সে_আমার_অসুখ,পর্ব_০৫
লিখা_মুনিয়া_রহমান
রাতে ইবতিয়াজ আমার পরিবারের সকলের সাথে খেতে বসলো।বাবা, দুলা ভাই সকলের সাথেই টুকটাক চাকরি সম্পর্কে কথা বলছে। আমার মাতো ইবতিয়াজের সামনে সব আইটেমের তরকারির বাটি রেখে একটু পর পর আহ্লাদে গদ গদ হয়ে বলছে আরেকটু দেই, আরেকটু দেই। এটা দেখে দুলাভাই বললো
–মা! এ বাড়ির জামাই আমি নাকি ইবতিয়াজ ?
–এ আবার কেমন কথা রুহান।
–না মানে আপনি যেভাবে ওকে আপ্যায়ন করছেন তাতে মনে হচ্ছে ইবতিয়াজ এ বাড়ির জামাই।
মা কিছু বলতে চাইছিলো। আপু মাকে থামিয়ে দিয়ে বললো
–ইবতিয়াজ আমার ভাই। সুতরাং ও তোমার থেকেও স্পেশাল এ বাড়িতে।
আপুর এমন কথায় ইবতিয়াজ একটু কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ করে বললো
–আপু দেখো দেখো তোমার বর আমাকে সহ্য করতে পারছে না। কেমন করে তাকাচ্ছে আমার দিকে। মনে হচ্ছে আমাকেই আস্ত চিবিয়ে খাবে।
ইবতিয়াজের মুখে এমন কথা শুনে আমরা সবাই বিস্ময় নিয়ে ইবতিয়াজের দিকে তাকালাম। দুলাভাই ইবতিয়াজকে বললো
–সেকেন্ডে সেকেন্ডে এত পাল্টি কি করে খাস বলতো তুই ?
–আমি পাল্টি খাই নাকি তুই পাল্টি খাস ?
–আমি আবার কখন পাল্টি খেলাম?
— এই যে বিয়ের আগে তুই কত দানশীল ছিলি। সন্ধ্যা লাগলেই ফোন দিয়ে বলতি, দোস্ত আয়! একটু সুখ, দুঃখের কথা বলি। আমি পৌঁছানোর আগেই পিজ্জা,বার্গার অর্ডার দিয়ে বসে থাকতি।বিয়ের পর তুই তোর শালীর মত কিপ্টা হয়ে গেলি। বিয়ের দিন তোর শালী কি হিসেব করে খাওয়ালো আমায়। আজ আবার তুই আন্টিকে বলছিস আমাকে হিসেব করে খাওয়াতে।
ইবতিয়াজের এমন কথায় দুলাভাই মুখটা কাঁচু মাচু করে বললো
–কর কর তোর যা খুশি কর। দিন একদিন আমারও আসবে।
আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনে মনে বললাম আপনার সে দিন বুঝি এই জীবনে আর আসবেনা দুলাভাই।আসলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবেনা।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে আমি যখন আমার রুমে এলাম। ইবতিয়াজ আমার সাথে সাথে রুমে এলো
আমি একটু রাগ হয়ে বললাম
–আমার সাথে আসতেছেন কেন ?
ইবতিয়াজ আমার খাটে আরাম করে বসে বললো
— ওমা! এত এত খেলাম এখন যদি তোমায় কোন গিফ্ট না দেই পরেতো তুমি নিজেই বলবে এক গরুকে দাওয়াত দিয়েছিলো সে নিজেই সব খেয়ে গেছে। কোন গিফ্ট দেয়নি।
— আমি এমন কিছুই বলবো না।
–তা বললে কি হয়? আমারওতো একটা চক্ষু লজ্জার ব্যাপার আছে।
কথা গুলো বলতে বলতে ইবতিয়াজ ওর পকেট থেকে একটা জুয়েলারি বক্স বের করলো। বক্স খুলে একটা সোনার ব্রেসলেট বের করে ঝট করে আমার ডান হাতে পরিয়ে দিলো। এত তাড়াতাড়ি কাজটা করলো যে আমি কিছু বলার সময় পেলাম না।
–এটা কি?
–এটা কি মানে? এটা একটা গোল্ডের ব্রেসলেট। আর ব্রেসলেট এর মধ্যে যে পাঁচটা পাথর দেখছো ওগুলো কিন্তুু ডায়মন্ড। আবার ভেবোনা এটা গোল্ড প্লেটের। সস্তা মার্কেট থেকে কিনে এনেছি। বক্সের মধ্যে মেমো আছে। একদম সলিড।
আমি এবার ভালো করে ব্রেসলেটটার দিকে তাকালাম। খুবই চমৎকার ব্রেসলেটটা। মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেও আমার পুরো হৃদয় একটা মিষ্টি অনুভূতিতে ছেয়ে গেল কিন্তুু এই অনুভূতি টুকু আমার হৃদয়ে বেশি সময় স্থায়ী হলো না। মনে পড়ে গেল এই মানুষটাইতো অন্যকারও। যার এই একটা গিফ্টে আমার মনে এত এত আনন্দ জড়ো করেছে সে যদি নিজেই আমার জীবনে থেকে যেত তাহলে আমিতো দ্বিতীয় তাজমহল বানিয়ে ফেলতাম মনে হয়।
–কি ব্যাপার বেয়াইনসাফ কোথায় হারালেন ?
আমি নিজেকে সামলে বললাম
–কই হারিয়েছি ? কোথাও হারায়নি আমি?
আচ্ছা! আপনি যার সাথে নিষিদ্ধ ব্যাপার গুলো দেখতে চান। সে ও কি আপনার সাথে নিষিদ্ধ ব্যাপার গুলো দেখতে চায়?
আমার এমন কথায় ইবতিয়াজ হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতে একদম বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়ার মত অবস্থা।
–সে নিজেইতো বললো এই ব্যাপারটার কথা। আমিতো শুধু তার কথায় হ্যা বলেছি।হাজার হোক বউয়ের আবদা বলে কথা।
–বিয়ের আগেই সে এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বললো
–ঝিনুক তুমিতো ম্যাথের স্টুডেন্ট। এই বুদ্ধি নিয়ে ম্যাথ ক্যালকুলেট করো কি করে বলোতো ?
–মানে?
— আমার অত সাহস আছে নাকি যে বউয়ের পারমিশন ছাড়া এগুলোর এরেন্জ করবো। তাকেতো আমি আমার মনের রাণী মানি। তাছাড়া বিয়ের পরতো তার কথা শুনেই আমি চলবো। এরপরও সে যদি দেখতে না চায়। তাহলে সমস্যা নেই। এই নিষিদ্ধ ব্যাপারটা না হয় আমি তোমার সাথেই দেখবো। তাছাড়া সম্পর্কে তুমি আমার বেয়াইন হও। একটা দুষ্টু দুষ্টু সম্পর্কতো তোমার সাথে আমার রয়েছেই। আরও একটু না হয় হবে।
ইবতিয়াজ কথা গুলো বলে একটা চোখ টিপ দিয়ে একদম আমার গায়ের সাথে মিশে বসলো।
ইবতিয়াজের কথা শুনে আমার কান দিয়ে তখন ধোঁয়া বের হচ্ছে। এই ছেলের সাথে কথা বলা মানে ইচ্ছে করে লাল মরিচ গায়ে ডলে নেয়া।
–কি ব্যাপার বেয়াইনসাফ আপনি কি আমার সাথে নিষিদ্ধ ব্যাপার গুলো দেখতে রাজি আছেন ?
–আমি.. আমি মোটেও আপনার সাথে ওসব কিছু দেখবো না।
–কিন্তুু আমারতো খুব ইচ্ছে করে। আমার ডানপাশে আমার বউ আর বাম পাশে এই কালো পরীটা আর মাঝখানে আমি। সামনে সব নিষিদ্ধ ব্যাপার..
ইবতিয়াজ কথা গুলো আমার কানের কাছে এসে একদম ফিশ ফিশ করে বললো
আমার তখন কি হলো আমি নিজেই জানিনা। হুট করে ইবতিয়াজকে জড়িয়ে ধরলাম। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আমার এমন আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় ইবতিয়াজ কিছুটা অপ্রস্তুুত হয়ে পড়লো।আমার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বললো
–কি হয়েছে ঝিনুক? এভাবে কান্না করছো কেন? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো। আমিতো তোমার সাথে মজা করে কথা গুলো বলেছি।
ইবতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছি এই ব্যাপারটা বুঝতে পারতেই দ্রুত ওকে ছেড়ে দিলাম।
–আপনি শুধু মজা না আর কোনদিন কোন কথাই আমার সাথে বলবেন না।
ইবতিয়াজ আমাকে বার বার কিছু বলতে চাইছিলো আমি ওর কথাগুলো না শুনে এক প্রকার জোর করে ঠেলে রুম থেকে বের করে দিলাম।
দরজা আটকিয়ে সারা রাত ফ্লোরে বসে কান্না করলাম। ভয়ংকর এক বাজে অনুভূতির সামিল হলাম সে রাতে। আমি যাকে প্রচণ্ড ভাবে ভালোবাসি। যাকে আমি আমার জীবনে বিশেষভাবে চাই। সেই মানুষটার কোথাও আমি নেই এই ব্যাপারটা ভাবতেই আমার নিশ্বাস বার বার বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো।আমি সে রাতে বুঝতে পারলাম এক পাক্ষিক ভালোবাসার মত ভয়ংকর বাজে অনুভূতি এই পৃথিবীতে বোধহয় আর দ্বিতীয়টি নেই।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলো অনেক বেলা করে। ঘুম ভাঙতেই মনে পড়লো কাল রাতে ইবতিয়াজকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমি। ভাবতেই অনেক অনেক ভালো লাগা কাজ করলো আমার হৃদয়ে। নাইবা হোক সেই মানুষটা আমার তবুওতো তাকে একবার জড়িয়ে ধরেছি এটাই বা কম কি ? এটাই আমার অসুখের জন্য এক চামচ ওষুধ স্বরুপ হুম!
ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই দেখি আপু একটা প্লেটে পরোটা, ডিম ভাজি আর এক কাপ চা নিয়ে বসে আছে। আমি রুমে আসতেই রাগী স্বরে বললো
–কাল রাতে ইবতিয়াজের সাথে তুই কি করেছিস?
আপুর এমন কথা শুনে একটা ঢোক গিললাম।তবে কি আমি যে কাল ওনাকে জড়িয়ে ধরেছি এই ব্যাপারটা উনি আপুকে বলে দিয়েছেন?
–চুপ করে না থেকে বল কাল কি করেছিস ?
–আমি আবার কি করেছি? তা এতই যখন দরদ তোমার ভাইয়ের প্রতি তাহলে তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করোনা তাকে ?
–জিজ্ঞেস করতে হয়নি। সে নিজেই বলেছে।
আমি এবার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম
–কি..কি বলেছে ?
–বলেছে তোকে খুব শীঘ্রই বিয়ে দিয়ে দিতে। বেশি সময় নিলে তুই যে কোন সময় ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারিস। তখন দেখা যাবে আমাদের মান সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে।
–এরকমটা বললো?
–হ্যা। তাইতো আজ সকালে বাবার সাথে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি খুব শীঘ্রই তোর বিয়ের ব্যাবস্থা করবো। আর যাই হোক মানসম্মানতো আর তোর জন্য হারাতে পারবো না।
আমি মনে মনে তখন এই পৃথিবীর জঘন্যতম গালিটা ইবতিয়াজকে দিলাম। আর বললাম ইবতিয়াজ নামটা আমার অসুখ নয় এটা একটা পয়জন। যা আমাকে মৃত্যু পর্যন্ত টেনে না নিয়ে মুক্তি দেবে না।
চলবে