নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_৩০ শেষাংশ দ্বিতীয়ভাগ

0
848

নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_৩০ শেষাংশ দ্বিতীয়ভাগ
লেখায়_জারিন

১৭৮.

রাত এগারোটা প্রায়। মেহমান সব বিদায় নিয়েছে শেখ ভিলা থেকে। আজ শেখ ভিলাতেই রাফিদ ও মেহেরের বাসরের আয়োজন করা হয়েছে। একই সাথে চুপিসারে নতুন করে বাসরের আয়োজন হচ্ছে ইরিন-নক্ষত্রের জন্যও।
রাফিদ,মেহের, রুনা এখানেই থাকছে আজ রাতে।মারিয়াকে থাকতে বললেও সে থাকেনি। বাড়ি ফিরে গেছে। নীচে সবাই যে যার মত অনুষ্ঠান পরবর্তী গোছগাছের কাজে ব্যস্ত। এই ফাঁকে রাফিদ আর মেহের মিলে নক্ষত্র আর ইরিনকে প্রায় ধরে বেঁধে ছাদে নিয়ে এসেছে।

দুধের মত সাদা ধবধবে একটা চাঁদ উঠেছে আকাশের আঁধার চিরে। তারায় তারায় ঝলমল করছে পুরো আকাশ। বিয়ে উপলক্ষে বাড়ির ছাদজুড়ে করা হয়েছে ছোট ছোট সাদা ও হলুদ মরিচ বাতির আলোকসজ্জা। সেখানেই সিমেন্টের মসৃণ মেঝেতে মাদুর পেতে বসেছে তারা চারজন। আলোকিত ঝলমলে পরিবেশের শোভা যেন আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের সবাই হাসিমুখগুলো।

কনক গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চা পাঠিয়েছে। সারাদিনের ক্লান্তি কাটাতে এই যেন ভীষণ জরুরি ছিল সবার জন্যই। সবাই যার যার মত স্বস্তি নিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।আর নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছিল।

এরমাঝেই রাফিদ চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘এখন বলুন ইরিন, কিভাবে কি এমন চমৎকার ঘটে গেল যে আপনার এতদিনের ডিভোর্সের ঘ্যানঘ্যানানি একেবারে ঘুচিয়ে দিল ভাই?

‘আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন রাফিদ। আমি মোটেও ঘ্যানঘ্যান করিনি। তখন যেটা ঠিক মনে হয়েছিল সেটাই করেছিলাম। এটা মোটেও ঘ্যানঘ্যানানির কিছু ছিল না।’ কপট রাগ দেখিয়ে বললো ইরিন।

‘ওকে…ওকে…আ’ম স্যরি। ভুল বলে ফেলেছি।মাফ করুন জনাবা। এখন বলুন কিভাবে কি হলো?’

‘উনি তুলে নিয়ে গেছিলেন আমাকে।তারপর…’

‘কিহ…আবার!!

‘হু।’ বিরস মুখে বললো ইরিন। বিপরীতে রাফিদ চেঁচালো।

‘এই আপনি কাকে বিয়ে করেছেন বলুন তো? এই লোক তো কথায় কথায় মেয়ে তুলে নিয়ে যায়!’

‘রাফিদ! হোয়াটস দিস ইয়াররর?? নিজের ভাবীর সামনে বড়ভাইকে নিয়ে কিসব বলছো তুমি?’ নক্ষত্র হুশিয়ারি দিয়ে বললো। এদের সম্পর্ক এক রাতেই এমনভাবে বদলে গেছে যেন এরা সত্যিকার অর্থেই ভাই। বছরের পর বছর ধরে পরিচিত একে অন্যের সাথে।

‘স্যরি ভাই। বাট তুমি যা করো তাই তো বললাম। ‘

‘সিরিয়াসলি, রাফিদ? আমি মেয়ে তুলে আনি?’

‘তা নয় তো কি?প্রথমবার বউয়ের জন্য মনিরাকে তুলে নিয়ে গেছিলে, এবার ভাইয়ের জন্য বউ তুলে আনলে আবার এখন শুনছি তুমি নিজের জন্য নিজের বউকেই তুলে নিয়ে গেছিলে। হোয়াটস দিস, ভাই??’

‘তো কি করবো! ভাইও একটা আর বউও একটাই। আমিও একটাই। তাদের আর নিজের ভালোর জন্য এটুকু করা কোন অন্যায় না। ‘ নিজেই নিজের পক্ষপাতিত্ব করে বললো নক্ষত্র।

‘হ্যাঁ, তা আর বলতে!’ রাফিদ বললো বিরস গলায়।

‘এই তোমরা থামো তো। যেটা শোনার জন্য আসছি সেটাই বাদ দিয়া কিসব আজাইরা প্যাঁচাল শুরু করে দিছো। ‘ রাফিদ ও নক্ষত্রকে উদ্দেশ্য করে বললো মেহের। তারপর ইরিনকে বললো, ‘তুমি বলো তো ভাবী। কোথায় নিয়ে গেছিল ভাইয়া তোমাকে?’

‘নক্ষত্রবাড়ি।’

‘মানে সিলেটে? আপনার বাড়িতে?’ রাফিদ উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করলো।

‘হ্যাঁ। ‘

‘ও আল্লাহ! কিভাবে কি?’

‘সেদিন কোর্ট থেকে শপিং করার কথা বলে নিয়ে গেলেন, না? তারপর, শেখ ভিলায় না নিয়ে এসে সোজা সিলেটের রাস্তা ধরেছিলেন উনি।আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে যখন খেয়াল হলো এটা শেখ ভিলার রাস্তা নয় অন্য কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি ততোক্ষণে উনি ঢাকার রাস্তা ছেড়ে সিলেটের রাস্তা ছুঁই ছুঁই। ‘ বিরস মুখে বললো ইরিন।

পাশে বসে নক্ষত্র মিটিমিটিয়ে হাসছে। রাফিদ পুরো হা। মেহের অপেক্ষা করতে না পেরে তাড়া দিল।

‘তারপর…তারপর?? ‘

ইরিন লাজুক হাসলো। তারপর,আস্তে আস্তে বলতে লাগলো সেদিনের ঘটনা।

১৭৯ (১).

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। নক্ষত্র চুপচাপ ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে চুপচাপ বসে আছে ইরিন। গত ৩/৪ দিনে কেসের রায় নিয়ে চিন্তায়, উত্তেজনায়,সেই সাথে অফিসের কাজ সব মিলিয়ে ঠিকমত ঘুম হয়নি তার। আজ প্রায় দুপুর পর্যন্ত কোর্টেই কেটে গেল সময়টা। এতসব কিছুর ধকলে মাথা ব্যাথা করছে এখন তার হালকা বিস্তর। বাইরে দুপুরের কড়া রোদ। যদিও গাড়িতে এসি চালু থাকায় গরম লাগছে না। তবে,ইরিনের ভেতর ভেতর হাঁশফাস লাগছে। গাড়িতে এসি তার মোটেও ভালো লাগে না। কিন্ত, বাইরের এই কড়া রোদ আর ঢাকার ধূলোবালির মাঝে জানলা খুলে দেওয়ার কথা বলার সাহসও ইরিন পাচ্ছে না। তাই একহাতে মাথা কিছুটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলো সে।আলগোছে মাথাটা এলিয়ে দিল জানলার ধার ঘেঁষে ।

নক্ষত্র মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছিল। ইরিনকে এত চুপচাপ পেয়ে এবার একনজর তার দিকে তাকালো। তারপর, সামনে তাকিয়ে ইরিনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মাথা ব্যাথা করছে ইরিন?’

এভাবে বসে থাকতে থাকতে হালকা তন্দ্রাভাব এসে গেছে ইরিনের। নক্ষত্রের প্রশ্নে সেই ঘুম জড়ানো কন্ঠে ছোট্ট করে জবাব দেয় সে, ‘হু’।

‘বেশি খারাপ লাগছে?’

‘না। হালকা একটু মাথা ব্যাথা জাস্ট। ‘

‘মেডিসিন নিবা? চা/কফি খাবা কিছু? ‘

‘উহু। লাগবে না। আচ্ছা, আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে? ‘

‘এই তো আর ঘন্টা চারেক।’

নক্ষত্রের এমন জবাবে তন্দ্রাচ্ছন্ন ইরিন তড়াক করে চোখ মেলে তাকালো। সামনে তাকিয়ে ভড়কে গেল সে। হাইওয়ের মত লম্বা রাস্তা। তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে বসতে বসতে আশেপাশের বাইরের পরিবেশ দেখলো। অচেনা ঠেকলো সব। মস্তিষ্ক জানান দিল কোনভাবেই এটা শেখ ভিলায় যাওয়ার রাস্তা নয়। ইরিন অস্থির হয়ে উঠলো। বিচলিত গলায় প্রশ্ন করলো,

‘এই পুতুলের বাবাই….কই যাচ্ছেন আপনি? এটা তো শেখ ভিলার রাস্তা না। ঢাকার রাস্তাও মনে হচ্ছে না। কই এটা?’

ইরিনের এই অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসলো নক্ষত্র। সোজা সাপটা সাবলিল গলায় বললো, ‘এটা সিলেট যাওয়ার রাস্তা। নক্ষত্রবাড়ি যাচ্ছি আমরা ।’

নক্ষত্রের কথায় মূহুর্তে মধ্যেই হতভম্ব হয়ে গেল ইরিন। কিছুসময় বোকা চোখে চুপচাপ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থেকে চেঁচিয়ে উঠলো সে।

‘তার মানে আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন?’

‘হ্যাঁ।’ সহজ গলায় জবাব দিল নক্ষত্র।

‘কেনওওও? আর আপনি কবে থেকে মিথ্যা বলতে শুরু করেছেন, পুতুলের? আপনি তো এমন ছিলেন না!’ অনেকটা আহাজারি করে বললো ইরিন।

‘তোমার কি আমাকে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির মনে হয় ইরিন? সিরিয়াল লায়ার না হলেও জীবনের প্রয়োজনে টুকটাক মিথ্যা কিন্তু বলতেই হয়। সবাই বলে কম বেশি। আমিও এর বাইরে নই।’

ইরিন ভীষণরকম হতাশ হলো নক্ষত্রের এমন হেয়ালি জবাবে। একই সাথে মেজাজ খারাপ লাগছে তার এখন। একরাশ বিরক্তি গলায় ঢেলে বললো,

‘এই…গাড়ি থামান। আমি যাবো না কোথাও আপনার সাথে।’

‘গাড়ি সোজা নক্ষত্রবাড়ি গিয়ে থামবে। এন্ড মিসেস.ইয়াসমিন রাওনাফ ইরিন….ইউ হ্যাভ টু গো উইথ মি। দ্যায়ার ইউ হ্যাভ নান আদার অপশন ফর ইউ।’

‘আপনি বললেই হলো?’

‘অবশ্যই!’

‘অবশ্যই না। আপনি গাড়ি থামান। আমি আমার বাসায় যাবো।’

‘তোমার বাড়িই যাচ্ছি ইরিন। ‘

‘ওটা এখন আর আমার বাড়ি নয়। আপনার দেওয়া সব কিছু ফিরিয়ে দিয়েই ডিভোর্স ফাইল করেছি আমি।’ জেদি গলায় বললো ইরিন।

‘আমার দেওয়া ভালোবাসাটুকু তো ফিরিয়ে দাওনি। সব কিছুর চাইতে দামী এবং অনেক বেশি ওটাই তো দিয়েছিলাম তোমাকে। তাই, ওটা ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত তুমি তো ডিভোর্স নিতে পারবে না, মিসেস. নক্ষত্র।’

নক্ষত্রের এ কথার পরে ইরিন সহসা চুপ হয়ে গেল।সত্যিই তো এটা ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি তাকে। কি করেই বা দিত? ভালোবাসা কি ফিরিয়ে দেওয়া যায় কখনো কোন ভাবে? অনুভূতিটা অমূল্য। এটা কি করে ফিরিয়ে দিবে সে? অসম্ভব তার জন্য। হতাশ হয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইরিন।আরও একবার নিজের কথা মানানোর চেষ্টা করে শান্ত গলায় বললো, ‘গাড়ি থামান, পুতুলের বাবাই। আমি নামবো। তারপর, আপনার যেখানে যাওয়ার আপনি যান।আমি যাবো না সাথে। ‘

‘গাড়ি তো এখানে থামবে না।তবে তুমি নামার চেষ্টা করে দেখতে পারো। দেখো…লক খুলে নামতে পারো কিনা! ‘ দুষ্টুমির স্বরে বললো নক্ষত্র।

ইরিনের এবার রাগ হলো। কিন্তু, সে নক্ষত্রের সাথে ঝামেলা করতে চাইছে না কোন। তাই রাগ চেপে অন্য পথ ধরলো। বাহানা করার সুরে বললো,

‘আমার বাসায় যেতে হবে, পুতুলের বাবাই। বাসায় রিতু একা।’

‘রিতু শেখ ভিলায়।ওখানেই থাকবে আজ।’

‘কিহ? ‘

‘হু।’

‘তারমানে আপনি সব আগে থেকেই প্ল্যান করে করেছেন?’

‘না। হুট করেই প্ল্যান করতে হয়েছে। কেস শেষে কোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে।’

‘মানে কি? আপনি এক্স্যাক্টলি কি করতে চাইছেন বলুন তো?’ চেঁচিয়ে বললো ইরিন।

‘এখন এত প্রশ্ন করো না তো পুতুলের আম্মু। আমাকে মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করতে দাও। নইলে এক্সিডেন্ট হয়ে গেলে তোমার আর ডিভোর্সের দরকার পড়বে না। একেবারে মুক্তি পেয়ে যাবে আমার থেকে। তুমি কি সেটাই চাও, পুতুলের আম্মু?’

নক্ষত্রের এমন কথায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো ইরিনের। মস্তিষ্কে ব্যাপারটা টোকা দিতেই মূহুর্তেই কান্না জড়ো হলো চোখে। রাগে অভিমানে কান্না দমানো গলায় চেঁচালো সে আবারও।

‘এই…পুতুলের বাবাই, কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলতেছেন আপনি? না মানে…মুখে যা আসে তাই বলবেন, নাহ? ভাল্লাগে না আমার আর এসব।’

ইরিনের কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পেরে একটা সূক্ষ সুখানুভূতি ছেয়ে গেল নক্ষত্রের ভেতরে। মুচকি হাসলো সে। ইরিনকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে বললো, ‘আমারও ভাল্লাগে না আসলে। কিন্তু, যতদিন বাঁচবো আমার থেকে তোমার মুক্তি নেই। আর তোমার তো আমার থেকে মুক্তিই চাই তাই না? ‘

ইরিন আর কিছু বলতে পারলো না। কান্না চেপে যেতে এবার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে তার। নক্ষত্রকে সে চিনে।খুব ভালোই চিনে। এ যাত্রা নক্ষত্রবাড়ি গিয়েই শেষ হবে। বুঝে গেছে সে। তাই চুপচাপ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল ইরিন। মাথা ব্যাথাটাও বেড়েছে আগের চাইতে। আবারও তাই চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে দিল সে। সাথে সাথেই বন্ধ চোখ বেয়েও নেমে এলো কিছু সিক্ত অভিমান।

ইরিনের থেকে কোন জবাব না পেয়ে পাশ ফিরে ইরিনকে দেখলো নক্ষত্র। কাঁদতে দেখেও বললো না কিছুই। আলতো হেসে সামনে তাকিয়ে পুনরায় ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিল সে।

১৭৯ (২).

গাড়ি যখন নক্ষত্রবাড়ির বিশাল গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো তখন সাঁজের আলোয় নিমজ্জিত প্রকৃতি। বাড়ির গেইটের দুপাশে জ্বলছে ঝলমলে গোলগাল বড় বড় দুটো সাদা আলোর বাতি।শ্বেতশুভ্র বিশাল দুতালা এ বাড়িটা দেখলে মনে হয় যেন সত্যিই একটুকরো নক্ষত্র খসে পড়েছে পৃথিবীর জমিনে। বাড়িটা এমন মনে হওয়ার পেছনে অবশ্য অবদানটা ইরিনেরই। বাড়ির নকশা নক্ষত্র করলেও বাড়ির রঙ আর টুকিটাকি সাজসজ্জা ইরিনের চাওয়া মতই করা হয়েছে। নক্ষত্র যখন জিজ্ঞেস করেছিল, বাড়ির নাম কি রাখবে? ইরিন নক্ষত্রের মুখপানে তাকিয়ে অতশত না ভেবেই বলেছিল, ‘নক্ষত্রবাড়ি।’

নক্ষত্র অবাক হয়েছিল খুব তার কথায়। হেসে বলেছিল, বাড়ি যখন ইরিনের তখন নামটাও তার সাথে সম্পর্কিত একটা নাম হওয়া উচিৎ। ইরিনের সেদিন কি হয়েছিল সে নিজেও জানে না। মিষ্টি হেসে বলেছিল, ‘আমার বাড়ি বলেই তো নাম হবে নক্ষত্রবাড়ি। যার প্রতিটা দেয়ালে, ইট পাথরের ছাঁচে ছাঁচে, বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় থাকবে নক্ষত্রের চিন্তা…কল্পনার..ভালোবাসার ছাপ।’

নক্ষত্র সেদিন বিশ্বাস করতে বাধ্যই হয়েছিল বলতে গেলে,প্রেয়সী তার সত্যি সত্যি গভীর প্রণয়ে মজেছে। আজীবন এভাবেই ভালোবাসবে তাকে।’ তাই ইরিনের ইচ্ছেতেই বাড়ি বাইরেটা সাদা রঙের এবং ভিতরটা ধূসর ও সাদার সংমিশ্রণে তৈরী করা হয়েছে। খুব অল্পসল্প আসবাব দিয়ে হালকা পাতলা তবে আভিজাত্যের ছোঁয়ায় সাজিয়ে তোলা হয়েছে এ বাড়িটাকে। সারাবছর রাখা হয় নিবিড় যত্ন ও পরিচর্যায়। যার জন্য দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে মানুষজনের দৈনন্দিন বসবাস নেই।

সবুজে ঘেরা পাহাড়ি এলাকায় বিশাল জায়গা জুড়ে নির্মিত এই বাড়িটার সামনে লম্বা একটা লন, দু পাশে সবুজ ঘাসের রাস্তা। সাদা রঙের বিভিন্ন ফুল, নীল অপরাজিতা ও কালো গোলাপের বাগান আর নীল জলের মাঝারি আকৃতির একটা সুইমিংপুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বাইরের অংশ।

দিনের বেলায় এ বাড়িটা যেমন মনের মাঝে একরাশ স্নিগ্ধতা জাগায়, মনে হয় সবুজের মাঝে মেঘ এসে থেমেছে জমিনে। তেমনি রাতের বেলাও ঝলমল করে এ বাড়িটা।ছোট বড় অনেক আকৃতির সাদা ও হলুদ আলোয় ভরিয়ে রাখা হয় বাড়িটা।দূর থেকে দেখতে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করছে বলে মনে হয় জায়গাটা।

ইরিন সেই যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছিল, সারা পথ সে ঘুমিয়েই এসেছে। নক্ষত্র যে এর মধ্যে দুবার গাড়ি থামিয়েছে সেটাও টের পায়নি সে। কিন্তু, বাড়ির বন্ধ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে পর পর দু/তিনবার হর্ণ বাজাতেই ঘুম হালকা হতে শুরু করলো তার। নড়েচড়ে উঠতে উঠতেই ভেতর থেকে দুজন গার্ড টেনে খুলে দিল কালো রঙের নকশা করা বিশাল গেইটটা। নক্ষত্র গাড়ি ভেতরে নিতে নিতেই ইরিন ঘুম ঘুম চোখেই সোজা হয়ে বসলো সিটে। লম্বা লনটা পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে গিয়ে থামলো গাড়িটা। নক্ষত্র নিজের সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বললো, ‘এবার তুমি নামতে পারো ইরিন। তোমার বাড়ি এসে গেছি।’

ইরিন অভিমানে মুখভার করে রেখেছে। নক্ষত্রের বিপরীতে তাই টু শব্দটি করলো না। নক্ষত্র দরজার লক খুলে নেমে গেল গাড়ি থেকে। ইরিনও আস্তে ধীরে নেমে এলো। কিন্তু, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো তার। কোন মতে গাড়ির খুলে রাখা দরজার পাল্লাটা ধরে দাঁড়িয়ে সামলে নিল নিজেকে। নক্ষত্র সেটা দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। ব্যতিব্যস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘আর ইউ ওকে?’

‘হু।’

‘হেঁটে যেতে পারবা…নাকি হেল্প করবো?’

‘পারবো।’ কথাটা বলেই গাড়ির দরজাটা লাগিয়ে যাওয়ার জন্য আগাতেই আবারও ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। নক্ষত্র দ্রুত এগিয়ে এসে ইরিনে ধরলো। তার এমন অবস্থা দেখে নক্ষত্রের মনে পড়লো, আজ সারাদিন তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি ইরিনের। দুপুর অবধি প্রায় কোর্টেই সময় গেছে। তারপর আবার এত লম্বা জার্নি। দূর্বলতা থেকে এমন হচ্ছে তার বারেবার। নক্ষত্র আর ঝুঁকি নিল না। আচমকা পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ইরিনকে।
ইরিন হকচকিয়ে গিয়ে ভারসাম্য রাখতে নক্ষত্রের গলা জড়িয়ে ধরলো। অস্থির গলায় বললো,

‘এই পুতুলের বাবাই, কি করতেছেন…নামান আমাকে। আমি হেঁটেই যেতে পারবো। ‘
নক্ষত্র ইরিনে কথা কানে নিল না। সোজা নিজের মত হেঁটে বাড়িতে প্রবেশ করলো।

পাহাড়ি রাস্তার মতই বাঁক তোলা সিড়ি ভেঙে সোজা দুতালায় উঠে গেল নক্ষত্র। করিডোর পেরিয়ে মাঝ বরাবর নিজের ঘরে এসে থামলো সে। ইরিনকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিল।এমনিতেই এত দীর্ঘ পথ একটানা ড্রাইভ করে এসে ক্লান্ত ছিল ভীষণ। তারপর, আবার এভাবে ইরিনকে নিয়ে নিজের ঘর পর্যন্ত এসেছে। হাঁপিয়ে গেছে সে ভীষণ।

তাকে এভাবে শ্বাস নিতে দেখে মায়া হলো ইরিনের। কিন্তু এটাকে ছাপিয়ে সে তার অভিমানকে অগ্রাধিকার দিল। পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে মনে মনে আউড়ালো, ‘ঠিকই আছে। আমাকে জোর করে তুলে আনার ফল। ভুগতো আব(ভোগ করো এবার)।’

নক্ষত্র নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে ইরিনকে বললো, ‘টায়ার্ড লাগছে খুব।ফ্রেশ হওয়া দরকার। তুমি আগে যাবা নাকি আমি যাবো?’

ইরিন কোন জবাব দিল না। মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।নক্ষত্র বুঝলো ইরিন ইচ্ছা করে এমন ভাব নিচ্ছেন। সেও বা কম কি। ইরিনকে বললো, ‘এক কাজ করো।তুমি বরং রেস্ট নাও দশ মিনিট। আমি ফ্রেশ হতে আসি ঝটপট। তারপর তুমি যেও।’

ইরিন এবারেও কিছু বললো না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে হতাশ হলো নক্ষত্র। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ আলমারি থেকে নিজের জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

১৭৯ (৩).

নক্ষত্র ওয়াশরুমের দরজা লাগাতেই ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লো ইরিন। যেন এতক্ষণ কেউ জোর করে তার নিশ্বাস আটকে রেখেছিল। মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে তার। তাই হেঁটে গিয়ে বিছানায় বসলো সে। চুপচাপ মাথা নীচু করে ভাবতে থাকলো নক্ষত্রকে নিয়ে।

ইদানীং নক্ষত্রকে বেশ অন্যরকম লাগছে ইরিনের।ডিভোর্স দিতে সে শুরু থেকেই নারাজ। ইরিন ‘শেখ ভিলা ‘থেকে চলে আসার পরেও অনেকবার বলেছে পুতুলের জন্য তাকে ফিরে যেতে।

কিন্তু,সেদিন রাতে নিজের জন্য বন্ধু হিসেবে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছে সে ইরিনকে। ইরিন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, আদতে কি চলছে নক্ষত্রের মনে। তবে কি নক্ষত্র চাইছে ইরিন ডিভোর্স ক্যান্সেল করে শেখ ভিলায় ফিরে যাক? নাকি ফিরে আসুক নক্ষত্রের জীবনে।কি চায় সে? যদি বা চায়ও তবে কি করবে ইরিন? ফিরে যাবে? নাকি ডিভোর্স ফাইনাল করে একাই থাকবে বাকি জীবন?

কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনা ইরিনের মন। শেষে হাল ছেড়ে দেয়। যা হবে দেখা যাবে। আগে নক্ষত্র কি চায় সেটা জানা দরকার।

সব ভাবনা ছেড়ে ইরিন উঠে দাঁড়ালো।ঘরটাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। আজ তৃতীয় বারের মত এ বাড়িতে এসেছে সে। প্রথমার এসেছিল নওরিনের আগমনের মাস দেড়েক আগে। বাড়ির কাজ শেষ করার পর সপরিবারে প্রথম পা রেখেছিল সে এই বাড়িতে। ওর যতদূর ধারণা নওরিনের আগমনের সূচনাও ঘটেছিল সেদিনই। তারপর,ইরিন যখন চার মাসের গর্ভবতী। দ্বিতীয়বারের মত ঘুরতে এসেছিল সিলেটে। তারপর আর আসা হয়নি বিগত কয়েক বছরে।

বেশি কিছু নেই ঘরে। একটা বড় খাট। দুটো বেড সাইড টেবিল, একটা আলারি, একটা ডিভান আর বিছানার মুখোমুখি দেওয়ালে টিভি ও ঠিক তার উপরে একটা দেয়াল ঘড়ি। ঘরের মাঝ বরাবর এক পাশে ওয়াসরুম, অন্যপাশে মাঝারি খোলা ব্যালকোনি। যেটা বাড়ির পেছন দিকটায় পড়েছে। সেখানে পাহাড়ি জঙ্গলে ঘেরা অনেকটাই। সকালে পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসা সূর্যের ঝলমলে আলো এসে পড়ে ব্যালকোনি জুড়ে। হিম শীতল স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে চলে। রাতদিন শোনা যায় কিছু দূরের পাহাড়ি ঝরণার কলকলিয়ে নেমে আসার জলতরঙ্গে শব্দ ।

এর আগে মাত্র দুবার এসেছিল সে এখানে। অথচ এতেই কতশত স্মৃতি জন্ম নিয়েছে এই ঘরে।এই বাড়ির কোণায় কোণায়।তার ধারণা নওরিনের আগমনের সূচনাও এই বাড়িতে। এই ঘরেই। অথচ, এ বাড়িতে পা রাখার ভাগ্য তার হয়নি। এসব ভেবেই আপনমনেই স্মিত হাসলো ইরিন।

১৭৯(৪).

‘আলমারিতে তোমার জামা কাপড় রাখা আছে। যাও ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নাও।’

আচমকা নক্ষত্রের গলার স্বরে ভাবনাচুত্য হয়ে চমকে উঠলো ইরিন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার জামা কাপড় এখানে কি করে?’

‘আমি এনে রেখেছি। খুলে দেখো।’

নক্ষত্রের কথায় ইরিন আলমারি খুলে তাজ্জব বনে গেল। আলমারি ভর্তি শাড়ি। ব্যক্তিগতভাবে নক্ষত্র তাকে শাড়িতে দেখতেই পছন্দ করে। কিন্তু, এসব শাড়ি একটাও তার নিজের না। ইরিন বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করে,

‘এগুলো কার শাড়ি?’

‘তোমার। তোমার জন্য কিনেছি একে সময়। কিন্তু, দেওয়া হয়নি কখনো। আমার আলমারিতে জায়গা হচ্ছিল না।তোমার আলমারিতে জায়গা দিতে চাইনি। তাই একবার যখন সিলেট এসেছিলাম তখন কয়েকটা এনেছিলাম। এরপর থেকে জায়গা না হলেই এখানে পাঠিয়ে দেই। রাইজু খালা গুছিয়ে তুলে রাখেন। দেখো..ম্যাচিং ব্লাউজ পেটিকোটও আছে বোধয় কিছু কিছু। ‘

‘কতগুলো শাড়ি এখানে?’

‘উমমম…সঠিক বলতে পারছিনা। হবে শ’খানিক।’

‘আপনি পুরাই একটা যা তা…পুতুলের বাবাই। ‘

‘বউ আমার একটাই। আমার সব শখ আহ্লাদও তাকে ঘিরেই।’

‘বউ! খালি মুখে মুখেই স্বীকার করেন। সত্যিকার অর্থে স্বীকৃতি আর পায় কই সে!’ তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো ইরিন। নক্ষত্র টি-শাট পড়তে পড়তে বললো, ‘ফ্রেশ হও…যাও। বাকি যা অভিযোগ, সেসব শোনার জন্য পুরো রাত পড়ে আছে।’

‘আমার কোন অভিযোগ নেই। ‘ সহজ গলায় অভিমান ঢেলে বলে ইরিন।

‘নেই?’ শান্ত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।

ইরিন এর জবাব দেয় না। নতুন করে আর কি বুঝাবে তাকে? যে ব্যাপারগুলো নক্ষত্র নিজের জন্য ইরিনের অভিযোগ ভাবে, আসলে তা ইরিনের অভিমানের কারণ। এটা কেন বুঝে না সে?

ইরিন কথা বাড়ায় না। আলমারি থেকে একটা শাড়ি বেঁছে নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে যায়। নক্ষত্র মুচকি হাসে ইরিনের নাজেহাল অবস্থা দেখে। মনে মনে আউড়ায়, ‘বেচারি! ‘

১৭৯ (৫).

ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে আছে ইরিন। সদ্য ভেজা চুলগুলো থেকে এখনো পানি ঝরছে তার। পাহাড়ি স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে ক্ষণে ক্ষণে। শিহরণে জাগিয়ে তুলছে প্রতিটি লোমকূপ। ছড়িয়ে পড়ছে তার সর্বাঙ্গজুড়ে। কোমড় পর্যন্ত করা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইরিন। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে পরিবেশটা।

হঠাৎ পিঠে কারও আঙুলের ছোঁয়া লাগতেই চমকে উঠলো সে। আরও কয়েকসেকেন্ড যাওয়ার পর সে বুঝলো এটা নক্ষত্রের স্পর্শ। পেছনে দাঁড়িয়ে ইরিনের চুল মুছছে সে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ইরিন। নক্ষত্র চুল মুছে দুই একবার নিজ হাতে ঝেড়ে দিল। তোয়েলেটা রেলিং এর এক পাশে মেলে দিয়ে ইরিনকে বললো, ‘এক্সট্রা টাওয়াল নিয়ে গেলেই তো পারতে। এ বাড়িতেও তোমার কোন কিছুর অভাব আমি রাখিনি, ইরিন। ‘

‘আপনি আমার জীবনে আসার পর থেকে অভাব শব্দটাই আমার জীবন থেকে উধাও হয়ে গেছে প্রায়। শুধু একসময় স্বস্তির অভাব মনে হতো, আর এখন শুধু ভালোবাসার অভাব লাগে। এছাড়া, আর কোন অভাব নেই আমার জীবনে।’

‘এই অভাবগুলোর জন্য তুমি যতটা দায়ী আমিও ততোটাই দায়ী, ইরিন। শুরুতে আমি তোমার মনের অভাবটা বুঝতে পারিনি আর এখন বুঝেও পূরণ করতে ব্যর্থ।’

‘এ ব্যর্থতার দায়টাও তো আমারই।’

‘ঠিক তা নয়। আসলে কি জানো তো ইরিন, কোন সম্পর্কে বা কাজে যখন একের অধিক মানুষ জড়িত থাকে তখন কোন কিছুর জন্য একা কেউ দায়ী বা জয়ী হয় না। কমতি আমারও ছিল। আমি কষ্ট পেয়ে নিজেকে তোমার থেকে দূরে করে নিয়েছিলাম। আর তুমি অপরাধবোধে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলে আমার থেকে।’

‘তারপরও তো আমি কম চেষ্টা করিনি আপনার স্ত্রী হয়ে উঠার। কিন্তু আপনিই তো..’

‘স্ত্রী তো তুমি এখনো আমার। কিন্তু, তুমি কি কখনো আমার ভালোবাসার মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছিলে, ইরিন?’

নক্ষত্রের প্রশ্নে অবাক চোখে পাশ ফিরে চাইলো ইরিন। নক্ষত্র ইতোমধ্যে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ইরিনের নিরবতায় নক্ষত্র মুচকি হাসলো কেবল। পাশ ফিরে ইরিনের অবাক চোখের বিপরীতে নিজের সহজ সরল মায়া চোখে তাকালো। সরল স্বীকারক্তির সুরে বললো,

‘আমি আজও তোমাকেই ভালোবাসি পরী। আগের চাইতেও বেশি ভালোবাসি। জীবনের প্রথম প্রেম…প্রথম ব্যক্তিগত ভালোবাসার নারীটিকে কি এত সহজেই ভালোবাসা ছাড়া যায়? আমিই বা পারতাম কি করে বলো তো! শুধু এতকাল নিজের বিশ্বাস ভাঙার জন্য দায়ী নারীটিকে ভালোবাসাতে কষ্ট হতো বলে সেই ভালোবাসাকে আমি হৃদয়ের কালকুঠুরিতে বন্দি করে রেখেছিলাম। কিন্তু, কেউ একজন যখন সেই কাল কুঠুরিতে এক ছটাক আলো ফেলে আমায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, যে নারীটিকে আমি নিজের আঘাতের জন্য দায়ী করেছি সেই আঘাত করার সাহস ও সুযোগ আমিই তাকে দিয়েছিলাম। তাই এ আঘাত…এ কষ্ট আমার প্রাপ্য। ভালোবাসতে কষ্ট হওয়াটা আমার শাস্তি।

তবে, আমি চাই আমার এই শাস্তি শেষ হোক। আর তোমারও। দুজনেই তো ভুগলাম ইরিন। আর কত? এবার আমারও যে মুক্তি চাই।’

‘মুক্তিই তো দিতে চাইছি। ডিভোর্সটা হয়ে গেলে নিজের যোগ্য কাউকে চাইলেই বিয়ে করতে পারবেন আপনি। যে আপনাকে আমার মত আঘাত করবেনা, কষ্ট দিবে না..’

‘ভালোওবাসবে না সে তোমার মত।’

‘অবশ্যই। আমি আপনাকে ভালোবাসার যোগ্যই ন…

শব্দটা পূর্ণতা পেল না। কথাটাও সম্পূর্ণ হলো না। তার আগেই নক্ষত্রের গাঢ় প্রণয়স্পর্শের অবরোধে ঠোঁটের ডগায় এসেও আটকে রয়ে গেল। অপ্রত্যাশিত এ মূহুর্তের জন্য অপ্রস্তত ইরিন পাহাড়ের মতই শান্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।তবে, দুচোখ বেয়ে পাহাড়ি ঝরণার মত কলকলিয়ে নেমে এলো শান্ত ভংগিমায় অবাধ অশ্রুধারা।

১৭৯ (৬).

ভেজা চুলের ভাঁজে ভাঁজে নক্ষত্রের আঙুলগুলো শক্তপোক্তভাবেই মিশিয়ে নিয়েছে ইরিনকে তার সাথে। অন্যহাতের আঙুলের ভাঁজে ইরিনের আঙুলগুলোও শক্ত করেই আঁকড়ে ধরা। খানিকসময় বাদে রাগ-জেদটা কিছুটা শান্ত হয়ে আসতেই ঠোঁটের অবরোধ ক্ষান্ত হয়ে এলো তার।কিন্তু, রাগ জেদের রেশটা পুরোপুরি ক্ষান্ত হলো না। অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায় ভারী হয়ে আসা শ্বাসপ্রশ্বাসের চলাচল স্বাভাবিক করতে ইরিনের কপালে কপাল ঠেকেলো নক্ষত্র। ইরিন এখনো স্থির পূর্বের ন্যায়।নক্ষত্রও স্থির হয়ে মিশে রইলো তার সাথে। কিছু সময় পর চাপা রাগ মিশেল কন্ঠে বললো,

‘কাউকে ভালোবাসতে যোগ্যতা লাগে না। ভালোবাসাটা নিজের করে পেতে গেলে যোগ্যতা লাগে। তুই আমাকে ভালোবাসিস তোর অনুভূতিতে। আমাকে নিজের করার ক্ষমতা কেন তুই রাখিস না, তাহলে? নাকি ভালোবাসাটা অন্যকারো হয়ে গেছে তোর? তাই মুক্তির জন্য অহেতুক বাহানা করছিস?’

‘সন্দেহ করছেন?’ ঠান্ডা গলায় বললো ইরিন।

‘ভয় পাচ্ছি।’ বিপরীতে নক্ষত্রের সরল স্বীকারক্তি।

‘কিসের ভয়?’ ইরিন বিভ্রান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে।

‘তোকে হারানোর। ‘

‘আমি কে পুতুলের বাবাই? আপনি যে ইরিনকে ভালোবাসেন সে কবেই মরে গেছে। তাকে আবার হারানোর ভয় কিসের! আর এই যাকে আপনি এখন ছুঁয়ে আছেন সে কেবল আপনার বৈধ সন্তানের জন্মদাত্রী মা। ‘

‘আমাকে ভালোবাসিস, পরী?’

‘বাসি।’ শান্ত দৃঢ় স্বরে বলে ইরিন।

‘আরও একবার নক্ষত্রের হবি, প্লিজ? ভুলে ভুলে কাটাকাটি করে শূন্য থেকে শুরু করবি একটা জীবন?’

‘আমি তো সেই কবেই নক্ষত্রের হয়ে গেছি। নক্ষত্র বন্দনায় মরমে মরেছি। বারেবারে মরতে রাজি। তবে…

‘তবে..?’

‘তাকে অর্জন করতে ভয় হয়। আমার অগোছালো জীবনে যত্নে আগলে না রাখতে না পারার ভয়।তাই কেবল নক্ষত্র বন্দনাতেই মরে মরে বেঁচে থাকতে চাই।’

‘একলা পারবি না বলেই তো ভয় পাস।এবার না হয় দুজনে মিলেই আগলে রাখবো। ‘

‘এখানে কেন এনেছেন? ‘

‘তোকে চাইতে।’

‘মানে?’

‘একটা অন্যায় করবো আজ।তুই ভুল ভেবে মাফ করে দিস। না পারলেও তুই আমার হয়ে যাস।কথা দিচ্ছি…আমৃত্যু তোর হয়েই থাকবো।’

‘পুতুলের বাবাই আপনি…’

ইরিনকে কিছু বলার সুযোগ দিল না নক্ষত্র। একটানে কোলে তুলে ঘরের দিকে রওনা দিল।

‘এই কি হচ্ছেটা কি….নামান আমাকে। যখন তখন মন চাইলে কোলে তুলে নেয়া…আমাকে তুলে আনা…এত অধিকার কিসের আপনার?’

‘অধিকারের প্রশ্ন তুলছিস?’

‘হ্যাঁ..তুলছি। আপনার আমার ডিভোর্স হচ্ছে। এখন এত অধিকার কিসের আপনার?’

‘সত্যিই জানিস না তুই?’

‘যা নেই তা জানার কি আছে!’

‘আছে।’

‘কি?’

‘অধিকার।’

‘কিসের অধিকার? কোন অধিকার নেই আপনার।’

‘আছে তো।’

‘কিসের অধিকার আছে শুনি?’

‘তোর নক্ষত্র বন্দনার।’

ইরিন চোখ বড় বড় করে তাকালো নক্ষত্রের দুষ্টুমিভরা চোখের দৃষ্টিতে। বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না। খট করে নিভে গেল ঘরের উজ্জ্বল আলোর বাতিটা। ইরিন হকচকিয়ে গেল। পরিস্থিতি বিবেচনায় মস্তিষ্ক যথাযথ কোন প্রতিক্রিয়ায় পৌঁছানের পূর্বেই নক্ষত্রের ওষ্ঠদ্বয় ইরিনের কপাল ছুঁলো। আবাশে চোখের পাতা কার্নিশ ছুঁলো ইরিনের। নক্ষত্র মূহুর্তেটাকে এগিয়ে নিয়ে গেল গভীর থেকে গভীরতম স্পর্শের আদলে।

১৭৯ (৭).

নক্ষত্রের উন্মুক্ত বুকের মাঝে লেপ্টে আছে ইরিন।একদম চুপচাপ। নক্ষত্র পরম আদরে বিলি কাটছে ইরিনের আধভেজা চুলের ভাঁজে ভাঁজে। বিলি কাটতে কাটতেই বললো, ‘এরপর আর কখনো অধিকারের প্রশ্ন তুলবা,পরী?’

‘আপনি বরাবরই নিজের অধিকার খাটিয়ে গেছেন।
আমি স্ত্রী হয়ে তখনো বাঁধা দেইনি আর আজও না।’

‘অধিকারের জোরে অবলীলায় অধিকার পেয়েছিলাম বলেই তোমার মন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। কখনো মনেই হয়নি এই নারীটি যেমন আমার স্ত্রী তেমনি একটা আলাদা মানুষও। স্পর্শে ভালোবাসার কমতিকে জড়তা ভেবে আরও বেশি ভালোবাসা মিশিয়ে গেছি প্রতিবার। অথচ কখনো ভাবিইনি ওটা জড়তা নয়, গ্রহণ করতে না পারার অস্বস্তি। তোমার নিখুঁত দায়িত্ব পালন, সাবলিল আচরণকে স্ত্রীর চরিত্র ভেবে স্বস্তিতে থাকা আমি কখনো তাতে ভালোবাসার অভাব অনুভব করিনি।

আপাতদৃষ্টিতে তোমার সব চাহিদা মিটিয়ে যাওয়া আমি কখনো মনের চাহিদার কথা জানতে চাইনি।বুঝতে চেষ্টা করিনি। আজও অধিকার দিয়েছো। কিন্তু, আজ শুধু স্ত্রী হয়ে নয়, ভালোবাসো বলেই দিয়েছো।
আজ এই অধিকার থেকেই আমৃত্যু এই ভালোবাসাটুকু নিজের জন্য দাবি করছি পরী।তোমাকে আবারও উজাড় করে ভালোবাসার সুযোগ চাইছি। প্লিজ ফিরিয়ে দিও না।’

ইরিনকে একহাতে যথাসম্ভব নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো নক্ষত্র। ইরিন এতসময় চুপচাপ থাকলেও নক্ষত্রের স্বীকার করা ভুলগুলো,তার প্রতিটি কথা ইরিনের ভেতরে অশান্ত ঝড় সৃষ্টি করছিল। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা চেপে শুনে যাচ্ছিল সব। কিন্তু, শেষে নক্ষত্রের এমন আকুল দাবি সে ঝড়কে উত্তাল ঝড়ে রূপ দিল।নক্ষত্রকে একহাতে শক্ত করে জাপটে ধরে, তার বুকে মুখ গুঁজে সশব্দে কেঁদে ফেললো সে। নক্ষত্র বিচলিত হলো না এতে। মুচকি হেসে আগলে নিল তাকে। বেশ কিছুক্ষণ ইরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ইরিন ধীরে ধীরে ক্লান্তিতে শান্ত হয়ে এলো অনেকটাই। আরও কিছুটা মূহুর্তে কাটলো নিরবতায়। অতঃপর, নক্ষত্র তার
সিক্ত কন্ঠে হৃদয়ের সব প্রেম ঢেলে আলতো করে ডাকলো।

‘পরী।’

‘হু।’ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার স্বরে সাড়া দেয় ইরিন।

‘অনেক মুহুর্ত আমি ক্ষয়
করে ফেলে বুঝেছি সময়
যদিও অনন্ত, তবু প্রেম সে অনন্ত নিয়ে নয়।
তবুও তোমাকে ভালোবেসে
মুহুর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকুলে জেগে রয় :
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ-হৃদয়।”

(জীবনানন্দ দাশ)

‘ভালোবাসি নক্ষত্র।’ নক্ষত্রের বিপরীতে ছোট্ট করে বলে ইরিন। আরও নিবিড়ভাবে মিশে যায় নক্ষত্রের বুকে। প্রেম কুড়ায়, সুখ এসে ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের শিরায় শিরায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here