দূর আকাশে তখনই রুহির মনে হলো আজ এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিৎ। শরৎ মানেই প্রেম, শরৎ মানেই মুগ্ধতা। রুহি বিভোরের পানে মুগ্ধতা নিয়ে তাকালো। তারপর ওর চোখে চোখ রেখে বললো,

‘Of course love goes.’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৩

অস্তমান সূর্য! মাথার উপর বিশাল আকাশ। নীলাভ আকাশ ছেয়ে আছে লালচে আলোয়। নীড়ের পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যে। কেমন একটা মায়াময় আভাস চারদিকে। রুহি আর বিভোরের প্রেমের শুরু সেখান থেকেই। বিভোর তো কোনোদিন ভাবেইনি তার রক্তজবা ওকে মেনে নিবে, ভালোবাসবে! এই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ ওকে বেশ ভাবাচ্ছে। কারণ এই কদিন রুহি ওর সাথে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আচরণ করেছে। হতেও তো পারে এটা একটা মজা, এতো খুশি হবার কোনোই কারণ নেই। বিভোর আলতো হাসলো। মুখে কেমন বিষাদের ছায়া। প্রশ্ন করলো,

‘মজা করছো?’

রুহি বলল,

‘না। সত্যি বলছি।’

‘আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। সত্যিই কী তাই?’

রুহি বিভোরের কনুইয়ে জোরে চিমটি কেটে বলল,

‘সব সত্যি।’

বিভোরের চোখজোড়া চকচক করে উঠলো। ভারী হয়ে আসলো ওর গলা। খুশিতে কয়েক মুহূর্ত কথাই বেরুলো না ওর গলা দিয়ে। চোখের কোণে পানি জমে গেলো। রুহি দেখলো তার সুন্দর পুরুষটিকে এই মুহূর্তে কী অসাধারণ দেখাচ্ছে। এতো সুন্দর কোনো ছেলে হতে পারে ওর জানা ছিলোনা। আসলে ভালোবাসার মানুষটি সবসময়ই সবার চোখে সুন্দর দেখায়। এটাই বোধহয় নিয়ম। কালো ছেলেকে ভালোবাসলে সে-ই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, ফর্সা চামড়ার কাউকে ভালোবাসলে একইভাবে সেও ভালোবাসার মানুষের চোখে সবচেয়ে সুন্দর ব্যক্তি।

বিভোর অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো,

‘ইউ উইল ম্যারি মি?’

‘ইয়েস, আই উইল। কিন্তু আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।’

‘আমি সেটা বলছিনা। আমি সবাইকে জানাতে চাই, তুমি আমার স্ত্রী। সেই হিসেবে কিছু একটা তো করতেই হবে। হোক না সেটা আবার আমাদের নতুন করে বিয়ে!’

রুহি বলল,

‘এসবের দরকার কী!’

‘দরকার আছে। আমার বউ আমি নিবো, সেটা কী যেনতেন ভাবে নাকি! অবশ্যই সবাইকে জানিয়ে, ধুমধাম করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো।’

রুহি শুধু চুপ করে সব শুনছে৷ ওর হাসি পাচ্ছে। ডাক্তারদের কী এরকম সহজ-স্বাভাবিক মানায় নাকি! বিভোর এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। বলল,

‘আব্বু যদি এই খবর শুনে, নির্ঘাত তার একশো একবার হার্ট-অ্যাটাক হবে।’

‘বাবাকে নিয়ে এরকম কথা বলতে নেই।’

‘স্যরি। আমি এটা বুঝাতে চাইনি। বলতে চেয়েছি খুশিতে হার্ট-অ্যাটাক করবে। আব্বু তো সেই কবে থেকে বলছে বিয়ে কর, বিয়ে কর। এই ক’দিন তো ভালো করে আমার সাথে কথাই বলছেনা। উঠতে, বসতে, খেতে, ঘুমাতে গেলেও আমাকে কথা শুনাচ্ছে। আজ সকালেও বললো আমি নাকি বুড়ো হয়ে গিয়েছি। আমাকে নাকি এখন কেউ বিয়ে করবেনা, গ্রামের কচি মেয়েও না!’

‘আঙ্কেল তো ঠিকই বলেছে। হা হা।’

‘হাসবেনা একদম। তোমার এসব কান্ডকীর্তি দেখে আমি দিনদিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছি। খেতে পারছিনা। আমার এই সিচুয়েশন কী তোমার চোখে পড়ছেনা? তুমি যদি ওই নিরবকে বিয়ে করতে তাহলে স্ট্রোক ছাড়াই আমি কোমায় চলে যেতাম।’

‘আমি কি না খেয়ে থাকতে বলেছি? ইটস টোটালি ইউর প্রবলেম সো আমাকে এর জন্য দায়ী করবেন না। আমার এই বিষয়টা পছন্দ নয়।’

রুহির কথা শুনে বিভোরের মুখটা চুপসে গেলো।

‘রাগ করার কিছু নেই, আমিতো মজা করলাম।’

রুহি হেসে ফেললো। বোকা বানিয়েছে বিভোরকে। কয়েকটা ঘাস তুলে বিভোরের মুখে গুঁজে দিয়ে বলল,

‘ অনেকদিনের ইচ্ছে ডাক্তার সাহেব, আপনাকে ছাগলের খাদ্য ঘাস খাওয়াবো।’

‘তুমি বললে সেটাও খেতে রাজি আমি।’

বিভোর সত্যিই ঘাস চাবাতে লাগলো। রুহি বলল,

‘ফেলে দিন। ডায়রিয়া হয়ে যাবে।’

ততক্ষণে সেগুলো বিভোরের পেটে চলে গিয়েছে। কাশতে কাশতে বলল,

‘ছিঃ রক্তজবা। কি বিচ্ছিরি তোমার ছাগলের খাবার। আস্তাগফিরুল্লাহ!’

‘আমি ফেলে দিতে বলেছিলাম। রাক্ষসের মতো খেয়ে নিতে বলিনি।’

বিভোর বলল,

‘আব্বু যে আমাকে কী করবে, যখন শুনবে আরও পাঁচ বছর আগেই আমি বিয়ে করে নিয়েছি। তাও আবার তোমাকে। আমি জানিনা আব্বু কী রিয়্যাক্ট করবে!’

রুহি ভয়ার্ত গলায় বলল,

‘ওনারা কী আমাকে মেনে নিবেনা?’

‘ ধুর। পারলে এক্ষুণি কোনো পাগলিকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দেয়। সেদিন তো বলেই ফেললো আমাদের বাসার হাসেনা আন্টির মেয়েকে বিয়ে করবো কিনা।’

‘হাসেনা আন্টি আবার কে?’

‘আমাদের বাসায় কাজ করে আরকি। আম্মুর হাতে হাতে।’

রুহি থম মেরে বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। বিভোর সেদিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। ওর ছোট্ট বউ, ভালোবাসাটা। ওর লাল, মিষ্টি, ভোরের স্নিগ্ধতায় ঘেরা একমাত্র বউ রক্তজবা।

রুহি শান্ত দৃষ্টিতে বিভোরের দিকে তাকালো। তারপর ব্যথাভরা কন্ঠে বলল,

‘জানেন, আপনি যখন আমাকে অনন্যা আপুর কাছে আমার সব দায়িত্ব দিয়ে চলে গিয়েছিলেন তখন আমার খুব রাগ হয়েছিলো। আপু আমাকে সবসময় সাহায্য করতো পড়াশোনায়। ভাবতাম নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আমার প্রতি করা সব গাফিলতির মজা বুঝাবো আপনাকে।’

বিভোর মজা করলো,

‘তাই নাকি? তুমি ভীষণ ডেঞ্জারাস রক্তজবা, এটা কী তুমি জানো?’

রুহি কথাটা সিরিয়াসলি নিলো। অন্যদিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

‘না। আমি জানিনা। আমি খুবই সাধারণ একটি মেয়ে, যে ছোট থেকেই ভালোবাসার কাঙাল। ছোটবেলায় বাবার যত্ন পেলেও মায়ের ভালোবাসা পেতে চাইতাম, সে যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেলো অনেকদিন কেউ আর আমাকে ওদের মতো ভালোবাসেনি। এরপর আপনি এলেন হঠাৎ করেই, তেমন ভাবেই হারিয়ে গেলেন।’

‘খুব কষ্ট দিয়েছি তোমায় তাইনা?’

‘খুব। আমি তখন ছোট ছিলাম তাই হয়তো আবেগের বশে এমন করতাম।’

‘এখন বুঝি বড় হয়ে গিয়েছো?’

‘হুম। এখন মনে হয় আপনার প্রতি রাগ করা আমার উচিৎ হয়নি। আপনিও পরিস্থিতির শিকার। এমন করে বিয়ে হলে কে-ইবা মানতে চাইবে! আর আপনি যে প্রেমে মজেছিলেন সেসব ভুলে যাবার চেষ্টা করছি আমি।’

বিভোরের চোখেমুখে কৌতূহল খেলা করছে। বলল,

‘একটা কনফিউশানে আছি। তুমি প্লিজ আমাকে এই কথাটা ক্লিয়ার করে বলো!’

‘কোন কথা?’

‘তুমি ইভাদের বাসায় কী করে গেলে? ওদের সাথে পরিচয় কীভাবে তোমার?’

‘তার আগে জানতে চাইবেন না এই তিন বছরে আমি কোথায় ছিলাম? কী হয়েছিলো আমার সাথে?’

‘এটা তো জানা কথা, তুমি অনন্যার সাথেই ছিলে হয়তো।’

‘আপনি বিদেশে চলে যাওয়ার পরে অনন্যা আপুর সাথে কোনো যোগাযোগ করেছিলেন?’

বিভোর অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলল,

‘দুর্ভাগ্য, আমি তার সেলফোন নাম্বার হারিয়ে ফেলেছিলাম। সামাজিক যোগাযোগ সাইটে ওর সাথে আমার কোনো কন্ট্রাক্ট ছিলোনা।’

‘এখন যে দেশে এসেছেন আপুর কোনো খোঁজ নিয়েছেন কী?’

‘নেওয়া হয়নি। আমিতো হোস্টেলে গিয়েছিলাম একদিন। ওকে খুঁজে পাইনি। সুপার বললেন অনন্যা নামের কাউকে চেনেন না,ওনি নতুন জয়েন করেছেন।’

রুহি কোনো কথা বললোনা। বিভোর এতোটা ইররেস্পন্সিবল কীভাবে হলো। একটা মেয়ের কাছে নিজের বউয়ের দায়িত্ব দিয়ে গেলো। কারোর কোনো খোঁজই সে রাখেনি। এখন অবশ্য ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু অনন্যার সাথে কী হয়েছে সেটা কী করে বলবে কি করে? বিভোর কষ্ট পাবে নাতো! তখন রাত হয়ে গিয়েছে। লেকের কালচে পানি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলছে। অর্ধবাঁকা চাঁদটা কি সুন্দর দেখাচ্ছে। ঝোপঝাড়ে হাজারো জোনাকির মেলা বসেছে। অনেকদিন কোনো জোনাকি দেখেনি রুহি। শহরে আসার পর তো নয়ই৷ তাদের গ্রামে রাত হলেই দেখা যেতো জোনাকিদের। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ওদের হাতের মুঠোতে নিয়ে খেলা করতো। টিমটিম করে জ্বলতো জোনাককিদের পিঠ। রুহির খুব পছন্দের। কি সুন্দর ছিলো সেই স্মৃতিগুলো!

বিভোর আচমকাই রুহির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। চোখ দুটো বন্ধ করে আনন্দসূচক হাসি উপহার দিলো। মুখে শুধু বলল,

‘আহ! কী শান্তি।’

রুহি ওর চুলে হাত বুলালো। কেমন নরম, সিল্কি চুল। তারপর ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,

‘আপনার ফ্রেন্ড, আই মিন যার কাছে আমার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন অনন্যা আপু আর বেঁচে নেই। এই খবরটা আপনি জানেন?’

বিভোর লাফ দিয়ে উঠে বসলো। ভ্রু কুঁচকে সন্দেহী দৃষ্টিতে রুহির দিকে তাকিয়ে কাঁপানো গলায় বলল,

‘কি বলছো তুমি?’

‘সত্যি বলছি। আপুর বাস এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। সেখানেই স্পট ডেড!’

‘রুহি!’

‘হুম ডাক্তার সাহেব। এটাই সত্যি। আপনি দেখছেন আমার হাতের এই কাটা দাগ,এই যে পায়ের আঙুল নেই! কপালে সেলাই দেখছেন? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিয়ে গিয়েছে অনন্যা আপু।’

রুহি জুতো খুলে ওর পা দেখালো বিভোরকে। বাঁ পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলটা নেই। কপালে সেলাইয়ের দাগ, হাতেও! এতোদিন কেন চোখে পড়েনি বিভোরের? এতকিছু ঘটে গেলো ওদের জীবনে? অনন্যা, ওর বোনের মতো বন্ধুটিও আর বেঁচে নেই! কী বলছে এসব রক্তজবা? নিজেকে হঠাৎ ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগলো বিভোরের।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here