নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_১৭

0
612

নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_১৭
লেখায়_জারিন

৯০.

ইরিনের ঘুম ভেঙেছে বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু, ক্লান্তি যেন পুরোদস্তর জেঁকে বসেছে শরীরে। শরীর ব্যাথা করছে ভীষণ।মাথাটাও কেমন ভার ভার লাগছে তার। কপালে এক হাত ঠেকিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিলিং এর দিকে। কি দেখছে…কেন দেখছে মস্তিষ্কও সে ব্যাপারে জানে না কিছুই। যেন এ ব্যাপারে কোন অনুভূতি কাজ করছে না তার মাঝে।

আরও কিছুটা সময় কেটে গেলো এভাবেই। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক সচেতক হতেই টনক নড়লো ইরিনের। এতক্ষণ যাবৎ তাকিয়ে থাকা সিলিংটা অচেনা ঠেকলো। সাথে সাথে নিজের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্ত হলো সে। সিলিং থেকে চোখ সরিয়ে আশেপাশে তাকাতেই বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। এটা তার বেডরুম নয়। ওয়াসিফের রুম। অদূরেই বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াসিফ।

কিন্তু, সে এখানে কেন এই প্রশ্ন জাগতেই ধীরে ধীরে মনে পড়লো সব। বিছানা হাতড়ে মোবাইল ফোনটা নিল। পাওয়ার বাটন অন করেও লাভ হলো না। ফোনটা বন্ধ। চার্জ নেই বোধয়। ইরিন রুমের দেওয়ালে ঘড়ি খুঁজলো। দেওয়ালে টিভির উপর বরারবর পেয়েও গেল তা। ঘড়িতে সময় ৬’১৯ মিনিট। ইরিন তৎক্ষণাত বুঝলো না এটা সকাল নাকি বিকেল। কারণ, বাইরেটায় আবছা আলো। ঘরেও তাই। ভেতরে ভারী পর্দা টানানো। যার জন্য খুব একটা বোঝা যাচ্ছে না বাইরের পরিবেশটা।

ইরিন অতশত ভাবলো না। বিকাল হবে বলে ভেবে নিল।কারণ, ওর মনে আছে দুপুর ১’৩০ টা নাগাদ নক্ষত্রের সাথে শেষবার কথা হয়েছিল। তারপর, খাবার খেয়ে বমি করে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসেছিল। নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে গেছিল। সেই জন্যই বোধয় ওয়াসিফ রুম ছেড়ে দিয়ে বেলকোনিতে বসেছে যাতে ইরিনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়। এটুকু ভেবেই স্বস্তিতে আলতো হাসলো ইরিন।

হঠাৎ ওর মনে হলো এতটা সময় হয়ে গেছে ও বাড়ি ফিরেনি, যদি অদ্রিজা ফিরে গিয়ে ওকে না পায়? তখন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কি জবাব দিবে? ফোনটাও বন্ধ। ইরিন তাড়াহুড়ো করে চাদর সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো। উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো তার। কোনমতে সামলে নিল নিজেকে।বিছানার এক পাশে নিজের হ্যান্ডব্যাগটা দেখতে পেল ইরিন। আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে ব্যাগ থেকে পাওয়ার ব্যাংকটা বের করে ফোন চার্জে দিল। নক্ষত্রই কিনে দিয়েছে এটা। যাতে বাইরে গেলে ফোনের চার্জ নিয়ে কোন সমস্যায় না পড়তে হয়। ইরিন আলতো হাসে নক্ষত্রের এমন যত্নের কথা ভেবে। মানুষটা সবদিক থেকেই তার খেয়াল রাখে।

৯১.

ফোন চার্জে দিয়ে ওয়াসরুমে গেল ইরিন। ফ্রেস হয়ে এসে মুখ মুছতে মুছতেই নজর গেল বেলকোনির দিকে। ওয়াসিফ ফোন কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে বোধয় কারও সাথে। তার থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হবে বলে বেলকোনির দিকে পা বাড়ালো ইরিন। দূরত্ব কমতে কমতেই স্পষ্ট হলো কিছু কথোপকথনের স্বর।

‘ আরেএএএ…মা, তুমি বুঝতেছো না কেন! ওরে এভাবে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মেডিকেল ইস্যুর বেসিসেই এখন ওরে নিয়ে যাবো লন্ডন। আমি ফাহিমকে বলছি সব কাগজ রেডি করে দিতে। আজকে ১২ টায় ফ্লাইট বুক করা হয়েছে।

‘…………’

‘আরে…ধুর! সব তো ওই শালীর জন্যই হইলো। আমাকে এত গুলা টাকা খরচ করে নতুন করে সব প্ল্যান এক্সিকিউট করতে হচ্ছে। শালী বাচ্চা নাকি আদৃত রে দিয়া যাবে। যে বাচ্চার জন্য এত কিছু ওরেই নাকি দিয়া যাবে। শালী তামাশা করে আমার সাথে।

‘………’

‘হ্যাঁ, লন্ডন গিয়ে আগে এবর্শনটা করাবো। তারপর, কিছুদিন নিজের কাছে রেখে ঠিকঠাক করে তারপর যা করার করবো। বাচ্চা পেটে নিয়া যা চেহারা করেছে নিজের….পাগলেও মুখ ফিরিয়ে নিবে। কাস্টমার তো চেয়েই দেখবে না।

‘……..’

‘থাকলে থাকবে আমার সাথে। এমনিতেও তো সতী সাবিত্রি টাইপ কিছু না। বাচ্চা পেটে নিয়া প্রেমিকের সাথে পালানোর ধান্দা করে শালী…ব্যা* র থেকে আর কম কি! বিদেশে গেলে তো তাও ভালো একটা নাম পাবে ‘স্কট গার্ল’। নইলে আমি চাইলেই তো দেশী কুত্তাগুলার হাতেই দিয়া যাইতে পারতাম ওরে। ব্যা* নাম নিয়া রেড এরিয়ার বাসিন্দা হতো।

‘……’

‘ না, এখন আর ফিরবো না দেশে। একেবারে বিয়ের আগে আসবো। তুমি অদ্রিজার মাকে বলে মাস দুই পরেই বিয়ের ব্যবস্থা করাও। নইলে ইরিনের ব্যাপারটা সহজে চাপা পড়বে না। ‘

‘………’

‘হু…এখনো ঘুমে। হাই ডোজের ইঞ্জেকশন তো। একটাতেই প্রায় পুরা দিন কাভার। তারপরেও, আরেকটা ইঞ্জেকশন দিবো এখন আবার। লন্ডন পৌঁছানোর আগে আর ঘুম ভাংবে না তাহলে। বলতে পারো, যতক্ষণে ঘুম ভাংবে ইরিন রাণী অন্য এক রাজ্যে পৌঁছে যাবে। রাজকন্যা আর রাজা ক্ষুইয়ে সর্বহারা রাণীর মত জায়গা পাবে তার নতুন রাজ্যে। ‘

‘………’

‘বাচ্চার ক্ষতি হইলে হবে। এতে টেনশনের কি আছে।আর ইরিন মরলেও আমার কিছু যায় আসবে না। ওর খোঁজ করার লোক কই আর!’

‘…….’

‘তোমার জন্য আমি সব করতে পারি মা। তোমার এত বছরের কষ্ট যদি এতে বিন্দুমাত্র কম হয়,তাতেও আমার শান্তি। আর এরপর তো ফরিদা শেখের সাধের বংশ আর তার বংশধরের কিচ্ছা কাহিনী আজীবনের নামে এখানেই ইতি টানবে। সেই সুখটুকু তোমার করার জন্য যা যা করা লাগে আমি করবো। ‘

‘………’

‘আমাকে করা অবহেলাটুকু আমাকে যতটা না কষ্ট দেয়, আমার মাকে করা অবহেলাটুকু আমাকে তার থেকে বেশি কষ্ট দেয় মা। বিয়ে তো ঠেকানো গেল না। এবার বউ বাচ্চা দুটোই ক্ষুয়াবে শালা। ‘

‘……………’

‘হ্যাঁ, ডিভোর্স পেপার আজ সকালেই আদৃতর হাতে পৌঁছে যাবে। পুলিশও তখন আর কেস নিয়ে ঘাটবে না। পরকীয়ায় বউ হাতছাড়া হয়েছে, এই নিয়ে নিশ্চয় তোমার পেয়ারে ভাতিজা পুলিশ কেস করবে না…কি বলো? ‘ রসিকতার মত করে কথাটা বলেই সজোরে হেসে উঠলো ওয়াসিফ।

‘……’

‘হু, এরপর এম্নিতেও মনে হয় না দ্বিতীয় বিয়ে করবে ও। তারপরও তুমি তো আছোই ওর ব্রেইন ওয়াস করার জন্য। ‘

‘…………’

‘আচ্ছা, মা…রাখি এখন। ফ্লাইটে উঠার আগে কল দিবোনি। ‘

‘…..’

‘ওকে, বাই। ‘

ফোন কেটে দিল ওয়াসিফ। সেটা পকেটে রেখেই ঘুরে দাঁড়ালো ঘরে যাওয়ার জন্য। সামনে তাকাতেই তার চোখে পড়লো বিদ্ধস্ত ইরিনের মুখ।

৯২.

ইরিনের হাত পা মৃদু মৃদু কাঁপছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে একদম। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে।এই মূহুর্তে কি ছেড়ে কি করবে সেটাও বুঝতে পারছে না সে। ওয়াসিফ এমন একটা মানুষ হবে তা ওর কল্পনাতেও আসেনি কোনদিন।

এই তো আজ দুপুরেও কিভাবে ব্যাকুল হয়ে বলছিল, ইরিনকে সে ভালোবাসে। ওর বাচ্চাটার বাবা হতেও রাজি। অথচ, এই বাচ্চাটাকেই কিনা শেষ করে দিতে চাইছে? এটা সত্যিই ওয়াসিফ তো! নাকি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে সে? ভাবনার কোন কূল কিনারা ঠাওর করতে পারেনা ইরিন।

এদিকে ওয়াসিফ ওর দিকে চিন্তিত মুখে এগিয়ে আসছে। যা শুনেছে তারপর ওয়াসিফের সাথে একমূহুর্তও এখানে থাকা মানেই বড় কোন বিপদ ওর জন্য অপেক্ষমান। ইরিন কি করবে বুঝতে পারলো না। কিন্তু, মস্তিষ্ক বারবার জানান দিচ্ছে ওকে এখান থেকে বের হতেই হবে। নইলে বাচ্চাটাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।

হুট করে তার মনে হলো, নক্ষত্র তার মোবাইলে SOS সিস্টেম সেট করে দিয়েছিল। মাত্র একবার প্রেস করতে পারলেই নক্ষত্রের কাছে পৌঁছে যাবে ওর অবস্থান। ওকে খুঁজতে নক্ষত্র নিশ্চয় তখন এখানে আসবে। তার পরী আর রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে এই বিচ্ছিরি মানুষটার জাল থেকে।

ইরিন দেরি করলো না। দ্রুত বিছানা থেকে ফোন নিয়ে অন করে বাটন প্রেস করলো। ওয়াসিফ ততোক্ষণে ওর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ইরিনের চোখ মুখের অবস্থা আর বেলকোনির কাছাকাছি অবস্থান দেখে কপালে ভাঁজ পড়লো ওয়াসিফের। ইরিন কিছু শুনেছে কিনা সেই সন্দেহেই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লো সে। ইরিনের কাঁধে হাত রেখে চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘ কখন উঠেছো সুইটহার্ট? ‘

ইরিন সাথে সাথে দু কদম পিছিয়ে এলো। ওয়াদিফের নিশ্বাসের উষ্ণতাও এখন ঘৃণায় গা গুলিয়ে তুলছে ওর। শরীরের স্পর্শ সহ্য করা তো চরম অসহনীয় ব্যাপার। ওয়াসিফের সন্দেহ তীব্র হলো। এবার সরাসরি প্রশ্ন করলো ইরিনকে, ‘ তুমি আমার কথাগুলো শুনেছো , তাই না ইরিন?’

রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় বড্ড অসহনীয় লাগছে ইরিনের সবকিছু। এতবড় ষড়যন্ত্র, এতবড় প্রতারণা তার জন্য অপেক্ষা করছিল এটা ভাবতেই রাগে সারা শরীর রি রি করে উঠলো তার। মন বললো, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এগুলো তোমার পাপের ফল। যা তুমি নক্ষত্রর সাথে করতে যাচ্ছিলে সেটাই এবার বুমেরাং হয়ে তোমার প্রাপ্তিতে যোগ হলো। প্রকৃতি কাউকে ছাড়ে না। পাপ করলে সর্বনাশ নিশ্চিত।’

মনের কথায় এবার ভীষণ অসহায় লাগলো ইরিনের নিজেকে। সত্যিই তো, এগুলো তারই পাপের ফল। নক্ষত্রকে দিনের পর দিন ঠকিয়ে যাওয়ার শাস্তি। কিন্তু বাচ্চাটার কি দোষ? ও কেন শাস্তি পাবে?শুধুমাত্র ও ইরিনের অংশ বলেই কি তার পাপের শাস্তিসরূপ মৃত্যুভাগ্য হবে ওর? ইরিন আর ভাবতে পারে না। রাগে দুঃখে কান্না চলে আসে ওর।

৯৩.

ওয়াসিফ ইরিনকে চুপ থাকতে দেখে এবার সজোরে ধমকে উঠে। ‘সব শুনেছো তুমি, নাহ??’

ইরিন কেঁপে উঠে এমন ধমকে। কিন্তু, সাহস হারায় না। রাগে ঘৃণায় অগ্নিচক্ষু নিয়ে তাকায় ওয়াসিফের দিকে। দৃঢ়কন্ঠে প্রশ্ন করে তাকে।

‘কেন করছেন আপনারা এসব? আর ফুপু কি করে পারলো আপনার এই জঘন্য খেলায় সঙ্গ দিতে? কি সমস্যা আপনাদের? ‘ এবারে কিছুটা চেঁচিয়ে উঠলো ইরিন।

এতে খুব একটা ভাবান্তর হলো না ওয়াসিফের। ভুল তার দ্বারাই হয়েছে। তৃতীয় ডোজের ঘুমের ইঞ্জেকশনটা আরও আগেই দেওয়া উচিৎ ছিল। তা না হলেও রুমেই বসে থাকা উচিৎ ছিল ইরিনের কাছে। তবে যাই হোক, ভুল যখন হয়েই গেছে…..এর একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। সে খোলাসা করেই বললো।

‘প্রতিশোধ বলতে পারো। কিংবা প্রতিরোধের চেষ্টা। এ্যাজ ইউ লাইক টু স্যে। ‘

‘কিসের প্রতিশোধ? ‘ অবাক হয়ে বলে ইরিন।

‘আচ্ছা, আসো সুইটহার্ট…তোমাকে একটা গল্প শোনাই।এম্নিতেও ভালোভাবে সকাল হতে অনেকটা সময় বাকি। ফ্লাইটে উঠার আগে সময়টুকু কাটানোর জন্য এটা একটা ভালো উপায়..কি বলো?!’ বলতে বলতেই ইরিনের কাঁধে হাত রেখে তাকে জড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় ওয়াসিফ। ইরিন নড়ে না এক পাও!

একঝটকায় নিজের কাঁধ থেকে ওয়াসিফের হাত সরিয়ে দেয় সে। রাগে চেঁচিয়ে বলে, ‘কতবার বলেছি আপনাকে ছোঁবেন না আপনি আমাকে! তাও কেন টাচ করেন বারেবার! ‘

ওয়াসিফের ভেতর ভেতর রাগ হলো ইরিনের এমন ব্যবহারে।সেই শুরু থেকেই একটু ছুঁলেই এমন ব্যবহার সহ্য করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এবার আর সহ্য করলো না। প্রচন্ড রেগে ইরিনের কোমড় চেপে ধরে নিজের মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো।

দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘ শালী একজনের বাচ্চা পেটে নিয়া ঘুরিস, আবার আমি টাচ করলেই তোর শরীরের ফোঁসকা পড়ে না? এত কিছু শুনছিস তুই..এটা শুনিস নাই ক’দিন পরে তোর পরিচয় কি হবে? স্কট গার্ল বুঝিস? তোদের ভাষায় ব্যা*…পতিতা বলে যাদের। রেড এরিয়ার বাসিন্দা হবি তুই। তখন কাকে কাকে ঠেকাবি হ্যাঁ? কাকে বলবি টাচ না করতে?’

ওয়াসিফের এমন কথায় রাগে লজ্জায় কান গরম হয়ে গেল ইরিনের। কি নোংরা কথাবার্তা। শব্দগুলো কানের ভিতর গরম শিসা ঢেলে দিচ্ছে যেন। আর সে কিনা এতকাল এই মানুষটার কথায় বিভোর হয়ে থাকতো। নতুন জীবনের ভরসা খুঁজে পেত। একটা সুখের জীবন…স্বস্তির জীবন। অথচ এই মানুষটা তার জন্য কেমন নতুন জীবন সাজিয়ে রেখেছে? দূর দেশে যেখানে নিজের একটা সাজানো গোছানো বাড়ি হওয়ার কথা বলেছিল, সেই দূর দেশেই নাকি তাকে নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দা করতে নিয়ে যাবে!

এই চিনেছিল ইরিন তাকে? ভরসা করেছিল? এতটাই বিশ্বাস করেছিল যে নক্ষত্রকে পর্যন্ত বিনাবাক্য বেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। সই করেছে ডিভোর্স পেপারে! ইরিন আর ভাবতে পারলো না। চোখ বন্ধ করতেই গলগলিয়ে কান্না বেরিয়ে এলো তার।

৯৪.

‘ঘুমের মাঝে বড্ড জ্বালাও তুমি সুইটহার্ট। ‘ কথাটা বলতেই ধপ করে চোখ খুললো ইরিন। অবাক চোখে ওয়াসিফের দিকে তাকাতেই সে মুচকি হাসে। ইরিনের গালে নিজের বুড়ো আঙুল ঘঁষতে ঘঁষতে বলে, ‘এভাবে বারবার বিড়াল ছানার মত বুকে মুখ লুকালে, নাক ঘঁষলে নিজেকে কি আর কন্ট্রোল করা যায় বলো? আদৃতও কি নিজেকে কন্ট্রোল করে নেয় নাকি প্রতি রাতেই… – নিজের কথার ইংগিতে বাঁকা হাসে ওয়াসিফ।

ইরিন ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত চোখে তাকায় ওয়াসিফের মুখের দিকে। ওয়াসিফ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে,

‘দু রাত ধরে তো আমার সাথেই ঘুমাচ্ছো তুমি। আমার রুমে, আমার বিছানায়। আমার রাতের ঘুম হারাম করে ছেড়েছো। একেই বোধয় দেশী জিনিসের স্বাদ বলে। ইউ নো ডার্লিং, এত বছর হলো লন্ডনে আছি। কত মেয়ে কাছে পেয়েছি। কিন্তু, আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে কাছে পেয়েও এতটা কন্ট্রোল করার প্রয়োজন পড়েনি যতটা না তোমার জন্য করতে হয়েছে। নিজেকে বুঝিয়েছি এভাবে মজা পাওয়া যাবে না। এবর্শনটা হলেই তারপর না হয় সব হবে। ‘

ইরিনের মনে হচ্ছে ওর পায়ের নীচ থেকে একটানে জমিন কেড়ে নিয়েছে কেউ। অথৈ সাগরে নিয়ে ফেলেছে তাকে। যেখানে না তল আছে আর না কোন কূল। ওয়াসিফের ঠোঁটের যে বাঁকা হাসিটা ওকে মুগ্ধ করতো এতকাল এখন সেই হাসিটাই পৃথবীর বিদঘুটে আর নিষ্ঠুরতম হাসি বলে ঠেকছে ইরিনের কাছে। নিজের সাথে কি ঘটেছে সেটা মস্তিষ্কে খোলাসা হতেই ঘৃণায়, যন্ত্রণায়, লজ্জ্বায় গা জ্বলে উঠলো ইরিনের। অস্থির গলায় প্রশ্ন করলো, ‘আমি কত দিন হলো এখানে?’

‘উউউমমম….আজ নিয়ে দুই রাত তিনদিন। ‘

‘আপনি কি করেছেন আমার সাথে?’ শংকা আর ভয় নিয়ে কান্না জড়ানো অসহায় গলায় বললো ইরিন।

‘বেশি কিছু করিনি। জাস্ট একটু আধটু ছুঁয়েছি। এটাও করতাম না যদি তুমি ঘুমের মাঝেই আমাকে ওভাবে সিডিউস করতে। সো….দোষ কিন্তু আমার একার নয় ডার্লিং। ‘ দুষ্টু হেসে বললো ওয়াসিফ।

ইরিনের আর সহ্য হলো না এসব। ধাক্কা দিয়ে ওয়াসিফকে সরানোর চেষ্টা করলো সে। কিন্তু সফল হলো না সেটা। নিজেকে সামলে নিয়ে কঠোর গলায় বললো, ‘আমাকে ছাড়ুন ওয়াসিফ। বাড়ি যাবো। উনি নিতে আসছেন আমাকে।’

‘লাইক সিরিয়াসলি, ইরিন! এত কিছুর পরেও নক্ষত্র তোমাকে নিতে আসবে? তাছাড়া নক্ষত্র জানবেই বা কি করে তুমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে কোথায় গেছো?’ হাসতে হাসতে বললো ওয়াসিফ।

‘আমি বলেছি তাকে। আসবেন উনি। আপনি ছাড়ুন আমাকে।’

ইরিন মুচড়ামুচড়ি করছি, কিন্তু ওয়াসিফের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার।

‘কখন বলেছো?’ ভ্রু কচুকে বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো ওয়াসিফ।

‘ঘুম ভাঙার পরে। উনি এসে পড়বেন এখুনি। যেতে দিন আমাকে।’

ইরিনের কথায় কি যেন ভাবে ওয়াসিফ। তারপর ঝরঝরে গলায় বলে, ‘বুঝলে সুইটহার্ট এই চালাকি করার ব্যাপারটা না তোমার ক্যারেক্টারের সাথে ঠিক যায় না । মানায় না তোমাকে। তুমি তো ঠিক করে মিথ্যাও বলতে জানো না। ‘

‘আমি কোন মিথ্যা বলিনি। উনি আসছেন এখানে। আমাকে নিয়ে যেতে। ‘ দৃঢ় কন্ঠে বললো ইরিন।

‘ওকে….অল রাইট…অল রাইট। তাহলে তো আমরা ধরা পড়ে যাবো তাই না, সুইটহার্ট? তখন নক্ষত্র তোমাকে এক্সেপ্ট করবে?’

ইরিন এবার কথা খুঁজে পায় না। সত্যিই তো নক্ষত্র এসে ওকে ওয়াসিফের সাথে দেখে যদি প্রশ্ন করে ও দুদিন ধরে ওয়াসিফের সাথে কি করছিল, কি জবাব দিবে সে? সত্যি বলবে? বিশ্বাস করবে নক্ষত্র?

নাকি মিথ্যা বলবে যে ওয়াসিফ জোর করেছে? নাহ….যা হওয়ার হবে এবার আর সে মিথ্যা বলবে না। ওয়াসিফের সত্যি প্রকাশ করবে সবার কাছে। ওর জীবনের যাই হোক, অদ্রিজার জীবন বাঁচাতে হবে। ওয়াসিফের সাথে কিছুতেই বিয়ে দেওয়া যাবে না ওর। ‘

৯৫.

গলার কাছে উষ্ণ অনুভূতিতে ভাবনাচুত্য হয় ইরিন। ওয়াসিফকে নিজের এত কাছে দেখে কি ঘটতে চলেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না ওর। ওয়াসিফের বুকে হাত রেখে তাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করে আবারও।

‘ডোন্ট টাচ মি। আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে টাচ করার? ‘

ওয়াসিফ আর এবার নিজেকে সামলাতে পারে না। রাগ মাথায় চড়ে বসে তার। হুশ জ্ঞান ভুলে ইরিনের চুলের মুঠি ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় একেবারে। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে ইরিন। দূর্বল শরীরেও নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা।

ওয়াসিফ এসবের কিছুই মানে না। অন্য হাতে শাড়ির কুচিতে টান দিতেই ইরিন তার হাত ধরে ফেলে। নিজের সমস্ত জোর দিয়ে ওয়াসিফকে ধাক্কা দিতেই কিছুটা বেসামাল হয়ে দু কদম পিছিয়ে যায় সে। ইরিনও দেরি করে না। খুলে যাওয়া শাঁড়ির কুচিগুলো কোনমতে হাতে নিয়ে দরজার দিকে দৌঁড়ে যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না তার। এলোমেলো শাড়িতে পা লেগে উপুড় হয়ে পড়ে মেঝেতে। মূহুর্তেই প্রবল এক আত্মচিৎকারে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে ইরিনের। কিছুসময়ের ব্যাবধানেই ধীরে ধীরে অনুভব করে সূক্ষ ধারায় বেঁয়ে আসা তরল কিছুর অস্তিস্ত্ব। চিৎ হয়ে শুয়ে পেটে হাত রাখে সে। চিনচিনে একটা ব্যাথা ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে থাকে।

ওয়াসিফ আর তাড়া দেখায় না। ধীরে সুস্থে হেঁটে এসে ইরিনের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। বাঁকা হেসে বলে, ‘এত ছটফট করলে চলে বলো? কন্ট্রোল করতে প্রবলেম হয় তো।’

এরপর,একনজর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল ওয়াসিফ। ফ্লাইটের আরও ৪ ঘন্টা বাকি। তারপর কিছু একটা ভেবে বাঁকা হাসলো সে। ইরিনের এমন অসহায় অবস্থা দেখে বেশ খুশি খুশি গলায় বললো, সময় আছে তো অনেকটা।একদান তবে খেলেই নেই এখন, হোয়াটস স্যে সুইটহার্ট? তারপর, তোমার উনি এসে তোমায় নিয়ে যাক বা ফেলে যাক, আমি কিন্তু সাথে নিতে আপত্তি করবো না তখনো। ‘

৯৬.

ইরিন পেটের ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে একদম। ভিজে ভাবটা বাড়ছে মনে হচ্ছে।ব্যাথায় যন্ত্রণায় জর্জরিত থাকায় ওয়াসিফের কথা ওর কানেই গেল না একপ্রকার। অসহনীয় ব্যাথায় আর্তনাদ করে বললো, ‘ওয়াসিফ আমার বাচ্চাটা!’

ওয়াসিফ ইরিনের কথা যেন শুনেও শুনলো না। আলগোছে ইরিনকে কোলে তুলে নিল। ইরিন যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

‘ওয়াসিফ প্লিজ আমাকে হসপিটালের নিয়ে যান। আমার বাচ্চাটা…

কথা শেষ হয় না ইরিনের। তার আগেই তাকে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ওয়াসিফ। কোমড়ে বেশ জোড়েসোড়েই লাগে ইরিনের। ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে আসে ওর। তবুও, প্রাণপণে চেষ্টা চালায় নিজেকে রক্ষার।

ওয়াসিফকে শার্টের ইন আলগা করতে দেখে দ্রুত বিছানা ছেড়ে দ্রুত নেমে যায় ইরিন। ওয়াসিফ এগিয়ে যায় ইরিনের দিকে। পালানোর চেষ্টা করায় ঘাড়ে ধরে এবার দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে ইরিনকে সে। আরও একবার পেটে চাপ লাগে বাজেভাবে। ওয়াসিফ ইরিনের ব্যাথা বাড়িয়ে দিয়ে কাঁধে কামড় বসিয়ে দেয়। ইরিন চিৎকার দিয়ে উঠলে এক হাতে মুখ চেপে ধরে। তাকে আবারও একটানে বিছানায় এনে ফেলে। এই অসহায় মূহুর্তেও ইরিনের মস্তিষ্ক সংকেত দেয় আসন্ন বিপদের। কিন্তু, মুক্তির উপায় খুঁজে পায় না।

ওয়াসিফ এবার আর দেরি করে না। নিজের সমস্ত ভর ছেড়ে দেয় ইরিনের উপর। বলিষ্ঠ হাতের মাঝে মুঠোবন্দী একজোড়া হাত আর চেপে ধরে রাখা ঠোঁটের ভাঁজে চাপা পড়ে যায় মুক্তির চেষ্টা আর কিছু অস্পষ্ট আর্তনাদ।

৯৭.

শেখ ভিলার বিশাল ড্রয়িংরুমের দুটো সোফায় মুখোমুখি বসে আছে নক্ষত্র এবং মি. হামিদ। নক্ষত্রের হাতে ইরিনের সই করা ডিভোর্স পেপার।

গত দুইদিন ধরে হন্যি হয়ে ইরিনকে খোঁজার পর আজ সকালে মি. হামিদ আসেন নক্ষত্রের বাড়িতে। ইরিনের পক্ষ থেকে উকিল হিসেবে ডিভোর্সের নোটিশ নিয়ে। নক্ষত্র প্রথমে অবিশ্বাস করলেও ইরিনের স্বাক্ষর চিনতে ভুল হয়নি ওর। সেই সাথে সেদিন রাতে ইরিনের ছেড়ে যাওয়ার কথাগুলো মনে হতেই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলে নক্ষত্র।

নক্ষত্র এখনো ঝিম মেরে বসে আছে সোফায়। ক্লান্ত ঘুমহীন শরীর মনে ইরিনকে খোঁজার তাড়নায় যেটুকু জোর অবিশিষ্ট ছিল, সেটুকুও যেন শেষ এখন তার। এভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর মি. হামিদ বললেন,

‘আজ তাহলে উঠি, মি. আদৃত। আপনি আপনার পক্ষের উকিলের সাথে যোগাযোগ করুন। ইরিন ম্যাম দেশে ফিরে এলেই আপনাদের ডিভোর্স কেসটা কোর্টে উঠবে। ‘

‘ইরিন কোথায় গেছে?’ নিস্তেজ স্বরে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।

‘আ’ম স্যরি, মি. আদৃত। ম্যাম এটা বলার অনুমতি দেননি আমাকে। ‘

‘এটা কি সত্যিই ইরিন পাঠিয়েছে?’ নিজের বিশ্বাসটুকু বাঁচিয়ে নিতে কিঞ্চিৎ আশা নিয়ে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।

‘জ্বী। এবং উনি গতকাল রাতেই দেশ ছেড়েছেন। আমাকে নির্দেশ দেওয়া ছিল যেন আজ সকালে ডিভোর্সের নোটিশ এবং উনার সাইন করা কাজগটা আপনার কাছে পৌঁছে দেই। ‘

‘ডিভোর্স দেওয়ার কারণ কি?আমাদের মাঝে তো কোন সমস্যাই ছিল না কখনো। ‘

‘ কারণ মূলত আপনাদের বাচ্চাটা। ম্যাম বলেছেন, আপনি এবং আপনার পরিবার এই বাচ্চাটাকে জোর করে এবোর্ট করতে চাইছেন। কারণ এটা একটা মেয়ে বাচ্চা। আর আপনি মেয়ে চাননা।’

‘আপনি কি জানেন ইরিন মাত্র পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট ? এই সময় তো জানাই সম্ভব না বাচ্চাটা ছেলে নাকি মেয়ে! দ্যান হাউ কুড সি ব্লেইম মি লাইক দিজ?’

‘সম্ভব স্যার। আজকাল এটা অবৈধ্য হলেও দূর্নীতির বাজারে এটা ঠিকই টিকে আছে অগোচরে। জায়গামত টাকা ঢাললেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে সুড়সুড় করে। আপনিও জোর করে অবৈধ্যভাবে উনার গর্ভের সন্তানের সেক্স ডিটারমিনেশন টেস্ট করিয়েছেন।সেটার রিপোর্ট আমার কাছে আছে। ‘

নক্ষত্র পুরোপুরি হতভম্ব মি. হামিদের কথায়।ওর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হচ্ছে না যে ইরিন এমন কিছু করতে পারে। এমন একটা মিথ্যা কারণ, প্রমাণ সাজিয়ে ডিভোর্স পেপার সাইন করে পাঠাবে। তাও আবার বাচ্চাকে নিয়ে দেশ ছেড়েও নাকি চলে গেছে কোথাও একটা। কিন্তু, কার সাথে গেছে? ওর জানামতে ইরিনের তো কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল না কারও সাথে। বেশ সুখেই ছিল তারা।তাদের সুখের মাত্রা বাড়িয়ে নওরিন আসছে তাদের জীবনে। তাহলে কেন এই মিথ্যা? তাছাড়া, ইরিন খুব ভালো করেই জানে যে নক্ষত্র মেয়ে সন্তানই চায়। তাহলে এই মিথ্যা কেন? ভেবে পায় না নক্ষত্র।

‘আমি তাহলে আজ আসি। আপনার কোন সমস্যা হলে আপনার উকিলকে পাঠিয়ে দিবেন আমার কাছে।আমার কার্ড রাখা আছে টি টেবিলের উপর। বাকি যা করার আমি বুঝে নেব। আসছি। ‘

মি. হামিদ আর অপেক্ষা করে না। চুপচাপ বেরিয়ে যায় শেখ ভিলা থেকে। নক্ষত্র ওখানেই ঠাই বসে রয়। দৃষ্টি হাতে থাকা ডিভোর্স পেপারটায় নিবদ্ধ।

৯৮.

এতগুলো দিন এক সাথে থেকেও কিছুই টের পাওনি তুমি? ‘ – অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন শায়লা।

‘না।’ -কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয় নক্ষত্র।

‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না নক্ষত্র, ইরিন এমন করতে পারে। বলা নেই, কওয়া নেই….সরাসরি ডিভোর্স পেপার সাইন করে পাঠিয়ে দিল? আবার নাকি দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে গেছে। ‘

‘বলেছিল বহুবার, আমিই বুঝতে পারিনি। আভাস তো ঠিকই দিয়েছিল ও…আমিই বোকার মত সেটা ধরতেই পারনি। ‘

‘মানে? কি হয়েছে নক্ষত্র…খুলে বলো আমাকে। ‘ চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করলেন শায়লা।

‘জানেন আম্মু, ইরিন চলে যাওয়ার আগের রাতেও আমাকে পরোক্ষভাবে জিজ্ঞেস করেছিল যদি ও আর নওরিন আমাকে ছেড়ে যায় তাহলে কেমন হবে? আমি থাকতে পারবো কিনা! কিভাবে থাকবো! আমি বুঝিনি আম্মু, ইরিন আমাকে এভাবে ছেড়ে যাবে বলেই বলেছিল। বোকা আমিটা কিছু টেরও পাইনি ওর কথার ভাঁজে লুকানো উদ্দেশ্য সম্পর্কে। ‘ নিজের বোকামোর প্রতি আফসোস করে বললো নক্ষত্র।

‘কিন্তু, ইরিন কেন এমন করলো? ওর কারো সাথে সম্পর্ক ছিল? তোমাকে বলেছে কখনো কিছু?’

‘না। আমারও কখনো মনে হয়নি ইরিন আমাকে ছাড়া অন্যকাউকে… – গলা ধরে আসে নক্ষত্রের। কথা শেষ করতে পারে না।

শায়লা ব্যাথিত মনেই স্নেহভরা হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নক্ষত্রের। তাকে সামলানোর চেষ্টা করে বলে, ‘এতগুলো দিন একসাথে থেকেও আমার কখনো মনে হয়নি মেয়েটার মাঝে কোন খাদ আছে। তোমার প্রতি ওর যত্ন, দায়িত্ববোধ আমাকে নিশ্চিত করেছিল এই বুঝি আমি যোগ্য মানুষটাকে বেছে এনেছি আমার নক্ষত্রের জন্য। অথচ, আজ বুঝতে পারছি আমি কত বড় ভুল করেছি! ‘

‘আম্মু, ইরিন গেল তো গেলোই। আমার বাচ্চাটাকে কেন সাথে নিয়ে গেল? কি হতো ওকে দিয়ে গেলে? আমি তো কতবার বলেছিলাম ওকে তুমি যেতে চাইলে আটকাবো না, তাও কেন…’ কান্না দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে নক্ষত্র। ইরিনের এই বিশ্বাসঘাতকতা ও কিছুতেই মানতে পারছে না।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো নক্ষত্রের। আশপাশে তাকিয়ে দেখলো সাইড টেবিলের উপর ফোন রাখা। শায়লা এগিয়ে গিয়ে ফোনটা এনে নক্ষত্রের হাতে দিলেন। তাকে কথা বলতে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

৯৯.

ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই কপাল কুচকে গেল নক্ষত্রর। থানার ইন চার্জ অফিসার খালেদ সিদ্দিক কল করেছে। তাচ্ছিল্য করে হাসে নক্ষত্র। ইরিনের খোঁজ করতে গিয়ে এই ক’দিন খুব বিরক্ত করেছে নক্ষত্র তাকে। অথচ সেই ইরিনই কিনা…!

কল রিসিভ করে কানে ধরলো নক্ষত্র। অফিসারের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ইরিনের আর কোন খোঁজ…

‘আপনি একবার হোটেল এক্সটোরিয়াতে (ছদ্মনাম) চলে আসুন মি. নক্ষত্র।একজন প্রেগন্যান্ট মহিলার কেস। মলেস্ট হয়েছে। অবস্থা ক্রিটিকাল বলা হয়েছে। আপনার দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী আমরা সাসপেক্ট করছি ভিকটিম আপনার ওয়াইফ। আপনাকে ভিকটিম আইডেন্টিফাই করতে হবে। আ’ম অন দ্যা ওয়ে। কাম ফাস্ট প্লিজ। ‘ কথা শেষ করে দ্রুত ফোন কেটে দিল অফিসার খালেদ। গাড়ি দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে হোটেল এক্সটোরিয়াতে।

নক্ষত্র বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। যাবে কি যাবে না এই নিয়ে। অফিসার তো কেবল আন্দাজ করছে ভিকটিম ইরিন। কিন্তু, সে তো জানেই না ইরিন দেশ ছেড়ে চলে গেছে। তবুও, নক্ষত্রের মন চাইলো একবার গিয়ে দেখতে। বেচারা অফিসারকে অনেক জ্বালিয়েছে সে। তার কথায় একবার গেলেই বা কি। এতে বরং তার কাজটাও হয়ে যাবে। ইরিনের কেসটা ক্লোজ করার ব্যাপারটাও আলাপ করে নেওয়া যাবে।

এইসব ভেবেই নক্ষত্র উঠে দাঁড়ালো। ফোনটা পকেটে ঢোকাতে যাওয়ার আগে চোখে পড়লো স্ক্রিনে ভেসে উঠা SOS ম্যাসেজ। নাম্বারটা খেয়াল করতেই বুকের ভেতর ধক করে উঠলো নক্ষত্রের। ইরিনের নাম্বার…সেটাও বাংলাদেশের! ম্যাসেজের সময় দেখলো সে। ভোর ৬’৪৭ মিনিটে এসেছে ম্যাসেজটা।।অথচ নক্ষত্র খেয়ালই করেনি একবারও। গতকাল রাত থেকেই ফোনটা বেড সাইড টেবিলের উপর ছিল। ছুঁয়েও দেখা হয়নি। আর এখন বেলা ১ টা প্রায়।

নক্ষত্রের মাথায় এলো মি. হামিদ বলেছেন ইরিন গত রাতের ফ্লাইটেই দেশ ছেড়েছে। অথচ ম্যাসেজের সময় বলছে অন্য কথা। ইরিন কি তবে বাংলসদেশেই?

সময় নষ্ট করে না নক্ষত্র। ফোনটা হাতে নিয়েই লোকেশন সার্চ দেয়। গুগল লোকেশন দেখায়…এয়ারপোর্ট এরিয়া, হোটেল এক্সটোরিয়া!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here