নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_৭

0
765

নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_৭
লেখায়_জারিন

৩২.

‘উফ….কি ঝাল রে বাবা! এরা কি আজ বোয়মের সব মরিচ ঢেলে দিয়েছে নাকি কিমায়! ‘

গরম গরম বিফ রোল খেতে গিয়ে ঝালে ঝলসানো মুখ নিয়ে বললো রাফিদ। তারপর, গলা ছেড়ে পরিচিত একজন কর্মচারীকে ডাকলো , ‘সাদিক মামা…..এই সাদিক মামা? ‘

রাফিদের এমন বাজখাঁই গলার আওয়াজে একপ্রকার হন্তদন্ত হয়েই ছুটে এলো সাদিক মিয়া। আজ প্রায় ১৯ বছর সে এখানে কাজ করে। রাফিদের সাথে তার পরিচয় ৫ বছর যাবৎ। অফিসের কাছে এই হোটেলটায় প্রায়ই আসে রাফিদ নাস্তা করতে। এখানকার বিফ রোল ওর ভীষণ পছন্দের। কিন্তু, আজ খেতে গিয়ে প্রচুর ঝালে খাওয়ার মুডটাই খারাপ হয়ে গেলো ওর।

‘জে…মামা কন। ‘ হাসি হাসি মুখে আন্তরিকভাবে বললো সাদিক মিয়া।

‘আজকে তোমাদের বাবুর্চি বউয়ের সাথে ঝগড়া করে আসছে নাকি?’

‘না তো। খসরু রে তো মেলা হাসি খুশিই দেখলাম। আর ওর বউ তো শুনছি বাপের বাড়ি গেছে কাইল। হোটেলেই খায় খসরু এহন। ‘ – কিছুটা কনফিউজড স্বরে বললো সাদিক মিয়া।

‘ও….তা বউ বাপের বাড়ি গেছে এই খুশিতে তোমাদের খসরু মিয়া যে রোলের কিমা ঝালে লাল করে ফেলছে এই খবরখানা কি সে জানে??’ বেশ টিটকারির স্বরে বললো রাফিদ।

রাফিদের কথার ধরণের বোকার মত তার দিকে তাকিয়ে রইলো সাদিক মিয়া। তারপর, ঘাঁড় ঘুরিয়ে এক নজর ইরিনকে দেখলো। পুনরায় রাফিদকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘ঝাল কি খুব বেশিই হইয়া গেছে মামা? আম্মাজান তো দেহি মেলা আয়েশ কইরাই খাইতাছে। হেতে তো কিছু কয় না। ‘

সাদিক মিয়ার কথায় এবার ইরিনের কথাটা খেয়াল হলো রাফিদের।তার সামনের চেয়ারে বসেই দিব্যি কোন টু শব্দ ছাড়াই রোলে কামড় বসাচ্ছে। ইরিনের সমস্ত মনোযোগ আপাদত মোবাইলে। তা দেখে রাফিদ মনে মনে আউড়ালো, ইরিনের কি ঝাল লাগছে না, নাকি? কিভাবে খাচ্ছে সে এত ঝাল খাবার! তারপর ভাবলো, এতো মেয়ে মানুষ। মেয়েরা একটু ঝাল টাল খেতেই বেশি পছন্দ করে। ওর নিজের বোন রুনাও তো ফুচকায় এত এত ঝাল খায়। কিন্তু, এই ঝালটা কি সত্যিই একটু বেশি নয়?

এসব ভাবতে ভাবতেই কোন একটা টেবিল থেকে একটা মেয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘এই মামা…..এত ঝাল কেন কিমায়, মরিচ কি খুব সস্তা পাইছেন নাকি?! আইসক্রিম আনেন তাত্তাড়ি (তাড়াতাড়ি)। এই মামা…’

মেয়েটির কথা শুনে সাদিক মিয়া একবার রাফিদের তাকিয়ে দেখলো। রাফিদ মুচকি মুচকি হাসছে। এবারে আর দাঁড়ালো না সাদিক মিয়া। ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেল ওই টেবিলটার কাছে। কাস্টমার শান্ত করতে।

রাফিদ মুচকি হেসে ইরিনের দিকে তাকালো এবার। ইরিন বেশ মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। তা দেখে রাফিদ প্রশ্ন করলো, ‘এত ঝাল খাচ্ছেন কি করে! খারাপ লাগছে না?’

রাফিদের প্রশ্নে ওর দিকে একপলক তাকিয়ে বাঁকা হাসলো ইরিন। খেতে খেতেই জবাব দিল, ‘উহু। অভ্যস্ত আমি। এন্ড ইউ নো…..আমার এই ঝলসে যাওয়া জীবনের পেছনে শুরুর গল্পটার কিছুটা ছিল এই ঝাল খাবারকে কেন্দ্র করেই। যদিও এ গল্পটা কিছুটা আপনার জানা। ডায়রিতে লেখা আছে। তবুও, সামনা সামনি খুলে বলতে চাইছি না। ‘

‘লজ্জা লাগছে বলতে?’ ইরিনকে খোঁচা মেরে বললো রাফিদ।

‘না। ঠিক লজ্জা নয়। আপনি তো জানেনই। তবুও, উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত মূহুর্তেগুলো এখন খুব বিশেষ আমার কাছে। হোক সেটা আমার ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ঘটা। ওগুলো আমার অবদিই রাখতে চাই। তাছাড়া, স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো অন্য কারও কাছে এক্সপোস করাটা উনি বরাবরই অপছন্দ করেন। যার জন্য অনেক সময় অনেক লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে রেহায় পেয়েছি আমি। ‘

কথাগুলো একটানে বলে শেষ করলো ইরিন। প্লেটে থাকা রোল খাওয়া শেষ। বেশ অনেকদিন পর এমন ঝাল খাবার খেয়েছে। ভালো লেগেছে ওর। তাই রাফিদকে বললো,
‘আপনার সাদিক মামাকে বলুন তো আরও একটা রোল দিয়ে যেতে। সাথে কড়া করে এক কাপ চা আর….আপনার পছন্দের মিষ্টি। ঝাল বোধয় খুব একটা খেতে পারেন না আপনি। এরচে আজ মিষ্টি কিছু খান। ‘

ইরিনের কথায় তার দিকে অবাক হয়ে তাকালো রাফিদ। এই মেয়ে কি ঝাল খাক্ষসী নাকি! এত ঝাল দেওয়া কিমার রোল খেয়ে আরও চাইছে। ‘

‘কি হলো, মি. রাফিদ? নিন…নিন… জলদি অর্ডার করুন। খেয়ে বাড়ি ফিরবো। আজ আর গল্প বলার মুড নেই। বাড়ি গিয়ে আরামে একটা ঘুম দিবো। ‘ রাফিদকে তাড়া দিয়ে বললো ইরিন।

‘মানে কি?’ অবাক স্বরে বললো রাফিদ।

‘আজ আর মন ভার করতে ইচ্ছে করছে না। রোল খেয়ে মন ফুরফুরে হয়ে গেছে। সে জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। ‘ হাসি হাসি মুখে বললো ইরিন। তারপর, একটু থেমে আবার বললো, ‘আর হ্যাঁ, আজকের বিলটা কিন্তু আমিই দিব। মানা করলে আর আসবো না।’ হুমকির মত করে বললো ইরিন।

রাফিদ জানে ইরিন একরোখা, জেদি টাইপের মানুষ। এই দিয়েই এত সুন্দর জীবনের কাল ডেকে এনেছে সে। আর সেটার সবটা বুঝতে হলে…সবটা তার জানা দরকার। তাই ইরিনের মন মতই চলতে হবে তাকে। অবশ্য সে নিজেও চাইছে না ইরিনের এই হাসি মুখটা মলিন করে দিতে। তাই, ইরিনের কথা মত সাদিক মিয়াকে ডাকলো রাফিদ। কিন্তু, কয়েকবার ডাকাডাকির পরেও সাদিক বা অন্য কেউ এলো না। সব হয় তো কিচেনে লংকা কান্ড সামাল দিতে ব্যস্ত। অগত্যা ইরিনকে বসতে বলে সে নিজেই গেল কাউন্টারে অর্ডার দিতে।

রাফিদ চলে যেতেই মুচকি হাসলো ইরিন। মনে মনে হাঁটতে লাগলো এক টুকরো স্মৃতির পথ ধরে।

৩৩.

বিয়ের দু দিন পরের ঘটনা। ইরিন নক্ষত্রকে নিয়ে বাপের বাড়ি এসেছে ফিরানির রীতি অনুযায়ী। দুপুর বেলা খেতে বসেছে ইরিন ও আম্বিয়া খাতুন। বিয়ে উপলক্ষে কিছুদিন ধরে খিচুড়ি, পোলাও, বিরিয়ানি, মাংস এসব খেয়ে খেয়ে দুদিনেই যেন মুখে চড়া পড়ে গেছে ইরিনের। আজও বিয়ের পর প্রথমবার নতুন জামাইয়ের আগমন উপলক্ষে পোলাও মাংস করা হয়েছে এ বাড়িতে। তবে এত সব কিছুর মাঝেও, টেবিলে কালোজিরার ভর্তা আর গরম ভাত দেখতে পেল ইরিন। ও জানে এটা ওর ভাবীর জন্য। গর্ভাবস্থায় ঝাল খেতে ভালো লাগে বলে ইদানীং এই আয়োজনটা প্রায় সময়ই হয় ওদের বাড়িতে। মুখের স্বাদ বদলে এর চাইতে ভালো আর কি হতে পারে। তাই আম্বিয়ার কাছে সে ভাত খাবে বললো। পুরোটা ভাতও সে শুধু ঝাল ঝাল কালিজিরা ভর্তা দিয়েই খেলো।

এরপরেই বাঁধলো বিপত্তি। একে তো গরম ভাত তারসাথে শুকনা মরিচ আর কালোজিরার ভর্তা। ঝালে চোখ মুখ জ্বলে যাওয়ার উপক্রম হলো তার। মিষ্টি খেয়েও সে ঝাল কমলো না। ঝালে শুষিয়ে চোখ মুখ লাল হয়ে গেল একেবারে। আর এই ঝালের আগুনে ঘি হয়ে উপচে পড়লো ইরিনের বড় ভাবী নার্গিসের কিছু কটু কথা।

ইরিন ভাত খেতে চেয়েছিল বলে ওর মা আম্বিয়া খাতুন বললেন টেবিলে বাড়া ভাতটাই খেয়ে নিতে। নার্গিস ঘুমে তখনো। ইরিন এই ভাত খাক, নার্গিসের জন্য আরেক পাতিলে নতুন করে ভাত বসিয়ে দিবেন উনি। নার্গিস উঠতে উঠতে হয়ে যাবে ভাত। তখন সে খেয়ে নিবে। কিন্তু, কপালে তান্ডব থাকলে যা হয় আর কি। ইরিন খাওয়া শেষ করে উঠেছে মাত্র। ঝালে অবস্থা খারাপ। এমন সময় নার্গিস এসে ভাত খেতে চাইলো। কিন্তু ভাত তখনো রান্না হয়নি পুরোপুরি। মিনিট দশেক সময় লাগবে আরও। তাই আম্বিয়া নার্গিসকে বললেন, ‘আগের ভাতগুলা তো ইরিন খেয়ে ফেলছে বউ। ওর নাকি পোলাও মাংস খাইতে ইচ্ছে করতেছিল না। তুমিও ঘুমে ছিলা। তাই আমি নতুন কইরা ভাত বসাইছি। হইয়া আইছে প্রায়। তুমি একটু বসো। ‘

ব্যস্ত এইটুকুই যথেষ্ট ছিল নার্গিসের রাগে ফেটে পড়ার কারণ হওয়ার জন্য। ইরিনকে তো বটেই আম্বিয়াকেও কথা শুনাতে ছাড়লো না সে। সরাসরি চেঁচিয়ে উঠে বললো, ‘এইটা কি করছেন মা আপনি? ‘

‘কি করছি?’ বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলেন আম্বিয়া খাতুন।

‘না…মানে, বলি আপনার কি আক্কেল বলতে কিছু নাই? বাড়িতে পোয়াতি বউ। পোলাও মাংসের গন্ধ সহ্য হয় না বলে দুটো ভাত খায়, সেটাও আপনি আরেকজনকে খাওয়ায় দিলেন? এদিকে যে আমার সময় মত খাওয়া দাওয়া করা লাগে সেই কথা মাথায় আসে নাই আপনার? বয়স কি এতই বেশি হইছে যে বোধ বুদ্ধি সব খুয়ায় দিছেন? ‘

‘এগুলা কি ধরণের ব্যবহার, ভাবী! তুমি আম্মার সাথে এমন আচরণ কেন করতেছো? তুমি ঘুমে ছিলা বলেই না আম্মা আমাকে ওই ভাত খেতে দিয়েছে। তোমার জন্যও নতুন করে রান্না বসিয়েছে। সেটাও প্রায় হলো বলে। ‘

এবার নার্গিস ইরিনের দিকে নজর দিল। ঝালে চোখ মুখ লাল হয়েছে দেখে তার বুঝতে বাকি রইলো না যে ইরিন তার জন্য রাখা ভর্তা খেয়েছে। এই নিয়েও তার কথার তুবড়ি ছুটলো ইরিনের দিকে।

‘বাহ! ভাতের সাথে সাথে আমার জন্য করা ভর্তাও গিলেছো দেখছি। পুরোটাই শেষ করেছো নাকি? বলি, এত বড় বাড়িতে বউ করে পাঠালাম, নিজেদের যা ছিল সব দিয়ে বিয়ে দিলাম। ওই বাড়িতে এত খাবার থাকতে এখন এই গরীবের ভর্তা ভাতেও মুখ দিতে হলো তোমার?’

‘এই বউ, এগুলা কি বলতাছো। নতুন জামাই আসছে বাড়িতে। এম্নে চেঁচাইলে শুনবে তো সব। কি ভাববো কও দেখি। ‘

‘নতুন জামাই আসছে বইলাই তো আপনার ছেলের পকেট কেটে বাজার করিয়েছেন এত এত। পোলাও মাংস মিষ্টি কোন কিছু তো বাদ দেন নাই। প্রত্যেকটা মেয়ের জামাই আসলেই তো এই করেন। তাইলে এত কিছু থাকতে আমার ভাত খাইতে হইলো ক্যান ওর? আপনি জানেন না আমি এখন একা নাই? খিদা সহ্য করতে পারি না আমি। আমার কথা না হয় বাদ দেন, নিজের নাতির কথাও তো চিন্তা করতে পারতেন। ‘

‘ভুল হইছে ভাবী।মাফ চাইতেছি আমি। আর ওই যে বললা না, আমার স্বামীর জন্য তোমার স্বামীর পকেট কাটা গেছে? ভুলে গেছো বোধয়, বিয়ের দিন আমার মোহরানার টাকা যেটা উনি আমায় দিয়েছেন, সেটা থেকে পাঁচ লাখ টাকা আমি তোমাদের দিয়ে গেছিলাম। তাই উনার জন্য ভাত রান্না হোক বা পোলাও মাংস হোক। উনার টাকাতেই আজ সব হয়েছে। ‘

কথাগুলো বলার সময় বাইরে খুব শান্ত থাকলে ভেতর ভেতর কান্না দলা পাকাচ্ছিল ইরিনের। সামান্য ভাত খাওয়া নিয়ে এমন কথার মুখে পড়তে হবে জানলে সে কখনোই খেতো না। বিয়ের আগেও এমন অনেক কটু কথার মুখে পড়তে হয়েছে ওকে। বিয়ের দিন ভাবীর মুখের মিষ্টতা দেখে ভেবেছিল আর যাই হোক এমন কথা ও ব্যবহারের কবলে বোধয় আর পড়তে হবে না।কিন্তু, আজও এমন করলো নার্গিস। তাই পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে ইরিন।

‘এএএএহহহ……দুই দিন হইলো না বড়লোক বাড়ির বউ হইছো এখনই এত দেমাগ চড়ছে তোমার, ইরিন? কই আগে তো কখনো চু চা করতে দেখি নাই কোন বিষয়ে। আর টাকার কথা বলো? সেটাও তো পুরাটা দাও নাই। নিজেরটুকু কে ছাড়ে বলো! বুঝি তো সবই।
তাছাড়া দুই বছর যে তোমার বিধবা মা, তোমরা অনাথ দুই বোন আর বেকার ভাই আমার জামাইয়ের ঘাঁড়ে বইসা খাইছো তার বেলায়? শোনো ইরিন, এত টাকার গীত গাইয়ো না। শশুড় বাড়ি গেছো, এখন সংসার করো। এদিকে আর নজর দিও না। এইটা আমার সংসার, আমি বুঝবো।’

‘তোমার স্বামীর মা এখনো সহিসালামত জীবিত ভাবী। এটা তার সংসার। হতে পারে তুমি সেই সংসারের ভবিষ্যৎ মালকিন। কিন্তু এখনও হও নাই। তাই আম্মার সাথে ভালোভাবে কথা বলবা। ‘- কঠিন গলায় বললো ইরিন।

‘খুব বুলি ফুটছে মুখে না? বড় লোক বাড়ির বউ হইতে না হইতেই ভোল পালটায় গেছে তোমার। ‘ – রাগে কটমট করতে করতে বললো নার্গিস।

‘ও বউ কি শুরু করলা। এই ইরিন যা তো ঘরে যা। জামাইয়ের কিছু লাগবো নাকি দেখ গিয়া। যা..’ ইরিন আর নার্গিসের বাকদন্ডিতা থামানোর চেষ্টায় বললেন আম্বিয়া খাতুন।

ইরিন আর দাঁড়ালো না। চুপচাপ হাত ধুয়ে বেরিয়ে গেল ডাইনিং থেকে।

৩৪.

নার্গিস আর আম্বিয়ার সামনে নিজেকে সামলে রাখলেও ঘর পর্যন্ত আসতে আসতে চোখের পানিও বাঁধ ভাংলো তার। নাকের জল চোখের জল একাকার করে ঘরে ঢুকতেই নক্ষত্রের মুখোমুখি হলো সে।

নক্ষত্র সবে মাত্রই সিগারেট শেষ করে বেলকোনি থেকে ঘরে ঢুকেছিল। ইরিনকে এভাবে দেখে পা থমকে গেল তার। পড়নে গোলাপি রাঙা সুতি শাড়ি ইরিনের। ঝালে লাল হওয়া নাক, চোখ, ঠোঁট যেন অন্য একমাত্র যোগ করেছে তার সৌন্দর্যে। বড্ড মোহনীয় লাগছে তাকে। নক্ষত্র অপলক চেয়ে রইলো এই মোহিনীর মুখ পানে। কিন্তু, বেশি সময় তাকাতে পারলো না। ইরিনের অনবরত মুছতে থাকা চোখের পানি আর নাক টানার শব্দে ধ্যানচ্যুত হলো নক্ষত্রের। দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে গেল ইরিনের কাছে। চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে…এমন অবস্থা কেন তোমার?’

ইরিন চোখ তুলে এক নজর নক্ষত্রকে দেখে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। কোন উত্তর দিল না নক্ষত্রের প্রশ্নের। বিছানায় বসে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলো।নক্ষত্র আবারও প্রশ্ন করলো, ‘তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি ইরিন। স্পিক আপ। ‘

ইরিনের প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো নক্ষত্রের এমন চিন্তিত ভাব দেখে। কন্ঠে বিরক্তি নিয়েই বললো,’ কিছু না।’

‘কিছু না মানে? কিছু না হলে চোখ মুখের এমন অবস্থা কেন তোমার? ‘ নক্ষত্রের কন্ঠে উৎকন্ঠা।

এমনিতেই মন খারাপ। তারপর আবার নক্ষত্রের এমন একের পর এক প্রশ্ন। রাগ হলো ইরিনের। কিন্তু, সে রাগ চেপে গেল। থমথম গলায় বললো, ‘ঝাল লেগেছে।’

‘কিভাবে? কি খেয়েছো?’

‘সেটা জেনে আপনি কি করবেন? ‘ এবার আর রাগ না সামলে তেঁতিয়ে উঠলো ইরিন।

‘এভাবে কথা বলছো কেন ইরিন?’ হতবাক হয়ে বললো নক্ষত্র। ‘

‘তো কিভাবে বলবো? এত জেরা কেন করছেন আপনি? এত টাকা দিয়ে বিয়ে করে উদ্ধার করেছেন বলে মনে করবেন না যে আমি আপনার কেনা গোলাম হয়ে গেছি। ‘ রাগের মাথায় যা মনে এছেসেছে বলে দিলো ইরিন। নার্গিসের রাগটা না পারতে নক্ষত্রের উপর ঝাড়ছে সে।

‘আমি তোমায় টাকা দিয়ে কিনেছি, ইরিন?’ হতবাক হয়ে কিছুটা গম্ভীর গলায় বললো নক্ষত্র।

‘হ্যাঁ, কিনেছেনই তো। দশ লাখ টাকা এত সম্পত্তি মোহরানা দিয়েছেন ভুলে গেছেন সেটা?’

‘ওটা তোমার হক ইরিন। আল্লাহ তা’আলা এই হকের ভাগিদার করেছেন প্রতিটি স্ত্রীকে। তুমিও আমার স্ত্রী হিসেবে সেটা পেয়েছো। এটাকে তোমার মূল্য ধরো না। তুমি এত সস্তা নও।আর না বিক্রয়যোগ্য কোন পণ্য। ‘ – কঠিন গলায় বললো নক্ষত্র।

‘পণ্য নই কিন্তু পণ্য বানিয়ে নিয়েছে আপনারা আমাকে। এত সব সম্পত্তির বদলে আপনার জন্য কেনা হয়েছে আমাকে। নইলে আমি জীবনেও বিয়ে করতাম না আপনাকে। ‘

ইরিনের এমন কথায় থমকালো নক্ষত্র। ও ধারণা করেছিল ইরিন ওকে পছন্দ করেনি। কিন্তু বিয়ের পর ইরিনের ব্যবহারে ওর মনে হয়েছিল ইরিন মন থেকেই ওকে গ্রহন করে নিয়েছে। তবুও, ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য জিজ্ঞেস করলো ইরিনকে সে, ‘কেন বিয়ে করতে চাওনি?বিয়ের আগে তো আমি তোমার মতামত জানতে চেয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে স্বেচ্ছায় বিয়েতে রাজি তুমি। তাহলে আজ এমন কথা বলছো কেন ইরিন? ‘

নক্ষত্রের এমন কথায় চুপ হয়ে গেল ইরিন। রাগের মাথায় কি রেখে কি বলে ফেলেছে! এখন কি বলবে সে? বুক ঢিপঢিপ করছে তার। ওদিকে নক্ষত্র তাড়া দিল আবার, ‘চুপ করে আছো কেন, বলো?’

বিছানার চাদর খামছে ধরলো ইরিন। কান্না থেমে গেছে। কিন্তু চোখ এখনো টলমলে। মাথা ঝিমঝিম করছে এখন তার।খানিক সময় নিরবেই গেল তাদের। ইরিনকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে নক্ষত্র বললো,

‘তুমি কি জানো ইরিন…তোমার ভাবী আমার সাথে তার ছোট বোনের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? তোমার বদলে নাবিলার সম্বন্ধ পাঠিয়েছিলেন ঘটককে দিয়ে। সাথে এটাও বলেছিলেন আমি দেখতে কালো বলে আমাকে বিয়ে করতে চাও না তুমি। তবুও, আম্মু তোমাকেই আমার স্ত্রী আর ও বাড়ির বউ করতে চেয়েছেন বলেই নাবিলার সম্বন্ধটা উনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আর এই জন্যই বিয়ের আগে তোমার মত জানতে চেয়েছিলাম আমি তোমার কাছে। তুমি রাজি ছিলে বলেই… । যাই হোক, তাহলে কি এটাই কারণ? তোমার ভাবীর বলা কথাটাই কি আমি সত্যি বলে ধরে নিবো,ইরিন?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here