গজপ্রিয়া-10

0
483

গজপ্রিয়া-10
Chhaminq Begam

চোখ দিয়ে গঙ্গা বইছে বিলকিস আর মৌনির । বারবার নাক টানছে দুজনে। তবুও হাত দুটো চলছেই। এখনো অর্ধেক ঝুড়ি পেয়াজ বাকি আছে । মামানি দুজনের ফোন নিয়ে নিয়েছে । সব পেয়াজ কেটে উঠতে হবে নাহলে সন্ধ্যার আগে আর মোবাইল পাবে না । আর সন্ধ‍্যা হতে এখন ও অনেক দেরি । মাত্র সাড়ে দশটা বাজে । সাহানাজ, জাহানারা দুবোনই মেয়েদের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছেন । আসলে দুপুরের রান্না বাড়ির মহিলাদেরকেই করতে হবে । ক‍্যাটেরার লোক বারোটার পর আসবে । ওরা এসে রাতের খাবারের আয়োজন করবে । পুরো বাড়ি আত্মীয় স্বজনে ভরে গেছে । সবার দুপুরের খাবারের জোগান তো দিতে হবে । তাই মনিরা বাড়ির মেয়েদের সবজি কাটতে বসিয়ে দিয়েছেন । প্রতিবেশী মহিলারা অনেকেই এসেছে । কেউ সবজি কাটছে , কেউ হলুদ বাটছে । দুটো বাজলে মোস্তাফিনার হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে । বরের বাড়ি থেকে আবার হলুদ আসবে । রুমা আর মনিরা রান্নাঘরে ব‍্যস্ত । মৌসুমীও আগত অতিথিদের আপ‍্যায়ন করতে ব‍্যস্ত । তার মাঝেই কচিকাঁচারা উঠোন জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে । পুরো বাড়ি গমগম করছে মানুষের সমাগমে । পুরুষরা বেশিরভাগ বাইরের কাজ সামলাচ্ছেন ।

মোস্তাফিনার হাতে মেহেন্দি লাগানো শেষ হলে রানি উঠতে যাবে তখন বানি হাত দুটো বাড়িয়ে দেয় ,
-“আপু , আমার হাতেও রাগিয়ে দে ..”
-“কিন্তু মেহেন্দি তো শেষ হয়ে গেছে । “…
-“ওহ , থাক তাহলে ” ।
বাণীর চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে বড় মায়া লাগে রানির । মোটামুটি কাজিন সবার মেহেন্দি পড়া শেষ । শুধু ও আর বাণী বাকি আছে । রানির দেওয়ার ইচ্ছে নেই । কিন্তু বাণী ছোট মানুষ । ইচ্ছে পোষণ করেছে । না দিলে ইচ্ছে তা থেকেই যাবে । তাই বলল,
-” এক কাজ কর , সম্রাট তো বাজারে গেছে । ওকে ফোন করে মেহেন্দি আনতে বল । আমার ফোন ড্রেসিংয়ের ড্রয়ারে আছে । যাহ ”
রানির কথা শুনে বাণী নাচতে নাচতে চলে গেল ।
রানি মৌনিদের দিকে এগিয়ে এল । মৌনি আর বিলকিস কছ উদ্দেশ্য করে বলল,
-” ইয়া আল্লাহ , একি হাল তোদের !একেবারে নদী বইছে তো চোখ দিয়ে । আগেই বলেছিলাম উপরের খোসা ছাড়িয়ে দু ঢুমো করে গামলায় জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখ । সবগুলোর খোসা ছাড়ানো হয়ে গেলে একসাথে কাটিস । শুনলি না আমার কথা ! শুনলে এমন গঙ্গা যমুনা বইত না চোখ দিয়ে । যাহ , ওঠ এখন । মুখ ধুয়ে আয় । ”
মনিরা বারান্দায় দাড়িয়ে ছিল । কথা বলছিল এক আত্মীয়ের সাথে । রানির কথা শুনে বলল,

-” বিলকিস ,মৌনি যাহ,মুখ ধুয়ে আয় । কোনো রকম চালাকি করবি না । সব এগারোটা হতে হতে কাটা চাই কিন্তু । না হলে কিন্তু ফোন পাচ্ছিস না । ”
-” মামানি , তুমি এত খারাপ কেন গো ? আমাদের মতো এমন অবলা বালিকাদের ওপর এমন অত‍্যাচার কিভাবে করতে পারছ ? হ‍্যাঁ ? বিয়ে তোমার মেয়ের আর তুমি আমাদের খাটিয়ে মারছ ! ” অভিমানী সুরে বলল বিলকিস । মৌনিও গলা মেলালো ওর সাথে বলল,
-“সত্যি তো । মামানি , তোমার মেয়ের বিয়ে । কাজ তো তোমার করা উচিত । তা না করে তুমি আমাদের সাথে জুলুম করছ । ” তারপর হাত দুটো নাকের কাছে এনে নাক শিটকে বলল,
-“ছ‍্যাঃ । দেখছ মামানি , আমার কোমল কোমল হাত দুইটা দিয়ে পেয়াজ পেয়াজ গন্ধ বেরুচ্ছে । ছিহ, । মনে হয় সাবান দিয়ে ঘষলেও এ গন্ধ যাবে না । সাজগোজ করে যদি হাত দিয়ে পেয়াজের গন্ধ আসে । তাহলে সেজে লাভ কি হবে ! ”
-“আহারে আমার বাচ্চা গুলা। এটুকুতেই এত । আমি তো আরো ভাবছি পেয়াজ কাটা হয়ে গেলে মুসুর গায়ের হলুদের জন্য আনা কাঁচা হলুদ গুলো তোদেরকেই বাটতে দেব !..” মুখে একটা চিন্তিত ভাব এনে বলল মনিরা । মৌনি বিলকিস “কিহ” বলে আতকে উঠল । একসঙ্গে বলল,
-” মামানি ,এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না । ”

ওদের চুপসে যাওয়া আতঙ্কিত মুখ দেখে সবাই মুখ টিপে হেসে উঠল । রানি বলল,
-“হয়েছে , মামানি । আর ভয় দেখিয়ো না ওদের ।
ওই যাহ তোরা, মুখ ধুয়ে আয় । তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে এসব । তার আগে এই গামলায় জল দিয়ে যা । ”

-” আপু , ভাইয়াকে বলেছি।….. কিন্তু আপু, ভাইয়ার কলটা কেন যেন ঠাস করে শব্দ হয়ে কেটে গেল ? ”
বানির শঙ্কিত কন্ঠস্বর শুনে রানি চোখ তুলে তাকাল । বলল,
-” তো । এতে চিন্তার কি আছে ? নেটওয়ার্ক প্রবলেম হতে পারে …তাই হয়তো কেটে গেছে !” পেয়াজ কাটতে কাটতে ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল রানি ।

সবজি কাটা প্রায় শেষের দিকে এমন সময় একটা দশ এগারো বছরের ছেলে এসে রুমাকে ডেকে বলল,
-“বড় মা । সম্রাট ভাইয়া নাকি এক্সিডেন্ট করছে ।”
কথা টা এমন ভাবে সবার মস্তিষ্কে আঘাত করল মুহুর্তের সব কিছু যেন থমকে গেল । মৌসুমীর হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল । রুমা ভাতের হাড়ি নামাচ্ছিল । পড়েই যাচ্ছিল । মনিরা সামলে নিল । রুমাকে ধরে বসিয়ে দিল একটা চেয়ারে । মুহুর্তেই বিয়ে বাড়ি শোকসভায় পরিনত হল ।
মৌসুমী ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল,
-“এই ফরিদ, কি বলছিস এসব ? এক্সিডেন্ট করেছে মানে !তুই কার কাছে শুনলি ?”
-” ফাহিম দা , বড়বা , মেজআব্বুরা এখনি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল তো । মহসিন চাচা বাজার থেকে ফিরছিল । উনি বলছিলেন রাস্তায় । ভাইয়াকে নাকি হসপিটালে নিয়ে গেছে !”

পুরো বাড়িতে কান্নার রোল পড়েছে । রুমাকে সামলানো যাচ্ছে না । বারবার সম্রাটের কথা বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন । মনিরা , জাহানারা মিলে ওনাকে বিছানায় শুইয়ে দিল । ফাহিমরা যাওয়ার কুড়ি মিনিটের বেশি হয়ে গেছে । কিন্তু এখনো বাড়িতে কিছু জানায় নি । কি জানি হসপিটাল পৌছেছে কিনা ! রানি থম মেরে বসে আছে । চোখ দিয়ে একটা সরু জলের রেখা ক্রমাগত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে । সম্রাটের এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে । ওর জায়গায় তো সম্রাট গেছে কিনা । ও নিজে দর্জির কাছে গেলে তো সম্রাটকে যেতে হত না । আচ্ছা, সম্রাট ঠিক আছে তো । যদি বেশি ক্ষতি হয়ে যায় !না না । এমন কিচ্ছু হবে না । কিচ্ছু হবে না । ও ঠিক আছে । ওকে ঠিক থাকতেই হবে । আল্লাহ ওকে তুমি সহি সালামতে রেখ প্রভু । ইয়া শাফি, ওকে তুমি শেফা দান কর মালিক । প্লিজ ।

সবাই বিদ্ধস্ত হয়ে আছে । হঠাৎ মিলির চোখ চলে যায় রানির হাতের দিকে । গলগল করে রক্ত পড়ছে বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলী বেয়ে । উঠোনের মাটি ভিজে গেছে অনেকটা । হাতটা কাঁপছে অনবরত । অথচ রানি বিকারহীন । মিলি চিৎকার করে ওঠে ,
-” রানিইইই, একি অবস্থা করেছিস ! হাত কাটল কি করে ? ইসস, কতটা রক্ত বেরিয়ে গেছে !”

সবাই মিলির চিৎকারে রানির দিকে তাকায় । কেমন নিস্তেজ চাহনি মেয়েটার ! জাহানারা ,বিলকিস দৌড়ে আসে । মৌসুমীকে রুমার পাশে বসিয়ে মনিরাও হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে । মোস্তাফিনাকে বলে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আসতে । ততক্ষণে রানি অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়েছে জাহানারার কোলে । ওর হোমোফোবিয়া আছে । রক্ত দেখলেই মাথা ঝিমঝিম করে ।

রানির যখন জ্ঞান ফিরল তখন দুপুর গড়িয়েগেছে । চোখ খুলেই রানি বাণীকে শিয়রে বসে থাকতে দেখল । আলতো হাতে সে দিদির মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে । বাইরে থেকে মহিলাদের গীতের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । হয়তো মোস্তাফিনার হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে । চট করে সকালের কথা মনে পড়ল সম্রাটের । উঠে বসল বিছানায় । কাপা কাপা স্বরে বানীকে জিজ্ঞেস করল ,
-” সম্রাট কেমন আছে বাণী ? ও এখন কোথায় রে ? ”
-” ভাইয়াকে বাড়ি নিয়ে এসেছে তো । রেস্ট করছে । একঘন্টার মধ্যেই চলে এসেছিল ওরা ।বেশি কিছু হয়নি । শুধু বাঁ পায়ের হাতে আর বাঁ হাতের কুনুইয়ে ছিলে গেছে । ডাক্তার ড্রেসিং করে দিয়েছে । ”
বাণীর কথায় স্বস্থি পেল রানী । মনে মনে আল্লাহ তায়ালাকে শুকরিয়া জানাল । তারপর জিজ্ঞেস করল ,
-” হলুদের অনুষ্ঠান কি শুরু হয়ে গেছে ? ”
-” হ‍্যাঁ আপু ,একটু আগে …”
-“তুই যাসনি কেন তাহলে ? ”
-” বাহ রে ,তুমি এখানে একা আছ আর আমি যাব অনুষ্ঠান দেখতে …”
ওর কথায় হাসল রানি । মৃদু হেসে জড়িয়ে ধরল বোনকে । বাণি বলল,
-” আপু সবাই হলুদ শাড়ি পড়েছে । মৌসুমী ভাবি আমাকে শাড়ি দিয়ে গেছে তোর জন্য। বলেছে তুই উঠলে যেন দিয়ে দেই । ওটা পড়ে বাইরে যেতে হবে । ওঠ , … চল ”

ফুপাতো দাদার সাথে পাত্রের ছোয়ানো হলুদ নিয়ে এসেছে রিয়ানা । সবার সাথে হাসি মুখোমুখে কথা বললেও উসখুস করছে । চারিদিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি বোলাচ্ছে । অথচ কোথাও নেই সম্রাট । আজব, ছেলেটা গেল কোথায় ? একটু পরেই ফিরতে হবে ওদের । যাওয়ার আগে একবার অন্তত দেখা করে যেতে চায় । অনেক জোরাজুরি করে ফুপাতো ভাইয়ের সাথে আসার অনুমতি পেয়েছে । কষ্টটা এভাবে নিষ্ফল হবে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে রিয়ানার । যদিও রাতে বরযাত্রী হিসেবে আসবে ওরা । তবুও এখন এভাবে খালি হাতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না । মৌনি বিলকিসের সাথে ইতিমধ্যে স‍খ‍্যতা গড়ে উঠেছে ওর । সমবয়সী কিনা । তাই ইনিয়েবিনিয়ে জিজ্ঞেস করল সম্রাটের কথা ।

বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সম্রাট । বাঁ পা টা ভীষণ ব‍্যাথা করছে সাথে কাধেও ব‍্যাথা পেয়েছে । ডাক্তার পেনকিলার দিয়েছেন । খেয়ে রেস্ট করতে বলেছেন । হয়তো সন্ধ্যা নাগাদ ব‍্যাথা টা কমে যাবে । বাণীর মুখে শুনেছে রাণী নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছে । হাতেঠাত কেটে যাচ্ছে-তাই অবস্থা । সম্রাট জানে রানির হেমোফোবিয়া আছে । ছোটবেলায় ছাগল জবাইয়ের রক্ত গায়ে লাগিয়ে রানির সামনে গিয়েছিল । সেদিন ভয়ে রানি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ওদের উঠোনে । আজ ও নিশ্চিত নিজের হাতের রক্ত দেখেই ভয় পেয়েছে । মনটা বারবার ছুটে যাচ্ছে ওবাড়িতে । রানি এখন কেমন আছে কে জানে ? ওর কি জ্ঞান ফিরেছে ? কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও শরীর সায় দিচ্ছে না । সন্ধ্যায় সুস্থ হয়ে হেটে বেড়াতে চাইলে এখন চুপচাপ শুয়ে থাকতে হবে ।তাই ইয়ারফোন গুজে একমনে গান শুনছে সম্রাট । গানে সুরে নিজেও গুনগুন করে গাইছে,

I’m in love with the shape of you
We push and pull like a magnet do
Although my heart is falling too
I’m in love with your body ……

To be continue…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here