“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৮৭

0
2524

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮৭
(নূর নাফিসা)
.
.
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সময় প্রায় রাত ১টার কাছাকাছি। এতোক্ষণ ধরে কান্না করছে এখনো কাদছেই! চোখের পানি মুছে দিয়ে ইমরান বললো,
– এতো কান্না করছো কেন! মাথা ব্যথা করবে জান। স্টপ ক্রায়িং। আর একটুও কাদবে না। হুম?
নাফিসা লক্ষ্য করে দেখলো ইমরানের বুকের একপাশ খামছিতে ঝাঝরা করে ফেলেছে! যতগুলো আঁচড় পড়েছে প্রত্যেকটা আঁচড় লম্বাটে হয়ে ফুলে গেছে! কোনো কোনো ক্ষত হতে রক্তও বের হচ্ছে! গলার নিচে কামড়টাও দেবে গেছে বেশ! তার এই অবস্থা দেখে আরও কান্না পাচ্ছে! ভেতরটা চিনচিন ব্যাথা করছে এই ভেবে, তিনটা থাপ্পড়ের জন্য এই অবস্থা করেছে সে! ইমরানকে ছাড়িয়ে সে উঠতে গেলে ইমরান বাধা দিয়ে বললো,
– আবার কোথায় যাও!
– স্যাভলন নিয়ে আসি।
– লাগবে না। হা করো তো, মুখটা দেখি।
নাফিসা হা করলে ফোনের টর্চ দিয়ে দেখলো ডানপাশের সামান্য বাঁকা দাঁতটাতে চাপা পড়ে গালটা ভেতর থেকে একটুখানি কেটে গেছে। তখন রক্ত পড়লেও এখন শুধু জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে আছে। মলিন স্বরে ইমরান বললো,
– ব্যাথা লাগছে খুব?
– উহুম। ছাড়ো, স্যাভলন নিয়ে আসি।
– বললাম তো, লাগবে না।
– ইনফেকশন হয়ে যাবে, ছাড়ো।
নাফিসা তুলায় স্যাভলন নিয়ে একটু লাগাতেই ইমরান তার হাত ধরে বাধা দিলো! প্রচুর জ্বালা করছে! নাফিসার আরও কান্না পাচ্ছে ইমরানের বর্তমান অবস্থা দেখে! তুলো ঠেকাতেই দিচ্ছে না জ্বালার কারণে! তবুও অনেক্ক্ষণ সময় নিয়ে নাফিসা আস্তে আস্তে স্যাভলন দিয়ে মুছে দিলো। ঘুম আসছে না কারো চোখে। রাতভর গল্প করলো দুজন। তিনটার দিকে নাফিসা ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু ইমরান জেগে! কিছুক্ষণ পর আযান পড়লে নাফিসাকে ছাড়িয়ে সে উঠে ঘরে নামাজ আদায় করে নিলো। অত:পর আবার শুয়ে পড়লো ঘুমানোর জন্য। সকাল ছয়টার পর ঘুম ভাঙলো নাফিসার। পেট টা ব্যাথা করছে আর গুড়ুম গুড়ুম ডাকছে। হবেই না কেন! কাল দুপুরে খেয়েছে আরেক দুপুর এসে হাজির হচ্ছে! ইমরানকে ঘুমাতে দেখে সে যথাসম্ভব কম নড়াচড়ায় উঠে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নামাজ পড়ে নিলো। এই ঘরে খাওয়ার মতো কিছু নেই। কালকের ঘটনার জন্য সেই ঘরেও যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে বোরকা পড়ে দোকান থেকে কিছু কেনার জন্যই তৈরি হয়ে গেলো। পার্স নিয়ে দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাইরে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বাড়ি থেকে বের হতে হতে ভাবতে লাগলো কি কিনবে! বিস্কুট? না! কেক? না! রুটি? খেতে ইচ্ছে করছে না! মিষ্টি জাতীয় কোনো কিছুই রুচিতে আটছে না! দোকানের কাছে এসেও সিদ্ধান্ত বদলে পুরি সিঙ্গারা কেনার জন্য হোটেলের দিকে হাটতে লাগলো। হাটতে হাটতে সেখানে এসেও সিদ্ধান্ত বদলে পরটা ভাজি কিনে নিলো।
এদিকে ইমরানের ঘুম ভেঙে গেছে। সে নাফিসাকে রুমে দেখতে পেল না। সাতটা বেজে যাচ্ছে তাই আর শুয়ে না থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লো। বাইরে এসেও দেখলো বাড়ি জনশূন্য! কোনো কোলাহল নেই। এমন স্তব্ধ হয়ে গেছে কেন সব! গতকালের ঘটনার জন্যই কি? জিহান হয়তো ঘুম থেকে উঠেনি, তাই তার গলাও শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু নাফিসা কোথায়!
গুমোট পরিস্থিতির কারণে ইমরানের মনে একটু খটকা লাগলো। বাথরুমের দিকে নাফিসাকে না পেয়ে সে বড় ঘরের দিকেই এলো। এ ঘরেরও গেইটের তালা খোলা কিন্তু গেইট লাগানো। সে গেইটে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমেই কিচেনে গেলো, তার মাকে একা রান্না করতে দেখলো। কিন্তু নাফিসার কথা কিছু জিজ্ঞেস না করে বড় মা’র রুমে এলো। কেউ নেই এখানে। মায়ের রুমে শুধু নিশাত ঘুমাচ্ছে। আর ড্রয়িং রুমও ফাঁকা। ইমরান বেরিয়ে এলো বড় ঘর থেকে। ভেতরের খটকাটা যেন এবার ভয়ে পরিণত হয়েছে! সে আর কোনো দিকবিক না তাকিয়ে সোজা তার রুমে চলে এলো। আলমারি খুলে নাফিসার সেই বোরকা এবং পার্স ছাড়া বাকিসব ঠিকই আছে। নাফিসা কি সত্যিই চলে গেলো! এটা কেন করলো সে! কাল রাতেই তো তাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গিয়েছিলো! তাহলে!
ইমরানের ভেতরটা ভয়ে খুব উথাল-পাথাল করছে! এভাবে রাগ করে সে চলে গেলো কিভাবে! তার শ্বশুর বাড়িতে জানাজানি হলেই ব্যাপারটা কোনদিকে পৌছতে পারে ভাবতে পারছে না ইমরান! কেন সে হাত তুললো তার গায়ে! নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার কাছে! সে ঝটপট নাফিসার ফোনে কল করলো, ফোন ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে বেজে চলেছে! যেখানে ইমরান রেখেছিলো সেখানেই! এখন কি করবে ইমরান ভেবে পাচ্ছে না! এতো প্রচেষ্টার পর রাগ ভাঙালো, নাফিসা তাকে আঘাত করে আবার আদরও করলো, তাহলে আজ সকাল হতেই সে চলে গেলো কেন! রাতে কি তার রাগ ভাঙেনি!
ইমরান মুখ ধুয়ে পোশাক পড়ে যতদ্রুত সম্ভব তৈরি হয়ে গেলো! মনে মনে এই প্রত্যাশা করছে ওবাড়িতে যেন নাফিসা কিছু না জানায়। আর সে যেনো নাফিসাকে ফিরিয়ে আনতে পারে! বাবাকে কি একবার কল করে শিওর হয়ে নিবে সে ওবাড়িতে গেছে কিনা! নাহ, যদি সে ওবাড়িতে না যায়! তখন বাবাকে সে কি জবাব দিবে! আর কোথায়ই বা খুজবে তাকে! আগে চুপচাপ দেখে আসা দরকার।
ইমরান তড়িঘড়ি করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে ফোন হাতে নিয়ে যেই দরজার দিকে যাবে, তেমনি নাফিসা রুমে প্রবেশ করলো! ইমরান কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে! নাফিসা তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেছে! চোখ লাল হয়ে আছে, চেহারায় যেন রাগান্বিত ভাব ফুটে আছে! ভয়ার্ত ইমরানকে দেখে তার পা দরজার কাছেই স্থির হয়ে গেছে! এমন দেখাচ্ছে কেন তাকে! কি হয়েছে তার! সে কি তার উপর রেগে আছে! রাগবে কেন শুধু শুধু! কি করেছে সে! নাফিসা এক ঢোক গিলে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে হাতের প্যাকেট এবং পার্স ড্রেসিং টেবিলে রাখলো। ইমরান যেন পাথর হয়ে দাড়িয়ে আছে! ভয়ে ভয়ে নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে?
ইমরানকে খুব রাগান্বিত দেখা গেলেও খুব শান্ত স্বরে সে প্রশ্ন করলো,
– কোথায় গিয়েছিলে?
– পরটা আনতে।
– বলে যাওনি কেন আমার কাছে?
বলে যায়নি তাই কি সে রেগে আছে! এখন কি আবার মারবে তাকে! ভয়ে নাফিসার প্রায় কাদো কাদো অবস্থা! চোখ যেন ভেজা হয়ে আসছে সাথে কম্পিত গলায় ইমরানের প্রশ্নের জবাবে বললো,
– আরেকবার আমাকে মারলে কিন্তু আমি মরে যাবো!
সাথে সাথেই ইমরান তাকে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো, যতটা শক্ত করে ধরা যায় ঠিক ততটাই! মাথায় চুমু দিলো! তার ভেতরটা যেন কাপতে কাপতে ফেটে যাচ্ছে!
– তুমি কি এখনো রেগে আছো আমার উপর? বলো?
ইমরানের কণ্ঠ কেমন যেনো ধাধানো! তার বর্তমান অবস্থা কোন দিকে আছে তার কিছুই বুঝতে পারছে না নাফিসা! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাই মুখ থেকে নিকাব সরিয়ে নিয়ে বললো,
– উহুম।
– তাহলে তুমি বলে যাওনি কেন আমার কাছে? আমি তো ভয় পেয়ে গেছি! ভেবেছি আমাকে রেখে চলে গেছো! নাফিসা, আমি কখনো কোন ভুল করলে কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? মানুষ তো ভুল করতেই পারে। আমি ভুল করলে কি আমাকে শুধরানোর সুযোগ দিবে না? অভিমান নিয়ে কি পালিয়ে যাবে আমার কাছে থেকে? আমি তো কোনো কিছুর বিনিময়ে হারাতে চাই না তোমায়। তুমি কি আমাকে হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করবে? বলো? সত্যি, আমি ঘুম থেকে উঠে তোমাকে না দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেছি! যখন দেখলাম আলমারিতে পার্স ও বোরকা নেই, তখন আরও অনেক ভয় পেয়ে গেছি! বিশ্বাস করো, অনেক ভালোবাসি। আল্লাহর কাছে আমি সবসময় প্রার্থনা করতাম, যদি আমাকে জীবনসঙ্গী দেয়া হয় তো এমন একজনকে যেন দেয় যাকে আমি অনেক ভালোবাসতে পারবো। আমার মায়েদের পর যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারবো সে যেন আমার সঙ্গীই হয়। আমি তোমাকে জেনে, তোমাকে পেয়ে সেই ভালোবাসতে শুরু করেছি। আখিরাত পর্যন্ত যেন টিকে যায় এই ভালোবাসা এখন এই প্রার্থনাই করি আল্লাহ তায়ালার কাছে। তাহলে তুমি কি আমাকে কোনো কারণে এতো অল্প সময়ে এই পৃথিবীতেই ত্যাগ করবে?
ইমরানের কথাবার্তায় নাফিসার ভেতরটা ই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে! চোখের পানি তো কোনো বাধা মানছেই না! গলা দিয়েও কোনো কথা বের হচ্ছে না! তবুও তাকে শান্ত করতে বললো,
– এমন করছো কেন তুমি! আমি যাই নি তো। কোথায় যাবো তোমাকে ছেড়ে! ক্ষুধা লেগেছিলো তাই একটু বেরিয়েছিলাম। তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই ঘুমটা নষ্ট করিনি।
ইমরান নাফিসাকে ছেড়ে দুহাতে তার মুখখানা ধরে চোখ মুছে দিতে দিতে বললো,
– নাফিসা শোনো, সংসার করতে গেলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটু আধটু ঝগড়া, মনোমালিন্য হয়ই। এসবে এতো রিয়েক্ট করা ঠিক না। রাগ করলেও ক্ষণিকের জন্য সেটা স্থীর করবে। আর যত দ্রুত সম্ভব তার মীমাংসা ভালো। আমিও তো তোমার উপর রেগে গিয়ে হাত তুলে ফেলেছিলাম। তুমি কি রেগে গিয়ে আমাকে উল্টাপাল্টা বলো না? আমি কি তখন তোমাকে চলে যেতে বলি? তোমার সাথে থাকবো না সেটা বলি? তোমাকে মেন্টালি অনেক টর্চার করি? এভাবে তো সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে! এসব মোটেও করবে না কখনো। রাগ সবারই হয়। তাই বলে রাগ করে উল্টাপাল্টা কিছু করা মোটেও ঠিক না। যারা এসব করে তারা কখনো সুখী হয় না। আমি সুখের সংসার সাজাতে চাই তোমায় নিয়ে। রাগ অভিমান নিয়ে কখনো পিছপা হবে না তো? বলো?
নাফিসা ডানেবামে মাথা নাড়তেই শুরু হলো ইমরানের সেই গত রাতের মতো পাগলামো! নাফিসার সারামুখ চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে! তাকে থামানো দায়! কতটা পাগল হলে এমন কাজ করতে পারে নাফিসা ভাবতেও পারছে না! তার ভেতর থেকে শুধু কান্না আসছে! কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারছে, এই কান্নাটা কষ্টের না! তাহলে এটা কিসের কান্না! কাল ইমরান তাকে আঘাত করলো তবুও এই পাগলামো এতো ভালো লাগছে কেন তার!
ইমরান তাকে পূর্বের ন্যায় শক্ত করে জরিয়ে ধরে চোখের পাতা বন্ধ রেখে কপালে ঠোঁট ছুয়ে রাখলো! নাফিসাও চোখের পাতা বন্ধ করে খুব অনুভব করলো ইমরানকে! কয়েক মিনিট কেটে গেলো তাদের এভাবেই। এক পর্যায়ে নাফিসাই অশ্রুসিক্ত লোচন ও মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,
– ক্ষুধায় পেট ব্যাথা করছে আমার।
ইমরান তার নাকে আলতো কামড় দিয়ে বললো,
– এতো খাই খাই কেন করিস! যা ভাগ।
– তুই ভাগ!
– তুই ভাগ!
অত:পর দুজনেই নিচু শব্দে হেসে উঠলো!
নাফিসা বোরকা খুলতে খুলতে বললো,
– শার্ট প্যান্ট পড়ে এখন কোথায় যাচ্ছিলে?
– আমি তো তোমাকে খুজতেই বের হচ্ছিলাম! সোজা তোমাদের বাসায় যেতাম এখন।
– সেখানে গিয়ে না পেলে?
– জানিনা কি করতাম।
নাফিসা চুপচাপ বোরকা হিজাব রেখে হাতমুখ ধুয়ে এলো। পরটার প্যাকেট খোলার সময় ইমরান বললো,
– এতো ক্ষুধা লেগেছে আমাকে ডাকলে না কেন?
– রাতে ঘুমাওনি তুমি, তাই ঘুম নষ্ট করিনি।
– তুমি বুঝলে কিভাবে আমি ঘুমাইনি?
– আমি ঘুমে থেকেই তোমার পাগলামো গুলো অনুভব করেছি।
– ফোন নিয়ে যাওনি কেন সাথে?
– পাঁচ দশ মিনিটের জন্য যাবো, শুধু শুধু ফোন নেয়ার কি প্রয়োজন। তাছাড়া ভেবেছি পাশের দোকান থেকে কেক অথবা বিস্কুট নিয়ে চলে আসবো। কিন্তু ওইগুল খেতে রুচিবোধ হচ্ছিলো না৷ তাই আরও সামনে গিয়ে পরটা ভাজি নিয়ে এলাম।
– ঘুমাই আর যা-ই করি না কেন, আমাকে ইনফর্ম না করে কোথাও যাবে না। আর বাড়ির বাইরে দুই মিনিটের জন্যও ফোন ছাড়া থাকবে না।
– ওকে। হাত ধুয়ে এসো।
– পেট ব্যাথা করছে না? একটা রেনিটিডিন খাও।
ইমরান নিজেও গ্যাস্ট্রিকের একটা ট্যাবলেট খেলো এবং নাফিসাকেও খাওয়ালো। পুচকে বউয়ের আলসে বর’টা আর হাত ধুয় নি! দরজা লাগিয়ে বউকে তার হাটুর উপর বসিয়ে তারপর বউয়ের হাতেই ব্রেকফাস্ট সাড়লো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here