গজপ্রিয়া-18(অন্তিম পর্ব-শেষ অংশ)
Chhamina_Begam
অতিরিক্ত দুঃচিন্তায় কখনো কখনো মানুষের বাস্তব বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। যেই সমস্যার সমাধান নিমেষেই সম্ভব তাই করতে ঘন্টার পর ঘন্টা লাগিয়ে দেয় । তেমনটাই হয়েছে লাবিবদের সাথে । রানির বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে কল করতে করতেই রাত আটটা বাজিয়ে ফেলেছে । এদিকে বাড়িতেও বেশ কিছু আত্মীয়রা এসেছে । সবার মুখে মুখে রানির কথা ঘুরছে ।তাদের সবারই আশ্চর্য লাগছে রানির মতো মেয়ে এমন একটা কাজ কিভাবে করতে পারে ? তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না কথাটা । কেউ আবার আড়ালে ওকে নষ্টা উপাধিও দিয়ে দিচ্ছে । নিশ্চয়ই কারো সাথে পালিয়ে গেছে ? মৌসুমী বেচারি সবাইকে চুপ করাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে । অনেক আত্মীয় আবার অনুষ্ঠান হবে না ভেবে বাড়ি চলে গেছে । ডাক্তার এসে প্রেশার মেপে ওষুধ দিয়ে গেছেন লাবিবের বাবাকে । তিনি কোথাও ঠিক মতো বসে থাকতে পারছেন না ।তাই মনিরা তাকে জোর করে শুইয়ে দিয়ে গেছে ।
ছোট দেখে যখন কেউ বানিকে গুরুত্ব দিচ্ছিল না তখন সে ছুটল সম্রাটের কাছে । বাড়ি থেকে বেরতেই দেখতে পেল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে সম্রাট । বানিকে দেখেই দাড়িয়ে পড়ল ।বলল,
-“বানি কখন হয়েছে এমন ? ”
একে একে বানি পুরো ঘটনা বলল সম্রাটকে । সম্রাট সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল,
-” তুই চিন্তা করিস না । রানির কিচ্ছু হবে না । আমরা ঠিক খুজে বের করব ওকে …”
সম্রাট চলে যেতে নিলে বানি পেছন থেকে ডেকে ওঠে ,
-“ভাইয়া ?”
সম্রাট ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল ।বানি বলল,
-“ভাইয়া একটা কথা বলি….”
-” বল..”
-” ভাইয়া , বাজার এরিয়াটা তো বেশ ছোট । এখান থেকে অটো ছাড়া আর অন্য কোনো গাড়িই চলে না ।আপু যদি নিজে কোথাও গিয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই অটোতেই যাবে । তুমি কি একবার অটো ওয়ালাদের জিজ্ঞেস করে দেখবে ?যদি কোনো খবর পাওয়া যায় ”
সম্রাট বাণীর উপস্থিত বুদ্ধি দেখে চমকিত হল সম্রাট । সে যে এই কথাটা ভাবেনি তা নয় । কিন্তু এতটুকু একটা মেয়ের মাথায় যে এই বুদ্ধিটা এসেছে তার মানে সে কতটা প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন তার কিছুটা আন্দাজ করাই যায় । সম্রাট হাসল একটু। বলল,
-” তুই চিন্তা করিস না । আমি দেখছি কি করা যায় ….”
বলেই সম্রাট আবার বাড়ি ফিরে গেল । কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর বাবার গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেল । পথে যেতে যেতে অনেক বার কল করল রানির নাম্বারে । প্রত্যেক বার এক মিষ্টভাষী মহিলার যান্ত্রিক কন্ঠে ‘ সুইচ অফ ‘ শুনতে শুনতে বিরক্ত হলেও শেষমেশ কল রিসিভ হল । বিস্ফোরিত চোখে কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনের ওপর তাকিয়ে থেকে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলতে লাগল ,
-” রানি কোথাও তুই ? এসব কি পাগলামি শুরু করেছিস বলতো । কি হল? কথা বল । এখন কোথায় আছিস ? ঠিকানা বল তাড়াতাড়ি ..”
একনাগাড়ে কথা গুলো বলে থামল সম্রাট । কিন্তু ওপাশের ব্যক্তিটির কন্ঠস্বর শুনে যেমন নিরাশ হল তেমনি ভীত , সন্ধিগ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল
-” কে আপনি ? এই ফোন কোথায় পেলেন ? আর রানি কোথায় ? ”
-” দেখুন আমি একটু আগেই এই ফোনটা আমার অটোতে পেয়েছি ”
সম্রাট অটো চালকের কাছ থেকে ওনার ঠিকানা নিয়ে প্রায় আধঘণ্টার মতো পৌঁছে গেল । তার সাথে কথা বলে সম্রাট জানতে পারল তিনি ফোনটা বাড়িতে ফিরে পেয়েছেন । ফোনটা সুইচ অফ ছিল । তিনি চার্জে বসিয়ে অন করতেই দেখতে পান একটি হাস্যোজ্জল মেয়ের ছবি । হয়তো তিনি চিনতে পারতেন না কারন গাড়িতে সারাদিন অনেক যাত্রী যাতায়াত করে । তবে একে চেনার কারন রানি তিরিশ টাকার ভাড়াতে একশ টাকার নোট দিয়ে চলে যাচ্ছিল । তিনি ডেকে ফেরত দিলে তার মনে হয় মেয়েটা ভীষণ আনমনা ছিল । তার আচরণ অসঙ্গত মনে হয়েছে তার । তবে তিনি মাথা ঘামাননি । এরকম অনেক যাত্রী রোজ যাতায়াত করে তার অটোতে। সবাইকে নিয়ে মাথা ঘামানো তার কম্ম নয় । অটো চালকের কাছ থেকেই সম্রাট জানতে পারে তার লাস্ট স্টপেজ নিউ আলিপুর জংশন ছিল । এবং রানি ওখানেই নেমেছে । সম্রাট অটোচালককে ধন্যবাদ জানিয়ে রানির ফোন নিয়ে হাওয়ায় বেগে গাড়ি ছোটায় । জানালা দিয়ে হু হু করে শীতল বাতাস ঢুকছে । নিঃসন্দেহে গ্ৰীষ্মকালে তা আমামদায়ক অনুভূতি প্রদান করে। তবে দুঃচিন্তায় সম্রাট কিছু অনুভব করতে পারছে না । মাথার ভেতর প্রশ্নরা কিলবিল করছে । ক্ষণে ক্ষণে তা ওকে অস্থির করে তুলছে । রানি কেন স্টেশনে গেল ?সে কোথায় যেতে চাইছে ? চলে গেছে নাকি এখন ও আছে ? অবশ্য সে এখনো সেখানে আছে এই আশা করাটা বোকামি । কারণ অটোচালকের মতে তিনি দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ রানিকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়েছে । আর এখন রাত ন’টার ও বেশি হয়ে গেছে । তবুও মনের মাঝে ক্ষীণ আশার আলো এখনো ধিকধিক করে জ্বলছে । হয়তো রানি আছে সেখানে ? মনুষ্য জাতিটাই এমন । তারা কখনো আশা ছাড়ে না । আশার-আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করেই তারা জানা থেকে অজানার দিকে পাড়ি জমায় । দেশ থেকে দেশান্তরী হতে দুবার ভাবে না ।
সম্রাট যখন স্টেশনে পৌঁছালো তখন ঘড়ির কাটা দশটা ছুই ছুই । এরমধ্যেই লাবিবকে ফোন করে সব কিছু বলে দিয়েছে সম্রাট । পার্কিংয়ে গাড়ি পার্ক করে সম্রাট দৌড়ে গেল প্লাটফর্মে । রাত গভীর হয়ে যাওয়ায় স্টেশন বেশ ফাকা । সম্রাট স্টেশনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দৌড়ে দৌড়ে খুঁজল রানিকে । বার বার নিরাশ হতে হতে চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করল সম্রাটের । কিন্তু কান্না বেরুলো না । কাঁটার মতো দলা পাকিয়ে আটকে রইল গলায় । পরিবর্তে ফোস ফোস করে ফুপিয়ে ওঠার শব্দ শোনা গেল । সরু একটা জলের ধারা নীরবে গড়িয়ে পড়তে লাগল গাল বেয়ে । দু হাতে মাথার চুল টেনে ধরে বসে পড়ল প্লাটফর্মের একটা সিমেন্টের বেদিতে। তীব্র এক অপরাধ বোধ কুট কুট করে খেতে লাগল সম্রাটকে । আজ ওর জন্যই রানি নিরুদ্দেশ হয়ে গেল । নাহলে কাল অবধি তো সব ঠিকই ছিল । ও যদি কাল রানিকে এত কথা না শোনাত তাহলে এমন কিছুই হতো না । হ্যাঁ, করে ফেলত বিয়ে আশিককে । থাকত ওর থেকে অনেক দূরে । তবুও তো মন চাইলে চোখের দেখা দেখতে পেত । এভাবে একেবারে হারিয়ে যাওয়ার থেকে এই ঢের ভালো ছিল । হয়তো তখন সম্রাট নিয়তি ভেবে একসময় মেনেও নিত নিজের ভাগ্যকে ।
পাশে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল সম্রাট । দেখতে পেল একটা এক-দেড় বছরের বাচ্চা হাত পা ছোড়াছুড়ি করে কান্না করছে । তার মা তাকে চুপ করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে । বাচ্চাটার হাতে, খেলনা , কেক , চকলেট দেওয়ার পরেও যখন চুপ হল না তখন পাশ থেকে সম্ভবত বাচ্চার বাবা হবেন তিনি ,বললেন,
-” মিনি , বাবুনের মনে হয় ক্ষিদে পেয়েছে । আমাদের ট্রেন আসতে আরো আধ ঘন্টা দেরি । তুমি ততক্ষণে ওকে ওয়েটিং রুমে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে আনো ।আমি এখানেই আছি । ”
ওই ব্যক্তির কথা শুনে কিছু মনে পড়তেই সম্রাট ছুটল ওয়েটিং রুমের দিকে । সব জায়গায় খোঁজা হলেও ওয়েটিং রুমটা বাদ পড়ে গেছে । মরুভূমিতে একটু জল পাওয়ার আশায় যখন একজন তৃষ্ণার্ত পথিক দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটতে থাকে মরিচিকার পেছনে ঠিক তেমনি সম্রাট ছুটে গেল ওয়েটিং রুমের দিকে । মনের মাঝে পাওয়া না পাওয়ার হাজারো দন্দ্ব নিয়ে যখন ওয়েটিং রুমের দরজায় দাড়ালো কয়লাখনিতে হিরে খুজে পাওয়ার মতো ধক করে জ্বলে উঠল সম্রাটের চোখ দুটো । অস্ফুটে উচ্চারণ করল ‘রানিইইই’ । ধীরপায়ে এগিয়ে গেল রানির দিকে ।রানি তখন চেয়ারে ‘দ’আকৃতিতে বসে আছে । ডান হাতে গালে ভর দিয়ে একমনে মেঝেতে পা খুঁটছে । স্থস্থির হাসি হাসল সম্রাট । একটু গলা খাকড়ি দিয়ে বলল ,
-” আমি ভাবলাম পেতনি মনে হয় কোনো প্রতাত্মার খোঁজ পেয়েছে । তাই বাকি সবার কথা ভুলে গেছে । তাই ভাবলাম দেখা করে আসি । তুই তো কখনো বলবি না । আমার নিজেকেই হাসতে হল । ”
একটা অতি পরিচিত কন্ঠস্বরে মাথা তুলে তাকাল রানি । দেখল একজোড়া অতি উৎসাহি চোখ ওকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে । মুখে তার মিচকে হাসি । অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিল রানি ।
প্যান্টের পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে সম্রাট । দৃষ্টি রানিতে নিবদ্ধ । এখনো ঠোঁটের কোণে লেগে আছে এক চিলতে হাসি । মুখে খানিকটা গাম্ভীর্য এনে বলল,
-” তুই এতটা কেয়ারলেস কেন বলবি একটু ? তোর চিন্তায় বাড়ির সবার প্রান যায় যায় অবস্থা আর তুই এখানে দিব্যি বসে আছিস । একটুও কি আমাদের কথা মনে পড়েনি ?”
অভিমানে টইটম্বুর চোখ দুটি দিয়ে তাকাল রানি । বলল,
-“হ্যাঁ , আমি জানি তো , আমি স্বার্থপর , কেয়ারলেস , উদাসীন সবকিছুই । আমি কারো জন্যই ভাবি না । কারো কোনো কিছুতে আমার কিছু যায় আসে না । আর তাই তো এখানে বসে আছি এখনো । কিন্তু তুই ? তুই তো আমার থেকেও বেশি খারাপ । একজন খুব স্বার্থপর লোক তুই । কখন কি বলতে হয়? করতে হয় ? কিচ্ছু জানিস না । আর তোর জন্য এখন আমাকে সাফার করতে হচ্ছে … ”
বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল রানি । এতক্ষণের দাবিয়ে রাখা কান্না গুলো এখন আর বাঁধ মানছে না । অঝোর ধারায় বইতে লাগল । ওকে ওভাবে দেখে ভীষণ খারাপ লাগতে লাগল সম্রাটের । আর একটু এগিয়ে এসে রানির মুখোমুখি দাড়িয়ে কাধে হাত রাখতেই রানি দুহাতে শক্ত করে কোমড় জড়িয়ে ধরল । সম্রাটের পেটে মুখ লুকিয়ে কাদতে লাগল ফুপিয়ে ফুপিয়ে । সম্রাট আর কিছু বলল না ।মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল । মানুষ সবসময় কোনোকিছু হারিয়ে গেলেই কাদে না । মাঝেমাঝে কোনো কিছু পাওয়ার খুশিতেও কেদে ফেলে । মাঝে মাঝে কান্না গুলোকে বেরিয়ে যেতে দিতে হয় । তখন অনেকটা হালকা লাগে নিজেকে ।
সম্রাটের ফোন পেয়ে আর একটুও অপেক্ষা করেনি লাবিব আর ফাহিম । তখনই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল স্টেশনের উদ্দেশ্য । ওরা যখন পৌছালো তখন স্টেশনের বিদ্যুৎ চালিত ঘড়িটায় দশটা বেজে চোদ্দো মিনিট । এদিক ওদিক খোজার পর রানি সম্রাট কাউকেই না পেয়ে ওয়েটিং রুমে তাকতেই দুজনের চোখ আটকে গেল এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্যে । যেটা ফাহিমের অজানা না হলেও লাবিবের কাম্য ছিল না । দেখল রানি সম্রাটের কোমড় জড়িয়ে ধরে হাপুশ নয়নে কাদছে এবং সম্রাট রানির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে যত্ন সহ কারে । অভিজ্ঞ লাবিবের চোখ যখন এই ঘটনার সারমর্ম অনুমান করল তখন সে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল ফাহিমের দিকে । ফাহিম কিছু বলল না বরং প্রশ্রয়ের হাসি হাসল । যার অর্থ বুঝতে বাকি রইল না লাবিবের । ফাহিম ভাইকে দেখে বোঝার চেষ্টা করল সে আসলে কি ভাবছে ? কিন্তু লাবিবের অভিব্যক্তিহিন মুখের ভাবার্থ বের করতে অসমর্থ হল সে । লাবিব ফোন বের করে কল করল ওর বাবাকে । রিসিভ হতেই বলল,
-” বাবা, কাজি সাহেবকে আসতে বলে দাও । আজকেই বিয়ে হবে রানির ।”
এর উত্তরে অপর পাশ থেকে কি জবাব এল জানা নেই ফাহিমের ! তবে দেখল তার ভাই ততক্ষণে ফোন ডিসকানেক্ট করে এগিয়ে গেছে রানিদের দিকে ।
রাত এগারোটা । বিয়ে বাড়ির পুরোনো আমেজটা ফিরে না এলেও লোকজনের কলরবে মুখর হয়ে রইল । লাবিবের কথা মতো কেউ রানিকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি যে সে কেন এমন একটা কাজ করল ? তবে আত্মীয় স্বজনদের মাঝে ফিসফাস কমানো গেলেও তাদের দমিয়ে রাখা গেল না । তারা সুযোগ পেলেই নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করতে লাগলো ।
অবশেষে রাত পৌনে একটায় দুই পক্ষের সম্মতিতে মৌনির বাবার ওকালতিতে বিয়ে হয়ে গেল সম্রাট আর রানির । কাজি সাহেব যখন রানির কাছে এসে বললেন
-” আলিপুর দুয়ার নিবাসি জনাব মোশারফ হোসেনের দ্বিতীয়া কন্যা রানি বিনতে মোশারফ আপনাকে আপনাকে জনাব খালিদ হোসাইনের প্রথম পুত্র সম্রাট বিন খালিদ , জেলা-আলিপুর দুয়ার সজ্ঞানে এবং পূর্ণ সম্মতিতে এক লক্ষ একান্ন হাজার এক টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া বিবাহ করিতে আসিয়াছে। আপনি কি রাজি আছেন ? বলুন ,আলহামদুলিল্লাহ …”
রানী তখন বিস্মিত দৃষ্টিতে একবার লাবিবের দিকে তাকিয়ে দেখল সে হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে । তার পাশে সম্রাট নিজে দাড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে । রানির মনে হচ্ছিল সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে । না হলে এত তাড়াতাড়ি দৃশ্য বদল হচ্ছে কেন ? এই তো একটু আগে স্টেশন থেকে ফেরার সময় লাবিব ভাইয়া কেমন গম্ভীর মুখ করে বসেছিল । একটা কথাও বলেনি ওর সাথে , না ফিরে এসে বলেছে ! সবার মুখ থমথমে হয়ে ছিল ।মৌসুমী ভাবি শুধু হেসে হেসে ওকে শাড়ি পড়িয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে । গতরাতে বিলকিস জোর করে মেহেন্দী পড়িয়ে দিয়েছিল । ওদের গাছেরই মেহেন্দী । মামানি কেনা মেহেন্দী গুলো পছন্দ করেন না । তাই তিনি নিজেই বেটে প্লাস্টিকের কিউব বানিয়ে দিয়েছিলেন । শুকানোর পর লেবু চিনি ঘষে দিয়েছে । যার ফলে রং টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিল । তাই দেখে ভাবি কত মজা করেছিল ওর সাথে ! বলেছে রানির বর নাকি ওকে খুবই ভালোবাসবে ! অবশ্য রানির তাতে হেলদোল দেখা যায়নি । সে বরাবরই নির্বিকার ছিল । আর এখন সবাইকে এমন হাসিমুখে দেখে রানি পুরো ভেবলে গেছে । হাঁ করে একবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মেহেন্দী রাঙানো হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল । তখনই কাজি সাহেব আবার তাড়া দেওয়ার লজ্জা রাঙানো মুখে মাথা নিচু করে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলেছে ।
তিনবছর পরের কথা –
—————————
রাতের খাওয়া শেষে সদ্য মাজা বাসন গুলো সাজিয়ে রাখছিল রানি । গুরগুর শব্দে আকাশ শব্দ করে উঠল । সারাদিনের কাঠফাটা রোদের পর বিকেল থেকেই আবহাওয়া বেশ আদ্র । বৃষ্টি হবে হয়তো ? রানি ডাকল সম্রাটকে ,
-“সম্রাট ,এই সম্রাট.. শুনছিস ? ”
-“হ্যাঁ বল…”
-“বৃষ্টি আসবে মনে হয় । বেলকনিতে কাপড় গুলো মেলে দেওয়া আছে । নিয়ে আয় তো । ”
-“আমি পারব না ।ব্যস্ত আছি । ”
-“মাত্র পাচঁ মিনিটের কাজ । তবুও বাহানা !” বিরবির করতে করতেই হাত গুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো রানি । তখনি ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল ।বিরবির করে উঠল রানি ‘আবার লোডশেডিং’ । কোমড়ের কাছে কারো স্পর্শ টের পেতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠল । তখন খুব কাছে ঘাড়ের কাছটায় শুনতে পেল এক অতি পরিচিত কন্ঠস্বর ,
-“সসসসস, আমি….”
স্বস্থির নিশ্বাস ফেলল রানি । কপট রেগে বলল,
-” তোর স্বভাব বদলালো না এখনো ! …”
-“কারণ আমি যে বদলাতে চাই না …”
হাসল রানি ,হাসল সম্রাটও । সম্রাট নিজের হাত জোড়া দিয়ে আলতো করে রানির চোখ ঢেকে দিয়ে বলল,
-“চল, ধীরে ধীরে..”
-“কিন্তু …”
-“কোনো কথা নয় । আমি যতক্ষণ বলব না ততক্ষণ চোখ খুলবি না । ওকে ”
রানি মাথা ঝাকাল । কয়েক পা ফেলার পর সম্রাট রানিকে দাড় করিয়ে দিল একটা জায়গায় । রানি বেশ বুঝলো এটা তাদের সোফার সামনে টা । ততক্ষণে সম্রাট রানির চোখ খুলে দিয়েছে ,
-” হ্যাপি থার্ড অ্যানিভার্সারি মাই বেটারহাফ ”
চোখ খুলে রানি স্বপ্ন রাজ্যে প্রবেশ করল । এই এতটুকু সময়ের মধ্যে সম্রাট ওদের ছোট্ট ঘরটাকে লাল ,সবুজ, হলুদ রঙের মরিচ বাতি দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছে । রানি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পিছনে একটা মাঝারী সাইজের ব্যানার । তাতে একটা হার্ট শেপের মাঝে রানি আর সম্রাটের ছবি । তার চারিদিকে অসংখ্য ছোট বড় হার্ট শেপ । সেন্টার টেবিলের ওপর একটা কেক রাখা । তাতে সুন্দর করে রানি আর সম্রাটের নাম লেখা । খুশিতে কান্না করে দিল রানি । সেমিনারের জন্য পেপার তৈরি করতে গিয়ে ও তো ভুলেই গিয়েছিল যে আজ ওদের বিবাহবার্ষিকীর কথা । প্রতিবারের মতো সম্রাট এবারও ঠিকই মনে রেখেছে ।
-” শুভ বিবাহবার্ষিকী আমার গজপ্রিয়া । তৃতীয় বিবাহবার্ষিকীর অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোকে । ”
চোখে আনন্দাশ্রু নিয়েই হাসল রানি । শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সম্রাটকে । ফিসফিস করে বলল,
-“তোকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা সম্রাট । এভাবেই পাশে থাকিস। সবসময় হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিটি ছন্দে তাল মিলিয়ে চলিস আমার সাথে । আই লাভ ইউ । অনেক ,অনেক ভালোবাসি তোকে ….”
রানির মুখটা সামনে এনে চোখ চোখ মিলিয়ে বলল সম্রাট,
-“আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি রানি ”
তারপর টুক করে রানির ঠোঁটে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“ওয়াশরুমে একটা ড্রেস আছে ।যা পরে আয় ।সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য ..”
-” কে অপেক্ষা করছে ?”
-“সেটা সারপ্রাইজ ….”
রানি ভালো করে দেখল সম্রাটকে । সে ইতিমধ্যে মধ্যে ফরমাল পোশাক পড়ে ফেলেছে । সম্রাট এমনিতেই সুন্দর । কিন্তু আজকের কালো প্যান্ট আর সাদা ফরমাল শার্টটায় একটু বেশি সুন্দর লাগছে যেন । সিল্কি চুল গুলো একটু আধটু উড়ছে । রানি আলতো করে কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিল । সম্রাট হাতটা ধরে ফেলে পৃষ্ঠদেশে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“যা , তাড়াতাড়ি । দেরি হয়ে যাচ্ছে ”
রানি মাথা ঝাকিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে । কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বেরিয়ে এল । দরজা খোলার শব্দ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সম্রাট ।চোখে একরাশ মুগ্ধতা । পিচ রঙের ফুলেল নকশা করা সিফন সিল্কের গাউনটায় অপরুপা লাগছে রানিকে । সাথে হালকা প্রসাধনী আর কোমড় অবধি লম্বা চুল গুলো একটু বাতাস পেয়েই বেশ অবাধ্যতা করছে । তা একহাতে সামলে রানি ধীরে পায়ে এগিয়ে এল সম্রাটের কাছে । মুগ্ধতাকে এক পাশে সরিয়ে সম্রাট অধরবন্দি করল নিজের প্রেয়সীকে ।
কেকের ওপর মোম বাতি গুলো নেভানোর আগে আরো একবার সারপ্রাইজড হল রানি । প্রিয়জনদের কলকলানিতে সামনে তাকিয়ে দেখল ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভিড় করে আছে মামানি, আম্মু ,মৌসুমী , বিলকিস, বানি, রুমা খালামনি, ওয়াহিদ, লাবিব, ফাহিম সবাই । ওদের সামনে মেঝেতে হাটু ভেঙে বসে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে তান্নু । এত কিউট কেন বাচ্চাটা ! একটু পর ফাহিম স্ক্রিন টা ঘুরিয়ে দিল সম্রাটের বাবা আর রানির আব্বুর দিকে । খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল রানি । পড়াশোনা চাপে অনেক দিন এই লোকগুলোর সাথে ঠিক মতো কথা হয় না ওর । এই বিশেষ দিনটায় তাদের সবাইকে একসঙ্গে দেখে আবার কেঁদে ফেলল রানি ।তখনই সম্রাট আক্ষেপ করে বলল,
-“বড় মা দেখেছ , কেমন কাদুনেবুড়ি জুটেছে আমার কপালে !”
রানি আলতো করে সম্রাটের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে অভিমানি চোখে তাকাল ।
একে একে সবাই শুভেচ্ছা জানাল সম্রাট-রানিকে । কেক কাটা ,সবার উইশ সবকিছু মিলে সময়টা স্মরণীয় হয়ে রইল স্মৃতির পাতায় । বাইরে জোরে হাওয়া বইছে । একটু পরেই প্রবল বাতাসের সাথে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । প্রকৃতি যখন তার সহজাত তান্ডব লীলায় মত্ত ঠিক তখনই সম্রাট ব্যস্ত আদিমলীলার রহস্য উন্মোচন করতে । প্রকৃতির অশান্ত, উত্থালরূপের মতোই আজ রানিও বাধা পড়েছে সম্রাটের নাগপাশে । রানি মৃদু স্বরে বলল,
-” সম্রাট, বেলকনিতে কাপড় গুলো ভিজছে মনে হয় ?”
-“আমি তুলে এনেছি ..”
রানি তবুও হাল ছাড়ল না । বলল,
-” সম্রাট , কাল আমার সেমিনার আছে …”
-“আমি পৌছে দেব তো …” মোহাবিষ্টের ন্যায় বলল সম্রাট । তারপর আবার বলল,
-” নিজের বৌকে আদর করা প্রত্যেক স্বামীর অর্জিত অধিকার বুঝলি । সেই অধিকারে একদম নাক গলাতে নেই রানি … ”
সম্রাটের কথায় খিলখিল করে হেসে উঠল রানি ।
ইউনিভার্সিটি চত্তরে দাড়িয়ে আছে সম্রাট আর রানি । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ একসপ্তাহ ব্যাপি এক সেমিনারের আয়োজন করেছে । বাংলার পিএইচডি হোল্ডার হওয়ার জন্য রানিও পেপার জমা দিয়েছে । ওর শিক্ষকের সহায়তায় ওকেও আজ প্রজেন্টেশন দিতে হবে । রানির বেশ নার্ভাস লাগছে । এতবড় সেমিনারে এর আগে কখনো সে বক্তৃতা দেয়নি । শক্ত করে সম্রাটের হাত ধরে রেখেছে তবুও কাপছে যেন । সম্রাট বলল,
-“কুল ডাইন, রানি । সব ঠিক হবে । আমি আছি তো এখানেই ।”
মুহূর্তেই রানির চোখ দুটো চকচক করে উঠল । তবে তা বেশিক্ষণ টিকল না । মনমরা গলায় বলল,
-“কিন্তু তোকে তো ফিল্ডে যেতে হবে ..”
হাসল সম্রাট । বলল,
-“না । আজ আমি ছুটি নিয়েছি । আজ তোর জন্য এতবড় একটা দিন ! আমি না এসে পারি ?”
-“সত্যি..”উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করল রানি । সম্রাট হেসে মাথা ঝাঁকাল ।
-“তোরা দুজন এখনো একে অপরকে তুই-তোকারি করিস ?”
পাশ থেকে একটা পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে রানি সম্রাট দুজনেই পিছন ফিরে তাকাল । দেখল আশিক দাড়িয়ে আছে হাসি মুখে । রানি সম্রাট দুজনেই থমকাল । তবে সম্রাট দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি মুখে বলল,
-” আমরা এতেই বেশি কম্ফোর্টেবল ভাইয়া । কেমন আছেন আপনি ?”
–” এই তো চলছে । তোমাদের কি খবর ?”
-” আমরাও ভালো আছি । তা আপনি এখানে ?”
-” হ্যাঁ । ভুলে গেছিস নাকি আমিও কিন্তু বাংলারই প্রফেসর । ”
লজ্জিত হয়ে একটু হাসল সম্রাট । বলল,
-“না, ভুলিনি ভাইয়া । তবে এখানে আপনাকে দেখে একটু চমকেছি বটে..” সাবলীল জবাব দিল সম্রাট ।
-“এরা ইনভিটেশন পাঠিয়েছে আমাকে ”
-“ও আচ্ছা ”
-“আর তোরা এখানে কেন ?”
-“আজকের সেমিনারে রানি পেপার জমা দিয়েছে । তাই আসা আরকি ..”
-‘ওহ ,আচ্ছা । কনগ্ৰাচুলেশন রানি । ”
-“থ্যাঙ্ক ইউ, ভাইয়া ”
আশিক কে দেখার পর থেকেই রানি সেই যে মাথা নিচু করেছে । এখনো সেই অবস্থাতেই জবাব দিল । আশিক হাসল একটু।বলল,
-“তোমার লজ্জা পাওয়ার প্রয়োজন নেই রানি । আমি তোমার ওপর রেগে নেই । আমি তোমার সিচুয়েশনটা বুঝতে পেরেছি তখনই ।আর তোমার পুরো অধিকার আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। .. আর যদি আমাকে নিয়ে ভাবছ , তাহলে বলব , আমি আবেগের বশে এমন কিছুই করব না যাতে তোমার বা আমার সম্মান নষ্ট হয় । আমাকে সবসময় একটা কথা মাথায় রাখতে হয় । কি জানো তো ? আমি একজন শিক্ষক । আমার কিছু দায়িত্ব আছে এই সমাজের প্রতি । স্টুডেন্টরা আমাকে অনুকরণ করে । তাই আমার এমন কোনো আচরণ করা সমীচীন নয় যা তাদের ওপর কোনো খারাপ প্রভাব ফেলবে । তাই তুমি নিশ্চিন্তে থাকো । আচ্ছা , তো ভালো করে প্রজেন্টেশন দিও। আমার শুভকামনা রইল তোমার সাথে । এখন আসি …”
রানি সম্রাট দুজনেই হাসি মুখে বিদায় দিল আশিককে । দুজনেই তাকিয়ে রইল কিছু মুহুর্ত ওনার চলে যাওয়ার দিকে । সম্রাট অস্ফুটে বলল ,
-“আশিক ভাইয়া, কত্তো ভালো একজন লোক । সত্যি ওনার মতো মানুষ হয় না । অন্য কেউ হলে কখনো সোজা মুখে কথাও বলত না আমাদের সাথে …”
-” হ্যাঁ, একদম । আশিক ভাইয়াও আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে । ” একটু থেমে আবার বল রানি ,”মামা কি কখনো আমাকে ক্ষমা করবে সম্রাট ?”
সম্রাট ঘুরে দাড়াল রানির সামনে । রানির চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের ফোটাটা মুছে দিয়ে বলল,
-” রানি , ওনাকে সময় দেওয়া উচিত আমাদের ”
-“কিন্তু আর কতদিন ? তিন বছর হয়ে গেল ! আমাদের ক্ষমা করার জন্য আর কত সময় দরকার ওনার ? ”
-“একদিন নিশ্চয়ই ক্ষমা করবে দেখিস । আমার বিশ্বাস আছে ওনার ওপর ..”
গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সম্রাট । কিছু লোক থাকে যারা আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে । কিন্তু তারা কখনোই বুঝতে চায় না আমাদের । তবুও আমাদের তাদের সাথে মানিয়ে চলতে হয় । ভালো-মন্দ, দোষ-গুন মিলে এটাই আমাদের জীবন । আমাদের সারাজীবন এই সম্পর্ক গুলো বয়ে বেড়াতে হয় এই আশায় যে জীবনের কোনো না কোনো প্রান্তে এসে একদিন নিশ্চয়ই তারা আমাদের বুঝবে । আমাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবে ।
সমাপ্ত