জীবনসঙ্গী_১
ছামিনা_বেগম
সাত সকালে বাবার চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেল আদিলার, কিন্তু তবুও বাইরে বেরুলো না সে । এটা বরকত ভিলাতে নিত্যদিনের ঘটনা ।আজ ও তার ব্যতিক্রম হয়নি ।আদিলা ভাবছে আজ আবার কি নিয়ে শুরু ঝগড়া বাধাল দুজনে ? দুজনে বলতে আদিলার বাবা-মা। ওর বাবা রোজ ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে ওর মায়ের সাথে এবং বেশির ভাগ দিনেই ঝগড়ার বিষয় থাকে আদিলার বিয়ে আর আদিলার ভাই সায়নকে নিয়ে । যে সায়ন কেন দোকানে বসে তাকে সাহায্য করছে না।
আদিলার পুরো নাম আদিলা আহমেদ । শ্যামবর্ণী, টানা টানা চোখ ,তীক্ষ্ণ নাক এবং পাতলা অথচ কোমর অবধি সোজা লম্বা চুল সমেত বেশ মানানসই চেহারা।দোষের মধ্যে শুধু রোগা পাতলা শরীরের জন্য লম্বা টা একটু বেশি মনে হয়। আদিলা এবার এম.এ দ্বিতীয় বর্ষের ইতিহাসের ছাত্রী । সে ফাস্ট ক্লাস নিয়ে গ্ৰাজুয়েশন পাশ করেছে ।ও বরাবরই খুব ভালো ছাত্রী ।
আদিলাদের একতলা “বরকত ভিলা” ওর দাদুর তৈরী । ওর দাদু ওখানকার মস্ত আড়তদার ছিলেন । আদিলার বাবার আর কোনো ভাই বোন না থাকার জন্য “বরকত ভিলা” আর ভাগ করতে হয়নি।কিন্তু দাদুর ব্যবসা ওর বাবা ধরে রাখতে পারেননি অতিরিক্ত ব্যয়বিলাসি হওয়ার কারণে।ওর বাবা আরাফাত আহমেদ এখন একটি মুদির দোকানের মালিক। সংসারের ইনকামের উৎস বলতে এই দোকানটিই একমাত্র ভরসা।
আদিলার ভাই সায়ন এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে । সেও পড়াশোনাতে খুব ভালো, ক্লাসের ফাস্ট বয় । আদিলারা তিন ভাই বোন, বড়ো দাদা সাকিব পেশায় ডাক্তার । দাদুর স্বপ্ন ছিল বড় নাতিকে তিনি ডাক্তার বানাবেন।সেই মতো তিনি বেচে থাকতে সাকিব এর পড়াশোনার সমস্ত খরচ দেন এবং সাকিব এম.বি.বি.এস শেষ করে হাওড়া জেলাতে জয়েন করেছে । সাকিব এর চাকরির সাত মাসের মধ্যে দাদু স্ট্রোক করেন আর হাসপাতাল যাওয়ার পথেই ইন্তেকাল করেন ।
আদিলারা তিন ভাই বোনের মধ্যে খুব মিল থাকলেও সাকিবের স্ত্রী ফারিহার জন্য সাকিবের ইচ্ছে থাকলেও পরিবারের জন্য বেশি কিছু করতে পারে না। ফারিহা শহরের মেয়ে তাই সে গ্ৰামে আসতে চায় না ।সাকিব মাঝে মাঝেই ছেলে রহিদকে নিয়ে বেড়াতে আসে ।
অনেক দিন থেকেই আরাফাত সাহেব আদিলার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। ” আরাফাত সাহেব আপনার মেয়ে আদিলার বয়সি সব মেয়ে শশুর বাড়ীতে দিব্যি সংসার সামলাচ্ছে ,তা ওর কবে বিয়ে দেবেন “, ” আপনার মেয়ের বয়স তো দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে মশাই “, “মেয়ে মানুষ কে এত পড়িয়ে কি হবে ,শেষে তো গিয়ে ওই হাতা খুন্তি ধরতে হবে ,শুধু শুধু এত টাকা খরচ করে কি লাভ ” এই রকম হাজারো কথা শুনে অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন । আরাফাত সাহেব তাই এবার কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন যে ভাবেই হোক মেয়ের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হবেন ।কিন্তু বিয়ে দেব বললেই তো বিয়ে হয়ে যায় না । লোক দেখতে আসে আদিলা কে , ইচ্ছে না থাকলেও প্রত্যেক বার সেজেগুজে তাদের সামনে যেতে হয় তাকে । কিন্তু প্রতি বার একি উওর আসে ” গায়ের রঙ টা যদি আর একটু উজ্জ্বল হত তাছাড়াও এত হ্যাংলা পাতলা মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে খাবে কি করে ? ”
এই তো সেদিনের কথা আদিলাকে পাএ পক্ষ দেখতে এসে ছিল । ছেলের বাড়ির লোকজন আদিলা ক জিজ্ঞেস করল …..” তুমি নিজের বাড়ির ঠিকানা লিখতে পারো , লিখে দেখাও তো ।” এই কথা শুনে তো আদিলার প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিল আবার রাগ ও হচ্ছিল ।কিন্তু বেচারি বাবার সম্মান নষ্টের ভয়ে কোনো অনূভুতি প্রকাশ করতে পারল না । কি আর করা ? লিখে দিল ঠিকানা আর ভাবতে লাগল আশ্চর্য একজন এম.এ পড়া মেয়েকে কেউ কিভাবে জিজ্ঞেস করে যে ,সে নিজের ঠিকানা লিখতে পারে কীনা ? যাইহোক আদিলা কে পছন্দ করলেও আদিলাদের বাড়ি থেকে মানা করে দেওয়া হয়।
প্রকৃতির নিয়মে আদিলা মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ায় একসময় ও নিজেও আর পাচঁ টা মেয়ের মতোই স্বপ্ন দেখতো ওর বিয়ে হবে ,নিজের সংসার হবে ,ওর জীবনসাথিকে খুব ভালো বাসবে।কিন্তু এখন আর সেই স্বপ্ন গুলো আর দেখে না। এটুকু বয়সেই ও অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে । রোজ বাবা মায়ের ঝগড়া, পাশের বাড়ির দাদা-বৌদি,কাকা-কাকির নিত্য দিনের ঝগড়া-মারামারি , স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির আগমনে সংসারে অশান্তি….এসব দেখতে দেখতে সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাস উঠে গেছে। আদিলা ঠিক করে ফেলেছে ও কখনও বিয়ে করবে না ।কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে গেলে আগে একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে। কিন্তু যতদিন না কোনো চাকরি পাচ্ছে ততদিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেজে গুজে পাত্রপক্ষের সামনে বসতেই হবে।
দুদিন পর আদিলার খালাতো বোন মাহির বিয়ে । তাই আজ সকাল সকাল আদিলা প্যাকিং শুরু করেছে। ও ,ওর মা আর ওর ভাই সায়ন আজ যাবে এবং ওর বাবা বিয়ের দিন যাবে । এমনিতে আদিলা বিয়ের অনুষ্ঠান গুলোতে যেতে চায় না কারণ এই অনুষ্ঠান গুলিতে আদিলাকে দেখলেই সবার আলোচনা আদিলার বিয়েতে গিয়ে শেষ হয় । আর নানা জনের নানা কথায় বাবা মা খুব কষ্ট পায়। কিন্তু এবার তো যেতেই হবে । মাহির বিয়ে কথা।ওরা দুটিতে খুব মিল । ওরা যখনই নানু বাড়িতে যেত ফোনে যোগাযোগ করে একি সময় যেত যাতে ওরা একসঙ্গে প্রচুর সময় কাটাতে পারে ।মাহি আদিলার থেকে তিন বছরের বড় ।আদিলার খালার বাড়ি রায়গঞ্জে। প্রায় চার পাঁচ ঘন্টার রাস্তা । ওরা এগারোটার ট্রেনে যাবে ঠিক করেছে। তাই এত ব্যস্ততা । প্যাকিং, খাওয়া দাওয়া সেড়ে সাড়ে দশটার মধ্যে স্টেশনে পৌছাতে হবে ।
ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় , তবুও শীত যেন এবার বিদায় নিতে চায় না। ভাগ্য ক্রমে ওরা ট্রেনে জানালার পাশে সিট পেয়ে যায়। আদিলার ছোট বেলার অভ্যাস ট্রেনে উঠলেই ফাস্টফুড খেতে খেতে জানালা দিয়ে বাইরের চলমান দৃশ্য দেখা । এই কাজটা করতে ওর খুব ভালো লাগে। কিন্তু আজ ট্রেনে ওঠার আগে উত্তেজনার বশে ফাস্টফুড কেনার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। কি আর করার ? পরের স্টেশন না আসা অবধি কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে লাগল।
প্রায় আধ ঘণ্টা পর ট্রেন আলিপুরদুয়ার জংশন এ থামলে মা-কে বলে আদিলা কিছু খাবার কিনতে নেমে পরল। কেনা হয়ে গেলে ফিরে আসার সময় প্লাটফর্মের গেট দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা একটি ছেলের সাথে ধাক্কা লেগে গেল তার।ফলস্বরূপ নিজে তো পড়লই, সাথে ফাস্টফুডের প্যাকেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল প্লাটফর্মের মেঝেতে । কিন্তু ধাক্কা লাগার পরেও ছেলেটি কিছু না বলেই ট্রেন ধরতে ছুটে চলে যায়।ওই টুকু সময়ের মধ্যেই আদিলা দেখে নেয় ছেলেটির বয়স আন্দাজ ছাব্বিশ কি সাতাশ হবে, ফর্সা গায়ের রঙ , মুখে চাপ দাড়ি সুন্দর করে ছাটা। ভীষণ মন খারাপ হয় আদিলার । এত বেয়াদব কেন ছেলেটা ? রাগে ওর কান লাল হয়ে যায় । কিন্তু ট্রেন মিস হয়ে যাবার ভয়ে বেশি কিছু না ভেবেই ফাস্টফুডের প্যাকেট গুলো তুলে ছুটে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে। দেরি হওয়ার জন্য মা অবশ্য একটু বকে দেয় আদিলাকে। কিন্তু আদিলা ওর মাকে প্লাটফর্মের ঘটনাটি বলে না । শুধু শুধু অস্থির হবেন তাহলে। আদিলা সায়নের হাত থেকে চিপসটা নিয়ে মুখে পুরে । সায়ন রে রে করে ওঠে ,
-“আপুউউউ , তোর কাছেও তো আছে ! ”
-কিন্তু তোর হাতের টা বেশি মজার …” বলেই মুচকি হাসে আদিলা । সায়ন বেজার মুখে তাকায় । আদিলা চোখ ফিরিয়ে চলন্ত ট্রেনের বাইরে তাকায় । মনে হচ্ছে যেন সে থমকে আছে এক জায়গায় । আর সমস্ত সৃষ্টি প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলেছে আবহমান কাল ধরে । ইয়ারফোনে তখন একটা শ্রেয়া ঘোষালের একটা রোমান্টিক গান বেজে চলেছে । কিন্তু আদিলার ভাবনঘরে এখনও প্লাটফর্মের ওই ক্ষনিকের মুহুর্ত ভীষণ রকম ঝামেলা করছে । না চাইতেও বিরক্তি এসে ভর করছে বারবার । মনে মনে একটু অসন্তোষ ও প্রকাশ করে ফেলল সে । আজব লোক তো! কতটা ইররেসপনসিবল হলে কেউ এরকম আচরণ করে ! নিজের ভুলের জন্য সরি তো বললই না । উলটো ডোন্ট কেয়ার ভাব মেরে চলতে গেল । আমি ট্রেন টা মিস করে ফেলতাম ! তাহলে কি হত ? বেয়াদব লোক একটা , আর যেন কখনও দেখা না হয় ! ”
To be continue………