“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৮০

0
2610

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮০
(নূর নাফিসা)
.
.
বাসায় ফিরে মেহেদীকে পেল না। ফ্ল্যাটের তালা খুলে জহিরুল ইসলাম মেহেদীকে কল করলে মেহেদী বললো সে বাসায় আসছে। নাহিদা রুমে এসে দেখলো খাটে শপিং ব্যাগ রাখা আছে। প্যাকেট একটু ফাক করে কাপড় দেখতে পেল। অত:পর চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে তারপর প্যাকেট খুললো। একটাতে টিশার্ট, আরেকটাতে প্যান্ট এবং আরেকটায় বোরকা! নাহিদা বোরকাটা খুলে দেখলো স্টোনের হালকা কাজ করা। দেখতে খুবই সুন্দর। মাত্রই মেহেদী রুমে এসেছে। নাহিদাকে বোরকা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে বললো,
– পড়ে দেখো তো, ঠিক আছে কি-না!
নাহিদা তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কখন এসেছো বাসায়?
– তোমরা যাওয়ার সময় বের হওয়ার পর এগারোটার দিকে এসেছিলাম। গোসল করে আবার বেরিয়েছি যোহরের নামাজ পড়ে ফিরেছি। সারা দুপুর ঘুমিয়ে আসরের পর আবার বেরিয়েছি।
– সারাদিন তো বাসায়ই কাটালে। কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ তো দেখলাম না। তাহলে গেলে না কেন? আশিকের জন্য?
মেহেদী ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো,
– এমন কিছু হলে তোমাকেও যেতে দিতাম না।
– এ ছাড়া তো আমি অন্য কোনো কারণ দেখছি না! এখনো কি বিশ্বাস করতে পারছো না আমাকে?
– অযথা রেগে যাচ্ছো কেন! বলেছি তো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিলো।
– কোথায় তোমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ? সারাদিন ঘুমিয়েছো আর শপিং করেছো এটাই তোমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ?
নাহিদার গলার স্বর আস্তে আস্তে বেড়ে গেছে, সাথে চোখে অশ্রু এসে ভীড় জমিয়েছে। সে রাগলেও মেহেদী একটুও রাগ দেখালো না। কারণ সে জানে বর্তমান অবস্থার কারণে নাহিদার মেজাজ এখন একটু খিটখিটে হয়ে গেছে। মেহেদী শান্তভাবে তার পাশে এসে তার বাহু ধরে বললো,
– সত্যিই কাজ ছিলো। তা না হলে কি আব্বু জোর করতো না আমাকে তোমাদের সাথে যাওয়ার জন্য? সাড়ে দশটার দিকে এক লোকের সাথে দেখা করার কথা ছিলো। অফিস থেকে লোন নিয়েছিলো, আজ পরিশোধ করবে বলেছে। তাই অফডে হওয়া সত্ত্বেও যেতে হয়েছে অফিস। আমি অফিস যাওয়ার পর কল করে বললো তার একটু সমস্যা, এখন আসতে পারবে না। তাই বিকেলে আসবে। এরপর লোকের আসতে আসতে সন্ধ্যা! এই মাত্র চেক নিয়ে এলাম। বিশ্বাস না হলে এই যে দেখো..
মেহেদী পকেট থেকে চেক বের করে দেখালো। নাহিদা বললো,
– তো, এটা পরে দেওয়া যেতো না! আর বিকেলে আসবে যেহেতু তুমি দুপুরে যেতে পারলে না কেন?
– এটা লক্ষাধিক টাকার ব্যাপার। ডেট ঘোরাতে ঘোরাতে আজ দিবে বলেছে৷ তাই প্রাধান্য দিতে হয়েছে। আর তোমরা চলে গেছো সেখানে আমি একা যাই কিভাবে। তাই আর যাইনি। তাছাড়া এই যে, এসেছো সন্ধ্যায়। লোকের কথার নেই স্টেশন! আমি যেতাম কল করলে আবার তারাহুরো করে চলে আসতাম এটা কি ভালো দেখাতো!
নাহিদা চোখ মুছতে মুছতে বললো,
– দুপুরে খেয়েছো কিছু?
– এতোক্ষণে না লাইনে এলে। একটা কেক খেয়ে ঘুম দিয়েছিলাম। আর কিছু না।
– কেন, রেস্টুরেন্ট ছিলো না? দিনদিন খাওয়া একদম ভুলে গেছে! আগে তো তিনবেলা রেস্টুরেন্ট টাকা ফেলা হতো। আর এখন প্রয়োজনেও কেন নয়?
– আসলেই তোমার মতো না-খাদকের সাথে থাকতে থাকতে খাওয়া ভুলে গেছি! এবার পড়ে দেখো তো বোরকাটা। আমিও দেখি।
– এসব বোরকা এনেছো কেন? আমি এসব পড়ি? আর এখন বোরকারই প্রয়োজন ছিলো না। যথেষ্ট আছে।
– প্রয়োজন আছে বলেই এনেছি। পড়…
নাহিদা বোরকা পড়লো। কফি কালারটা ভালোই মানিয়েছে তাকে৷ তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে। বোরকা পড়ার পর মেহেদী তার পেটের দিকেই বেশি তাকিয়েছে৷ নাহিদাও এবার আন্দাজ করতে পেরেছে কেন এনেছে এই বোরকা! পরক্ষণে বললো,
– হয়েছে দেখা? খুলে ফেলবো?
– হুম। এখন থেকে এটা পড়ে ভার্সিটি যাবে। আর আগের গুলো আলমারিতেই থাকুক আপাতত।
– কেন?
– এমনি।
– হুহ্, এমনি! কেন বলছে বুঝিনা না-কি!
বিড়বিড় করে বললেও মেহেদী বুঝতে পেরেছে। এসি টা অন করে সে ধপাস করে খাটে শুয়ে পড়লো এবং বললো,
– বুঝোই তো সব। আবার জিজ্ঞেস করো কেন?
নাহিদা বোরকাসহ বাকি প্যাকেটগুলো রেখে মেহেদীর দিকে তাকাতেই মেহেদী হাত বাড়িয়ে ইশারা করলো তার কাছে যাওয়ার জন্য। নাহিদা এসে পাশে বসে বললো,
– কি?
মেহেদী তাকে টেনে তার হাতের উপর শুয়িয়ে দিয়ে একটু আদুরে গলায় বললো,
– মাঝে মাঝে শাড়ি পড়তে পারো না বাসায়?
– ইশ! শখ কতো! ছাড়ো, রান্না বসাতে হবে৷
– উহুম।
– বালিশ ছাড়া শুয়েছো কেন। উঠো।
মেহেদী মুহুর্তেই ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। না নিয়েছে বালিশ আর না ছেড়েছে নাহিদাকে। নাহিদা তার নাক টেনে ধরলো, তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না! এবার নাহিদা বললো,
– অনেক দিন হলো বাসায় যাই না। বেড়াতে যাবো না?
মেহেদীর কোনো সাড়া নেই! নাহিদা তার গালের উপর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বললো,
– সিরিয়াস কথা বলছি তো!
– আজ দেখা হয়নি বাবামায়ের সাথে?
– এটুকু সময়ের জন্য! বাড়িতে গিয়েও তো কিছুদিন থাকতে ইচ্ছে হয়।
– ওকে, যাবে।
– কবে যাবো?
– পরে।
– আজ নাফিসা গেছে। একসাথে বেড়াতে গেলেই তো ভালো লাগে।
মেহেদী এবার চোখ খুলে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। আর নাহিদার মুখটা মলিন হয়ে গেছে! সে ভেবে নিয়েছে মেহেদী নারাজ! তাই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মেহেদী তার দুই গাল এক হাতে চেপে ধরে বললো,
– বাবুর সাথে একটু কথা বলছিলাম, শান্তি দিলো না বাবুর আম্মু! যাও, কাল সকালে অফিস যাওয়ার আগে দিয়ে আসবো। দুদিন পর বিকেলে অফিস থেকে ফিরে আবার নিয়ে আসবো। এবার তো একটু চুপ থাকো।
নাহিদা এবার খুশিমনে চুপচাপ মিশে রইলো মেহেদীর সাথে।
বাসায় ফিরে নাফিসা তার মায়ের হাতে কাগজে মোড়ানো কিছু দিলো।
– এটা কি?
– নাকফুল। আসার সময় আম্মা দিয়ে দিছে নাক ফুটো করে যেন পড়ি। এখন আমি তো নাক ফুটো করবো না। তাহলে কিভাবে কি করা যায় বলোতো একটু। এটাকে কি কোনোভাবে চাপ দিয়ে লাগানো পিন বানানো যাবে?
– একটা মাইর দিয়ে নাক ফাটিয়ে ফেলবো! শ্বাশুড়ি শখ করে দিয়েছে আর সে চাপ পিন বানাতে যায়! কাল ফুফু আম্মাকে ডাকবো নাক ফুটিয়ে দেওয়ার জন্য।
– মাইর দিয়ে নাক ফাটাবে তো তোমার ফুফু আম্মাকে আবার ডাকার কি প্রয়োজন! ফাটার মধ্যেই না হয় ফুল পড়ে নিবো!
রুমানা বেগম হেসে উঠলো নাফিসার কথায়। পরক্ষণে হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কে দিয়েছে এই বালা? তোর শ্বাশুড়ি?
– বড়মা দিয়েছে। আর আম্মা এই প্রথম আজ নাকফুল দিলো৷
– আমিও তো বালা বানিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন তো হাতটানের সময় তারাহুরো করে সব হয়ে গেলো! আরও কিছুদিন যাক, দেখি খামারে একটু ভালো আয় হলে নাজিয়া নাহিদার টার চেয়েও বেশি মোটা করে বানিয়ে দিবো তোকে।
– লাগবে না আমার ওসব। মোটা করে বানিয়ে তুমিই পড়ে থেকো। এইটা পড়েই যেই যন্ত্রণায় আছি! কোনো কাজে হাত লাগাতে গেলে মহা ঝামেলা সৃষ্টি করে!
– পড়তে পড়তেই অভ্যাস হয়ে যাবে। আর শোন, ওবাড়িতে সবার কথামতো চলবি তো আদর পাবি। বাবামায়ের সম্মান বাঁচিয়ে রাখিস শ্বশুর বাড়িতে। আর শ্বশুর বাড়ির সম্মানও বাঁচিয়ে রাখবি বাবার বাড়িতে। দুটোই তোর পরিবার। কাউকে কোনোদিকে ছোট হতে দিস না। আর ইমরানের কথা একদমই অমান্য করবি না।
– তোমাদের দেওয়া এতো রুলস আমার মনে রাখা সম্ভব না। শুনতে শুনতে ক্লান্ত! বেড়াতে এসেছি এখনো শান্তি নেই। এর চেয়ে ভালো লিস্ট করে দিও, সময় নিয়ে পড়ে নিবো।
– বড্ড বেশি মজা করতে জানিস!
– মজা না করলে থামো নাকি আম্মাজান! যেই জ্ঞান দিতে থাকো, আমার ব্রেইনে জায়গা হয় না! আর শুনো, নাক ফুটো করবো না ফাইনাল ডিসিশন। প্রয়োজনে ওবাড়িতে যাওয়ার সময় দোকান থেকে টিপ নত কিনে নিয়ে যাবো। এটা এখানেই থাকুক। শ্বাশুড়ি আম্মার চোখের আড়ালে। আর ফেরত চাইলে নিয়ে ফেরত দিয়ে দিবো।
– সাহস কত বড় মাইয়ার!
– ঠিক তোমার মাইয়া যত বড়… হিহিহি…
রাত এগারোটার দিকে ঘুমাতে গেলেও ঘুম আসছে না চোখে! তাই একটু অনলাইনে ভ্রমণ করতে গেলো। তিন চার মিনিট অতিক্রম হতেই ইমরানের আইডি থেকে মেসেজ! সিন করে দেখলো,
“ঘুমাসনি কেন রে?”
অটোমেটিক নাফিসার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে! সে-ও রিপ্লাই করলো,
“আমি ঘুমিয়ে গেলে তোর তদারকি করবে কে?”
“ঠিকই তো! তা তদারকি করে কি অনুসন্ধান করতে পারলি?”
“মাত্রই অনুসন্ধানে নেমেছি আর অমনি তোর মেসেজ! আপাতত এইটুকু নিশ্চিত, তুই ঘুমাসনি! আচ্ছা, তুই ঘুমাসনি কেন রে?”
“ক্যামনে ঘুমাই বলতো! বউ যে আজ গলা জড়িয়ে ঘুমালো না!”
“ইশ, কি আমেজ! তা, বউ ছাড়া এখন কি করছিলি?”
“বউ তো আমাকে একা রেখে বাপের বাড়ি গেছে, তাই একটু মাস্তিতে নেমেছি!”
“মাস্তি! পাশে কে? তোর গার্লফ্রেন্ড নাকি?”
“না, বয়ফ্রেন্ড”
“নাম কি ছোকড়ার?”
“আশিক”
“ভাইয়া যায়নি পরে?”
“না, রেখে দিয়েছি আজ।”
“মাস্তি কি বাইরে না ঘরে?”
“তোর আমার শয়নঘরে।”
“ভাইকে দেখিয়ে বউয়ের সাথে আলাপ করছিস, লজ্জা করে না! ছি!”
“বিপরীতমুখী তো। ভাই একদিকে আমি আরেকদিকে।”
“যেই কচ্ছপ ভাই তোর, দেখ আবার উঁকি মেরে দেখছে কি-না!”
ইমরান পেছনে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই উঁকি মেরে আছে আশিক! ইমরানকে তাকাতে দেখে আশিক বললো,
– ভাই! ভাবি তোমাকে তুইতোকারি করে! আর কতবড় কোটনা দম্পতি তোমরা, অন্যকে নিয়ে সমালোচনা করো। এটা কিন্তু ঠিক না ভাই! আমার বাড়ন্ত বয়সে দুজন মিলে আমাকে পঁঁচিয়ে ফেলছো!
ইমরান নাফিসাকে রিপ্লাই করলো,
“সত্যিই আশিক উঁকি মেরে দেখছিলো বউ! দাড়াও, তার আগে স্পেশাল ক্লাস নিয়ে নেই।”
নাফিসা হাসতে হাসতে টাইপ করলো,
“ক্লাস নে তুই, ঘুম চলে আসছে আমার। গুড নাইট ফর আস, বেড না ফর আশিক ভাই….!”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here