নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_৪,৫
লেখায়_জারিন
পর্ব_৪
১৭.
সেরাতে নক্ষত্র শুয়ে পড়ার পরে ইরিন ঠিক কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ওর পাশে শুতে ইচ্ছে করছিল না ইরিনের । একে তো পুরুষ, তারওপর আবার নক্ষত্রকে পছন্দও হয়নি ওর । এমন একজন পুরুষের সাথে এক বিছানায় শুয়ে থাকা ওর কাছে সহজ লাগছিল না কিছুতেই। সে যতই স্বামী হোক, বৈধ সম্পর্ক হোক। বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। ঘরটাকে আরেকনজর দেখে নিলো ইরিন। সোফায় শোবার চিন্তা করেও বাদ দিলো।এসব নাটক সিনেমার গল্পেই মানায় কেবল।বাস্তবে এসব চরম পর্যায়ের বাড়াবাড়ি। আর সেটা যদি হয় সদ্য বিবাহিত বউ আর রাতটা হয় বিয়ের প্রথম রাত।
এসব দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝেই হঠাৎ চোখ পড়লো বিছানায় রাখা বাক্সটার উপর। ক্লান্তিতে চোখ ভেঙে ঘুম নেমে এলেও মনের অস্বস্তি সে ঘুমকে চোখের পাতায় ঝুঁকতে দিল না। তাই আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও বাক্সটায় কি আছে তা দেখার সিদ্ধান্ত নিল সে। এতে কিছুটা হলেও সময় কাটবে এই ভেবেই।
১৮.
ঘরের বাতি নিভিয়ে ইরিন নিজের পাশের ল্যাম্পশেড জ্বালিয়ে মেঝেতে বসে গেল উপহারটা নিয়ে। খুলতে শুরু করলো ওটাকে। চওড়া বাক্সটা কালো রঙ এর যার্পিং পেপার দিয়ে মোড়ানো। ওপরে কালো ফিতে দিয়েই বাঁধা। আর তাতে এক পাশে গুঁজে রাখা হয়েছিল একটা কালো গোলাপ। এই লোকটার সবতেই কেমন কালোর ছাপ। হুহ! মনটা যে কেমন আল্লাহ মালুম। – মনে মনে ভাবলো ইরিন।
বাক্সটা খুলে বেশ খানিকটা নয়, নিজের পরিসীমার বাইরে চূড়ান্ত পর্যায়ের অবাক হয়েছে সে। কালো মলাটের মাঝারি আকৃতির একটা ডায়রি। সাথে ১১ টা কলম।আর একটা কলম গুঁজে দেওয়া ডায়রির মলাটে। কলমটা হাতে নিয়ে দেখার জন্য ওটা খুলতে গিয়ে দেখলো একটা পাতা সমেত তা মলাটে গুঁজে রাখা। কলম অনুসরণ করে পাতাটা খুলতেই নিজের চূড়ান্ত অবাকের মাত্রাও ছাড়িয়ে গিয়ে তা এবার ওর বিস্ময়ে পরিণত হলো ইরিনের।
ডায়রির পাতাগুলো কালো রঙের। প্রথম পাতায় নজর পড়তে দেখলো একটা নোট লিখা । ছোট ছোট আকৃতির অক্ষরে খুব সুন্দর করে লিখা। হাতের লেখা দেখেই মুগ্ধ হলো ইরিন। চোখের তারায় ঝিলিক দিল সেই মুগ্ধতা। আগ্রহ বাড়লো তার। একপ্রকার ঘোর নিয়েই দ্রুত পড়তে শুরু করলো।
“আমার কাছে অর্থ-বিত্ত কষ্টের অর্জন হলেও সবটাই আবার হাতের ময়লা।আজ আছে তো কাল নেই। যদি সত্যিকার অর্থে জীবনে সম্পদ হিসেবে কিছু থেকে থাকে তা হলো মানুষ ও সম্পর্ক। আর বিশেষভাবে কিছু স্মৃতি। হোক সে সুখের কিংবা কোন খারাপ লাগা অনুভূতির। এগুলোই জীবনের প্রকৃত সঞ্চয় বলেই মনে হয় আমার।
আচ্ছা ইরিন ,তুমি কি কখনো মাটির ব্যাংকে পয়সা জমিয়েছো? কিংবা কোন কৌটার মুখ কেটে তাতে টাকা ভরে রেখেছো কখনো? আবার প্রয়োজনে চুলের ক্লিপ বা পিন দিয়ে খুঁচিয়ে জমানো টাকা/পয়সা বের করেছো কখনো? আমি করতাম ছোটবেলায়। ভীষণ মজার কিন্তু ব্যাপারটা!
অর্থ জমা করতে যেমন নির্দিষ্ট কোন রাখার জায়গা লাগে তেমনি স্মৃতিগুলোকে জমিয়ে রাখতেও কিছু একটার প্রয়োজন হয়।অবশ্যক নয়। তবুও হাতে থাকা নগদ আর ব্যাংক ব্যালেন্সের মাঝে কিছুটা তফাৎ তো থাকেই, না?
স্মৃতি জমানোর জন্য আমার কাছে সেই জায়গাটা হলো ডায়রির পাতা। বয়সের সাথে মস্তিষ্কেও তো জং ধরে। কত কথা, কত স্মৃতি আমরা অচিরেই ভুলে যাই। তাই, লিখে জমিয়ে রাখার ব্যাপারটা কিন্তু মন্দ নয়। আবার সময় অসময়ে পাতা উল্টে দেখাটাও!
চাইলে তুমিও স্মৃতির সঞ্চয়স্থান হিসেবে এই ডায়রিটা ব্যাবহার করতে পারো। সযত্নে তুলে রাখতে পারো জীবনের সুখ দুঃখের গল্পগুলো। বন্ধু ভেবেও ভাগাভাগি করতে পারো নিজের মনের কথা। অর্থ বিত্ত তোমার অনেক হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও হবে আশা করি। তাই সেসব ছেড়ে স্মৃতি সঞ্চয়ের খাতাটাই তোমার হাতে তুলে দিলাম।
সবশেষে…জীবনের নতুন অধ্যায়ে তোমাকে স্বাগতম, ইরিন।”
১৯.
লেখাটা পড়ে কতক্ষণ থম ধরে বসে রইলো ইরিন। মনে মনে ভাবলো, ক্ষীণ হলেও ওই সময়ের মধ্যেই মানুষটার যে ব্যবহারের সাথে ওর পরিচয় ঘটেছে তার সাথে এই লেখার লেখকের স্বভাবের কোন মিল নেই। ওর সাথে প্রয়োজনের বাইরে একটা শব্দও যে ব্যবহার করে না, সেই মানুষটাই এত সুন্দর করে কথা বলতে জানে? তাও বলেছে কাকে? ইরিনকেই! এতসময়ের মাঝে জন্মানো নক্ষত্রেরর প্রতি ধারণায় তীব্রভাবে ঘাত পড়লো ইরিনের।
এবার সে ঘাড় ঘুরিয়ে বিছনায় ঘুমিয়ে থাকা মানুষটাকে দেখলো একবার। ঘুমের মাঝেই পাশ ফিরে ইরিনের মুখোমুখি হয়ে শুয়ে আছে নক্ষত্র। মাথার নিচে এক হাত রেখে অন্য হাত পেটের কাছে গুঁজে রেখে দিব্যি শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। কালো গায়ে কালো রঙের টি-শার্ট। সাদা কালো চেক প্যান্ট। মাথা ভর্তি একঝাঁক কোঁকড়া চুল। ঘরের আধো আলো আধো অন্ধকারের পরিবেশে অনেকটা তথাকথিত কাল্পনিক ভূতের মত ঠেকলো ইরিনের কাছে নক্ষত্রের অবয়ব। বিরক্তির সাথে আবারও চোখ ফিরিয়ে নিল সে। ইরিন ভেবে পায় না, এ বাড়ির সবাই কম বেশি ফর্সা, সুন্দর। তাহলে এই মানুষটা একা কি করে এত কালো হলো! আর সে তো খুব বেশি কিছু চায়নি, শুধু সুন্দরমত দেখতে হবে তার স্বামী…এটুকুনই চেয়েছিল। অথচ বিপরীতে সে কি পেলো? বড় বাড়ি,গাড়ি, বিলাশবহুল জীবন আর কালো একটা বর!
আরও একবার ডায়রিটা দেখে নিল ইরিন। ঘুম তো আসবে না, তাই মনের না বলতে পারা কথাগুলো এই নির্জীব ডায়রিটার সাথে ভাগাভাগি করেই রাতটুকু পার করবে বলে ঠিক করলো।যদিও জীবনে কখনো ডায়রি লিখেনি সে । তবে আজ লিখবে বলে ভাবলো। বিছানায় ওপর থেকে তার জন্য বরাদ্দকৃত বালিশটা টেনে নিল ইরিন। নিজের কোলের উপর রেখে ডায়রিটা রাখলো তার উপর। কালো কলমটার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। তারপর, কলমের ক্যাপটা খুলে পাতা উল্টে লিখতে শুরু করলো নিজের অব্যক্ত অনুভূতিগুলো। লিখতে গিয়েও আবার অবাক হলো সে। কলমের বাইরেটা কালো হলেও ভেতরে রূপালী কালী। কালো পাতার উপর রুপালী কালির ব্যাপারটা এবার ঠিকই বুঝলো ইরিন। সব কিছু দেখে ওর মনে হলো,এগুলো সাধারণ কোন ডায়রি ও কলম নয়। বিশেষভাবে আলাদা করে তৈরী। নক্ষত্রের উপহারের ক্ষেত্রে এমন অদ্ভুত চিন্তা ভাবনার কথা ভেবে ছোট একটা শ্বাস ফেললো সে। উপহারটা ভালো লেগেছে তার।কিন্তু, মানুষটাকে তো সে ভালো লাগায় জায়গা দিতে পারেনি। কি হবে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ। এসব ভাবতে ভাবতেই কলম ছোঁয়ালো ডায়রির দ্বিতীয় পাতায়।
২০.
ফজরের আযানের সুমধুর সুরে ঘুম ভাঙে নক্ষত্রের। ধীরে সুস্থে বিছানায় উঠে বসতেই নিজেকে আবিষ্কার করে বিছনার একপাশে। এতকাল বিছানার মাঝখানে শুয়ে ঘুমানোর অভ্যাসে ব্যাতিক্রম ঘটেছিল তার। প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেলেও কয়েক মূহুর্তের ব্যাবধানেই মনে পড়ে গেল তার সবটা। নিজের পাশে সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ইরিনের শোয়ার জায়গা করে রাতে বিছানার একপাশে শুয়েছিল সে। কিন্তু, বিছানার অন্যপাশটা তো খালি। তাহলে ইরিন কোথায় গেল? ওয়াসরুমের দিকে তাকাতেই দেখলো দরজাটা হালকা ফাঁক করা। মানে ওখানে কেউ নেই। বিছানায় বসে পুরো ঘরে নজর বুলিয়েও ইরিনকে কোথাও দেখতে পেল না নক্ষত্র । চিন্তিত হয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো সে।
বেলকোনিতে দেখবে বলে ওদিকটায় যেতেই দেখলো ইরিন মেঝেতে এলোমেলোভাবে শুয়ে আছে। অবাক হলো নক্ষত্র। মূহুর্তেই আবার চিন্তার ভাঁজ পড়লো কপালে। নতুন বউ এভাবে মেঝেতে পড়ে থাকাটা স্বাভাবিক কিছু নয়। অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেল না তো আবার? ব্যাপারটা মাথায় আসতেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ইরিনের সামনে বসলো।খানিক ঝুঁকে ভালো করে খেয়াল করে দেখলো ইরিন ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। অর্থ্যাৎ, সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নক্ষত্র। কিন্তু পরমূহুর্তেই মনে প্রশ্ন জাগলো, ইরিন এমন গুটিশুটি মেরে কেন ঘুমাচ্ছে মেঝেতে শুয়ে? জামা, ওড়না, খোলা চুল সব এলোমেলো হয়ে আছে। মাথার নীচে লম্বা করে একহাত রেখে আরেকহাতে বালিশটা বুকে চেপে রেখে ঘুমাচ্ছে সে। নক্ষত্র ভেবে পেলো না, বালিশ মাথার নীচে না দিয়ে বুকে চেপে রেখে ঘুমানোর কি হলো?! ‘সিলি গার্ল ‘বলে সকৌতুক হাসলো সে মনে মনে।
২১.
ইরিনের সজ্ঞানে তার দিকে ভালো করে তাকানো হয়নি নক্ষত্রের। সে তাকায়ইনি আসলে। সংকোচ হচ্ছিল তার। নিজের স্ত্রী হলেও ইরিনের সামনে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগে ওর নিজেকে। ওর মনে হয় ইরিনও ওকে পছন্দ করে না। কিন্তু, ওর তো ইরিনকেই বিয়ে করতে হতো। হাজার হোক ওর আম্মুর পছন্দ বলে কথা! তাই এসব দোলাচলে পড়ে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সে ইরিনকে। এসব কথা মনে হতেই হতাশায় মন ভার হয়ে উঠো নক্ষত্রের।
কিন্তু, এখন তো ইরিন গভীর ঘুমে। এ সুযোগটা হাত ছাড়া করলো না নক্ষত্র। সংকোচ ঝেড়ে ভালো করে ইরিনের দিকে নজর বুলাতেই স্বস্তি ও মুগ্ধতায় ভরে উঠলো তার সমস্ত সত্তা। মনে হলো যেন শেষরাতের কোলজুড়ে কোন ঘুমন্ত পরী শুয়ে আছে। একদম আহামরি সুন্দরী না হয়েও ইরিনের মুখটা বেশ সুন্দর। কিন্তু, এখন গুটিশুটি মেরে ঘুমানোর জন্যই কিনা একদম নিঃষ্পাপ দেখতে লাগছে ইরিনকে। এসব ভাবতে ভাবতেই আবারও তার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। চেহারায় ফুটে উঠলো বিষণ্ণতার ছাপ। চাপা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবার তার ভরাট গলায় ইরিনকে ডাকলো বার কয়েক। কিন্তু, ইরিন কোন সাড়া দিল না।
গত ক’দিন ঠিক করে ঘুম হয়নি নানান চিন্তায়। আর বিয়ের দিনটাও বেশ ধকল গেছে তার। সারা রাত প্রায় জেগেই কাটিয়েছে সে। কিন্তু, ডায়রি লিখতে লিখতেই কখন যে চোখ লেগে এসেছে আর এভাবে মেঝেতেই শুয়ে পড়েছে, বুঝতে পারেনি ইরিন।
২২.
এদিকে ইরিনের কোন সাড়া না পেয়ে এবার তার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো নক্ষত্র। ছোট থেকেই বেশ অন্তর্মুখী স্বভাবের নক্ষত্র। নিজের বোনদের ছাড়া অন্য মেয়েদের সাথে খুব একটা সাবলীলভাবে মেশা হয়নি তার। জীবন যাত্রায় একসাথে চলতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে যতটা পরিচিতি, কথাবার্তা না বললেই নয়, কেবল ততোটাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে এক্ষেত্রে। তাই নিজের বোনদের ছাড়া এই প্রথম কোন নারীকে এতখানি স্বেচ্ছায় ও স্নেহের সাথে স্পর্শ করলো নক্ষত্র। পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিল ইরিনের মোলায়েম চুলের উপর। কিন্তু ইরিনের ঘুম ভাঙা তো দূর, এতে যেন তা আরও গভীর হলো। আরেকটু গুটিয়ে গিয়ে প্রায় গোল হয়েই শুয়ে রইলো সে। হতাশ হলো নক্ষত্র। না পারতে এবার ইরিনের বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে নাম ধরে ডাকলো ইরিনকে।
এতেই কাজ হলো। প্রবল ঘুমের ঝোঁকে লাগাতার এমন তীব্র ঝাঁকুনি আর একটা অচেনা কন্ঠের ডাকে ফট করে চোখ মেলে চাইলো ইরিন। সামনে নক্ষত্রকে দেখে কয়েকসেকেন্ড সময় নিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সে। বুকের কাছে বালিশটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলো। ঝরঝরে লম্বা মোলায়েম চুলগুলোকে এক হাতে কোনরকম ঠিকঠাক করে জামা নিয়ে টানাটানি করলো দুবার। সব ঠিকঠাক আছে নিশ্চিত হতেই ক্লান্ত, ঘুম জড়ানো লাল লাল চোখ মেলে নক্ষত্রের দিকে চাইলো। নক্ষত্র তখনো হাঁটু ভেঙে ওর সামনেই বসা।ইরিনের ওমন চোখজোড়া দেখে আচমকাই ওর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো।মনে পড়ে গেল একটা মুখাবয়ব। দ্রুত নিজেকে সামলে সরাসরি প্রশ্ন করলো ইরিনকে, “বিছনা ছেড়ে তুমি মেঝেতে ঘুমাচ্ছিলে কেন?”
আকস্মিক এমন প্রশ্নে ঠিক কি উত্তর দিবে ইরিন ভেবে পেল না। বালিশের সাথে তখনো ডায়রিটা তার বুকে লুকিয়ে রাখা।বাক্সটা অনেকটা বিছানার নীচে থাকায় দেখা যায়নি। ফলে নক্ষত্রেরও চোখে পড়েনি সেভাবে। একটা শুকনা ঢোক গিললো ইরিন। সত্যি তো কোনক্রমেই বলা যাবে না। উপহারে পাওয়া ডায়রিটা পেয়েই সে লিখতে বসে গেছিল,এটা বললে ভীষণ রকম লজ্জায় পড়তে হবে।আবার মিথ্যা বলার অভ্যাসও ওর একেবারেই নেই বলতে গেলে। তাই কি রেখে বলবে ভাবতে ভাবতেই নক্ষত্র আবার গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো…চুপ করে আছো কেন? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে,এন্সার মি! ”
এবার সত্যি সত্যি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল ইরিন। ওদিকে নক্ষত্র ওর জবাবের অপেক্ষা করছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ইরিন আমতা আমতা করে জবাব দিল, “প…প..পড়ে গেছিলাম।”
_মানে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো নক্ষত্র।
_মা…আ..মানে,বি..বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেছিলাম। ঘুমের মধ্যে গড়িয়ে পড়ার অ…অভ্যাস আছে আমার।” -হরবর করে বলে ফেললো ইরিন।তবে, কি বুঝে কি বললো সেটা সে নিজেও বুঝলো না। নক্ষত্রকে কিছু একটা বলা জরুরি ছিল,এটাই কেবল মাথায় ছিল ওর। তাই যা মনে এসেছে বলে দিয়েছে।
ওদিকে ইরিনের এমন উদ্ভট অভ্যাসের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে নক্ষত্র।’ স্লিপিং ওয়াক ‘ মানে ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাটি করার অভ্যাসের কথা জানে সে।এটা একটা রোগের মতই। কিন্তু, ঘুমের মধ্যে বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার এবং না জেগেই দিব্যি মেঝেতে শুয়েই ঘুমিয়ে থাকার মত অভ্যাসের কথা আজ প্রথম জানলো সে। তাও আবার কার সূত্রে? ওর নিজের বউয়ের এমন উদ্ভট অভ্যাসের জের ধরে ! শেষে কিনা এই ছিল তার কপালে? এখন কি তবে বউ বেঁধে রেখে ঘুমাতে হবে নাকি তার যাতে রোজ রাতে বিছানা থেকে না পড়ে যায়!
কিন্তু,তার এই কাল্পনিক চিন্তাভাবনার পরিধি সে খুব বেশি বাড়ালো না। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলো নক্ষত্র। ৫:৩৩ বাজে। ফজরের নামাযের সময় চলে যাচ্ছে। মসজিদে যেতে হবে তাকে। তাই, এই ব্যাপারটা এখানেই ইতি টানলো সে।বাকি যা হবে পরে দেখা যাবে। বউ তো এখন তারই সাথে থাকবে আজীবন। এটা ভেবে প্রসন্নচিত্তে মনে মনে আলতো হাসলো নক্ষত্র।
চলবে…
#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_৫
#লেখায়_জারিন
২৩.
ইরিন এখনো মাথা নিচু করে বসে আছে। এমন উদ্ভট ধরণের মিথ্যা বলায় ভেতর ভেতর কেমন ভয় ভয় করছে তার। বিয়ের একরাতও গেলো না। নতুন বরকে মিথ্যা বললো সে। এখন যদি ধরা পড়ে যায়? ভীষণ রকম লজ্জায় পড়তে হবে। আর যদি এ কথা নক্ষত্র কাউকে বলে দেয়… শশুড় বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়,তখন?? হাসির খোরাক হয়ে উঠবে সে। ছিঃ ছিঃ কি একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে তখন! ভাবতেই ইরিনের চোখ মুখ কুচকে এলো। সেটা খেয়াল করলো নক্ষত্র। কিন্তু, কিছু বললো না এ নিয়ে। প্রসঙ্গ পাল্টে ইরিনকে বললো, ‘ফজরের নামায পড়বে না? ‘
এম্নিতেই ভয়ে, অস্বস্তিতে কাটা হয়ে ছিল ইরিন। তারওপর আচমকা নক্ষত্রের কথায় চমকে উঠলো সে। একপলক নক্ষত্রকে দেখতেই আবারও দুঃখে- বিরক্তিতে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। ধীরকন্ঠে জবাব দিল, ‘হুম…পড়বো। ‘
_ঠিক আছে। আমি মসজিদে যাবো। অযু করে আসি পরে তুমি অযু করে নামায পড়ে নিও। ফ্লোরে শুয়ে ঘুম হয়নি বোধয় ঠিকমত। নামাযের পর ঘুমিয়ে নিও কিছুক্ষণ। এখানে সকাল ৮ টায় ব্রেকফাস্ট হয়। তার আগেই উঠে ফ্রেশ হয়ে নিও।
কথাগুলো বলে নক্ষত্র আর দেরি করলো না। দ্রুত উঠে ওয়াসরুমে চলে গেল। ইরিন এতক্ষণ মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনছিল। নক্ষত্র সামনে থেকে উঠে চলে গেছে বুঝতে পেরে এবার সেও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এতক্ষণ যাবৎ বুকের কাছে চেপে রাখা বালিশটা বড্ড অলস ভংগিতে সরিয়ে মেঝেতে রাখলো। যে পাতাটায় লেখা শেষ করেছিল, কলমটাও সেখানেই রাখা ছিল। সেটা বের করে মলাটে গুঁজে দিল আবার। আরেক নজর ওটাকে দেখে কোলের উপর রাখলো।তারপর, আড়মোড়া দিয়ে ক্লান্তির সাথে ঘুমের আভাস হিসেবে বিস্তর এক হাই তুললো সে। আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। ঘুমে ঢুলতে ঢুলতেই নিজের আনা লাগেজের কাছে গেল। ওটা খুলে তাতে কাপড়ের ভাঁজে সুন্দর করে তুলে রাখলো ডায়রিটা। কাজ শেষে আবার ঢুলতে ঢুলতেই বিছানায় এসে বসলো, যেখানটায় নক্ষত্র ঘুমিয়েছিল। খালি বিছানা পেয়েও একদম কিনারা ঘেঁষেই শুয়ে পড়লো সে। আবারও তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
অযু করে এসে নক্ষত্র দেখলো ইরিন আবার ঘুমিয়ে গেছে। নামায পড়া হলো না তার।কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলো নক্ষত্রের। তবে, ঘুমন্ত ইরিনের শরীর যতটা না বিছনায় তার চাইতেও বেশি বাইরে ঝুলছে। এ দেখে বড্ড হাসি পেল তার। সে মনে মনে আওড়ালো, “এভাবে ঝুলে ঝুলে ঘুমালে রাতে গড়াগড়ি করে মেঝেতে তো পড়বেই! স্টুপিড একটা, ঠিক করে ঘুমাতেও শেখেনি। ” এরপর, বেরিয়ে গেল সে মসজিদের উদ্দেশ্যে।
২৪.
বাড়ি ফিরেও নক্ষত্র ইরিনকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো। ঘড়িতে তখন সময় সকাল ৭’৩০ মিনিট। আর মাত্র আধা ঘন্টা পরেই নীচে সবার ডাক পড়বে সকালের নাস্তার জন্য। অথচ ইরিন এখনো ঘুমাচ্ছে। সেটাও ভীষণ অগোছালোভাবে। নিজের ঘরে, নিজেরই বিছানায় কোন নারীকে এভাবে দেখে বেশ লজ্জা পেল নক্ষত্র। কিন্তু, ইরিনকে ডেকে তোলা দরকার। বাড়ি ভর্তি বিয়ে উপলক্ষে আসা মেহমান। নক্ষত্র চায় না প্রথম দিনই ইরিনকে এই ব্যাপারে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হোক। এমনিতেই তারা সুযোগ পেলেই নক্ষত্র কেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে ছাড়ে না। বিশেষ করে, তার আম্মুর বড় বোন।কিন্তু, ইরিনকে কেউ কিছু বলার সুযোগ না পাক, এটা নক্ষত্র খুব ভালো করেই খেয়াল রাখার চেষ্টা করে।
সময় নষ্ট করলো না নক্ষত্র। কাছে গিয়ে ইরিনকে ডাকলো। কিন্তু ইরিন উঠলো না। নক্ষত্র মনে মনে ধারণা করে নিল, ইরিন বোধয় বড্ড ক্লান্ত। শুধুমাত্র ডাকাডাকি করে এত দ্রুত তাকে ঘুম থেকে তোলা সম্ভব না। তাই, ইরিনের মাথার কাছে গিয়ে বসলো। অগোছালো চুলগুলোকে যথাসম্ভব গুছিয়ে ইরিনের দিকে তাকাতেই কোন এক অজানা নেশায় পড়লো যেন। ছবিতে দেখেই ইরিনকে ভালো লেগেছিল তার । আর ইরিনের বর্তমান জীবন সম্পর্কে জানার পর ওর প্রতি আলাদা এক মনোভাব তৈরী হয় নক্ষত্রের।
যদিও সে ইরিনের মতামত না জেনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে না বলেছিল,কিন্তু ইরিনের থেকে ইতিবাচক উত্তর পেয়ে আর না করতে পারেনি। তার আম্মুর পছন্দ আর নিজের ভালো লাগাকে প্রশ্রয় দিয়ে বিয়ে করে ইরিনকে। অথচ, ইরিন জানেই না এই মানুষটার কাছে তার জায়গাটা ঠিক কতটা!
এবারেও ইরিনের ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিতে ছাড়লো না নক্ষত্র। নিজের অনুভূতির পালে হাওয়া দিয়ে ইরিনের খুব কাছাকাছি গেল সে। তারপর, ইরিনের ছোট্ট কপালে জুড়ে দিল নিজের প্রথম চুম্বন। বেশ সময় নিয়ে সযত্নে স্পর্শ করে রইলো তাতে।
নিজের উপর ভারী কিছুর অস্তিস্ত্ব বোধ হতেই ঘুমের মাঝেই নড়েচড়ে উঠলো ইরিন। সরে এলো নক্ষত্র। নিজেকে সামলে নিল দ্রুত। এরপর, কড়া গলায় ডাকলো, ‘ইরিন “!
ঘুমে ভাটা তো আগেই পড়েছিল ইরিনের, নক্ষত্রের এমন ভারী ভারাকাম ডাকে তা একেবারে ছুটে গেল। দ্রুত চোখ খুলে কয়েকসেকেন্ড সিলিং এর দিকে তাকাতেই অচেনা ঠেকলো তা। নতুন সিলিং এর ব্যাপারটা মাথায় ধরতেই নক্ষত্রের কথা মনে পড়লো তার।
নক্ষত্র ততোক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে। ওয়াসরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, ‘পরে ঘুমিয়ে নিও। এখন নীচে যাওয়ার সময়। গেট রেডি। ”
ইরিন কিছু বলার সুযোগ পেল না। ড্যাবড্যাব করে নক্ষত্রের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো কেবল।
২৫.
খাবার টেবিলে সবাই নিজেদের মত খেতে, গল্প গুজব করতে ব্যস্ত।এদিকে নতুন বউ এসে যে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা কেউ খেয়ালই করেনি। ইরিনের শাশুড়ি শায়লা খাবার টেবিলে সবার তদারকিতে ব্যস্ত। হঠাৎ ইরিনকে দেখতে পেয়ে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। হাস্যজ্জ্বল মুখে ইরিনের দিকে তাকাতেই হাসি মিলিয়ে গেল তার।
আপাদমস্তক নজর বুলাতেই দেখলো, জামরাঙা একটা জামদানি শাড়ি পড়েছে ইরিন।এটা তাকে বিয়ের তত্ত্বে দেওয়া হয়েছিল। খুব সুন্দর মানিয়েছে ইরিনের ফর্সা শরীরে। কিন্তু, শরীরে গয়না বলতে শাড়ির সাথে মিলিয়ে দু হাতে এক গোছা করে কাঁচের চুড়ি।গলায় একটা ইমিটিশনের লকেটসহ চেইন।আর কানেও ছোট দুটো দুল।
ইরিনকে এভাবে দেখে হতাশ হলেন তিনি। ইরিনের হাত ধরে চাপা স্বরে বললেন, ‘এ কি! এভাবে নিচে এসেছো কেন?’
ইরিন প্রথমটায় বুঝলো না তার শাশুড়ি কিসের কথা বললো। তাই অপ্রস্তুত হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘এভাবে মানে?’
‘তোমার গয়না কই? নতুন বউ তুমি।এভাবে সাদামাটা হয়ে ঘুরে বেড়ালে সবাই কি বলবে! এটুকু তো খেয়াল রাখা উচিৎ ছিল রে মা’।
শাশুড়ির কথা বুঝতে পেরে লজ্জা পেল ইরিন। সত্যিই ভুল হতে গেছে কাজটা। খেয়াল রাখা উচিৎ ছিল। কিন্তু, বিয়েতে পাওয়া সব গয়নাই মুটামুটি বেশ দামী আর ভারী। এমন গয়না পড়ার অভ্যাসই কোনকালে ছিল না ইরিনের। বিয়েরদিন বেশ কষ্ট হয়েছে সামলাতে।তাই,ঘরের ভেতর এসব পড়ে ঘুরে বেড়ানোর কথাও ওর মাথায় আসেনি। লাগেজে শাড়ি ব্যাতিত অন্য পোশাক কিছু ছিল না বলেই শাড়ি পড়েছে। কিন্তু, গয়নার ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।
শাশুড়ি কথার জবাবে বেশ লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো, ‘ভুল হয়ে গেছে মা। আসলে গয়নাগুলো অনেক ভারী তো আর অভ্যাসও নেই বাসায় এমন সেজে থাকার তাই বুঝতে পারিনি। মাফ করবেন। ‘
ইরিনের কথায় স্মিত হাসলেন শায়লা। চারদিকে একবার দেখে নিয়ে ইরিনকে তাড়া দিয়ে বললো, ‘ব্যাপার না। আমি অদ্রিকে দিয়ে কিছু হালকা গয়না পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি ওগুলো…
শায়লার আর এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়ে উঠলো না। তার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো তার বড় বোন আফিয়া । মহিলার স্বামী পুলিশের বড় কর্মকতা। বাপের বাড়ি তো বটেই শশুড়বাড়ির পরিবারও যথেষ্ট ধনী। তাই অর্থ ও অহংকার তার আপাদমস্তক জুড়ে। সেই সাথে কথাবার্তায় খানিক লাগামহীন স্বভাবও।
ইরিনকে দেখেই চোখমুখ কুচকে ফেললেন। তাদের কথার মাঝেই শায়লাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিসের গয়না পাঠাবি রে শালু?’
কথায় আছে..যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। শায়লা মনে মনে এমন কিছুর আশংকা করেই ইরিনকে ঘরে পাঠাতে তাড়া দিচ্ছিলেন। কিন্তু, বিধি বাম। সেই আফিয়ার সামনেই পড়তে হলো। তার বোনের কথার কোন লাগাম নেই। নক্ষত্রকে তো তিনি সহ্যই করতে পারেন না। কেবল মাত্র, শায়লার অনুরোধে তিনি বিয়েতে এসেছেন। এখন ইরিনকে পেয়ে কি না কি বলে বসে সেই ভয়েই শুকনো ঢুক গিলে বললেন, ‘ ইরিনের গয়না আপা। আমার কাছে রাখা। এই জন্যই দেখোনা গয়না ছাড়াই নীচে নেমে এসেছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। নতুন বৌকে এভাবে দেখলে কি ভাববে, তাই বলছিলাম যে গয়না পাঠিয়ে দিলে যেন পড়ে নেয়। ‘
‘বিয়েতে তো এত এত গয়না দিলি। আরও লাগবে? এত গয়না দিয়ে কি করবে ও! অবশ্য কপালও বটে এ মেয়ের। ঘুরে ফিরে কোন ফকিন্নির ছেলের কপাল গুণে এত বড়লোক বাড়ির বউ হয়ে গেল। জীবনে যা না পেয়েছে সেসব পেয়েও এখন আরও লাগবে। হুহ!এদের এত পেয়েও কেন যে পেট মন ভরে না আল্লাহ ভালো জানে। ‘
আফিয়ার কথায় একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলো ইরিন। আফিয়ার এত অপমানজনক কথার মাঝেও ‘ফকিন্নির ছেলে ‘ কথাটা খট করে মস্তিষ্কের নিউরনে গিয়ে তীব্রভাবে নাড়া দিল। বিস্ফোরিত চোখে শায়লার দিকে তাকাতেই দেখলো তার মুখ ইতোমধ্যে চুপসে গেছে। ইরিনের সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জিত ভঙ্গিতে ইশারায় অনুনয় করলেন চুপ থাকার জন্য। ইরিন চুপ করে রইলেও তার মনে শব্দ দুটো খচখচ করতে লাগলো।
শায়লা আমতা আমতা করে বললেন, ‘এসব কি আজেবাজে কথা বলছো আপা। নক্ষত্র এ বাড়ির একমাত্র ছেলে। ওর বউ হিসেবে সব তো ইরিনই পাবে। এইসব গয়নাগাটি তো সামান্য ব্যাপার। ‘
‘তুই চুপ থাক শালু। তুই যে কি বুঝে ওই ছেলেকে এত আহ্লাদ করিস বুঝিনা আমি। ‘
‘আমার ছেলে আমি আদর আহ্লাদ করবো এটাই তো স্বাভাবিক। আর তুমি কি নিয়ে পড়লে বলো তো। যাও নাস্তা করতে বসো। আমি আসছি ওখানে। ‘
‘আল্লাহ যে তোকে কি দিয়ে বানায়ছে আল্লাহই ভালো জানে। ওই ফকিন্নির ছেলে…
‘আপা! ‘এবার কড়া গলায় বাঁধ সাধলেন শায়লা। কন্ঠের গম্ভীরতা বজায় রেখেই বললো, ‘তোমাকে নাস্তা করতে যেতে বলেছি। বাড়ি ভর্তি মেহমান। কোন তামাশা করো না প্লিজ।’
শায়লার এমন প্রতিবাদে প্রচন্ড অপমানিত বোধ করলেন আফিয়া। রাগে গমগম করতে করতে চেঁচিয়ে বললেন,’ আমি তামাশা করি? এই অপমান তুই আমায় করবি বলেই এত অনুরোধ করছিলি বিয়েতে আসার জন্য? আমি তো শুধু তোর মুখের কথায় এই বিয়েতে আসছি। নইলে ওই ছোটলোকের বাচ্চার ছেলের বিয়েতে আমি আমার পায়ের ধুলাও দিতাম না। ‘
এতক্ষণ ব্যাপারটা ঘরের একটা কোণায় চলতে থাকলেও আফিয়ার চেঁচানোতে তা পুরো ডাইনিং জুড়ে ছড়িয়ে গেল। খাওয়া, কথা বার্তায় মুখোরিত পরিবেশ থমকে গেল নিমিষেই। ঘটনা কি ঘটেছে তা ঠিকঠাক কিছু বুঝে উঠার আগেই আচমকা কোথা থেকে নক্ষত্র এসে ইরিনের হাত ধরলো। স্থান ত্যাগ করার আগে শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘খালার যেন কোনরকম কোন অসুবিধা না হয়, একটু খেয়াল রাখবেন আম্মু। ইরিনকে নিয়ে যাচ্ছি আমি। ওর খাবারটা কাউকে দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিবেন প্লিজ। ‘
‘হুম। নিয়ে যাও। আমি এদিকে দেখছি সবটা। ‘ শায়লা নক্ষত্রকে আশ্বস্ত করে বললেন।
শায়লার কথায় তার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো নক্ষত্র। তারপর আফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আম্মুর কথায় এখানে এসেছেন বলে ধন্যবাদ। কিন্তু আম্মুকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আম্মু আপনাকে অপমান করে কিছু বলেননি। যান, নাস্তা করে নিন। ‘
কথা শেষ করে নক্ষত্র একমূহুর্তও দাঁড়ালো না। ইরিনের হাত ধরেই টানতে টানতে নিয়ে গেল ওখান থেকে। আর ইরিন! সে কেবল বিষ্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে দেখলো সবটাই। কিছু বলার বা বোঝার সুযোগ কোনটাই তার হলো না।
চলবে…