“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৮৫

0
2508

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮৫
(নূর নাফিসা)
.
.
নামাজ পড়ে নাফিসা ফোনটা দুই লাঠির মাঝে আটকে নিয়ে ভাবি ভাবি বলে জোর গলায় ডাকতে ডাকতে বড় ঘরের গেইটের সামনে এলো। আরমান মাত্রই আসরের নামাজ পড়ে এসেছে। জেরিনও বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো এক হাতে নাফিসা নাক চেপে ধরে রেখেছে আর অন্যহাতে দুই লাঠির মাঝে তার ভেজা ফোন! নাফিসা বললো,
– ভাবি, এটা আপনার ফোন নাকি?
নিশাত দেখে বললো,
– এটাই তো আপুর ফোন!
– তো ভাবির ফোন ও ঘরের বাথরুমে গেলো কি করে!
– বাথরুমে!
– হুম, আমি বাথরুমে যাওয়ার পর দেখি আলো জ্বলে আছে কমোডের ভেতরে! পরে ব্যাপারটা বুঝার জন্য লাঠি দিয়ে তুলে দেখলাম ফোন! আর মনে হলো ভাবি ফোন খুজে পাচ্ছে না যেহেতু এটা ভাবির ফোন নয়তো!
জেরিন তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
– আমার ফোন বাথরুমে যাবে কি করে!
– সেটাই তো আমি জিজ্ঞেস করছি! আপনার ফোন বাথরুমে গেলো কি করে! জিহানকে তো আজ ওই বাথরুমে যেতে দেখলাম না! আপনি না দুপুরে বাথরুমে গিয়েছিলেন? তখন পড়ে যায়নি তো আবার?
– আ..আমি কখন বাথরুমে গেলাম!
নিশাত বললো,
– হ্যাঁ, আমি যখন বাসায় ঢুকছিলাম তখন না তুমি বাথরুম থেকে বেরিয়ে ভাবির রুমের দিকে গেলে!
– আমি ফোন নিয়ে বাথরুমে যাইনি!
আরমান বললো,
– তাহলে ফোন উড়ে উড়ে গেছে? আজকাল তোমার ধ্যান কোথায় থাকে বুঝি না! বাথরুমে ফোন ফেলে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছো চোর এসে শুধু তোমার ফোন নিয়ে চলে গেছে, না? আবার ক্ষণে বলছো জিহান কোথাও ফেলে এসেছে!
– আশ্চর্য, আমি বলছি আমি ফেলি নি আর তোমরা সবাই মিলে আমাকে বকছো! হতেও তো পারে কেউ চুরি করে বাথরুমে ফেলে দিয়েছে!
নাফিসা বুঝতে পেরেছে অপবাদটা তার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে! আরমান ব্রু কুচকে জেরিনকে বললো,
– ঘরের সদস্য ছাড়া তো আর কেউ বাথরুম ইউজ করে না! তো তুমি কিসব উল্টাপাল্টা বুঝাতে চাইছো? আমরা কেউ তোমার ফোন চুরি করে তাও আবার বাথরুমে ফেলে এসেছি?
– আমি সেটা বলেছি নাকি!
– তো কি বলছো?
– এতো মেজাজ দেখাও কেন! হতেও তো পারে জিহানই খেলতে খেলতে ফেলে এসেছে। দুপুরের আগে কি তারা বাড়িতে ছিলো, যে দেখবে!
– জিহানের হাতে আর কখনো ফোন দিবে না। এবার ইউজ করো ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত ফোন।
আরমান ঘরে চলে গেলো। নিশাতও হাসতে হাসতে চলে গেলো। ইমরান তাদের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলো এবং শুনছিলো সব। জেরিন প্রচুর রেগে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে। যেন কান্নাই করে দিবে! সে জিদ্দি গলায় বললো,
– কাজটা তুই মোটেও ভালো করলি না। একে একে আমার সব ধ্বংস করে দিচ্ছিস! পরিনতি খুব খারাপ হবে দেখিস!
নাফিসা লাঠি ফেলে ফোনটা হাতে নিয়ে জোরপূর্বক জেরিনের হাতে রেখে বললো,
– সময় হয়তো এখনো আছে। ভালো হয়ে যান। ভালো হতে পয়সা লাগে না, শুধু একটু চেষ্টা থাকলেই যথেষ্ট। আগেও অনেকবার বুঝিয়েছি, এখনো আবার বলছি। তবে এটা লাস্ট ওয়ার্নিং ভেবে নিতে পারেন। এরপর এমন আলতু ফালতু কাজ করতে দেখলে জেলের ঘানি টানাতেও দ্বিধাবোধ করবো না। তাছাড়া আমি কিন্তু সত্যি চাপা রাখতে পারি না! আজ শুধু ইমরান জেনেছে আপনার কর্ম, এরপর ফুল ফ্যামিলি জানবে। সুতরাং সময় থাকতে শুধরে নিন। আরে ফোন তো আজ মগে পরিষ্কার পানির ভেতর চুবিয়েছি, নেক্সট টাইম এমনও হতে পারে আপনাকে সহ না আবার কমোডের ভেতরে চুবানি দেই!
নাফিসা ফোন তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শুকনো কাপড়চোপড় নিতে লাগলো। তবুও জেরিন হয়তো কিছু বলতো কিন্তু ইমরানকে দেখে আর কিছু বলেনি।
সন্ধ্যার আগে বড়মা তার ভাইয়ের বাড়ি গেছে, অসুস্থ ভাইকে দেখতে। ইমরান পৌছে দিয়ে এসেছিলো। সন্ধ্যায় যখন নাফিসা রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছে, কথায় কথায় নাফিসাকে স্পষ্ট দোষী করে তুলেছে আবিদা বেগমের কাছে। চোরের অপবাদ দিয়েছে সে নাফিসাকে। কিন্তু তা নিয়ে আবিদা বেগম নাফিসাকে কিছু বলেনি। শুধু জেরিনকে একবার চুপ থাকতে বলেছিলো। কিন্তু মিথ্যে অপবাদ নিতে তো নাফিসা প্রস্তুত নয়! তাই সে জেরিনের মুখের উপর জবাব দিয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছে দুজনের মধ্যে তর্কবিতর্ক! আরমান ঘরে ছিলো না তখন। তাদের গলা শুনে ইমরান ও নিশাত এই ঘরে চলে এলো। ইমরান জানতে চাইলো কি হয়েছে, কিন্তু তার জবাব পেল না কারো কাছেই। তারা দুজন তর্ক করেই যাচ্ছে আর আবিদা বেগম দুজনকেই থামানোর চেষ্টা করছে। জেরিনের প্রায় কাদো কাদো ভাব! হঠাৎই নাফিসার মুখ থেকে একটা কথা বেরিয়ে এলো, “যেমন ফুপি তেমন ভাতিজি! সব এক গোয়ালের মুর্খ গরু!”
যদিও নাফিসা ইঙ্গিত করেছিলো আয়েশা বেগমকে, ইমরান বুঝে নিয়েছে তার মাকে বলেছে! অথচ আবিদা বেগম যে জেরিনের ফুপু, এই মুহূর্তে তা খেয়াল ছিলো না নাফিসার! যার ফলে সাথে সাথেই খেতে হলো ইমরানের হাতে সজোরে থাপ্পড়! মুহুর্তেই নাফিসা স্তব্ধ এবং চোখ ভরে গেছে পনিতে! বিনা অপরাধে থাপ্পড় খেয়ে সে রেগে বললো,
– আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে মারার!
ইমরান আরও একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো,
– কেন, আমার সাহস হতে পারে না তোকে মারার! এতো স্পর্ধা কেন তোর? যা, ঘরে যা। আর একটা কথা বললে মেরে ফেলবো একদম। যা, ঘরে যা!
খুব জোরে ধমক দিয়ে বললে নিশাতই ভয় পেয়ে গেছে। দ্বিতীয় বার হাত তুলতে দেখেও থামানোর চেষ্টা করতে মুখে উচ্চারণ করলো, “ভাইয়া!”
আর নাফিসা কান্না করতে করতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে! পরিবেশ এখন সম্পূর্ণ নিরব! ইমরান জেরিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি হয়েছে তোর? বল আমাকে? কি হয়েছে?
জেরিন একদম চুপসে গেছে! আবিদা বেগম ইমরানকে বললো, “কিছু হয় নাই। শান্ত হ তুই। জেরিন, ঘরে গিয়া চুপচাপ বইসা থাক। আর একটা কথাও যাতে না শুনি।”
ইমরান বললো,
– না, যাবে কেন এখন। বল কি বলছিলি এতোক্ষণ। আমিও শুনি।
জেরিন চুপচাপ কেটে পড়লো এখান থেকে। “ফোন নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে” এটুকু বলে আবিদা বেগম ইমরানকে শান্ত করতে ব্যস্ত। কিন্তু ইমরান কি শান্ত হয়েছে। সে তো অনেক কিছু জানে এই ফোনের ব্যাপারে যেটা বাকিরা জানে না। তার আগেই ধারণা ছিলো এটা নিয়ে একটা গন্ডগোল বাধবে! তাছাড়া আবিদা বেগম একটু বললেও সে অনেকটা বুঝে নিয়েছে। আর মায়ের কথায় কান না দিয়ে সে এক গ্লাস পানি পান করে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলো। পিছু নিলো জিহান! ইমরান আবার জিহানকে ঘরে রেখে গেইট লাগিয়ে নিজের ঘরে এলো। নাফিসা বোরকা পড়ে মাথায় কোনোমতে ওড়না পেচিয়ে প্রস্তুত! অশ্রুতে গাল ভেজা! বারবার চোখের ধার ও নাক মুছতে মুছতে এটুকু সময়েই চেহারা লাল বানিয়ে ফেলেছে। চাবি নিয়ে আলমারি খুলছে সে। ইমরান কাছে এসে বললো,
– কোথায় যাচ্ছো?
নাফিসা কোনো জবাব না দিয়ে আলমারি থেকে তার পার্স বের করে নিলো। অত:পর আলমারি লক করে বেরিয়ে যেতে লাগলে ইমরান হাত ধরে টেনে বললো,
– হচ্ছে কি এসব! কোথায় যাচ্ছো!
– যেখানেই যাই না কেন, তোর কাছে জবাবদিহি করতে হবে! হাত ছাড় আমার।
– বিহেভিয়ার ভালো করো।
– পারি না আমি ভালো বিহেভ করতে, আর পারবোও না কোনোদিন। যে পারে তার কাছেই যা। আমার সাথে কথা বলতে আসবি না।
নাফিসা কথা বলতেই ইমরান লক্ষ্য করলো তার মুখের ভেতর রক্ত! দাতের ফাঁকে ফাঁকে লাল হয়ে আছে! নাফিসা ঝাড়ি দিয়ে হাত ছুটিয়ে নিলে দরজার দিকে যাওয়ার আগেই ইমরান আবারও হাত টান দিয়ে নিজের সাথে তাকে একহাতে চেপে ধরে বললো,
– দেখি মুখে কি হয়েছে! মুখ খোলো। খোলো…
নাফিসা দুই ঠোঁট চেপে রেখেছে। সাথে ইমরানের কাছ থেকে ছোটার চেষ্টা। ইমরান তার হাত থেকে পার্স টানলো নাফিসা ছাড়লো না। অত:পর মাথায় প্যাচানো ওড়না ছুটিয়ে ঢিল মেরে খাটে রেখে বললো,
– রাতের বেলা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এতো সাহস আসে কোথা থেকে! এক পা ও ঘরের বাইরে রাখবে না।
– তুই বলার কে! সর!
– আবারও এভাবে কথা বলে! একদম চুপ থাকো। এভাবে রাগ করে বাড়ি ছাড়লে ভালো দেখায়! যাবেই বা কোথায়? এখন যদি তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাও বাবা মা কি ভাববে!
– যে যা ভাবার ভাবুক। সেটা তোর ভাবতে হবে না। যেদিকে খুশি যাবো। প্রয়োজনে পথেঘাটে দিন কাটাবো। তবুও তোর সংসারে না।
– একদম চুপ! বাড়াবাড়ি করলে একটা মাইর দিবো এখন।
– দে, দিবি ই তো। এ আর নতুন কি, সেই শুরু থেকেই তো মেরে আসছিস! এখন মেরে ফেল একাবারে। বেঁচে থাকতে আমি এ বাড়িতে থাকবো না।
নাফিসার অতিরিক্ত মাত্রায় জেদ ইমরানের মোটেও ভালো লাগছে না! এমনিতেই সে রেগে আছে। তার উপর একে তো তার এই ধরনের কথাগুলো ভালো লাগছে না, অন্যথায় মুখের ভেতরটা দেখারও সুযোগ পাচ্ছে না। তাই সে-ও অতি রেগে আবারও একটা থাপ্পড় দিলো, যেটা আগের গুলোর মতো এতোটা জোরে নয়। নাফিসার কান্না আরও বেশি বেড়ে গেলো! সে কান্নার সাথেই এক হাতে পার্স থেকে ফোন বের করার চেষ্টা করতে করতে বললো,
– এখন আমি বাবার কাছে কল করে বিচার দিয়ে বলবো আমাকে নিয়ে যেতে। পেয়েছিস কি, যখন ইচ্ছে তখন মারবি! আর আমি চুপচাপ মার খেয়ে যাবো!
ইমরান তার দুই গাল চেপে ধরে বললো,
– এতো জেদ কেন তোর? কখন থেকে বলছি চুপ করতে! আর কখন থেকে বলছি মুখ দেখাতে! বেশি আস্কারার পরিনাম না এগুলো? এইজন্যই লাঠির আগায় রাখতে হয় এসব মেয়েদের! দেখি কিভাবে তুই ঘরে থেকে বের হোস! আর কিভাবে বাবার কাছে বিচার দিস!
ইমরান তাকে ছোটখাটো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পার্স থেকে ফোনটা নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো। নাফিসা কান্না করতে করতে দরজায় থাপ্পড়, লাথি দিতে লাগলো। খুব কষ্ট লাগছে ভেতরটা! পরপর তিনটা থাপ্পড় খেতে হলো বিনা কারণে! চোখের সামনে যা আছে সব তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তেমন কিছুই করলো না। শুধু হাতের পার্সটা বরাবর ছুড়ে মারলো, যেটা খাটে ড্রপ করে মেঝেতে পড়ে গেছে। বোরকা খুলে সে ফ্লোরে বসেই কান্না করছে।
এদিকে ইমরানেরও ভেতরটা বড্ড অশান্ত লাগছে নাফিসাকে মেরে! এতো জেদ করলে কি নিজের রাগ কন্ট্রোল করা যায়! বড় ঘরে থাকাকালীন যেই থাপ্পড়গুলো দিয়েছে, তার কারণেই ঠোঁটের ভেতরের দিক অথবা গাল কেটে গেছে। সেটাই ইমরানের ভাবনা। দেখতেও তো দিলো না জিদ্দি মেয়েটা! কান্নার শব্দ রুমের বাইরে চলে আসছে। খুব ব্যাথা পেয়েছে নিশ্চয়ই!
ইমরান জানালা থেকে একটু দূরে অন্ধকারে দাড়িয়ে নাফিসাকে লক্ষ্য করছিলো, অতি রেগে আবার উল্টাপাল্টা কিছু করে কি-না দেখার জন্য! যদিও সে ৮০ ভাগ নিশ্চিত, নাফিসা এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না যেটা হারাম! জিদ্দি হলেও তার মাঝে একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে। যার কারণে সে হালাল হারাম বেছে চলতে জানে। অপকর্ম সম্পর্কে নিজে বুঝে এবং অন্যকেও বেশ ভালো বুঝাতে পারে। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এমন নারী নিশ্চয়ই সুইসাইড জাতীয় কোনো কাজ করবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here