প্রনয়ের_ছন্দ,পর্ব-২,৩

0
1095

প্রনয়ের_ছন্দ,পর্ব-২,৩
আনজুম_তানিশা
পর্ব-২

০২.

আকাশে মুক্ত পাখিদের আনাগোনা। কিচিরমিচির শব্দে বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাড়না আর একটুপরেই ডুববে সূর্য। ডুববে এই ধরণীতল আধার রাজ্যে। ঢাকায় ফিরে নিজের সেই৷ ভাই ভাবীর কাছে ফিরল। তারাও সাদরে গ্রহন করল নূর কে। নূর এখনো কাউকে সত্য টা বলেনি। নূর গতকাল থেকে নিজেকে অনেকটা বন্দী করে রেখেছে। না কাঁদে নি সে। কিছু অপূর্ণ অঙ্কের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত সে।

অফিস থেকে ফিরে আগে বোনের ঘরে দৌড়ে আসল ফাহিম। দুপুরে তার স্ত্রী আফিয়া ফোন করে বলল তার বোন নাকি গ্রাম থেকে ফিরেই নিজেকে বন্দী করে রেখেছে। এই৷ খবর শুনার পর সব কাজ কোনোরকম গুছিয়ে দৌড়ে আসল ফাহিম। নূরের রুমে নক করে ডুকল ফাহিম আফিয়া। ফাহিম এসেই কপালে গলায় হাত দিয়ে চেক করল বোনের জ্বর নাকি! নাহ জ্বর ও না! তাহলে কী গ্রামে কিছু হয়েছে? ফাহিম এমন আকাশ কুসুম চিন্তা করতে করতে নূর ব্রু কুচকে বলল,

— ভাই সমস্যা কী তোর? কি হইসে এমন পাগলের হতো লাগছে কেন? ঠিক আছিস তো নাকি নতুন কাউকে দেখে উল্টে গেসোস কোনটা?

শেষের কথা টা কিছুটা বিদ্রুপ করে ঠোট কামড়ে হেসে বলল নূর। নূরের কথায় বিরক্তি নিয়ে নূরের দিকে তাকালো। নূর ইশারায় স্ত্রী আফিয়ার দিকে তাকাতে বলল। বোনের ইশারায় স্ত্রী র দিকে তাকাতেই ভীত বিড়াল হয়ে গেল ফাহিম। তাহ সাহস নিয়ে ফাহিম বলল,

— তোর সমস্যা কী কাল গ্রাম থেকে আসার পর থেকেই নিজেকে বন্দী করে রেখেচিস নাকি।

— তুই দেখেছিস বন্দী থাকতে আমাকে? বলদের মতো কথা বলিস না। আমি আবার জয়েন করব তাই প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম।

নূরের কথায় হ্মুদার্থ বাঘের ন্যায় হ্মেপে গেল আফিয়া ফাহিম। ফাহিম ধমক দিয়ে বলল,

— ৪ বছর আগের ঘটনার পূর্নাবৃওি করতে চাচ্ছিস তুই। মরতে মরতে বেঁচেছিস আবার সেই একই লাইনে। তোকে নিয়ে একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই। প্লিজ বোন তুই জয়েন হোস না। নাহলে খুব খারাপ হবে।

কথা গুলো বলে ফাহিম চলে গেল। তার পিছন পিছন আফিয়াও চলে গেল। আর নূর বাঁকা হেসে বলল,

— আমাকে তো জয়েন হতেই হবে। অতীতের অপূর্ন হিসাব গুলো যে এখনো মিলানো বাকি!

কথা গুলো আপন মনে বলে আবারো হাসল।

???

ব্যস্ত পায়ে দৌড়ে হাসপাতালে ডুকল নিশান মির্জা। দৌড়ে রিসিপশনে জিজ্ঞেস করে হাসপাতালের অটির সামনে গিয়ে হাঁপাতে লাগল। করিডোরে ই বসে ছিল আরো অনেক জন। নিশান মির্জা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল,

— মনিকা কই? ও ঠিক আছে তো? সবাই এমন চুপ কেন? কথা বলো? আমার মনিকা কই? কথা বলো না কেউ?

শেষের কথাটা কিছুটা জোরে চেচিয়ে বলল নিশান। নিশানের বলা শেষে পিছন থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেলো। নিশান পিছনে ঘুরে দেখল তাওয়ালে পেছিয়ে এক ফুটফুটে বাচ্চাকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে নার্স। নিশান ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে বাচ্চা টিকে কাঁপা কাঁপা হাতে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধড়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল৷ বাকিরাও চুপ। কিছুহ্মন পর ডাক্তার বেড়িয়ে এসে নিশান কে বলল,

— কনগ্রেস ইয়াং বয়। তোমার ছেলে হয়েছে। মা ও সন্তান দুজনেই ঠিক আছে। কিছুহ্মন পর কেবিনে দেওয়া হবে দেখা করিও৷ আর কাঁদা লাগবে না৷

কথা গুলো বলে ডক্টর চলে গেল। আর নিশানের কোল থেকে বাচ্চাকে বাকিরা কোলে নিলো। কিছুহ্মন পর মনিকা কে কেবিনে দেওয়া হলো। তারপর এঁকে এঁকে সবাই দেখা করল। সবার শেষে মনিকা দেখতে গেল নিশান। ছলছল চোখে মমিকার কাছে বসে ডান হাতে মাথা ঠেকিয়ে কান্না বিজরীত কন্ঠে বলতে লাগল,

— খুব কষ্ট হয়েছে না তোমার? আর কষ্ট করতে হবে না৷ আমি তো এসে পড়েছি। জানো নিবিড় যখন বলেছিলো তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে আর ফোনের ওপর পাশে তোমার চিৎকারের আওয়াজ পাই তখন মনে হচ্ছিল আমার কলিজা টাই কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। আর দূরে যাবো না আমি তোমার থেকে। আমরা এক সাথে খুব হাসিখুশি ভাবে থাকব। কোনো দুঃখ আমাদের ছুতে পারবে না৷

নিশানের কথায় নিরব ভাবে হাসছে মনিকা। এরা হয়ত জানে না দুঃখের ভয়াল থাবা নরক করতে আসছে তাদের জীবনে।

???

চেম্বারে বসে ব্যস্ত হয়ে একের পর এক রোগী দেখছেন আফ্রাম। দরজার বাহিরেই ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে আফিম। আফ্রাম খান আর আফিম খান চার বছরের ছোট বড়। আফ্রাম পেশায় কার্ডিওলজিস্ট ডক্টর আর আফিম লো নিয়ে পড়ছে। ঢাকা শহরের ছোট্ট একটা নিজস্ব বাড়ি তেই বাবা-মা কে নিয়ে থাকছে আফ্রাম।

বেশ কিছুহ্মন পর আফ্রাম বের হতেই বাচ্চাদের মতো আফ্রামের হাত ধরে হাটতে লাগল আফিম। বয়সে বড় হলেও কিছু কিছু স্বভাব এখনো বাচ্চাদের মতোই রয়ে গেছে আফিমের। যেমনঃ আফ্রামের হাত ধরে হাটা, আফ্রামের নতুন সব জামাকাপড় আফিম একবার ট্রায় করে তারপর আফ্রাম কে দিবে, মাঝে মাঝে বাচ্চাদের মতো ভাইয়ের হাতে খাবে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ঘুমাবে, নিজের ফোন থাকা স্বও্বেও আফ্রামের ফোনে গেম নামিয়ে তারপর খেলে আফিম। এইস্বভাব গুলোর জন্য ই আফিম আর আফ্রাম দু জন সবার প্রিয়। আফ্রাম অনেকটা শান্ত শিষ্ট জেন্টলম্যান হলেও আফিম দুষ্ট প্রচুর৷

আফ্রামের হাত ধরে গাড়ি পর্যন্ত এসে হাত ছেড়ে গাড়ি উঠে বসল দুই ভাই৷ আফ্রাম নিজের ফোন আফিমের দিকে বাড়িয়ে দিল আফিম খুশি মনে ফোনে গেম খেলতে লাগল আর আফ্রাম আপনমনে গাড়ি চালিয়ে রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রতিদিন দুভাই এক সাথে বাড়িতে আসে এক সাথে বেড় হয়।

চলবে…

#প্রনয়ের_ছন্দ
পর্ব-৩
#আনজুম_তানিশা

০৪.

নিস্তব্ধ রাতের নিরবতার মাঝে মাঝে এক দু বার রাতের অচেনা পাখিরা ডেকে ডেকে উঠছে।জানালার সাদা পর্দাকে স্বচ্ছ কাঁচের উপর মৃদু দুলিয়ে উঠে বাইরে থেকে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করছে হালকা হিমেল হাওয়া।শুধু কি বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেছে!সাথে করে চাঁদের শুভ্র মায়াবী আলোকে টেনে এনে পরিবেশটাকে আরো মোহনীয় বানিয়ে রেখেছে। সারাদিনের হাজারো জল্পনা কল্পনা কে বাস্তব রুপ দেয়ার পরিকল্পনা করে রাতের শেষ আধারে বিছানায় পিঠ লাগালো নূর। চোখে মুখে ক্লান্তি থাকলে ঘুম নেই চোখে। নূর কিছু না ভেবে ফোন বের করে পুরোনো আইডি অন করলো। সাথে সাথেই হাজারো মেসেজে ভরে গেলো তার আইডি। নূর আইডি থেকে নিজের পরিবারের একটা ছবি নামিয়ে দ্রুত আইডি আবার লগ আউট করে ফেলল। নূর চায় না অতীতের পিছুটানে ফিরতে কিন্তু মন তো মানে না।

বাবা মা ভাইদের ছবি দেখে নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেলল নূর৷ কিন্তু নিজের অনুভূতিকে পাওা না দিয়ে ফোন রেখে দিয়ে রেডি হয়ে, সবার আড়ালে বেড়িয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।

???

নিঃস্তব্দ রাতের শেষ আধারে ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় হেটে চলছে আফ্রাম। হাটতে হাটতে পৌছালো সেই স্মৃতি ময় রাস্তায়।পাশ দিয়ো সা সা করে ছুটে চলছে গাড়ি। এই রাস্তায় ই তো চার বছর আগে পেয়েছিল তার প্রেয়সী কে। আবার হারিয়ে ফেলেছে তার প্রেয়সী কে। জানে না এখনও বেঁচে আছে কীনা। শুধু এতটুকুই জানে যি বেঁচে থাকে তার প্রেয়সী তাহলে তাকে কোনোভাবেই আর হারাতে দিবে না। হঠাৎ ই আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসায় ভাবনার জগৎ থেকে বের হলো আফ্রাম। কল রিসিব করল,

— আসসালামু আলাইকুম! কে বলছেন?

অপর পাশ থেকে নারী কন্ঠের মিষ্টি আওয়াজ পেলো আফ্রাম।

— ওয়া আলাইকুম আস্সালাম! আমাকে আপনি চিনবেন না হয়ত, আবার চিনতেও পারেন। আপনি মনে হয় রাস্তায় আছেন। আপনার সাথে কী আমি দেখা করতে পারি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা ছিলো। দেখা করে না বললেই নয়। প্লিজ সাহায্য করুন আমাকে।

নারী কন্ঠের এমন আকুতি নাকোচ করতে পারল না আফ্রাম। আফ্রাম সেই নারী কন্ঠের মানুষটিকে সামনের একটা লেক এ দেখা করতে বলল। আশ্চর্য জনক ব্যাপার হলো আফ্রাম সেই কন্ঠের মুগ্ধতায় এত টাই ডুবে ছিলো যে নাম টাও জিজ্ঞেস করে নি। আফ্রাম নিজেও বিরক্ত নিজের এই কাজে।

০৫.

বেশ কিছুহ্মন পর কালো একটা বাইকে করে ছুটে আসল কেউ। দূর থেকে ছেলে না মেয়ে বুঝা যাচ্ছে না কারন হেলমেট গ্লাব্স পড়া। আস্তে আস্তে মানুষটি আফ্রামের সামনে এসে হেলমেট খুলে ফেলল। সাথে সাথে ল্যাম্পপোষ্টের আবছা আলোয় হিজাব আর মুখোজ এর মাঝে খোলা চোখ দুটো দৃশ্য মান হলো। আফ্রাম চেয়ে রইল চোখ দুটোর পানে। অপর পাশের মেয়েটি আফ্রামকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— দুঃখীত এত রাতে এই আপনার সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু আমিও নিরুপায় তাই এইভাবে দেখা করতে হচ্ছে।

আফ্রাম লেকের পানির দিকে চেয়ে পকেটে হাত দিয়ে বলল,

— বুঝতে পেরেছি আপনার সমস্যা টা প্রচন্ড রকমের গুরুতর। নাহলে এত রাতে কোনো মেয়েই কোনো ছেলের সাথে এমন টা নির্জন জায়গায় দেখা করতে চাইতো না।

অপরপাশের মেয়েটি বলতে লাগল,

— জানি না আপনার মনে আছে কীনা তবুও একটু মনে করার চেষ্টা করবেন। গত চার বছর পূর্বে একটা মেয়েকে রক্তাক্ত অবস্থায় আপনি হসপিটালে নিয়ে যান। আর তারপর তাকে তার ভাই-ভাবী সিঙ্গাপুর নিয়ে যায়।

মেয়েটির কথায় বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল আফ্রাম। আফ্রাম উৎফুল্ল হয়ে বলল,

— আচ্ছা আপনি কী জানেন পরিনিতা কেমন আছে? আপনি কীভাবে এইসব জানেন?

মেয়েটি হেসে নিজের মুখোশ খুলে বলল,

— আমিই সেই পরিনিতা অরফে নূর।

নূরের কথায় আকাশ থেকে পড়ল আফ্রাম। অনেকটা বড় বড় করে চেয়ে রইল নূরের দিকে। নূর আফ্রামের এমন বোকা বোকা চাহনী দেখে মুচকী হেসে বলল,

— আপনি হয়ত আমায় আশা করেন নি। যাই হোক আপনিই এখন আমার সবচেয়ে বড় প্রমান। প্লিজ সাহায্য করুন আমাকে।

আফ্রাম নিজের বিস্ময় কাটিয়ে বলল,

— বল কী সাহায্য চাই তোমার?

নূর বলল,

— গত চার বছর আগে আপনি কোথায় কীভাবে, কী অবস্থায় আমাকে পেয়েছিলেন। আর ভাই ভাবী কীভাবে আমাকে পায়। A টু Z সব বলুন আমাকে।

আফ্রাম কিছুহ্মন চুপ থেকে বলতে লাগল,

— গত চার বছর আগে মাঝ রাতে হসপিটালের ডিউটি শেষ করে বাড়ি যাওয়ার সময়, এই লেক থেকে কিছুটা সামনে একটা পিলার আর ইলেকট্রিক খাম্বা আছে সেখানেই রক্তাক্ত অবস্থায় পাই আপনাকে। আপনার সাথে আমি কোনো ফোন অথবা ব্যাগ বা আইডি কার্ড পাই নি। তারপর আপনাকে গাড়িতে উঠিয়ে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর, আপনার কোনো আত্নীয় স্বজনকে খবর না দিতে পেরে আমি আপনার গার্ডিয়ান হয়ে যাই। তারপর ভোর বেলা এক দম্পতি এসে আপনাকে তাদের বোন দাবি করেন। তারপর আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম ওনারা কিভাবে আপনার খোজ পায়? তখন ওনারা বললেন এই হসপিটালের একজন নার্স নাকি ওনারদের পরিচিত। সেই ই বলেছেন৷ এর পর দুদিন আপনাকে নিয়ে আমাদের হসপিটালে থেকে আপনাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যায় তারা।কোনো পুলিশি ঝামেলা না হওয়ায় আপনারা খুব দ্রুত হাসপিটাল ত্যাগ করতে পারেন কিন্তু সত্য বলতে আপনার অবস্থা এতটাও খারাপ ছিলো না যে আপনাকে সিঙ্গাপুর নিতে হবে। বরং আপনার ঙ্গান ও ফিরেছিল।

কথা গুলো শুনে নূর চুপ করে রইল। আফ্রাম আবার বলল,

— দেখুন একটা কথা বলতে চাই। জানি না আপনি মাইন্ড করবেন কিনা!

নূর ইশারায় বলতে৷ বলল,

— আপনি হঠাৎ এইসব কেন জিজ্ঞেস করছেন। আর কেন সামান্য এইটুকু জানতে আপনি গভীর রাতে ছুটে এসেছেন জানতে পারি? ভরসা রাখতে পারেন।

নূর চুপ করে রইল৷ নূর অনেক ভেবে বলতে লাগল। নূর জানে এমন রহস্যের সন্ধান করতে সে একা থাকতে পারবে না। কারো সাহায্য লাগবে। অতীতের মানুষগুলো কে ভরসা করতে ইচ্ছে হয় না। তাই এই মানুষটা কে একটু ভরসা করলো৷

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here