নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_২৫

0
580

নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_২৫
লেখায়_জারিন

১৪৭.

‘কতদিনের জন্য যাচ্ছেন?’

‘ঠিক নেই। আপাদত ১৫ দিনের প্রিপারেশন নিয়ে যাচ্ছি। এর কম বেশিও হতে পারে। কাজ শেষ হওয়ার উপর ডিপেন্ড করছে।’ – জুতোজোড়া পায়ে পড়তে পড়তে বললো নক্ষত্র।

‘এতদিন!!’ অবাক হয়ে বললো ইরিন।

‘হু। এবার একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই।এই প্রোজেক্টের সাথে কোম্পানির রেপুটেশন অনেকখানি জড়িয়ে আছে।তাই আমি নিজে সবটা দেখে শুনে হ্যান্ডেল করতে চাইছি।’ ইরিনের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো নক্ষত্র।

‘তাহলে পুতুলকে আর কিছুদিন আমার কাছে রেখে দেই?’ কিছুটা কাচুমাচু করে আবদারের স্বরেই বললো ইরিন।

‘তোমার তো আজকে ছুটি শেষ। কাল থেকে অফিস জয়েন করবা। পুতুল একা থাকবে কিভাবে! ‘

‘আমি আম্মাকে আসতে বলবো। অফিস টাইমটুকু আম্মার সাথেই থাকবে না হয়। রিতুও তো আছে। মেয়েটা অসুস্থ..আপনি দেশের বাইরে যাচ্ছেন। আমিও কাছে থাকবো না…মেয়েটা এভাবে একা থাকবে? ‘

‘একা তো তুমিই করে দিয়েছো পুতুলের আম্মু। তাছাড়া, এটা তো নতুন না। আমি আগেও পুতুলকে ছেড়ে অনেকবার অফিসিয়াল ট্যুরে গেছি।আম্মু,কনকের কাছে থেকেছে পুতুল। ওর অভ্যাস আছে। ‘

‘হ্যাঁ…কিন্তু এতদিন তো থাকেননি কখনো।মেয়েটা থাকুক না আরও কিছুদিন আমার কাছে।’

‘তাহলে তুমি চলো শেখ ভিলায়।পুতুলের সাথে থাকবে। ‘

ইরিন চুপ করে গেল নক্ষত্রের এমন কথায়। শেখ ভিলা ছেড়ে আসার পর এই এক বছরে তার যাওয়া হয়নি আর কখনো। এতগুলো বছরের এত এত স্মৃতি ও বাড়িতে।কত সুখ দুঃখের সময় পার করেছে সে ওখানে। কত ভালোবাসা.. অপমান, অবহেলার সাক্ষী ও বাড়ির প্রতিটি ইট পাথর । তার থেকেও বড় কথা ও বাড়িতে নক্ষত্র আর তার ঘর রয়েছে একটা।চার দেয়ালের একটা ঘর হলেও কত কত মূহুর্তের স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ও ঘরের কোণায় কোণায়। যা ইরিনকে প্রচন্ড দূর্বল করে দেয়। পিছু টেনে ধরে। শায়লার থেকে যেতে বলার মত স্নেহভরা আবদার উপেক্ষা করতেও কষ্ট হয় ওর। তাই ইরিন যায় না ও বাড়িতে।

ইরিনকে এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নক্ষত্রও এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাত হয়ে যাচ্ছে। পুতুলকে নিয়ে ফিরে যাবে আজ সে শেখ ভিলায়। আগামীকাল একটা প্রোজেক্টের কাজে ইউরোপ যেতে হবে তাকে। সেটারও প্রস্তুতি নিতে হবে। হঠাৎ করেই জরুরি ভিত্তিতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েছে। তাই শায়লা দুই দিন থাকতে বললেও এক দিন থাকার পরেই আজ পুতুলকে নিয়ে ইরিনের বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে সে। ইরিনকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে না দেখে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললা নক্ষত্র। নিজেই বললো,

‘অনেকবার তো বলেছি তোমাকে..ফিরে চলো। এভাবে আলাদা থাকার কোন দরকার নেই। পুতুলের মা তুমি ,ওর মা হয়েই থাকো ও বাড়িতে। এমন তো না যে তোমার চাকরি করে ক্যারিয়ার গড়ার শখ। শুধুমাত্র আমার থেকে কোন ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট না নিয়ে একলা থাকছো বলেই তো করছো। কি দরকার এসবের? তোমার কোন কিছুর অভাব কি আমি কখনো রেখেছি?

‘আমার জীবনের সব থেকে বড় অভাবটাই আপনি তৈরী করে দিয়েছেন, নক্ষত্র। অথচ সেটা আপনি কখনোই পূরণ করেন না। অথচ, আপনার অভাবেই আমি আপনাকে ছেড়ে…আপনার সংসার ছেড়ে আমার ভালোবাসাগুলোকে ছেড়ে দূরে থাকছি।’ -কথাগুলো মনে মনে বললো ইরিন। নক্ষত্র নিজের মত বলে গেল যা বলছিল..

‘তাছাড়া, আম্মুর বয়স হয়েছে। কনকের পড়াশোনা আছে, ক্যারিয়ার আছে একটা। ও-ই বা কতটুকু সময় দিতে পারে পুতুলকে! আম্মু একা কত দিক সামলাবে? এন্ড মোস্ট ইম্পর্টেন্টল যেটা…পুতুল নিডস ইউ। ওর মা হিসেবে ওর সাথে থাকাটা কি তোমার দায়িত্ব নয়, পুতুলের আম্মু?’

‘আপনি ভালো করেই জানেন আমি কেন ও বাড়ি ছেড়ে এসেছি। কেন আমাকে পুতুলের থেকে আলাদা থাকতে হচ্ছে।’ নরম সুরে বললো ইরিন।

‘তুমি নিজের জন্য আমাদের মেয়েটাকে কেন কষ্ট দিচ্ছো পুতুলের আম্মু? একটা মেয়ের জীবনে মা কতখানি ইম্পর্টেন্ট তুমি বুঝো না এটা?’

‘বুঝি। তাই জন্যই পুতুলকে নিজের সাথে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, আপনাকে আপনার সন্তান থেকে আলাদা করতে চাইনি। তাই রেখে এসেছি আপনার কাছেই। ‘

‘তুমি নিজের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে মেয়েটাকে ওর অধিকার থেকে বঞ্চিত করছো, পুতুলের আম্মু। ‘ – রাগী গলায় বললো নক্ষত্র।

‘সন্তানের মা হলে কি আপন সত্তা নামক ব্যাপারটা থাকতে পারে না একজন নারীর? আত্মসম্মান বলে কিছু থাকে না তার? আর পুতুলের মা হওয়ার আগে তো আমি আপনার স্ত্রী। তাহলে স্ত্রীর অধিকার, মর্যাদা ছাড়া একই বাড়িতে…এক ঘরে, একই বিছানায় কেবলমাত্র আপনার সন্তানের মা হয়ে কি করে থাকতাম আমি আপনার সাথে? এভাবে তো স্বামী নামাক মানুষটাকেও পরপুরুষ লাগে। তার সাথে কিভাবে থাকি! এটুকু আত্মসম্মান কি আমার নেই?’

এতক্ষণ মাথা নীচু করে কথাগুলো বলছিল ইরিন। কথা শেষ করে নক্ষত্রের মুখপানে চোখ তুলে তাকালো সে। সহসা বুকের ভেতরটা সংকীর্ণ হয়ে এলো ওর। নক্ষত্র রক্তচুক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিন বুঝলো নক্ষত্র ভীষণ রেগে গেছে। চোখ নামিয়ে নিল সে। ও চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস তার নেই।

১৪৮.

সেকেন্ড কয়েকের মাঝেই হাতে টান পড়লো ইরিনের। নক্ষত্রের উপস্থিত আরও নিবিড় হলো তার সম্মুখে। দূরত্ব.. মিশে যেতে না পারা নিশ্বাসের অপারগতাসম। ইরিন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চুপচাপ নক্ষত্রের রাগ হজম করার প্রস্তুতি নিয়ে নিল মনে মনে।

‘পরপুরুষ লাগে তোর আমাকে? তাহলে এই দুইরাত আমাকে নিজের বাসায় রাখলি কেন? নাকি ডিভোর্স ফাইল করছিস বলে বাসায় পরপুরুষ রাখার লাইসেন্স পেয়ে গেছিস তুই?’

ইরিনকে নিজের সাথে মিশিয়ে উপচে পড়া রাগেও চাপা স্বরে বললো কথাগুলো ইরিনকে। যাতে তার রাগের আভাস ইরিন বাদে ভেতর ঘরে থাকা পুতুল কিংবা রিতুর কানে না পৌঁছায়।

হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে রাখায় ব্যাথা পাচ্ছে ইরিন। তবুও চুপচাপ সহ্য করে নিল। নক্ষত্রের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো, ‘আমি পুতুলের মা। ওর সাথে আমার আজন্মের রক্তের সম্পর্ক। আমি চাইলেও কোন কিছুর বিনিময়ে এ সম্পর্ক অস্বীকার বা ছিন্ন করতে পারবো না। কিন্তু, আপনিই তো বলেছিলেন একদিন, সব বাবা মা স্বামী স্ত্রী হয়ে থাকে না আজীবন। তাই আপনি যখন আপনার প্রতি কোন অধিকার, আমার প্রাপ্য মর্যাদা ছাড়াই আমাকে শুধুমাত্র পুতুলের বৈধ মা হিসেবে নামমাত্র আপনার স্ত্রী করে রাখবেন, তার থেকে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই তো ভালো, পুতুলের বাবাই। ‘ এটুকু বলে ইরিন থামলো। নক্ষত্রের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে বললো,

‘আপনি ভুল এটা আমি কখনোই বলবো না। আমি যে এত কিছুর পরেও আমার এই অপবিত্র শরীরে আপনার অংশকে ধারণ করতে পেরেছি, আপনার সন্তানকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে জন্ম দিতে পেরেছি এটাকে আমি আমার সৌভাগ্য মনে করি। আমাকে মা হওয়ার স্বাদ দেওয়ার জন্য আমি আজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। কিন্তু, এভাবে আর কতদিন থাকতাম বলুন তো? যাকে ভালোবাসি তার প্রতি সবরকম অধিকার থাকা সত্ত্বেও, তাকে নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েও..মানুষটার এমন উপেক্ষা কতদিন সহ্য করতাম আমি?

আমি জানি, দোষ আমার। অনেক ভুল করেছি…অন্যায় করেছি আপনার সাথে….কিন্তু ভালোবাসার মানুষটাকে এত কাছে পেয়েও তা নিজের করতে না পারার কষ্ট যে কতটা অসহনীয় সেটা আপনাকে আমি বলে বোঝাতে পারবো না,নক্ষত্র। তাই, দূরে সরে এসেছি।’

‘এই অসহনীয় কষ্টটা কি তোর একার? আমার হয় না এমন কষ্ট? ভালোবাসা চোখের আড়াল হলে কেমন অস্থির লাগে বুঝিস তুই? নাকি বুঝিস বলেই ইচ্ছে করে এমন করছিস?’ রাগে কোন কিছু না ভেবেই দাঁতে দাঁত চেপে বললো নক্ষত্র।

‘আপনি এখনো আমাকে ভালোবাসেন নক্ষত্র?’দ্বিধান্বিত মনে.. বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে ইরিন। কিন্তু, নক্ষত্র আর জবাব দেয় না। চোখ সরিয়ে নেয় ইরিনের প্রশ্নবোধক চোখের বিপরীতে। ইরিন আলতো হাসে নক্ষত্রের এ কাজে। যন্ত্রণা মিশেল সে হাসিও যেন তার নিজের জন্যই এক করুণ উপহাস। দলাপাকানো কান্নার স্বরে বলে,

‘আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। যার যার মত ভালো থাকার, সুখী হওয়ার অধিকার এবং সুযোগ আমরা দুজনেই প্রাপ্য। পুতুল তার বাবা মাকে একসাথে করে রেখেছে। তারা তাদের সম্মান করে,অধিকার দেয়। এটুকু পর্যন্তই থাক সম্পর্কটা। ভালো থাকবে সেটা।বাকিটা গুটিয়ে ফেলাই ভালো।’

ইরিনের এমন কথায় চমকে তাকায় নক্ষত্র তার দিকে। কিছু একটা ভাবে ইরিনের মুখপানে চেয়ে। সেই সাথে মনে উঁকি দেয় এক আদিম ভয়। প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়। আংশকা ও বিভ্রান্তি জড়িত গলায় প্রশ্ন করে ইরিনকে সে।

‘তুমি কি অন্য কাউকে পছন্দ করো,পুতুলের আম্মু? সম্পর্কে জড়িয়েছো কারো সাথে?’

ইরিন বেশ অবাক হলো আচমকা নক্ষত্রের এমন প্রশ্নে। নক্ষত্রের বিচলিত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো সে। তার থেকে জবাব না পেয়ে নক্ষত্র অস্থির গলায় প্রশ্ন করলো, ‘কি হলো বলো!’

‘ওয়াসিফের কেসের হিয়ারিং আছে সামনের মাসের ৯ তারিখ। আপনি এবার আসবেন সেখানে?’ নক্ষত্রের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো ইরিন।

‘এটা আমার প্রশ্নের জবাব না কিন্তু পুতুলের আম্মু!’ রাগে আরও জোরে ইরিনের হাত চেপে ধরে বললো নক্ষত্র। ইরিন ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। সাথে সাথে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা সিক্ত যন্ত্রণা। নিস্তেজ গলায় বললো,

‘হাত ছাড়ুন…পুতুলকে নিয়ে আসি। রাত হয়ে যাচ্ছে। ‘

‘তুই জবাব দিবিনা, নাহ?’

‘আমি বাধ্য নই। ‘ একরোখা স্বরে বললো ইরিন।

নক্ষত্র এবার সত্যি সত্যি রাগে ফেটে পড়লো।ইরিনের হাত ছেড়ে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল।ইরিন পিছিয়ে গেল দুকদম। নক্ষত্র কিছু বললো না তাকে। সোজা হেঁটে ভেতর ঘরে ঢুকে গেল। মিনিট খানেকের ব্যাবধানে পুতুলকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলো সে। লাগেজ আগেই গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে তাদের। তাই এবার সরাসরি পুতুলকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। না পুতুলকে কোন সুযোগ দিল তার মায়ের থেকে বিদায় নেওয়ার আর না ইরিনকে কিছু বলতে দিল। রিতু পুতুলের টেডি বিয়ারটা নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো ইরিন ছাড়া আর কেউ নেই সেখানে। অবাক স্বরে ইরিনকে প্রশ্ন করলো,

‘এই ছোটোপা, পুতুল আর ভাইয়া কই?’

ইরিন দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল।যেখান দিয়ে মিনিট খানিক আগেই তার ভালোবাসাগুলো ফিরে গেছে আবারও। মেয়েটাকে একটু ছুঁয়ে দিতে পারলো না সে। আবার কবে দেখা হবে কে জানে! নক্ষত্রের অনুপস্থিতিতে পুতুলের তার কাছে আসার অনুমতি নেই। ইরিন চাইলে শেখ ভিলায় গিয়ে থাকতে বা দেখা করে আসতে পারে। কিন্তু, সে কখনো শেখ ভিলায় পা রাখে না এখন আর । নক্ষত্রকেও আজ ফের নারাজ করে দিয়েছে সে। রাগ করে চলে গেছে। এর ঝাল কতদিনে মিটবে ইরিন জানে না সেটা।

সে বুঝে না আসলে…নক্ষত্র কি এখনো ভালোবাসে তাকে নাকি শুধুমাত্র পুতুলের মা বলেই এই সম্মান…এই খেয়াল রাখা? কোন জবাব নেই তার কাছে। তবে আজকে নক্ষত্রের কথাগুলো, তার প্রতিক্রিয়া ইরিনকে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে। নক্ষত্র আসলে কি চায়? তার পরীকে নাকি শুধু পুতুলের জন্য ওর আম্মুকে?

‘কি রে…ওরা কই?’ ঘরের চারপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়ে খোঁজ করতে করতে আবারও প্রশ্ন করে রিতু।

ইরিন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বিষাদের ক্লান্তি জড়ানো গলায় বলে, ‘সুখ পায়রা ফিরে গেছে আপন নীড়ে। এই বিষাক্ত শহরের বাতাসে তাদের নিশ্বাস নিয়ে টিকে থাকাও যে ভীষণ কঠিন।’

কথা শেষ করে ইরিন আর দাঁড়ায় না ওখানে। আস্তে ধীরে হেঁটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। রিতু হতবাক নয়নয়ে দেখে সবটাই। ইরিনের কথার অর্থ তার বোধগম্য হয় না পুরোপুরি। তবে সে এটুকু বুঝতে পারে যে, নক্ষত্র চলে গেছে।

রিতু হাতে থাকা টেডি বিয়ারটা একনজর দেখে আহত স্বরে বললো, ‘যাহ! পুতুল তো নিজের প্রিয় পুতুলটাই ফেলে গেলো!’

অথচ রিতু জানে না এর চাইতেও কত প্রিয় কিছু পুতুল ফেলে গেছে তার অবুঝ মনে অধিকার দাবি করতে না পারার অপরাগতায়।

১৪৯.

‘কি ব্যাপার মি. রাফিদ! এতদিন পর হঠাৎ? আমি তো ভেবেছিলাম গল্প শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে আলগোছে কেটে পড়েছেন আপনি। – প্রায় সপ্তাহ তিন পরে রাফিদের সাথে দেখা করতে এসে তাকে খোঁচা মেরে রসিকতা করে বললো ইরিন।

‘এই প্রোফেশনে আসার পর বিরক্তি জিনিসটাকে শূন্য পয়সা কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছি ম্যাডাম। তাই বিরক্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। ‘ – হেসে বললো রাফিদ।

‘তাহলে এতদিন ছিলেন কোথায়? ‘

‘একটা কেস নিয়ে বেশ ব্যস্ততা যাচ্ছে। রিসেন্টলি ইতালি, সিংগাপুর থেকে ঘুরে এলাম। দেশেই ছিলাম না বলতে গেলে। তাই আপনার সাথে সেভাবে যোগাযোগও করা হয়নি আমার। দ্যাটস হুয়াই আ’ম ভেরি স্যরি ম্যাডাম। ‘

‘বাব্বাহ! বেশ হাই প্রোফাইল কেস মনে হচ্ছে.. ‘

‘হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। অনেক ইম্পোর্ট একটা কেস এটা আমার জন্য। তাই এত মনোযোগ দিতে হচ্ছে। ঘাটাঘাটি করতে হচ্ছে। তবে এতসব ব্যস্ততার মাঝেও আপনার কথা কিন্তু আমার ঠিকই মনে পড়েছে।’ মিষ্টি হেসে বললো রাফিদ।

‘হুম…বাট ইউর স্যরি ইজ নট এক্সেপ্টেড।’ থমথমে মুখ করে বললো ইরিন। তা দেখে হাসি মিলিয়ে যায় রাফিদের অসহায় স্বরে প্রশ্ন করে সে, ‘হুয়াই?’

‘বিকজ দেয়ার ইজ নাথিং টু বি স্যরি, মি. রাফিদ! ‘ দুষ্টুমিষ্টি হেসে বললো ইরিন। তার কথায় রাফিদ প্রথমে চমকালেও পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সেও হেসে ফেললো আবারও।

এরপর রাফিদই কথা এগিয়ে নিয়ে বললো, ‘আমি একটা প্রোপজাল রাখতে চাই আপনার কাছে আজ। চাইলে আবদারও বলতে পারেন এটাকে।’

‘কি আবদার?’ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে ইরিন। তা দেখে রাফিদ বললো, ‘এই..এই..এই…এত সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই। জাস্ট ছোট্ট একটা আবদার করছি। শুধু চাই যে আপনি আমাকে মি. রাফিদ ছেড়ে রাফিদ বলে ডাকুন এবার থেকে। আর আমি আপনাকে মিসেস. ইরিন ছেড়ে শুধু ইরিন বলে ডাকবো। ‘ দাঁত ক্যালিয়ে হেসে বললো রাফিদ।

‘হঠাৎ! কি কারণে?’ গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করলো ইরিন।

‘বিশেষ কিছুই না। মি. রাফিদ…মিসেস. ইরিন এই সম্বোধনগুলো কেমন যেন প্রোফেশনাল টাইপ লাগে। অথচ, আমরা কিন্তু দূর সম্পর্কে বন্ধু হই।’ মন খারাপের স্বরে বলে রাফিদ।

‘কিহ? কি সম্পর্কের বন্ধু? আর বন্ধুই বা হলাম কবে আমরা?’

‘দূর সম্পর্কের বন্ধু। এক পাক্ষিক বন্ধুত্ব যেটা। মানে, আপনি তো আমাকে বন্ধু ভাবেন না। কিন্তু আমি তো আপনাকে আমার বন্ধু ভাবি। নইলে আর কি সম্পর্কের ভিত্তিতে আমার আপনার সাথে এত জানা-শোনা…সময় কাটানোর অধিকার বলুন তো?’

ইরিন চুপ হয়ে গেল রাফিদের এমন কথায়। সত্যিই তো! রাফিদের সাথে তার সম্পর্ক কি? শুধুই পরিচিত কেউ? এমন কাউকে নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কি এত কিছু বলা যায়? উহু…যায় না তো। তাহলে কি নিজের অবচেতন মনেই রাফিদকে বন্ধু জায়গাটা দিয়ে ফেলেছে সে? নয় তো এত অবলীলায় নিজের অনুভূতি, কথা এভাবে কারও কাছে মেলে ধরা যায়?

‘কি হলো…..আবদারটা কি অন্যায় হয়ে গেল নাকি?’

‘আজকে আপনাকে সম্পর্কের টানাপোড়নের গল্প শোনাবো রাফিদ, শুনবেন?’ আলতো হেসে বললো ইরিন।

‘গল্প শুনতেই তো এসেছি। আমার কথা আর কে শুনে কখনো…হুহ!’ নিজের আবদার অগ্রাহ্য হয়েছে ভেবে মন খারাপ করে বললো রাফিদ।

‘আজ তবে গল্পের শেষ অধ্যায় শোনাই আপ…

‘এই আপনি একটু আগে আমাকে নাম ধরে ডেকেছেন, নাহ?’ আচমকা ইরিনের কথার মাঝখানে উত্তেজিত হয়ে বললো রাফিদ।

‘হ্যাঁএএ…তো? আমি কি আপনার নাম এই প্রথম বলছি নাকি?’ একদম গা ছাড়া ভাব নিয়ে ঝরঝরে গলায় বললো ইরিন।

‘এই না…আপনি আমাকে শুধু রাফিদ বলেছেন।’

‘হ্যাঁ..বলেছি। আপনিই তো একটু আগে বললেন এভাবে বলতে!’

‘হ্যাঁ…হ্যাঁ, বলেছিলাম তো। কিন্তু, আপনি যে এত সহজে রাজি হয়ে যাবেন ভাবেইনি এটা। তাহলে আমরা এখন আর দূর সম্পর্কের বন্ধু নই, একেবারে কাট টু কাট লেভেলের বন্ধু হয়ে গেছি, রাইট?’ খুশিতে ডগমগ গলায় বললো রাফিদ।

কিন্তু, ইরিন কপাল কুচকে ফেললো। বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কাট টু কাট লেভেল মানে? এই আপনার মাথায় এত অদ্ভুত সব লেভেল আসে কি করে, হ্যাঁ?’

‘না…মানে এখন আমরা এক কথায় বন্ধু হয়ে গেছি। বন্ধু মানে বোঝেন তো? একদম সব বিপদে আপদে, সুখ দুঃখে একনিষ্ঠভাবে পাশে থাকার, সব সমানভাবে ভাগাভাগি করে নেওয়ার সাথী।আপনি ও আমি আজ থেকে তেমনই, দুজন দুজনের জন্য।’

ইরিন ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লো। নির্লিপ্ত চোখে একপলক রাফিদের খুশি খুশি উত্তেজিত মুখটা দেখে শান্ত গলায় বললো, ‘সব কিছুর এত নিখুঁত সংজ্ঞায়ন, এটাও কি আপনার প্রোফেশনাল স্কিল, রাফিদ?’

ইরিনের এমন কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেললো রাফিদ। রসিকতার স্বরে বললো, ‘পছন্দ হয়েছে আপনার? চাইলে আজীবন এভাবেই আপনাকেও নানানভাবে সংজ্ঞায়িত করে যেতে পারি। ‘

‘কোন দরকার নেই!’ একেবারে আপদ ঝাড়ার ভংগিতে হাত নেড়ে বললো ইরিন।

‘ইরিন…’ ভীষণ গাঢ় স্বরে ডাকলো রাফিদ। ঠিক যেমন প্রিয় কোন মানুষকে একদম দরদমাখা গলায় ডাকা হয়।

রাফিদের এমন ডাকে চমকে তাকালো ইরিন।রাফিদের চোখে মুখে অন্যরকম ঝলক। বিভ্রান্তির স্বরে সে জবাব দেয়, ‘হুম?’

‘জিজ্ঞেস করা হয়নি আজ। ভালো আছেন আপনি?’

রাফিদের এমন কথায় নিরবেই আলতো হাসলো ইরিন। ভালো থাকার প্রশ্নটা বরাবরই তার জন্য ভীষণ কঠিন একটা প্রশ্ন। সে বুঝে উঠতে পারে না তার ভালো থাকাটা বা প্রকৃত পক্ষে কারও ভালো থাকাটা ঠিক কেমন! শরীর ভালো থাকলে কেউ ভালো থাকে নাকি মন ভালো থাকলে? জীবনে স্বচ্ছলতা বা বিলাসিতা থাকলে মানুষ ভালো থাকে নাকি হাজার টানাপোড়নের মাঝেও মানসিক শান্তি..জীবনের স্বস্তিটুকু নিয়ে ভালো থাকা হয়?

তার তো স্বচ্ছলতা, কাছের মানুষ, গোছানো একটা জীবন আছে। ছেড়ে আসা জীবনের কোন পিছুটান ছাড়াই দিব্যি বেঁচে আছে। নক্ষত্র তাকে এত কিছুই দিয়েও এমন শূন্য করে দিয়েছে যে পিছুটান পর্যন্ত নেই তার। নতুন জীবনে কিছু অতীত অনুভূতি, বর্তমান প্রাণ নিয়ে ঠিকঠাকই তো চলছে সব। তবে এটাই কি ভালো থাকা? নাকি অব্যক্ত অনুভূতি, সম্পর্কের টানাপোড়ন আর বিষাক্ত সেসব অতীতের তিক্ত স্বাদ তাকে আজও যে মানসিক অশান্তিতে ভোগায়, কষ্টে ডুবিয়ে রাখে সেটা তো তাকে ভালো থাকতে দেয় না। তবে কি সে ভালো নেই?

এত কিছু ভাবার শেষে মন বলে, তুমি যেমন আছো সন্তুষ্ট আছো।পৃথিবীতে কষ্ট ছাড়া কেউ বাঁচে না।কষ্ট আছে বলেই সুখ এত ভালো লাগে। কিন্তু, তার থেকেও জরুরি তোমার অবস্থান। তোমার থেকেও অনেক কষ্ট নিয়ে যারা প্রতিনিয়ত বেঁচে আছে তাদের কথা ভাবলে দেখা যাবে তোমার অবস্থা তাদের থেকে অনেক বেশি ভালো। জীবনে যা হারিয়েছো সেসব গোণায় না ধরে যা পেয়েছো তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকো। এটাই তোমার সব খারাপের মাঝেও সত্যিকারের ভালো থাকা।

ইরিন আর ভাবে না। হাসিমুখে এক বাক্যে বলে, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?’

‘ভালো আছি। ‘ শুকনো হেসে বললো রাফিদ। তারপর, ইরিনের অসম্পূর্ণ কথাকে টেনে বললো, ‘এবার তাহলে আপনার আর মি. নক্ষত্রের বিচ্ছেদের গল্পটা শুনি। কেন আলাদা হয়েছেন আপনারা?’

‘অধিকার ছেড়ে দিয়ে বা হারিয়ে ফেললে সম্পর্ক বলে আর কিছুই থাকে না যে, তাই!’

ইরিনের কথায় এবার সত্যি সত্যি মন বিষন্ন হয়ে গেল রাফিদের। তবে কি সেও যদি অধিকার ছেড়ে দেয়, সম্পর্কটাও কি ছেড়ে দিতে হবে? পাওয়া হবে না তাকে আর? কিন্তু তার যে অনুভূতিগুলো দিনকে দিন গাঢ় হয়ে ভালোবাসার রঙ ছড়াচ্ছে হৃদয়ের শিরায় শিরায়! সেটা কি সত্যিই বুঝবে মানুষটা? ‘ জানে না রাফিদ।।এসব ভাবলেই তার মন ভার হয়ে আসে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরিনের দিকে বিষন্ন চোখে তাকায় রাফিদ। ম্লান গলায় বলে, ‘গল্পটা প্লিজ..

১৫০.

আমার গর্ভধারণকে কেন্দ্র করে নক্ষত্রের সাথে আমার সম্পর্কটা একেবারেই মরে গেছিল।আমি কাগজে কলমে,উনার সম্মতিতে সমাজের কাছে উনার স্ত্রী হয়ে ছিলাম ঠিকই…কিন্তু উনার উপর থেকে ব্যক্তিগতভাবে সব অধিকার হারিয়েছিলাম আমি। উনি উনার স্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, আমার সব আর্থিক, বেঁচে থাকার জন্য যা লাগে সেসব প্রয়োজনের খেয়াল রাখতেন,কেবল অনুভূতিটুকু ছাড়া। শরীরের প্রতি অধিকার তো উনি সেদিনই ত্যাগ করেছিলেন যেদিন পুতুল আসার খবর পেয়েছিলেন। মনের উপরও কোনদিন জোর খাটাননি আমার। তবে, উনার কোন কিছুতে ব্যক্তিগতভাবে আমি অধিকার ফলাতে পারতাম না। স্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারতাম না। অথচ, আমি উনার স্ত্রী হিসেবে এক ঘরে দিনের পর দিন উনার সাথেই থাকতাম।

নক্ষত্রকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম অনেক আগেই। কিন্তু… ‘

‘প্রথম বুঝেছিলেন কখন?’ ইরিনের কথার মাঝে প্রশ্ন করে রাফিদ।

‘যেদিন প্রথমবারের মত উনার হাত ছেড়ে প্রায় মৃত অবস্থায় অপারেশন থিয়েটারের বন্ধ দরজার ওপাশে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। আমাকে যখন ওয়াসিফ রেপ করেছিল আমার চিন্তা ছিল কেবলই আমার বাচ্চাটার কি হবে, ওয়াসিফ আমার সাথে এটা কি করলো এসব। কিন্তু যখন ওয়াসিফের হাতের পরোক্ষভাবে নিজের হাতের শিরা কেটে মরতে বসেছিলাম আমার সমস্ত ধ্যান জ্ঞানের বিচরণে ছিল কেবল ওই মানুষটাই….নক্ষত্র!

জানেন, আমাকে যখন এম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল…আমার পাশে থাকা অস্থির বিদ্ধস্ত চোখ মুখের মানুষটাকে আমি আমার কল্পনা ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম মরে যাচ্ছি বলেই মনের চাওয়া মতই আমি শেষ বারের মত তাকে দেখছি। অথচ তিনি সত্যিই আমার সাথে ছিলেন তখন।’ একটু বলে ইরিন চুপ হয়ে গেল। সে সময়টুকু কল্পনায় স্মৃতিচারণের চেষ্টা করছে সে।তার নিরবতায় ছেদ ঘটিয়ে রাফিদ জিজ্ঞেস করলো।

‘তারপর?’

‘সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম জীবন কতটা মূল্যবান।আমি সব কিছু খুইয়েও আমার ভালোবাসার মানুষটাকে ঠিকভাবে ভালো না বাসতে পেরে, অনুভব না করেই মরে যাবো এই আফসোসেই যেন মনে মনে বারংবার মরে যাচ্ছিলাম আমি। উনার সেই কষ্টে, ঘৃণায় জজর্জরিত চোখে আমি আমার জন্য তার ভালোবাসার মৃত্যু দেখেছিলাম। আমি অবাক হয়নি। কিন্তু, আফসোস হচ্ছিল…আমি তাকে বলে যেতে পারিনি তার অনুভূতি সত্যি ছিল। আমি নিজের অজান্তেই তাকে ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু,আমি বুঝতে বুঝতে আমার জন্য উনার ভালোবাসার মৃত্যু ঘটে গেছিল।

‘ভালোবাসার মৃত্যু কি এত সহজেই ঘটে,ইরিন? অনুভূতি কি খুন হয়? নাকি তারা আত্মহত্যার ক্ষমতা রাখে?’

‘অনুভূতি মরে গেলে মানুষ অমানুষ হয়ে উঠে। ভালোবাসা অনুভূতিদের হৃদস্পন্দন। এটা যখন থেমে যায় ভালোবাসার মানুষটার জন্য তখন পৃথিবীর কোন অধিকার..কোন ক্ষমতাই পারে না তার সাবলিল আচরণে,অনুভূতিতে আপনাকে জায়গা দিতে। উনার কাছে থেকে অন্তত এটাই জেনেছি আমি। ‘

‘আচ্ছা, তারপর কি হলো?’

‘তারপরেরটুকু তো আপনি জানেনই। কন্সিভ করার সেই সময়কার সিদ্ধান্তটা একেবারেই ভুল ছিল আমার। কষ্ট কম পোহাতে হয়নি আমাকে। তবে নিয়তের জোরেই হোক বা আল্লাহর নির্ধারিত রিযিক, আমি পুতুলকে কন্সিভ করি। ওর জন্মের সময় বা তার পরেও আমার প্রতিটা কষ্টের সমান ভাগীদার ছিলেন উনি। হয় তো আমার শারীরিক মানসিক কষ্টটা উনি প্রত্যক্ষভাবে গ্রহন বা অনুভব করতে পারতেন না। কিন্তু, সে সময় আমাকে সাপোর্ট দিতে গিয়ে যে কষ্টটুকু উনি করেছেন স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কেও কতজন স্বামী সেসব করে কিনা তা আমার জানা নেই। পুতুলকে নিয়ে আমি খুব একটা রাত জেগেছি বলেও আমার মনে পড়ে না। বেশিরভাগ সময় উনিই পুতুলকে আগলে রাখতেন। খাওয়া থেকে ঘুম সবটাই উনি সামলাতেন। কারণ আমি তখন ভঙ্গুর শরীর নিয়ে নিজেকে সামলাতেই হিমশিম খেতাম, বাচ্চাটাকে কি সামলাবো। অথচ উনি আমাকে আর পুতুলকে দুজনকেই সামলতেন।’

‘এমন মানুষটাও আপনি ছেড়ে এলেন?’ আফসোস করে বললো রাফিদ।

‘এলাম তো!’

‘খুব কি দরকার ছিল এটা করার?’

‘ভুল করতে করতে সব কিছু ক্ষুইয়েও আত্মসম্মানটুকু একেবারে ছেড়ে দিতে পারিনি। এখন এটাকেও যদি আপনারা আমার অপরাধ বলেন তাহলেও আমার কিছু করার নেই। ভালোবাসার মানুষগুলোর থেকে দূরে থাকার কষ্ট নিয়েও আমি আত্মসম্মানটুকু বাঁচাতেই ছেড়ে এসেছি তাকে। সম্পর্ক থাকার পরেও যে অধিকার, মর্যাদা আমাকে দেওয়া হয়নি সেসব সত্যিকার অর্থে ছেড়ে দিয়ে মুক্তি চেয়েছি সম্পর্কটা থেকে। ‘

‘আপনি উনার স্ত্রী।সমাজের কাছে, ধর্মীয়ভাবে এবং ব্যক্তিগত সম্মতিতেও আপনি উনার স্ত্রী, ইরিন। উনার সাথেই থেকেছেন, পরিচয় পেয়েছেন উনার স্ত্রী ও সন্তানের মা হিসেবে। আর কিসের অধিকার… মর্যাদা পাওয়ার ছিল আপনার?’ নারাজ গলায় বলে রাফিদ।

‘আপনাকে আপনার স্ত্রী তার ব্যক্তিগত জীবনের সব কিছু থেকে দূরে রাখবে, এমনকি তার ব্যাপারে কোন কিছুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার, মতামত দেওয়ার কিংবা তার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে কোন দায়িত্ব আপনি পালন করতে পারবেন না..নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে আপনার উপর। অথচ, আপনি তার সন্তানের বাবা। আপনাকে তার সন্তানের বাবার বাইরে নিজের স্বামীর জায়গা দিবে না। আবার, এক ঘরে এক বিছানায় দূরত্ব রেখে থাকবে আপনার সাথে দিনের পর দিন।তার এই আচরণের প্রতি আপনার মনোভাব কি হবে, রাফিদ? নিজের স্ত্রী মনে হবে তাকে? নাকি মনে হবে কোন পরনারীর সাথে এক ছাদের তলায় থাকছেন আপনি?

‘এগুলো আপনার অবান্তর মনের চিন্তাভাবনা ইরিন। আমি যতই ভুল করি আমাকে আমার বৈধ অধিকার দিতে সে বাধ্য।’

রাফিদের এমন একরোখা জবাবে হেসে উঠলো ইরিন।রাফিদ বিরক্ত হলো ইরিনের এমন প্রতিক্রিয়ায়। বিরক্ত স্বরেই বললো, ‘আমি হাসির মত কি এমন বলেছি, ইরিন?’

‘একটা কথা কি জানেন তো রাফিদ, পুরুষ প্রাপ্তিতে বিশ্বাসী আর নারী অর্জনে।’

‘মানে?’

‘অর্থ্যাৎ পুরুষের যা প্রাপ্য বা যা কিছুই তার চাই তা যে কোনভাবে পেয়ে যাওয়াটাই তার কাছে তার প্রাপ্তি। হোক সেটা অধিকার বলে অথবা জোর খাটিয়ে কেড়ে নিয়ে কিংবা জয় করে। পাওয়াটাই তার জন্য মুখ্য।

কিন্তু নারীর যা চাই তা সে অর্জন করে। সে জোর করে কেড়ে নিতে জানে না। ভালোবেসে হোক কিংবা ছলাকলায় সে নিজের চাওয়াটা অর্জন করে ছাড়ে। পুরুষের ভালোবাসা পাওয়া সহজ। কিন্তু, পুরুষকে নিজের করতে পারাটা এবং তাকে আজীবন নিজের করে রাখাটা নারীর অর্জন।আর নারী সেটাই চায়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে আপনাকে দু’জন বিখ্যাত কবির দুটো কথা শুনাই কেমন!

‘নারীকে ছুঁতে পারা সাধনার বিষয়
শরীর ছুঁয়েই যে পুরুষ বলে নারীকে ছুঁয়েছি, সে নির্বোধ
নারীর হৃদয় ছুঁয়েই তবে দেহ ছুঁতে হয়
শরীর তো ধর্ষকও ছোঁয়।

পুরুষের ভালোবাসা পাওয়াও সাধনার বিষয়।
দেহদানের পরেই যে নারী ব’লে পুরুষের ভালোবাসা পেয়েছি, সে নির্বোধ
পুরুষের বিশ্বাস ছুঁয়েই দেহ ছুঁতে হয়
শরীর তো বেশ্যাও দেয়।

এই কথাগুলো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর।
আবার রবি ঠাকুরও বলেছেন,

পাওয়া কাকে বলে?
যে মানুষ জানে না!
সে ছোঁয়াকেই পাওয়া মনে করে।

এর দ্বারা কি বোঝায়? পুরুষকে রূপের মোহে ফেলে বা সামান্য ভালোবাসার ছল করেও সহজেই পাওয়া যায়। ক্ষণিকের বিভ্রান্তিতে ফেলেও কিন্তু পাওয়া যায়!! কিন্তু, এতে তাকে অর্জন করা হয় না। এবং অর্জন বরাবরই সাধনার বিষয়। কিন্তু, আমি নিজ যোগ্যতায়….চেষ্টায় পুনরায় তার বিশ্বাস ছুঁতে পারিনি। ভুল অবশ্যই আমার ছিল। অস্বীকার করবো না তা।

অথচ, আপাদ দৃষ্টিতে পুরুষ নারীর শরীর ছুঁতে পারলেই প্রাপ্তি বলে। এমনভাবে যে কোন কিছু পেয়ে যাওয়াটাই তার কাছে মুখ্য। সে হয় তো বুঝে না প্রাপ্তি ক্ষণিকের ফল এবং অর্জন আজীবনের সম্পদ।

আমি স্বাভাবিকভাবেই নক্ষত্রের প্রাপ্তি ছিলাম। আমাকে অর্জনের পূর্ণ যোগ্যতা উনার ছিল। কিন্তু, প্রাপ্তির বাইরে উনি আমাকে অর্জন করার আলাদাভাবে প্রয়োজন মনে করেননি। বিশ্বাস করেছিলেন নিজের প্রাপ্তিকে উনার সফলতা হিসেবে। আর, আমি তাকে পেয়েও অর্জনের সুযোগ খুইয়েছিলাম..নিজ ভুলেই। আর যতক্ষণে আমি নক্ষত্র বন্দনায় মরমে মরেছিলাম, আমার সাধনায় অনিষ্ট ঘটিয়েছিল আমার অতীত কর্মফল।আমার ক্ষমা না পাওয়া ভুলগুলো।’

‘সাধনা কি এতই সহজ ইরিন? একবার ভাংলে কি দ্বিতীয়বার সাধনায় লিপ্ত হওয়া যায় না?’

‘আমি চেষ্টা করেছিলাম রাফিদ। আজও চেষ্টা করি।কিন্তু, পরপর দুবার যে বিশ্বাস আমি বড্ড অবহেলায়, বিদ্ধস্তরূপে ভেঙেছি তা কি আর সহজে অর্জন সম্ভব? নক্ষত্র আমায় আর ভালোবাসেন না। আসলে উনার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই তো আমি নই। তবুও আমি বেহায়ার মত নক্ষত্র বন্দনায় ডুবে যাই। তাকে অর্জনের চেষ্টা করি। ‘

‘তাহলে আত্মসম্মানের বুলি আউড়ে ছেড়ে এসেছেন কেন?’

‘কারণ, আমি যাকে অর্জন করতে চাই, তাকে নিজ যোগ্যতায় অর্জন করতে চাই। আমি নিজের কাছে বেহায়া হয়ে উনাকে পাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু, নিজের আত্মসম্মান নিংড়ে দিয়ে উনার স্ত্রীর বেশে কেবল উনার সন্তানের মা হয়ে একসাথে থাকাটা আমার আত্মসম্মানবোধ আমাকে সায় দেয়নি। তাই আলাদা হতে চাইছি। এতে করে যদি উনি চান নিজের জন্য যোগ্য কাউকে সহজেই নিজের করে নিতে পারবেন।’

‘হুম….বুঝলাম সবটাই। কিন্তু, উনি যে আপনাকে ডিভোর্স দিতে চাইছেন না। কারণ কি?’

‘উনি চান না পুতুল ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হিসেবে পরিচয় পাক। তার বাবা মায়ের পরিচয়টা আজীবনই একই থাকুক, তার বাবা-মাকে সমাজ স্বামী-স্ত্রী বলে জানুক সারাজীবন….এই কারণেই উনি চান না আমাদের ডিভোর্স হোক। আমরা আলাদা হয়ে যাই।’

‘এমনিতেও আপনারা একসাথে থাকছেন না। তো এই ডিভোর্স না দেওয়ার মানে কি?’

‘আমরা স্বামী স্ত্রী হিসেবে আলাদা হয়ে আছি কিন্তু পুতুলের বাবা মা সবসময় একসাথেই থাকে ওর প্রতিটি প্রয়োজনে।’

‘ডিভোর্স হয়ে গেলে কি করবেন? ‘

‘কি করবো মানে?’

‘বিয়ে করবেন আবার?’

‘পুতুলের জন্মের পরও রক্ত সল্পতায় আমার মরণ দশা হয়েছিল। তিন তিনবার মরতে মরতে বেঁচে এসেছি। প্রথমবার মৃত্যুর মুখে পড়ার পর থেকেই আমি আমার জীবনের মূল অর্জনের হদিস পেয়ে গেছিলাম। তাই বাকি জীবন যতদিন আছে নক্ষত্র বন্দনায় বাঁচব ইন শা আল্লাহ। ‘মুচকি হেসে বললো ইরিন।

ইরিনের এমন করুণ দশা দেখে রাফিদের বিষন্ন মন আরও বেশি বিষন্ন হয়ে গেল। জীবন আসলেই কেমন যেন। কখনো কখনো সব পেয়েও না পাওয়ার মত। কখনো বা সামান্য কিছু পাওয়ার জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার পরেও তা আর পাওয়া হয়ে উঠে না। নক্ষত্র ইরিন দুজন দুজনকে ভালোবাসে। কিন্তু, অভিমান এতটা গাঢ় চাদরে তাদের ঢেকে ফেলেছে যে তারা হৃদয় খুলে সম্মুখে মেলে দিলেও দেখার উপায় নেই।কিছু জানার উপায় নেই…আর না আছে কিছু বুঝার উপায়।

ইরিন রেস্টুরেন্টের কাঁচের দেয়ালের বাইরে রাস্তার কোলাহল দেখতে ব্যস্ত। সায় সায় গাড়ি ছুটে চলেছে। রিক্সা ধীর গতিতে প্যাডেলের চাপে এগিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নাগাদ যে যার বাড়ি ফিরতে উঠে পড়ে লেগেছে। ক্লান্ত শরীর মন নিয়ে পথের দূরত্ব অতিক্রম করছে। ইরিন বিষন্ন মন নিয়ে এই কোলাহল দেখছে মনোযোগ দিয়ে। কি জানি কি চলছে এখন তার মনে। কি ভাবছে সে!

ইরিনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাফিদ। মনে মনে আউড়ায়…

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে

ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;

(জীবনানন্দ দাশ )

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here