গজপ্রিয়া-11
Chhamina Begam
-” আম্মু আর খাব না । পেট ভরে গেছে । ..”
-” আর একটু খাঁ …”
-“উম । না …”
-” ঠিক আছে । ..নে ওষুধ টা খেয়ে নে । আর শোন, আমার আসতে একটু দেরি হবে । তুই আধ ঘন্টা পর এই ওষুধ টা খেয়ে নিস । .….এখন একটু রেস্ট কর । আমি ওবাড়ি যাচ্ছি । ”
-“আচ্ছা , যাও । ”
রুমা টেবিলের ওপর ওষুধ রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই সম্রাট আবার ডাকে ,
-“আম্মুউউ …”
রুমা ঘুরে দাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন ,
-” কি ?”
-” উমম, কিছু না যাও । ”
-” বল ,কি বলবি ?”
-” আসলে.… ,একটু আগে না আমি একটা শো দেখেছিলাম । দুই বান্ধবী ছোটবেলায় ঠিক করেছিল ভবিষ্যতে যখন ওদের ছেলেমেয়ে হবে তখন তাদের ছেলেমেয়ের বিয়ে দেবে । কিন্তু পরে ছেলের বাবা মত পাল্টে ফেলেন । এই নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে খুব ঝামেলা হয় । আচ্ছা , তুমিও এমন কিছু করো নি তো ?” ভ্রু সামান্য কুচকে জিজ্ঞেস করে সম্রাট ।
রুমা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখেন । মনে মনে হাসেন তিনি । ছেলের মতলব তিনি ভালোই বুঝতে পারছেন । কাল থেকে দেখছেন জাহানারার সেজ মেয়েটার সঙ্গে হাসাহাসি করতে । দুজনে বেশ গুটুর গুটুর করে গল্প করে । আজ সম্রাটকে হসপিটাল থেকে আনার পর বেশ কয়েকবার এসে দেখে গেছে । মা কে হাসতে দেখে সম্রাট একটু লজ্জা পায় । ডান হাতে চুলে এলোমেলো হাত চালিয়ে বলে ,
-“না মানে …আসলে আমি এমনি বলছিলাম । ধরো, যদি তুমি বা আব্বু এমন কিছু করে থাক আর আমি অন্য কাউকে পছন্দ করে বসলাম তখন তো অনেক ঝামেলা হবে তাই না । তাই আরকি….”
রুমা মুখে হাসি ধরে রেখেই বললেন,
-” না, আমরা এমন কিছুই করিনি । আর না করেই ভালো করেছি বল ?কারণ এখন যুগ পাল্টে গেছে । ছেলেমেয়েরা নিজের নিজের পছন্দ মত জীবন সঙ্গী বেছে নিচ্ছে। সেখানে আগে থেকে আমরা সব কিছু ঠিক করে রাখলে পরে দেখা যেত ছেলের বা মেয়ের পছন্দ হল না । তখন আমাদের কথার দাম কোথায় থাকল ? এর জন্য আমি মনে করি ছেলেমেয়েদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয় । সবসময় এই চাপিয়ে দেওয়া ব্যাপারটা সুফল নিয়ে আসে না । কখনো কখনো হিতে বিপরীত হয় । ……. আচ্ছা আমি গেলাম । তুই রেস্ট নে । কিছু দরকার পড়লে একটু কষ্ট করে উঠে নিয়ে নিস । পারবি তো ?”
-” হ্যাঁ পারব । তুমি যাও …”
রুমা চলে গেলে সম্রাট ওনার গমন পথের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে , আর সময় তো দুই বান্ধবী মিলে দুনিয়ার প্যাচাল পারো । আমাদের নাম গুলো মিলিয়ে রেখেছ অথচ কাজের কথাটাই বল নি। ইস, এমন যদি একটা প্রমিশ করতে তাহলে আজ আমি ইজিলি রানিকে পেয়ে যেতাম ।
বাড়ির উঠোনে আসন পেতে বসিয়েছে মোস্তাফিনাকে । মা, চাচিরা গালে, হাতে,পায়ে হলুদ ছোয়ানোর পর গ্রামের দাদি ,ভাবিরা হলুদ মাখাতে আসে । বয়স্ক কিছু মহিলা একপাশে গোল হয়ে বসে গীত গাইছে । যদিও লাবিবের বাবা একবার এসে বারণ করে গেছে এসব গীত না গাইতে কিন্তু কে শোনে কার কথা । মেয়ে বৌদের থেকে বয়স্ক দাদিদের হইচই যেন বেশি । মৌসুমী একটা হলুদ জামদানি পড়ে হাতে হলুদ নিয়ে তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে বেরাচ্ছে । আর ওর থেকে পালিয়ে বেরাচ্ছে মেয়েরা । তখনি এক প্রতিবেশী ননদকে ধাওয়া করতে গিয়ে মোস্তাফিনার ঘরের দরজায় চোখ আটকে যায় মৌসুমীর। একটা কথা প্রচলিত আছে “শাড়িতেই নারী ” । যদিও কথাটা মৌসুমী বিশ্বাস করে না । তার মতে একজন নারী কি পড়বে না পড়বে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার । একজন নারী তার নিজস্বতায় পরিপূর্ণ হয় । তাকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য শাড়ি , চুরিদার অথবা শার্টপ্যান্টের প্রয়োজন নেই । সে সবেতেই পরিপূর্ণা । কিন্তু তবুও আজ খুব করে এই প্রবাদটায় বিশ্বাস করতে মন চাইল । সাদা হলুদের মিশেলে একটা জামদানি পাঠিয়েছিল বানিকে দিয়ে , সাথে নিজের কনুই অব্দি লম্বা হাতা ব্লাউজ । খুব সুন্দর মানিয়েছে রানিকে । চোখে গাঢ় করে কাজল টেনেছে রানি । ঠোটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক , লম্বা চুল গুলোকে বিনুনী করে ছেড়ে দিয়েছে । হাটার সময় পিঠ জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে সেই বিনুনি ।
-” আপুউউউ, “হাতে একগাদা হলুদ নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে তাকাল রানি । মোস্তাফিনা দুইহাতের পিঠ দিয়ে মুখ ঢেকে বলল,
-“নোওওও , রানি মুখে নয় । প্লিজ না ………”
কিন্তু রানি শুনলে তো । হাত সরিয়ে দিয়ে দুই হাতে মোস্তাফিনার মুখে ঘষে দিল সবটা হলুদ । বলল,
-” আজ কোনো না নয় । সবেতেই হ্যাঁ বলতে হবে । তাই না ভাবি ….”
পাশে দাড়ানো মৌসুমী ও সায় দিল রানির কথায় । বলল,
-” তা নয় তো কি । রানি ঠিক বলেছে …..আজ কোনো না চলবে না । সবে তেই হ্যাঁ ..বুঝলা ননদিনী ” বা চোখ টিপে বলল মৌসুমী । মোস্তাফিনা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল । বলল,
-“ভাবি চুপ কর । প্লিজ ….. ।
পাশ থেকে এক দাদি বলে উঠল ,
-” লজ্জা পাইলে চলবে লো । আমাগোর শাশুড়িরা তো কইত বৌ মাইনষের স্বোয়ামি , খাওন আর ডাক্তার এই তিন জায়গায় লজ্জা করতে নাই । নাইলে দুনিয়া চলত না । ”
বৃদ্ধার ঠোটকাটা কথায় উঠোনের কেউ কেউ খিলখিল করে , আবার কেউ ঠোট টিপে হেসে উঠল । এতক্ষণ মোস্তাফিনা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ছিল , এবার গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে গেল , সাথে চিবুক বুকে ঠেকল । বৃদ্ধা অবশ্য রানিকেও ছাড়ল না । বলল,
-” লাবিবের বো কই গেলি ? মুসুর শরীলের হলুদ হ্যার গায়েও লাগায়া দে তো । লাগে জানি , কয় দিনের মইধ্যে এই রানিরও বিয়া খাইতে পারি । হেই তো জোয়ান হইছে । ”
রানি মিটমিট করে তাকিয়ে সেই বৃদ্ধার কথা শুনছিল । কিন্তু এবার চমকে উঠল । এতক্ষণ মোস্তাফিনাকে নিয়ে ঠাট্টায় মজা পেলেও এবার ভড়কে গেল । মৌসুমী শয়তানি হাসি দিয়ে দুই হাতের হলুদ দেখাচ্ছে । রানি বৃদ্ধার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল,
-” নানি , একপা কবরে দিছ ,এখনো তোমার খটখট কথা যায় না , না ? তোমার আবার জামাই লাগলে কও আমারে । আমি খুইজা দিব নি । তাও আমারে নিয়া টানাটানি কইরো না । এই তো বেশ আছি ….. ভাবি নোওও ” বলে শাড়ির কুচি একহাতে তুলে ভো দৌড় দিল রানি । পিছনে ধাওয়া করল মৌসুমী ,
-” রানি দাড়া। পালিয়ে লাভ নেই ….আমি কিন্তু ধরবই ।”
দৌড়তে গিয়ে রানির এক পায়ের চপ্পল খুলে গেলে সে পিছন ফিরে তাকায় । মৌসুমীকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে দৌড় দিতেই স্বজোরে ধাক্কা খায় শক্তপোক্ত কিছুর সঙ্গে । রানির মনে হয় নিশ্চিত দেয়াল হবে “উফ , আল্লাহ ” বলে স্বগোতক্তি করে । শুনতে পায় মৌসুমী চিৎকার করছে,
-“ভাইয়া ,ভালো করে ধরো ওকে ….”
মৌসুমীর কথায় মুখ তুলে তাকায় রানি । বাক্যহারা হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য । ধাতস্থ হতেই শুনতে পায় সামনের ব্যক্তিটার দ্রুত গতিতে চলা হৃদস্পন্দন , অনুভব করে বুকের ক্রমাগত ওঠানামা । নিজের ভেতর উষ্নতা টের পায় না রানি । বরং এক অবর্ণনীয় কুন্ঠায় সংকুচিত হয়ে আসে । সেই স্বল্প সময়েই অনুভব করে এতদিন এই মানুষটাকে ঘিরে যে অনুভূতি গুলো ছিল তা ভালোবাসা ছিল না । নিশ্চিত হয়ে যায় কিশোরী বয়সের ওই পাগলামী গুলো আবেগ বই আর কিছুই নয় । ঝট করে সরে আসে রানি আশিকের বুক থেকে । নিজেকে সামলে নির্দিষ্ট দুরত্বে সরে যায় আশিক । মৃদু হেসে বোঝার চেষ্টা করে কি হচ্ছে এখানে ? ততক্ষণে মৌসুমী ধরে ফেলেছে রানিকে । দুই গালে আলতো করে হলুদ ছুইয়ে দিয়ে ফিসফাস করে বলল ,
-“দাদির কথা মনে আছে তো ? অবিবাহিত মেয়ের গালে কনের হলুদ ছোয়ালে সেই মেয়েটির ও তাড়াতাড়ি বিয়ের ফুল ফোটে । আমিও অপেক্ষা করছি তোমার স্বপ্নের রাজপুত্রকে দেখার জন্য ”
মৌসুমীর কথায় রানি লাজরাঙা হয়ে চোখ পাকিয়ে তাকায় । মৌসুমী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ।’ এসো , এবার নাচগান হবে ..’ বলে চলে যায় মোস্তাফিনার কাছে ।
– ” শাড়িতে তোমায় খুব সুন্দর লাগছে রানি ” মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল আশিক ।
-” ধন্যবাদ ভাইয়া । “লাজুক হেসে বলে রানি ।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিরক্ত লাগছে সম্রাটের । ওবাড়িতে সবাই কত আনন্দ করছে আর ও কি করছে ? শুয়ে শুয়ে গেম খেলছে ! ধুর । সম্রাট নেমে আসে বিছানা থেকে । আলনা থেকে একটা শার্ট হাতে নেয় । তারপর বেরতেই দেখে রানি আসছে । বাড়িতে যেহেতু আর কেউ নেই তারমানে ওর কাছেই আসছে রানি । তাড়াতাড়ি করে আবার ঘরে ঢুকে দরজাটা আলতো করে ভেজিয়ে রাখে । শার্টটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে শুয়ে পড়ে বিছানায় । ফোন হাতে নিয়ে গেম খেলার ভান করে । বারবার দরজার দিকে তাকায় , কান খাড়া করে রাখে কখন পদধ্বনি শুনবে রানির । শুনতে পায় চপ্পলের মৃদু শব্দ দরজার কাছে এসে থেমে গেছে ।
দরজার কাছে দাড়িয়ে রানি ইতস্তত করতে থাকে । ঢুকবে কি ঢুকবে না- এই নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে । মন একবার বলছে ফিরে যা রানি । এই বান্দরটাকে দেখতে গেলে পরে আবার এটা নিয়ে খোটা দেবে । তুই ওকে নিয়ে ভাবিস এই কথা বলে বলে কান ঝালাপালা করে দেবে । ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মন আবার বলে , কি করছিস রানি ? তোর জন্য সম্রাটের এই অবস্থা । আর তুই ওকে না দেখেই চলে যাচ্ছিস । নূন্যতম মনুষ্যত্ব কি তোর মধ্যে নেই । এই দুবিধায় পড়ে রানি চলেই যাচ্ছিল কিন্তু মনটা আবার বিদ্রোহ করে ওঠে । সম্রাটকে একপলক দেখার জন্য মনের কোনো গোপন প্রকোষ্ঠ থেকে সম্পূর্ণ নতুন এক তাড়না অনূভব করে । শেষমেশ দরজায় আলতো করে নক করে রানি । তৎক্ষণাৎ ভেতর থেকে চিরচেনা কন্ঠস্বরে আওয়াজ ভেসে আসে -” দরজা খোলা আছে । ভেতরে আয় …..” । একটু থমকায় রানি । মনে হয় অপর পক্ষের মানুষটা যেন ওরই অপেক্ষায় ছিল । ভাবতেই ভেতরের মনপাখিটা খুশি হয়ে যায় । কিন্তু মস্তিষ্কের তীব্র শাসনে মিনমিন করে থাকে ।
ভেতরে ঢুকেই রানির চোখ চলে যায় বিছানায় আধশোয়া হয়ে থাকা মানুষটার দিকে । বা হাতের কুনুইয়ে ব্যান্ডেজ বাধা । হাটু শর্টস পড়ার জন্য ব্যান্ডেজের সাদা কাপড়টার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে । রানি সম্রাটের মুখের দিকে তাকায় । ওর দিকেই কেমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সম্রাট । অস্বস্থি বোধ করে রানি । দরকার না থাকা স্বত্ত্বেও বারদুয়েক শাড়ির আচঁলটা টেনে ঠিক করে । ঘরটার চারপাশে একবার চোখ বোলায় । স্কুলে থাকতে এসেছিল শেষবার, পরে আর আসা হয়নি । এই কয়েক বছরে ঘরের পুরো নকশা বদলে গেছে । ঘরের উত্তরমুখী জানালার পাশে আগে পড়ার টেবিল ছিল । এখন সেখানে বিছানা রাখা । একপাশে এক্সারসাইজের জন্য ডাম্বেল পড়ে আছে এলোমেলো হয়ে । দেয়ালে একটা গিটার ঝোলানো । ড্রেসিংটেবিল , আলমারি , আলনা সবের ই জায়গা বদল হয়েছে । রানি এগিয়ে যায় বিছানার কাছে । বলে,
-” কেমন আছিস ? ব্যাথা কি এখনো হচ্ছে ?”
-“হচ্ছে তো । এখানে..” বলে সম্রাট মুখ কুচকে বুকের বাঁ পাশে নির্দেশ করে । রানি ভীষণ ভয় পেয়ে যায় । একটু যেন দিশেহারা বোধ করে । বলে,
-” বুকেও লেখেছে নাকি ? এক্স-রে করেছে নিশ্চয়ই ..ডাক্তার কি বলেছে ? ”
-” ওষুধ প্রসক্রাইব করেছে । কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না.. ”
-“পাওয়া যাচ্ছে না মানে ?”
-“আসলে ভাইয়া খুজে পায়নি ..”
-“খুঁজে পায়নি কেন ? অনেক ফার্মেসি আছে এখানে, সব গুলোতে খুজেছে?”
-” হুম ..”
-“তবুও পায়নি ?”
-“না । পাবে কিভাবে ? ওষুধ যে সারাক্ষণ আমার সামনে ঘুরঘুর করে । ধরাই দেয় না জানিস …”
রানি এবার ভ্রু কুচকে তাকায় । সম্রাটের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মুখটা থমথম করে রাখে । বলে,
-” কেমন বদ ছেলে তুই ! এত চোট লেগেছে তবুও ছ্যাবলামি যায় না ! আর আমি ভাবলাম সত্যি সত্যি তোর বুকে ব্যাথা করছে ”
-“করছেই তো । কিন্তু তুই বুঝবি না । তোর মনটা এত নিষ্ঠুর হয়ে গেছে যে আমার ব্যাথাটা অনুভব করতে পারছিস না । যদি একবার বুঝতি ! এই যে তুই এত সুন্দর করে সেজে আমার সামনে এসেছিস । জানিস এই বুকে কতটা ব্যাথা হচ্ছে ? তোকে নিজের করে পাওয়ার লোভ বেড়ে যাচ্ছে । আর তুই কি করছিস ? আমাকে একসেপ্ট ই করছিস না । নিষ্ঠুর প্রিয়তমা …. ….” শেষের টুকু সুর করে গাইল সম্রাট । রানির মনে হচ্ছে ওর কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হচ্ছে । বলল,
-” আমার না এখানে আসাই ভুল হয়েছে । ” বলেই রানী চলে যেতে নিলে সম্রাট আবার বলল,
-” দেখলি তো । আমি কি এমনি এমনি বললাম তুই নিষ্ঠুর হয়ে গেছিস । কিসের আমার একটু সেবা করবি তা না মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিস । আ–রে শোন না..আমি উঠতে পারছি না । একটু তো হেল্প কর । ”
সম্রাটের শেষের কথায় থমকে দাড়ায় রানি । আবার ঘুরে আসে বিছানার কাছে । সম্রাট বলল,
-“টেবিলের ওপর ওই ক্যাপসুল টা দে .”
রানি চুপচাপ একটা ক্যাপসুল বের করে সম্রাটের হাতে দেয় । টেবিলের ওপর রাখা জলের বোতল টা এগিয়ে দেয় । সম্রাট ঠোট টিপে হেসে বলে,
-” একটা শার্ট নিয়ে আয় তো..”
রানি চোখমুখ শক্ত করে একটা শার্ট এনে দেয় । সম্রাটের হাত ধরে উঠে বসতে সাহায্য করে । সম্রাট টেবিলে হেলান দিয়ে দাড়ায় । রানি বলল,
-“দাড়িয়ে আছিস কেন শার্ট পর । ”
-” আমি কিভাবে পড়ব ? হাতে ব্যাথা তো .. ভাঁজ করলে ব্যাথা লাগছে ”
-” ওহ, দাড়া আমি হেল্প করছি ”
রানি খুব সন্তপর্ণে সম্রাটকে শার্টটা পড়িয়ে দিল । সম্রাট আর একটু এগিয়ে আসে রানির দিকে । বলল ,” বোতাম গুলো ..”
রানি একটা শুকনো ঢোক গিলল। সম্রাট আর ওর মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব । রানি শুনতে পাচ্ছে বুকের মাঝে কেমন হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হচ্ছে । কেমন যেন অস্থির লাগছে ভেতরটা ? তাড়াতাড়ি করে বোতাম গুলো লাগিয়ে দিয়ে দূরে সরে গেল । সম্রাট মনে মনে হাসল শুধু । রানি বলল,
-” চল । পারবি তো যেতে ? ”
-” হম ….” বলে দু পা এগোতেই পায়ের ব্যাথায় “আহ” করে উঠল সম্রাট । রানি দৌড়ে এসে ধরল সম্রাটকে । বলল,
-” ব্যাথা হচ্ছে বললেই পারতি ..”
সম্রাট কিছু বলল না । রানির কাধে ভর করে ধীরে ধীরে নেমে এল নিচে । সদর দরজার কাছে এসে দাড়িয়ে পড়ল । বলল
,
-“একটু দাড়া ..”
রানি প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে তাকাল । সম্রাট রানির আচলটা তুলে পিঠ ঢেকে দিয়ে বলল ,
চল এবার ”
সম্রাটের এহেন কাজে রানি বিস্মিত হল । আচলটা নামিয়ে দিয়ে বলল,
-“এসব কি হচ্ছে ?”
সম্রাট আবার পিঠ ঢেকে দিয়ে বলল ,
-“এত ডিপ নেক ব্লাউজ কেন পড়েছিস ? পুরো পিঠটাই বেরিয়ে আছে । ”
-” এটা এত বেশি ডিপ নয় যে ঢেকে রাখতে হবে । নরমালি সবাই এমন ব্লাউজ পড়ে । ” বলেই রানি আবার আচল নামিয়ে দেয় ।
-“সবাই আর তুই এক হলি নাকি । অন্যরা যেটা করবে তোকে সেটা ফলো করতে হবে কেন ? আবার যদি আচল নামিয়েছিস তাহলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম । আমি ওখানে ছিলাম না আর তুই যা ইচ্ছে তাই করছিলি , না ! ” গম্ভীর হয়ে বলল সম্রাট । আবার আচল দিয়ে পিঠ ঢেকে বলল ,
-“চল এবার ”
চোখ গরম করে তাকাল রানি । বলল,
-” আশ্চর্য ! তোর সব কিছুতে বাড়াবাড়ি কিন্তু ভালো লাগছে না সম্রাট । আমি কি করব না করব সেটা সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছে । তুই নাক গলাবি না । আর আমি এভাবেই যাব । ” বলেই আচল নামিয়ে দিল । সম্রাট কটমট করে দেখল রানির কীর্তিকলাপ । আচমকা রানি পিঠে খামচে দিল ডান হাত দিয়ে । রানি ব্যাথায় ” আহ “করে উঠল । মুখ কুচকে বলল,
-“এসব কি ধরনের বেয়াদবি হ্যাঁ । ইয়া আল্লাহ , জ্বলছে পিঠটা । ”
-” আমি তো কামড়ে দিতে চেয়েছিলাম । কিন্তু এখনো লাইসেন্স পাইনি আমি । তাই এটা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিলাম । ”
রানির পিঠের দিকে তাকাল সম্রাট । উজ্জ্বল শ্যামলা পৃষ্ঠদেশে তিনটা রেখা ফুটে উঠেছে । রক্ত জমে লাল হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে । বলল,
-“এবার যা এভাবেই । কেউ জিজ্ঞেস করলে বলিস আমি লাভ বাইট দিয়েছি । কি হল? যাহ । .. দাড়িয়ে আছিস কেন ? আরে এক সঙ্গে যাওয়া যাবে না বুঝলি । তোর কাধে ভর দিয়ে গেলে সবাই আমাদের জামাই-বৌ ভাবতে পারে । তার ওপর লাভ বাইট .…বুঝতেই পারছিস । …. ”
রানি কিছু বলল না । খুব বেশি রেগে গেলে ওর চোখে জল চলে আসে । কথা হারিয়ে যায় । এখন ও তাই হল । শুধু নিষ্পলক তাকিয়ে রইল সম্রাটের দিকে ।
-” এই যে আমার গজরানি , কাদিস না প্লিজ । তুই কাদলে এই বুকে লাগে রে । ” বলে আলতো করে চোখটা মুছে দিল সম্রাট । আবার বলল ,
-“তোকে শুধু আমি দেখব । হাজার ভাবে দেখার অধিকার শুধুই আমার । তুই আমার সম্পদ । এখন যেটা করলাম সেটা আমার সম্পদকে অন্যদের কুদৃষ্টি থেকে বাচানোর জন্য করলাম । তুই আমাকে ভুল বুঝিস না । এখন চল। আচ্ছা , তুই দরজা লাগিয়ে আয় । আমি এগোচ্ছি …” বলেই সম্রাট স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেটে চলে গেল । রানি শুধু ড্যাবড্যাব করে থাকিয়ে দেখল ওর হেটে যাওয়ার দিকে । কেমন অসভ্য, ইতর ,বদমাশ ছেলেটা …. এতক্ষণ নাটক করল পা ব্যাথার । কেমন বোকা বানিয়ে চলে গেল ওকে !
To be continue…