আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-২৪,২৫

0
1622

আঠারো_বছর_বয়স,পর্ব-২৪,২৫
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-২৪

সেদিনের ঘটনা। বিভোর রুহিকে অনন্যার কাছেই রেখে গিয়েছিলো, সব দায়িত্ব দিয়ে। প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সবাইকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারার গুণটা ওর মাঝে প্রবল ছিলো। ওর এই গুণটা ছোট থেকেই ছিলো। বিভোর আর অনন্যা একই স্কুলে পড়তো৷ বড় হওয়ার পরে যোগাযোগ কমে গেলে ও বন্ধুত্ব ছিলো। বিভোর ওদের বিয়ের কথাটা জানিয়ে গেলেও পরবর্তীতে রুহির কাছ থেকে বিয়ের বিস্তারিত ঘটনা জানতে পারে অনন্যা। রুহির যাবতীয় খরচ, লেখাপড়া সহ বিভিন্নভাবে সাহায্য করতো ওকে৷ নিজদের ফ্ল্যাটে একাই রুহিকে নিয়ে থাকতো৷ বোনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো রুহিকে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো। দেড় বছর পরে একদিন শপিং শেষে ফেরার পথে হাইওয়ে পার হওয়ার সময় রুহি সামনের দিকে না তাকিয়েই রাস্তা পার হতে যায়, বিপরীত দিক থেকে বাস আসছিলো। অনন্যা দ্রুত রুহিকে ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিলেও নিজে সরতে পারেনি। বাসের চাকার নিচেই পিষে যায়। রুহি গিয়ে পড়ে সূঁচালো রডের উপর। হাত-পায়ে মারাত্নক জখম হয়৷ জ্ঞান হারানোর আগে শুধু বুঝতে পারে বোনের মতো সেই মানুষটি আর বেঁচে নেই। অনন্যার চোখগুলো খোলা ছিলো। ঘোলাটে মণির দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল রুহির উপর। সবসময় বলতো তোর একদিন খুব ভালো কিছু হবে, তুই খুব সুখী হবি রুহি। দু’দিন পর যখন রুহি নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করে এবং জানতে পারে অনন্যা আর নেই, ওকে দাফন করা হয়েছে। এই ঘটনার পর থেকেই বিভোরের প্রতি আরও রাগ হয় রুহির। ওর জন্যই অনন্যার এই অবস্থা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিতো। বিষাক্ত হয়ে উঠে মন। যদিও বিভোরের সেখানে কিছুই করার ছিলোনা।

রুহির কাছ থেকে এই ঘটনা শুনে ‘থ’ হয়ে বসে আছে বিভোর। বাচ্চাদের মতো একটা কান্ড করে বসলো। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই, এই কথাকে দূরে ঠেলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। এই সিচুয়েশনের জন্য নিজেকে দায়ী করতে লাগলো। রুহি শুধু হাসলো। অপরাধবোধে ভুগলেই মনের শান্তি হবে। পরবর্তীতে কোনো ভুল করার সাহস পাবেনা। বিভোরকে অনেক বুঝলো রুহি। একটু দায়িত্ব আর সতর্কতা পালন করলেই ওদের তিনজনের জীবনটাই অন্যরকম হতো। একসময় শান্ত হলো বিভোর। কাঁপানো গলায় শুধু বললো,

‘তোমাকে আর কোথাও ছাড়ছিনা আমি।’

মুচকি হেসে রুহি বলল,

‘সবসময় কী আর সবাইকে ধরে রাখা যায়? হয়তো আমিও একদিন এভাবেই পালিয়ে যাবো।’

বিভোর নিজের বুকের সাথে জাপটে ধরলো রুহিকে। তারপর গম্ভীর শান্ত গলায় বলল,

‘পালিয়ে যেতে চাইলেই পালানো যায়না।’

‘এভাবেই ভালোবাসবেন তো আমায়?’

‘আরো বেশি।’

কাঠফাটা রোদ্দুর। এতো গরম বোধহয় এর আগে কখনো পড়েনি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। এই সময় এতো গরম থাকার কথা নয়, কিন্তু আজ তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রির কাছাকাছি। রুহি দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেনা। আজকাল অবসাদ গ্রাস করছে ওকে। চোখে ঝাপসা দেখে। রক্ত জমাট হয়ে লাল হয়ে যায়। অফিস শেষ করার পর বিভোরের সাথে দেখা করতে যাবে। কিন্তু আজ যা গরম! তবে ভালোবাসার মানুষটার জন্য এটুকু কষ্ট করতে রুহি এক পায়ে রাজি৷ সারাদিন অফিস শেষে বিভোরের সঙ্গে রিকশায় ঘুরাঘুরি, পার্কে বসে বাদাম খাওয়া, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রীম-ফুচকা খাওয়া, ছুটির দিনে লং-ড্রাইভে যাওয়া এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে। সুখের দিনগুলো এতো ক্ষুদ্র হয় কেন আর কেনই-বা এতো দ্রুত চলে যায়?

ফোন এলো বিভোরের। সচরাচর ওকে ফোন করেনা ও, কারণ রুহি বারণ করে দিয়েছে। ফোনে সস্তা প্রেমালাপ, সারারাত কথা বলা ওর মোটেও পছন্দ নয়। তাছাড়া ওদের দুজনে কেউ-ই ছোট বাচ্চা নয়, বড় হয়েছে, সবকিছু বুঝে। দুজনেই সারাদিন অফিস-হসপিটালে কাজ করে। খুব ক্লান্ত হয়ে থাকে। রাতটুকু যদি বিশ্রাম না নেয় তাহলে শরীর খারাপ হতে পারে ভেবেই রুহির এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু আজ ফোনের ওপার থেকে বিভোরের কন্ঠ শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। সব ক্লান্তি এক নিমিষেই চলে যাবে রুহির। ধরবেনা ধরবেনা করেও ফোন রিসিভ করলো রুহি।

‘আসসালামু আলাইকুম।’

‘ওয়ালাইকুম সালাম। কী করছো?’

‘অফিসে আছি। আজ খুব গরম।’

‘ঠিক আছে, আজ দেখা করতে হবেনা৷ তুমি বরং বাসায় চলে যেও।’

রুহি বলল,

‘না না। আমি আসতে পারবো।’

বিভোর ধমকে উঠতেই রুহি চুপ করে গেলো। এমনভাবে ধমক দেয় যে ওর আত্মা কেঁপে উঠে। কাঁচুমাচু করে বলল,

‘আপনি তো এসির হাওয়া খাচ্ছেন, তাইনা?’

‘নো। কানেকশানে ঝামেলা হয়েছে!’

‘ওহ আচ্ছা। বলছিলাম কী আমি আসতে পারবো। কোনো অসুবিধে নেই। রোদ কমে গিয়েছে।’

বিভোর রেগে উঠলেও সেটা প্রকাশ করলোনা। মৃদু হেসে কবিতার মতো করে বলল,

‘আঠারো বছর বয়সী রমণী
তোমাকে বলছি, শুনো!
রোদে হেঁটো না;
মেঘকে অনুরোধ করো, সূর্যকে যেন ঢেকে দেয়।
তুমি বরং বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে যাও,
আমি সেই ফোঁটায় ভিজে নিজেকে সিক্ত করবো।’

রুহি গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘বয়স আমার আঠারো নয়, চব্বিশ।’

‘আমার কাছে সে-ই ছোট্ট রক্তজবা রয়ে গিয়েছো। ওই লাল জবাফুলে রাঙানো শেষ বিকেলের মেয়েটি। রোদেরা তখন লজ্জ্বা পাচ্ছিলো, আর লাল হচ্ছিলো আমার বউয়ের গাল।’

‘যাহ।’

বিভোর বলল,

‘আমার একটা আফসোস হচ্ছে, কেন যে তখন কুটুস করে তোমার গালে চুমু খেলাম না। হায়!’

‘নির্লজ্জ। ভেবেছিলাম দেখা করতে আসবো এখন আর আসবোই না। ফোন রাখছি। সো কল্ড কথাবার্তা অন্য কাউকে শুনান।’

বিভোর হুমকি দেওয়া গলায় বললো,

‘উহু। একদম ফোন রাখবেনা। আজ খুব সস্তার প্রেম করতে ইচ্ছে করছে৷ একবার ভালোবাসি বলো না!’

রুহি তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিয়ে রিল্যাক্স হয়ে বসলো। কপাল বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। বিভোরটা যে কী না। এই ক’দিন খুব ভালো কেটেছে ওর। মনে হচ্ছে ওর হারানো সব সুখ একসাথে এসে ধরা দিয়েছে। মাঝেমধ্যে ভয় হয়, সুখগুলো আবার হারিয়ে যাবে নাতো!

রুহির হুটহাট রেগে যাওয়াটাকে দারুণ উপভোগ করে বিভোর। মেয়েটা ওকে সবসময় চমক দিতে চায়। ও ম্যাসেজ করলো হোয়াটসএ্যাপে, সিন করলো রুহি৷ তবে উত্তর দিলোনা। এবার সরাসরি ফোন লাগালো৷ রুহি ধরলো। কিছু বলার আগেই বিভোর রাগী গলায় বলে উঠলো,

‘ফোন কাটো কেন হ্যাঁ? তুমিতো ফোন দাওনি, আমার পয়সা খরচ করে আমি ফোন দিই আর তুমি কেটে দাও। সেদিনের বাচ্চা মেয়ে হয়ে আমার সাথে তেজ দেখাও? তুমি জানো আমার বয়স কত? এসব কী ব্যবহার তোমার? নূন্যতম সম্মান দিতে শেখোনি মানুষকে, মানুষের কথা না-হয় বাদই দিলাম। আমি তোমার স্বামী। এটলিস্ট একটু রেস্পেক্ট পাওয়ার যোগ্য নয় কী আমি? বলো? আন্সার মি!’

রুহি ঘাবড়ে গেলো। মিনমিন করে বলল,

‘দুঃখিত। আর কখনো ফোন কাটবোনা।’

-‘তোমার সো কল্ড স্যরি তোমার আঁচলের কাছেই রাখো। আমি, বাবর চৌধুরীর ছেলে বিভোর। রাগ করিনা বলে ভেবোনা আমার রাগ নেই।’

‘বললাম তো স্যরি। আর হবেনা।’

‘এভাবে হবেনা৷ তোমার আশেপাশে কেউ আছে?’

রুহি আশেপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো কেউ নেই।সবাই কাজে ব্যস্ত৷ বলল,

‘না নেই। কেন বলুনতো!’

‘আবার প্রশ্ন করছো! মেজাজটাই খারাপ করে দিলে।’

‘কী করবো বলুন৷ আমার ঘাট হয়েছে আপনার ফোন রিসিভ করে। মাফ দেন এবার!’

‘ভালোবাসি বললে মাফ করে দিবো।’

রুহি অবাক হয়ে বলল,

‘নো ওয়ে। কখনোই বলবোনা আমি।’

‘একবার শুধু।’

‘আমি কিন্তু এই কথা বলেছি আপনাকে।’

‘বারবার শুনতে ভালো লাগে।’

তারপর রুহি চুপ করে গেলো। মুখ ফসকে বলেছে তো একদিন যে ভালোবাসি। বারবার বলার প্রয়োজন কী! রুহির ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে৷ কিছুতেই সহজ হতে পারছেনা। ওর নীরবতা টের পেলো বিভোর। কিন্তু প্রশ্ন করলোনা। অনেকটা সময় হয়ে গেলেও বিভোরের রাগের কথা স্মরণ করে ফোন কাটার সাহস হয়নি রুহির। দুজনেই শুনতে পাচ্ছে নিঃশ্বাসের শব্দ। মৃদু বাতাসে গাছপালা দুলছে। ঝিঁঝি পোকারা কর্কশ গলায় ডাকছে৷ ভীষণ একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর একটা মুহূর্ত।

বিভোর মিষ্টি হেসে ফোনের মাঝেই অদ্ভুত কোমল স্বরে রবি ঠাকুরের গানের কথাগুলো বলল,

‘ওই কথা বলো সখী, বলো আর বার-
ভালোবাসো মোরে তাহা বলো বারবার।
কতোবার শুনিয়াছি, তবুও আবার যাচি
ভালোবাসো মোরে তাহা বলো গো আবার!’

এবার নীরবতা ভেঙে রুহি বলে উঠলো,

‘বলবোনা, বলবোনা এবং বলবোনা।’

বিভোরের সত্যিই এবার রাগ হয়েছে। রুহি ওকে বুঝতেই চায়না। একবার “ভালোবাসি” বললে কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে? বিভোর তো প্রতিটি নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও ভাবে তার একটা রক্তজবা আছে৷ ও না থাকলে সেই রক্তজবাটাও হারিয়ে যাবে। তাহলে কেন এইসব? ফোন কাটলো বিভোর। রাগের বশে মাথা ঠিক নেই। রুহি ওকে বড্ড জ্বালাচ্ছে। বিভোর হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো৷ ঠিক করলো মা-বাবাকে ওদের দুজনের কাহিনী এবার বলে দেবে। অনেক তো হলো, আর কতো? হাঁপিয়ে উঠছে বিভোর। নিজের ভুলের জন্য কত মাশুল দিতে হলো অনন্যাকে। ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধ ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। রুহিকে ছাড়া আর একটি দিন কাটানোও যেন মৃত্যুর সমান কষ্টের! ভালোবাসায় এতো কষ্ট, দুঃখ থাকে জানলে কখনোই এই ফাঁদে পা দিতোনা। আগেতো এইরকম হয়নি, এবার মনে হচ্ছে সত্যিই কিছু হারিয়ে যাচ্ছে, যাবে! কিন্তু এটা কিছুতেই হতে দেবেনা বিভোর।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৫

একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। এখন আকাশ পরিষ্কার। কেমন ভিজে মাটির গন্ধ আসছে। কোথা থেকে দুটো ভিজে টুনটুনি এসে বসেছে বারান্দায়। একজন আরেকজনের গায়ে ঠুকাঠোকি করছে। বাগানবিলাস গাছটা নেতিয়ে আছে। রুহি এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। নাদিরার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। প্রেশার ফল করেছে। রুহি জোর করে একটু ভাত খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছে। এই মহিলাটিকে সে মায়ের মতো ভালোবাসে। কোনোভাবেই চায়না মায়ের মতো সেও হারিয়ে যাক। এই বাসায় চার বছর ধরে আছে রুহি। অথচ নাদিরা বা ইভা কেউ-ই ওকে বুঝতে দেয়নি সে পর। এতোটা ভালোবাসে ওরা রুহিকে। ইভাকে ফোন করেছে রুহি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে। মায়ের শরীর ভালো নেই শুনে চিন্তায় পড়ে গিয়েছে বেচারি। রাতুল আসলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। চায়ের কাপে চুমু দিতে দিতে রুহির মনে পড়ে বিষন্ন আর ভয়ানক অতীতের কথা। আজকাল জানেনা রুহি ওর সাথে কি হচ্ছে, আগের মতোই হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। সবকিছুতে হারানোর ভয়, উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা। মনে হয় ওর সাজানোর এই পৃথিবীটা কোনো একদিন আবারও ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

চার বছর আগে। অনন্যা আর ইভা একই ভার্সিটিতে পড়তো। কীভাবে কীভাবে যেন ওরা হয়ে যায় প্রাণের বান্ধবী। সেই সুবাদেই মাঝেমাঝে অনন্যার ফ্ল্যাটে যেতো ইভা। সেখানেই রুহির সাথে ইভার পরিচয়। তিনজন মিলে ঘুরতো,এটা-সেটা করতো। এক্সিডেন্টের দিন ওরা তিনজন মিলেই শপিংয়ে গিয়েছিলো। ফেরার পথে রুহি ইভার সাথে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছিলো। সামনে থেকে আসা বাসটা ওর চোখে পড়েনি। পেছনে অনন্যা ছিলো। ইভা বাস দেখে রুহিকে টান দিতে যাবার আগেই অনন্যা পেছন থেকে ওদের দুজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। দুজন দুদিকে ছিঁটকে পড়ে। রুহি পড়ে রডের উপর। ইভা একটা রিকশার সাথে বারি খায়। হাত-পা ছিলে যায় কিন্তু খুব বেশি লাগেনি। জ্ঞান ফেরার পরে যখন রুহি অনন্যার মৃত্যুর খবরটা সহজভাবে নিতে পারেনি। যখন রুহির আর কোথাও যাওয়ার জায়গা রইলোনা তখন ইভা ওর পাশে দাঁড়ায়। ছোট একটা সার্জারির মাধ্যমে রুহির পায়ে আঙুল কেটে ফেলা হয়। এই পুরোটা সময় বড় বোনের মতো রুহিকে সামলিয়েছে ইভা আর ওর মা। নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। অনন্যার মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে অনেক সময় লেগেছে রুহির। পুরো একটা বছর শকে ছিলো। মাঝরাতে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠতো। রক্ত দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যেতো। রান্নাঘরে যেতে পারতোনা, আগুন দেখলেই মুখচোখ লাল হয়ে যেতো৷ পড়াশোনায় মনোযোগ ছিলোনা। শুধু দেখতো অনন্যা ওর পাশে বসে আছে, তাকিয়ে আছে আর খিলখিল করে হাসছে। মেয়েটা খুব সুন্দরী ছিলো। স্বপ্নে রুহির সাথে কথা বলতো। রুহি একপর্যায়ে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিনরাত নিজেকে আটকে রাখতো। কাঁদতো খুব। প্রচুর হ্যালুসিলেশন ওকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছিলো। অসংখ্য ফোবিয়ায় ভুগতো। এই ভয়ংকর সিচুয়েশন থেকে ইভা ওকে বের করে এনেছে। ডাক্তারদের নির্দেশনা মতো সবকিছু করেছে। যেখানে যাবার দরকার, যা দরকার সব করেছে। কতশত ডাক্তার দেখিয়েছে বলার বাইরে। কোনো আপনজনও বোধহয় এতোটা করেনা কারোর জন্য। দীর্ঘ একটা বছর পরে রুহি স্বাভাবিক হলো। পুরো জার্নিটাতে নাদিরা সবসময় ইভাকে সাপোর্ট করেছিলো। নাহলে আজ রুহি কোথায় থাকতো ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। হয় রাস্তায় নাহয় পাগলখানায়! ভাগ্যবতী বলেই সবসময় সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে রুহি। সবাই ওকে সাহায্য করে, জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো বিভোর, অনন্যা আর ইভাকে পাশে পেয়েছে। একেকটা জীবন-মরণ সমস্যা থেকে বের করে এনেছে এরা তিনজন, বিভিন্ন সময়ে। এদের ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা রুহির কোনোদিনও হবেনা। শহরের সব মানুষেরা খারাপ বা অকৃতজ্ঞ নয়। রুহি এখন সেটা বুঝতে পারে প্রবলভাবে।

অতীতের কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুলো রুহির। ওর এমন এলোমেলো জীবনে সদ্য ফোঁটা পদ্মের মতো আবারও ঢু মেরেছে বিভোর নামক মানুষটি। এই কথাগুলো যখন বিভোরকে জানিয়েছিলো তখন অদ্ভুত এক আর্তনাদ ওর চোখে টের পেয়েছে রুহি। বাইরে কিছু প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে নিদারুণ পুড়েছে সেটা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। কতোটা ডেস্পারেট হয়ে আছে এখন বিভোর! এক বুক ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে নতুন একটা পৃথিবী গড়ে দিবে সে রুহিকে। অল্প হাসলো রুহি। বেচারা না জানি কতোটা অসহায় অবস্থায় আছে। বাবা-মাকে কীভাবে জানাবে এসব? আর ওনারা রুহিকে মানবে তো? ভাবনার প্রহর কাটিয়ে উঠতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। ইভারা এসেছে বোধহয়। পড়ন্ত বিকেলের রোদে চায়ের কাপটা রেখে উঠলো রুহি। চমৎকার শেষবিকেলের দৃশ্য। বাগানবিলাসীরা যেন হাওয়ার সাথে পাঞ্জা লড়ছে। চারপাশে কেমন নীরব-নিস্তব্ধ আর উৎফুল্ল। প্রাণের সঞ্চার করেছে বৃষ্টিরা প্রকৃতিতে। জল-ফড়িংয়ের দলেরা উড়ুউড়ি করছে। সোনাবরণ রোদ্দুরে ঝকমক করছে পুরো পৃথিবী! রুহির বারবার কেমন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, ‘এতো সুন্দর হওয়ার কোনো দরকার ছিলো পৃথিবী?’

_____

এই নিয়ে চার গ্লাস পানি শেষ করলো বিভোর। নাসিমা চৌধুরী এবার বিরক্ত হয়ে ছেলেকে ধমক লাগালেন। তিনি বুঝতেই পারছেন না বিভোর এতোটা নার্ভাস হয়ে আছে কেন!

বিভোর নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই পারছেনা। কীভাবে বলবে যে সে বিবাহিত? বাবা তো নির্ঘাত ওকে কথা শুনাবে। মনে হচ্ছে এই কথাটা বাবাকে বলার চেয়ে ডাক্তারির পড়া করা ভীষণ সহজ। নাসিমা আর বাবর চৌধুরী পুত্রের মুখের দিকে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে। কি বলতে চায় বিভোর? এতো ইতস্তত করার মানে কী?

মুখচোখ রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে বিভোরের। ও একটু বেশিই ফর্সা। যার দরুন লজ্জ্বা বা অতিরিক্ত টেনশনে টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করে। নাসিমা চৌধুরী ওর এই অবস্থা দেখে উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হয়েছে বাবা তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?’

মিনমিন করে বিভোর বলল,

‘না আম্মু।’

‘তাহলে চেহারার এই অবস্থা কেন? কিছু খাওনি নাকি দুপুরে?’

‘না না খেয়েছি। একচুয়েলি আজ খুব গরম তো, তাই এরকম লাগছে।’

বাবর চৌধুরী মা-ছেলের কথার মাঝখানে বাগড়া দিয়ে বললেন,

‘শুনো, আমি তোমার বাবা। চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সিরিয়াস কোনো কথা বলতে চাও। তাই ঝটপট বলে ফেলো আর নিজেকে সামলাও।’

বিভোর নতমুখে বলল,

‘আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা শুনলে তুমি নিজেকেই সামলাতে পারবেনা আব্বু।’

‘তবুও শুনি কী বলতে চাও!’

বলতে গিয়ে আবার আটকালো বিভোর। কণ্ঠনালী যেন কেউ চেপে ধরে রেখেছে। আওয়াজই বেরুতে চাচ্ছেনা। বিভোর আরও একগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেলো। তারপর ধীরেসুস্থে বসলো। নাসিমা সন্দেহী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছেন। বিভোর শান্ত গলায় বাবর চৌধুরীর উদ্দেশ্য বলল,

‘কথাটা কিন্তু ভীষণ সিরিয়াস। তোমরা প্রচুর শকড হবে। ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ!’

বাবর চৌধুরী তাচ্ছিল্য করে বললেন,

‘হুম। মানলাম ভীষণ সিরিয়াস।’

‘আমাকে কিন্তু ভুল বুঝবেনা।’

দাঁতে দাঁত চেপে বাবর চৌধুরী বলল,

‘বলো এবার।’

‘আব্বু তুমি আমাকে বিয়ে দিতে চাও, তাইনা?’

বাবর চৌধুরীর চোখদুটো চকচক করে ওঠলো। তিনি উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন,

‘অবশ্যই চাই। কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করার কী আছে? প্রতিটা বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে স্যাটেল দেখতে চায়। তোমার তো অনেক বয়স হলো, সেই কবে থেকে বলছি বিয়ে কর, বিয়ে কর। আমার কোনো কথাকেই তো পাত্তা দাওনি!’

বিভোর অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকালো। বলল,

‘আমি এবার বিয়ে করতে চাই।’

নাসিমা অবাক হয়ে বললেন,

‘ভালো তো। কিন্তু ডিসিশনটা কী আমাদের জোড়াজুড়িতে নিয়েছো? নাকি নিজের ইচ্ছায়? শুনো, জোড় করে কিন্তু কিছু হয়না। বিয়ের পরে তুমি কিন্তু টালবাহানা করতে পারবেনা। তাই যা সিদ্ধান্ত নেবার তা ভেবেচিন্তে নাও।’

বাবর চৌধুরীও কঠিন চেহারায় নাসিমার কথায় সায় জানালেন। ওনি একটু হতভম্বই হয়েছেন। যে ছেলেকে বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিয়ে করানোর জন্য তিনি কলুর বলদের মতো ঘানি টানছে সেই বিভোর নিজ থেকে আজ বিয়ের কথা বলছে। স্ট্রেঞ্জ! নাসিমা ছোটছোট চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একঘেয়ে, বিরক্তকর এবং একইসাথে ভয়ংকর কয়েকটা মুহূর্ত পার হবার পরে নিস্তব্ধতা ভেঙে বিভোর মৃদু কাঁপা গলায় বলল,

‘আমার বিয়ে করে ফেলেছি আব্বু।’

নাসিমা এবং বাবর চৌধুরী দুজনেই চমকে উঠলো। প্রায় একসাথেই চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘কী বলছো তুমি বিভোর?’

বিভোর কথাটা বলে একটা প্রশান্তির হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। আসল কথাটা বলেছে, এবার সেকেন্ড টপিক অর্থাৎ রক্তজবার কথাটা বলতে পারলেই ওর বুক থেকে একটা পাথর নেমে যাবে। বলল,

‘হুম আব্বু। পিওর সত্য কথা বলছি আমি।’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here