“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮১
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যায় বলা মেহেদীর কথামতো সকালে অফিস যাওয়ার পূর্বে নাহিদাকে বাবার বাসায় রেখে গেছে আর সবার সাথে দেখা করে গেছে। ওবাড়ি থেকে আসার সময় মেহেরুন ইসলামের নানান সতর্কবাণী, বাসায় আসার পর ফোন কলে মেহতাজেরও সতর্কবাণী নাহিদার জন্য। রুমানা ও নাফিসা উভয়ের কাছেই ভালো লেগেছে নাহিদার প্রতি তার শ্বশুর বাড়ির কেয়ারনেস।
নাফিসা নাহিদার বোরকা দেখে বললো,
– সুন্দর তো বোরকাটা। দাম কত হয়েছে? কোথা থেকে কিনছো?
– আমি জানি না কিছু। তোর ভাইয়া এনে দিছে।
– জিজ্ঞেস করোনি কিছু?
– উহুম।
এদিকে নাহিদার উপস্থিতি দেখে নাফিসা নাজিয়াকে বারবার কল করে বিরক্ত করে ফেলছে এখানে আসার জন্য। নাজিয়ারও মন মানছে না। এমনিতেও ইচ্ছে করছিলো মায়ের কাছে কিছুদিন থেকে আসার, এখন বোনরা একসাথে যাওয়াতে আরও বেশি ইচ্ছে করছে! কিন্তু তাকে কি যেতে দিবে! রুমানা বেগম বলেছিলো আয়েশা বেগমের সাথে কথা বলবে। কিন্তু নাজিয়া নিষেধ করলো। ভয় একটাই, আয়েশা বেগম তার সাথে তেমন একটা কথা বলে না। সেই যে তার শ্বশুর বকাঝকা করেছিলো এখনো রেগে আছে তার উপর। এখন মা কথা বললে যদি উল্টাপাল্টা কিছু শোনায়, এখানেই তার ভয়। পরক্ষণে নাজিয়াই সুযোগ বুঝে কথা তুললো।
– আম্মা, নাহিদা নাফিসা বাসায় এসেছে। মা আমাকেও বলছিলো যাওয়ার জন্য। যাবো?
আয়েশা বেগম তার কোনো প্রত্যুত্তর করলো না! নাজিয়ার মনটা একটু বিষন্ন হয়ে গেছে! সে আর কোনো কথা বললো না। মাঝে মাঝে নিরবতাই অনেক কিছু বলে দেয়। এখনও স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আয়েশা বেগম অসন্তুষ্ট তার আবেদনে! সারাটাদিন বিষন্ন মনেই কাটালো সে। দুপুরে আরাফ কল করেছিলো একটু কথা বলার জন্য। তখন বিষন্নতা চাপা রেখে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিলো তার সাথে। তবুও আরাফ জিজ্ঞেস করেছে,
“মন খারাপ?”
“উহু।”
“মিথ্যে বলছো না?”
নাজিয়া চুপ করে রইলো। এতো কিছু বুঝে যায় কেন সে! নাকি দোষ তার নিজের, যে ঠিকমতো চাপাও রাখতে পারে না! তা ই যদি হয়ে থাকে তো অন্যরা বুঝে না কেন! নাজিয়াকে চুপ থাকতে দেখে আরাফ বললো,
“নাফিসা কল করেছিলো। নাহিদাও এসেছে ওবাড়িতে। তুমি যাবে?”
“উহু।”
“কেন?”
“এমনি।”
“যেতে ইচ্ছে হলে বলো, বাবার কাছে পারমিশন নিয়ে আমি আশিককে বলে দেই বিকেলে পৌছে দিয়ে আসতে। আমি তো কোচিং রেখে সন্ধ্যার আগে ফিরতে পারবো না।”
“না, যাবো না।”
” কিছু বলবে?”
“উহু।”
“আচ্ছা, রাখি এখন। ক্লাসে যাবো।”
“ওকে”
“আর তুমি, কাজগুলো একপাশে চাপিয়ে রেখে একটু ঘুমাও।”
নাজিয়া শেষ দুপুরে ঘুমিয়েছিলো। আসরের আযান পড়েছে তা-ও শুনতে পায়নি। ঘুম ভাঙলো আয়েশা বেগমের ডাকে।
– আযান দিছে এহনো ঘুমাইতাছো কে? উঠো, তোমার বাপে আইছে।
নাজিয়া বিছানা পত্র গুছিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আলফাজ সাহেবের ঘরে এলো। নিয়াজ উদ্দিনকে দেখে সালাম দিলো। নিয়াজ উদ্দিন সালামের জবাব দিলে নাজিয়া বললো,
– বাবা তুমি এসময়? আসবে যে আগে তো কেউ কিছু বললো না!
– এদিকে আসছিলাম হাটতে হাটতে। ভাবলাম বড় আম্মাকে দেখে যাই৷
নাজিয়া মুচকি হেসে বললো,
– বসো, আমি চা নিয়ে আসি।
– না, কিছু করতে হবে না। আমি চলে যাবো।
আলফাজ সাহেব বললো,
– আরে, থাকেন তো আরেকটু গল্পগুজব করি। রাতে খাওয়ার পর যাবেন।
– না, বেয়াই। তা হয় না।
– চাইলেই হইবো। নাজিয়া চা দিয়ো।
নাজিয়া চলে গেলো চা বিস্কুট আনতে। এদিকে কথায় কথায় নিয়াজ উদ্দিন আলফাজ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলো নাজিয়াকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দুই মেয়ে বাড়িতে আছে বড় মেয়েটা গেলেও ভালো লাগবে। আর এখানে আসার আইডিয়াটা ছিলো নাফিসার। এমনি কল করে বললেও আলফাজ সাহেব নিষেধ করতো না। কিন্তু আরাফ তো ব্যস্ত মানুষ। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে রাতে কি আর নিয়ে যেতে পারবে! তাই নাফিসা তার বাবাকেই বলে পাঠিয়ে দিলো নিয়ে আসার জন্য।
চা বিস্কুট নিয়ে আসার পর যখন আলফাজ সাহেব নিজেই জিজ্ঞেস করলেন নাজিয়া যাবে কিনা? নাজিয়া তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়েছিলো একবার। নিয়াজ উদ্দিন যখন বললেন,
– নাহিদা নাফিসা এসেছে, তবে নাজিয়া কেন যাবে না?
পরক্ষণে নাজিয়া হাসি মুখে বলে দিলো, “আম্মা বললে যাবো।”
আলফাজ সাহেব আয়েশা বেগমকে ডেকে বলে দিলো নাজিয়া আজ তার বাবার সাথে বাড়ি যাবে। আয়েশা বেগম বলে দিলেন যাওয়ার হলে যেন সন্ধ্যার আগেই যায়। সন্ধ্যা বেলা যেনো বাড়ির বাইরে ঘুরাঘুরি না করে। নাজিয়া খুশি হয়ে আসরের ফরজ নামাজ আদায় করে নিলো। পরক্ষণে রেডি হয়ে আরাফকে জানিয়ে সন্ধ্যার আগেই বাবার সাথে রওনা দিলো। রিকশায় থাকাকালীন বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা তুমি আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এসেছো না?”
প্রত্যুত্তরে নিয়াজ উদ্দিন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আর মনে মনে এই ভাবলেন, “নিজের মেয়ের উপর আজ নিজেরই অধিকার নেই। মেয়েকে আনতে যাবে তবুও কত কৌশলে প্রস্তাব করতে হয় শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কাছে! “হ্যাঁ” বলবে তো নিয়ে যাও আর “না” বলবে তো রেখে যাও! আযব নিয়তির খেলা! বিয়ে দেওয়া মানেই মেয়ে পর করে দেওয়া। হুহ্!”
বহুদিন পর ঘরটা পূর্বের ন্যায় কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠলো। তৃ-তনয়াকে কাছে পেয়ে আজ বাবা মায়ের মনটাও ভরে উঠলো। নয়টা দশটার ঘুম আজ বারোটা একটায়! গল্পগুজবেই কাটছে সময়। সকালে নাজিয়া আরাফকে কল করে বললো,
“দেখা করে আসিনি বলে রাগ করেছো?”
“উহুম।”
“তাহলে কল দাওনি যে একবারও!”
“কতদিন পর বেড়াতে গেলে, সবাই একসাথে গল্প করবে আড্ডা দিবে তাই আর বিরক্ত করিনি।”
“এভাবে কথা বলছো কেন? তুমি রেগে আছো না আমার উপর?”
“কেউ যদি ইতিবাচক মনোভাবকে নেতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করে তো আমার কি করার আছে বলো?”
“তোমার কথার ধরন বাধ্য করছে নেতিবাচক মনোভাবে গ্রহণ করতে!”
মুহুর্তেই আরাফ তার কথার ধরন পাল্টে বললো,
“উম্মে আরোহী, আমার ব্লু শার্টটা আয়রন করেছিলে?”
“হ্যাঁ”
“কোথায় রেখেছো?”
“আলমারিতে, সামনেই রাখা আছে।”
“জান, আমার কালো প্যান্টটা দেখেছো? আয়াতের বিয়ের পর যে বানিয়েছিলাম?”
“আলমারিতেই থাকে।”
“অহ, আচ্ছা। মিসেস আরাফ, আমার গ্রিন চেক লুঙ্গিটা দেখেছো?”
নাজিয়া হেসে উঠলো এবং বললো,
“গোসল করেছো?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে তোমার পরনেই আছে।”
“ওকে, এবার ঠিক আছে কথা?”
“একটু বেশিই হয়ে গেছে।”
“আচ্ছা, কমবেশি মিলিয়ে সমান করে নাও।”
“স্কুলের জন্য রেডি হচ্ছো নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“সবসময় ওই প্যান্ট দুটোই কেন পড়, মাঝে মাঝে জিন্স পড়েও তো যেতে পারো। একের পর এক চেঞ্জ করে পড়লে নতুনত্ব বজায় থাকে।”
“ওটা তো আমার স্কুল ড্রেস, জানো না!”
“এহ! যেন স্কুল থেকে নির্ধারিত করে দিয়েছে!”
আরাফ হেসে বললো,
“জিন্স পড়লে পিচ্চি পিচ্চি মনে হয়। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কেমন যেনো বেমানান! আমি যেখানে কাউকে শিক্ষা দিতে যাবো সেখানে যদি টিশার্ট, জিন্স পড়ে এমন পিচ্চি সেজে বসে থাকি তাহলে কি শিক্ষার্থীরা আমাকে অনুসরণ করতে অনুপ্রানিত হবে? শিক্ষক না ছাত্র বুঝতেই অসুবিধা হয়ে যাবে। একজন শিক্ষককে সবদিক থেকে অবশ্যই এমন মুডে থাকতে হবে যাতে আশেপাশের সকলে এক পলকেই চিহ্নিত করতে পারে ইনি একজন আদর্শ শিক্ষক। আর আমি মনে করি, বেড়াতে গেলে জিন্স পড়াটা মানানসই। বুঝতে পেরেছো?”
“হুম, মাস্টার সাহেব। খুব ভালো বুঝেছি। এবার সময় বাঁঁচিয়ে রেডি হয়ে যান, নতুবা আপনার লেট হবে।”
“যথা আজ্ঞে মিসেস।”
“ঘুম হয়েছিলো রাতে?”
“একটু সমস্যা তো হয়েছিলোই! তবে ঘুমিয়েছি।”
“আচ্ছা, তারাহুরোর প্রয়োজন নেই। খাওয়ার সময় ধীরে সুস্থে খেয়ো।”
“ওকে।”
“আর শুনো, ভালোবাসি আমার মাস্টারকে।”
“আর আমি, আরও ভালোবাসতে চাই তোমার মাস্টারের মিসেসকে।”
আস্তে করে শেষ কথাটা বলার সময়ই কারো উপস্থিতি টের পেয়েছিলো রুমে। আর এখন কল কেটে পেছনে ফিরে দেখলো নাফিসা দাত চেপে হেসে দুই কানে আঙুল দিয়ে দাড়িয়ে আছে। আর নাজিয়া তাকানোর সাথে সাথেই বললো,
– মনে হয়, শুনিনি কিছু।
নাজিয়া চোখ পাকাতেই নাফিসা হেসে পালিয়ে যেতে যেতে বললো,
– নাস্তা করতে এসো।
পরদিন দুপুরে নাফিসা যখন ঘুমাচ্ছিলো, হঠাৎই তার ঘুমটা ভেঙে গেছে! যেন কেউ তাকে ঘুমের মধ্যে বেত্রাঘাত করেছে! ঘটনা হঠাৎই সংঘটিত হওয়ায় সে ধরফরিয়ে উঠার চেষ্টা করলো কিন্তু চেষ্টা বৃথা! চারপাশে এতো লোক তাকে ঘেরাও করে বিছানায় চেপে রেখেছে। চাইতেও মিলছে না মুক্তি! যেন কেউ তাকে হত্যা করতে এসেছে। হত্যা তো করেছে ঠিকই কিন্তু পুরোপুরিভাবে না! অর্ধহত্যা! তার অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে,মুখ খোলা থাকতেও চিৎকার করতে পারছে না! এটা কি স্বপ্নের মধ্যে হত্যা করা হচ্ছে নাকি বুঝতে পারছে না কিছু! আরও দুমিনিট তাকে আটকে রেখে ছেড়ে দিতেই নাফিসা উঠে বসে খুব বড়সড় এক নিশ্বাস ছাড়লো। পরক্ষণে নাকে ব্যাথা অনুভব করলো! নাকে হাত দিয়ে দেখে নাকফুল! তার সামনে নাহিদা নাজিয়া সহ পাশের বাসার পার্লারে কর্মরত আপুটা! হাতে এতোবড় মেশিন! তাহলে কেউ বেত্রাঘাত করেনি! মেশিন দিয়ে তার নাক ফুটো করে ফেলা হয়েছে! এরপর বিনা বচনে শুরু হলো চিৎকার! এএএএ….. করে আছে তো আছেই! আশেপাশের সবাই হেসে উঠলো।
রুমানা বেগম বলে গেলো,
– ঢং দেখলে আর বাচিনা!
আর নাজিয়া তার মুখ চেপে ধরে বললো,
– কাদে না সোনাপাখি। কিচ্ছু হয়নি।
ওদিকে পার্লারের মেয়েটি বললো,
– যখন ফুটো করলাম তখন কাদলি না, আর এখন এএএ…? চুপ কর, কিছু হবে না। একটু পর দেখবি ব্যাথা গায়েব হয়ে গেছে।
– এএএ….আমি ব্যাথা পাচ্ছি! পড়বো না নাকফুল। নাক কেটে ফেলে দিবো। এএএ…
নাহিদা বললো,
– আয়, বটি দিয়ে কেটে দেই।
– কেউ কথা বলবে না আমার সাথে। সবগুলা ডাকাত। উউউউ….উহু উহু হু…!
পার্লারের মেয়েটি বললো,
– নাজিয়া, টক খেতে দিস না এই পেতনিকে। আমি যাই।
– দাড়া, একটু।
মেয়েটি বুঝতে পেরেছে টাকা দেওয়ার জন্য বলছিলো। কিন্তু সে টাকা নিবে না। সম্পর্কে তার প্রতিবেশী আপু হয়, আবার নাজিয়ার সাথে পড়াশোনা এবং চলাফেরা। নাজিয়া জোর করেও তাকে দাড় করাতে পারলো না। টাকা না নিলেও রুমানা বেগম ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে দিলে একটা নিয়ে চলে গেলো। রুমানা বেগম সুই সুতা দিয়ে নাক ফুটানোর কথা বলতেই নাজিয়া, নাহিদা উভয়েই বললো, এত ঝামেলার প্রয়োজন নেই। মেশিন দিয়ে একেবারে ফুল বসিয়ে দিবে সেটাই ভালো। তারা দুজনেই বুদ্ধি করে এই ঘুমের মধ্যে কাজ সেড়ে নিলো।
আর এখন নাফিসা কান্না করছে বলে নাহিদা আরও দুষ্টুমি শুরু করেছে হাতে ফোন নিয়ে। নাফিসার কান্নার ছবি তুলছে আর বলছে এমন পাগলামি করলে ছবি ইমরানকে দেখাবে। তবুও নাফিসার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অতপর ভিডিও করা শুরু করলো বাবাকে দেখানোর জন্য! একটু পর নিয়াজ উদ্দিন বাড়ি ফিরলে নাহিদা কি ভিডিও দেখাবে, তার আগে নাফিসাই মা সহ দুই বোনের নামে নালিশ করলো কিভাবে তাকে ঘুমের মধ্যে টর্চার করলো। আর মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে চললো নিয়াজ উদ্দিনের ছোট তনয়ার পক্ষ নিয়ে কথা বলা। বিয়ে হয়ে গেছে মেয়ের, তবুও পূর্বের ন্যায় আচরণগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি।