জীবনসঙ্গী_৫
Chhamina_Begam
রাস্তায় বের হয়ে দশ মিনিটের মধ্যেই রাহাত বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলে আদিলা শক্ত করে রাহাদের কাধ খাঁমচে ধরে। এতে রাহাত একটু ব্যাথা পায় বটে তবে লুকিং গ্লাসে আদিলার ভীতু মুখটা দেখে মুচকি হাসে । রাহাতের এই আচরণে খুব বিরক্ত হয় আদিলা । না পেরে বলেই ফেলে
-“আপনি এত স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছেন কেন ? আস্তে চালান না,”
-” কেন ? কোন সমস্যা আছে ? তোমার ভয় করছে নাকি ?”
-“না ভয় নয় ,আমার চিন্তা হচ্ছে ”
-“চিন্তা ? .কেন ? ”
– “দেখুন , এটা গ্রামের রাস্তা । শহরের মতো এখানকার বাচ্চারা চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থাকে না । তারা যখন তখন রাস্তায় খেলতে বেরিয়ে আসে । তাছাড়া কুকুর ,ছাগল ,মুরগি হঠাৎ করে যদি বাইকের সামনে চলে আসে ভালো-মন্দ কিছু একটা হয়ে যেতে পারে ।আর তাছাড়াও এত স্পিডে চালানোর জন্য আমার চুলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে..”
শেষের কথাটা মুখ ভার করে বলে আদিলা । তা দেখে খুব হাসি পায় রাহাতের । তবে সে হাসি চাপার চেষ্টা করে । আদিলা আবার বলে,
-” আমি আসার পথে পাঞ্চ ক্লিপ আনতেও ভুলে গেছি । বাড়ি গিয়ে চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে তো আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে । প্লিজ ,একটু আস্তে চালান ”
– “আচ্ছা ম্যাডাম ঠিক আছে । এত জ্ঞান দিতে হবে না । আমি আস্তে চালাচ্ছি”
রাহাত বাইকের স্পিড কমিয়ে দেয় । যেতে যেতে অনেক কথা হয় রাহাত আর আদিলার ।
-” আচ্ছা আদিলা , তোমাদের বাড়ি তো কোচবিহারে তাই না? ”
-” হ্যাঁ । কিন্তু কোচবিহার শহরে নয়, আমাদের বাড়ি গ্রামে ।”
” ওহ। তুমি পড়াশোনা করো ? ”
-” হ্যাঁ, মাস্টার্স করছি । ”
-” ও আচ্ছা । এবার বুঝলাম । এই জন্যই তুমি এত জ্ঞান দিচ্ছ আমাকে। তাই না ? ”
-” মানে বুঝলাম না । কি বলতে চাইছেন আপনি ? ”
-“বলছি, হয়তো টিচার বা প্রফেসর এমন কিছু হতে চাও ।তাই তাদের মত লেকচার শোনাচ্ছো আমাকেও ” মুচকি হেসে বলল রাহাত ।
-” কিন্তু আমি তো ভুল কিছু বলিনি। ”
-” হ্যাঁ ভুল বলনি ….”
আদিলার মনে হল রাহাতের সমর্থনে কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই ওর হৃদয়ে খুশির প্লাবন বয়ে গেল । আচ্ছা এমন কেন হচ্ছে ওর সাথে ? এমনটা কি সবার সাথেই হয় ? নাকি ওই বেশি ভাবছে? এই যে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের বাইকের পেছনে বসে সে নিশ্চিন্ত হয়ে সফর করছে তাতেও একটুও অস্বস্তি হচ্ছে না কেন ? নিজের চিন্তা ভাবনায় নিজেই বিস্মিত হয় আদিলা । আপাতত মস্তিষ্ককে ডাইভার্ট করতে প্রশ্ন করে ,
-” আচ্ছা আপনার বাড়িতে কে কে আছে ?”
-“আব্বু, আম্মু আর আমার ছোটবোন তিতলি আর আমি । ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’ তাই না ?
স্লোগানটা শুনে নিঃশব্দে হাসে আদিলা । বাইক ততক্ষণে পাকা সড়কে উঠে পড়েছে । পাকা রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত, খোলা জমির দিকে তাকিয়ে থাকে আদিলা । ওর খোলা চুল বড়োই অবাধ্যতা করতে । বাঁ হাতে প্রানপনে সেগুলো কে সামলে রাখতে ব্যস্ত আদিলা । লুকিং গ্লাসে ওকে দেখে রাহাতের হৃদয়ে প্রশান্তি নেমে আসে । আজ এই অন্যরকম লুকোচুরি খেলা বেশ লাগছে ওর ।
কসমেটিকের দোকান গুলো ভীড়ে ঠাসা এখন । বিয়ের সিজন চলছে কি না । দোকান গুলোয় ঢুকতে বেশ কসরত করতে হচ্ছে । আদিলা দোকানদারকে লিস্টটা দিয়ে বলল ,
-” দাদা এই সব জিনিস দিয়ে দিন।”
বাইক পার্ক করে রাহাত ও তখন পাশে এসে দাড়িয়েছে । দোকানের সেলস গার্লরা তখন খরিদ্দারদের চাহিদা সম্মত জিনিস দেখাতে ব্যস্ত । আদিলা তখন কয়েক জোড়া ঝুমকো দেখছে । চারিদিকে মৃদু গুঞ্জন উঠেছে । পাশেই কয়েকজন মহিলা খরিদ্দার অস্বস্তি নিয়ে আশপাশ দেখছে । রাহাত সচকিত হয় । দেখে একজন বয়স্ক ব্যক্তি এপাশ ওপাশ হাটাহাটি করে জিনিস দেখার করার ভান করে মহিলাদের শরীরে হাত চালিয়ে দিচ্ছে । রাগে চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায় রাহাতের । লোকটি তখন বেরিয়ে যেতে উদ্যত । রাহাত আদিলাকে আড়াল করে দাড়ায় । আদিলা চমকে ওঠে । চোখ ঘুরিয়ে দেখে রাহাতের হাতের বেষ্টনীর মাঝে আছে সে । চারপাশে তাকিয়ে দেখে একজন মধ্যবয়সি ব্যক্তি বেরিয়ে যাওয়ার নাম করে মহিলাদের গা ঘেঁষে চলেছে । তাই রাহাতের এমন আচরণের কারন বুঝতে দেরি হয় না ওর । ভালোলাগায় নিজের ভিতরটা কেমন থইথই করে ওঠে ওর ।
দোকানদার লিস্ট অনুযায়ী সমস্ত জিনিস একটা পলিথিনে ভরে হিসেব করে একটা বিল ধরিয়ে দিল আদিলাকে । আদিলা দেখল জিনিসের দাম মোট তিন হাজার দুশোশো টাকা হয়েছে । ও পার্স খুলে দেখে সেখানে শুধু তিন হাজার টাকাই আছে । আদিলা নিজের জন্য পছন্দ করা ঝুমকো গুলো বাদ দিতে বলে । আদিলার কথা মতো ঝুমকো বাদে দোকানদার দু হাজার নয়শো টার হিসাব ধরিয়ে দেয় । আদিলা বিল পরিশোধ করে রাহাতের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে । মানে হয় গেছে ওর কেনাকাটা ।
রাহাত এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল । আদিলাকে বলে ,
– ” তুমি বাইকের কাছে গিয়ে দাঁড়াও। আমি আসছি এক্ষুনি। ”
-” আচ্ছা ”
বাড়ি পৌছতে পৌছতে ওদের চারটা বেজে যায় ।বাড়ির দরজার সামনে বাইক থামালে আদিলা বাড়ির ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় ।তখনি রাহাত পিছন থেকে হাক দেয়,
– ” আদিলা একটু দাঁড়াও ”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে দাড়ায় আদিলা।
রাহাত বাইকের টুল বক্স থেকে একটা প্যাকেট বের করে আদিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে ,
-” ধরো । এটা তোমার ”
আদিলা দ্বিধায় পড়ে যায় । কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে ,
-“কি আছে এতে ? ”
-“দেখে নিও । ” বলেই বাড়ির ভেতরে চলে যায় রাহাত । আদিলা স্থানুর মতো দাড়িয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত । ওর কি এটা নেওয়া উচিত ? ধন্দে পড়ে যায় সে । প্যাকেট খুলে কানের ঝুমকো গুলো দেখে অবাক হয়ে যায় । এগুলো তো সেই ঝুমকো গুলো যেগুলো ও টাকা কম থাকায় দোকানে ফেরত দিয়ে এসেছিল ।
ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে আদিলা ওর মাকে ডেকে জানিয়ে দেয় যে সে এসে গেছে । ও দেখতে পায় ওর মা , ওর আব্বু , খালু তখন গল্প করছে ড্রয়িং রুমে । আদিলা ওর আব্বুকে জিজ্ঞেস করে,
– ” আব্বু কখন এসেছ তুমি ? ”
-“এই তো কিছুক্ষণ আগে ”
-” ও আচ্ছা । তোমরা গল্প কর । আমি আপুর সঙ্গে দেখা করে আসি ” বলেই উপরে চলে যায় সে । মাহিকে গিয়ে বলে সব জিনিস দেখে নেওয়ার জন্য ।
মাহি কসমেটিকস গুলো নাড়াচাড়া করে দেখতে নিলে আদিলা জিজ্ঞেস করে ,
-“আচ্ছা আপু, মিতু আপুকে কি ফাহিম ভাইয়া তোর বিয়ের কথা বলেছে ? ”
-” জানি না রে । আমি তো ভাইয়াকে বলেছিলাম আপুকে নিয়ে আসতে । কিন্তু ভাইয়া মানা করে দিয়েছে । বলল মিতু আপু আসলে প্রবলেম হতে পারে ”
– ” ও আচ্ছা । আপু তুই ততক্ষণে এইগুলো দেখ আমি একটু ফাহিম ভাইয়ার কাছ থেকে আসি ”
– “আচ্ছা যা ”
আদিলা ফাহিমের রুমে গিয়ে দেখে ফাহিম ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে । বাথরুম থেকে জল পরার আওয়াজ আসছে । ও চুপিচুপি ফাহিমের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় ।আদিলার ফাহিমের কথা শুনে মনে হল কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে ।তাই ও ফাহিমের পিঠে একটা খোঁচা মারে । ফাহিম চমকে পিছন ফিরে দেখে বলে,
– ” আদি তুই? আমি তো চমকে উঠেছিলাম । ভাবলাম কে না কে এসে গেল ।”
-” কার সঙ্গে কথা বলছিস ভাইয়া ”
-” তোর সঙ্গে মিতু আপুর সঙ্গে ”
– ” মিতু আপু ? আমাকে এতক্ষণ বলনি কেন? দাও দাও ”
আদিলা ফাহিমের কাছ থেকে ফোনটা প্রায় ছিনিয়ে নেয় ।ফোনের স্পিকার লাউড করে দিয়ে বলে,
– ” আপু কেমন আছো তুমি? ”
-” আমি ভালো আছি । কিন্তু তোমাকে তো চিনলাম না ”
-“গেস করো ”
“উমমমম, আদিলা রাইট ?”
হেসে দেয় আদিলা । মিতু উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,
-“কেমন আছো তুমি ? ”
-“আলহামদুলিল্লাহ । আমি ভালো আছি । আপু, তোমাকে ভাইয়া মাহি আপুর বিয়ের কথা বলেনি? ”
– ” হ্যাঁ বলেছে তো..”
-” তাহলে তুমি আসলে না কেন ? ”
-” আমি ? আমি সেখানে কি করে যাই বলো তো ? সবাই আমাকে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করবে । কে আমি ? কার আত্মীয় ? এসব । তখন আমি কি জবাব দেব ? ”
– ” হুম, তাও ঠিক । আচ্ছা আপু ,তুমি এখন কোথায় থাকো ? ”
– “আমি এখন রায়গঞ্জেই ভাড়া বাড়িতে থাকি । এখানে একটি গার্লস হাই স্কুলে জব করছি ।”
-“তুমি রায়গঞ্জে আছো! ” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে আদিলা । তৎক্ষণাৎ কিছু একটা ভেবে বলে ,
– “আপু , তুমি এক কাজ করো তো । আধঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে জামাকাপড় নিয়ে এক্ষুনি গাড়িতে বসে যাও। এখানে চলে এসো ”
-” কি! তুমি পাগল হয়ে গেছ নাকি ! কিন্তু আমি কিভাবে ?”
মিতুর কথা শেষ হয় না। আদিলা আবার বলে ,
-” তা নিয়ে তোমাকে টেনশন করতে হবে না । আমি আছি তো । সব সামলে নেব । কাকে কি বলতে হবে? আমি বলে দেবো । তুমি শুধু তাড়াতাড়ি চলে এসো । বুঝেছ ? ”
-” হ্যাঁ সে তো বুঝলাম । কিন্তু ?
-“কোনো কিন্তু নয় । তুমি আসবে । ব্যাস এটাই ফাইনাল । ”
আদিলার জেদি , একরোখা কন্ঠস্বরে চিন্তার মধ্যেও হেসে ফেলে মিতু । বলে,
-” আচ্ছা ঠিক আছে । কিন্তু ফাহিমও কি একমত ? ”
এতক্ষণ ফাহিম স্তব্ধ হয়ে দেখছিল আদিলার কান্ড। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,
– ” হ্যাঁ । আদি যদি সব সামলে নেয় তাহলে আর টেনশন করে লাভ নেই । তুমি গাড়িতে করে এসে চৌরাস্তার মোড়ে নেমে পড়ো । আমি তোমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসবো ”
– ” আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তাহলে রেডি হয়ে নেই ”
-“হুম ”
মিতু ফোন রেখে দেয় ।
ফাহিম বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আছে । তার কিছু মাথাতেই আসছে না ।এদিকে রাহাত আর মাহি কখন রুমে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা কেউ খেয়ালই করেনি । ফাহিম নিজেকে সামলে নিয়ে আদিলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– ” আদি, কি করলি এটা তুই ? ও এখানে এলে আমি কি বলে পরিচয় দেবো ?আল্লাহ আব্বু আজ আমাকে কেটে ফেলবে , ”
-“ভাইয়া ! কি যে যা তা বলো না ।!বি আ ম্যান ,ওকে । নিজের আব্বুর সামনে যদি নিজের পছন্দের কথা নাই বলতে পারো তাহলে তোমার প্রেম করা উচিত হয়নি ।”
-“চুপ কর পাকা বুড়ি । আব্বুর সামনে পড়লে ঝাড় টা তো আমাকে খেতে হবে । সেটা তো বুঝছিস না ”
-“আহঃ ভাইয়া !একটু রিল্যাক্স কর তো তুই। আর কত দিন এভাবে চুপিচুপি কথা বলবি ? কত্তো দিন তো হয়ে গেল ! এবার তো একটা সিদ্ধান্তে আয় । তোর জন্য বেচারি আপুও ঝুলে আছে । ”
অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকাল ফাহিম । মাহি , রাহাত মুখ টিপে হাসছে । আদিলার একটু মায়া হলো বোধহয় । নরম স্বরে বলল,
-“ভাইয়া , তুই একদম চিন্তা করিস না । তুই শুধু আমার হ্যা তে হ্যাঁ মেলাবি । বুঝলি ? বাকিটা আমি সামলে নেব ”
আদিলার আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে একটু যেন সাহস পায় ফাহিম ।মাহি এতক্ষণে বলে ওঠে,
– ” আমিও ভেবেছিলাম আপুকে আমার বান্ধবীর পরিচয়ে নিয়ে আসব । কিন্তু আমার সব বান্ধবীকে আম্মু-আব্বু সবাই চেনে । তাই আর রিক্স নেইনি। ”
– ” আচ্ছা , তাহলে তোমরা কথা বলো । আমি খালা খালুকে ম্যানেজ করে আসি । আমার বান্ধবী আসছে বলে কথা । যত্ন আত্তির কমতি থাকলে চলবে না কিন্তু । ”
আদিলা ভ্রু নাচিয়ে ফিচেল হেসে মাহিকে নিয়ে বেরিয়ে যায় । রাহাত ফাহিমকে জিজ্ঞেস করল,
– ” ও তোর গার্লফ্রেন্ডের কথা কিভাবে জানে ? ”
-” ও প্রথম থেকেই জানে । মিতুর সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয় তারপরেই আমি আদিলাকে জানিয়েছিলাম । ওরা দুজনে কথা বলে ফোনে ”
– “কিন্তু অতটুকু একটা মেয়ে ? এসব ব্যাপার সামলাতে পারবে তো ? ” রাহাত মনে সংশয় জাগে ।
-” আদি যখন বলেছে তখনো ঠিক সামলে নেবে ” ফাহিমের কন্ঠে আত্মবিশ্বাস ঝিলিক দেয় ।
-“এতটা বিশ্বাস করিস ওকে …”
-“না করে উপায় আছে ! ও যখন কাউকে কথা দেয় সে কথা রাখার জন্য সব কিছু করতে পারে । বুঝলি ? ”
প্রিয় বন্ধুর কন্ঠে আদিলার গুনাগুন শুনে মুগ্ধ হয় রাহাত । ভালোলাগা বাড়ছে মেয়েটার প্রতি । ধীরে ধীরে মনের গোপন প্রকোষ্ঠে আলাদা কিছু অনুভূতির সমাগম ঘটছে প্রতিনিয়ত ।
– ” খালাম্মা , আমার এক বান্ধবী রায়গঞ্জই ভাড়া থাকে । জব করে তো এখানে । তাই । আমি ওকে এখানে আসতে বললাম । ও একটু পরেই গাড়িতে উঠবে । তোমাদের না জানিয়েই ওকে ইনভাইট করে ফেলেছি । সরি হ্যাঁ । তুমি কি খারাপ পেয়েছ ? ”
– ” পাগলি মেয়ে ,এতে খারাপ ভাবার কি আছে ? বিয়ে বাড়িতে এত লোকজন আসছে । ওই একজন বাড়তি এলে কোন ক্ষতি হবে না। তুই সাবধানে আসতে বলিস ওকে ”
-“থ্যাংক ইউ খালাম্মা ” বলেই আদিলা ওর খালার গালে একটা চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে ।
– ” পাগলি একটা! ছাড় । লোকে দেখছে । ”
-“দেখুক গে । আমি আমার খালাম্মাকে আদর করছি । তাতে লোকের কি ?
– “এখন যাআ । আমার একটু কাজ আছে ” আদিলার খালা ঠেলে সরিয়ে দেয় ওকে ।
-“আরে বাবা । যাচ্ছি যাচ্ছি । ”
ফাহিম তখন দুরে দাড়িয়ে লক্ষ্য করছিল ওদের । আদিলা থামস্ আপ দেখিয়ে এগিয়ে যায় । ফাহিম হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ।আদিলাকে জিজ্ঞেস করে ,
– ” কিন্তু তুই হঠাৎ ওকে এখানে নিয়ে আসার জন্য এত জোর করছিস কেন ? ”
-” কেন তুই খুশি হোসনি ? ঠিক আছে, এখনি মানা করে দিচ্ছি আমি । কি বলিস ? দেব? ”
আদিলা মুখ ভার করে বলে । ফাহিম একগাল হেসে বলে,
– ” লক্ষ্ণীটি আমার । খুশি হব না কেন ?আমি তো খুব খুশি । কিন্তু বুঝতে পারছি না তুই ওকে হঠাৎ এখানে নিয়ে আসতে চাচ্ছিস কেন? ”
এবার আদিলা বিজ্ঞের মতো হাত দুটো মুড়ে বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে বলে,
-” দেখ ভাইয়া, তুই এক মাসের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিস ।আজ আপুর বিয়ে ।কাল আপু শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। তোর ছুটির ইতিমধ্যে দশ দিন চলে গেছে । তুই আর আপু দুজনে চলে গেলে এই পুরো বাড়িটা খাঁখাঁ করবে ।তখনই বাড়ির সবাই চাইবে তোর বিয়ে দিয়ে টুকটুকে একটা বউ নিয়ে আসতে । তার জন্য তারা মেয়ে খুঁজতে শুরু করে দেবে । তাই আমি আগেভাগেই আপুকে এখানে নিয়ে আসতে চাচ্ছি । আপু খুব ভালো মেয়ে । দেখবি, সবাই খুব পছন্দ করবে ওকে । ”
-” তুই এতদুর অবধি ভেবে ফেলেছিস ! এই না হল আমার লক্ষ্মী বোন । আর একটা তো সারাদিন শুধু সাজগোজ আর ফোন নিয়েই ব্যস্ত । আমার কথা ভাবার সময় কোথায় তার ? ”
শেষের কথাটা মাহিকে দরজায় দেখে ফোরণ কাটল ফাহিম । মাহির হাসি মুখটা নিমেষেই বাংলার পাঁচ হয়ে গেল ।
-” চলেই তো যাচ্ছি । যেতে যেতে অন্তত আমার নামে ভালো কিছু বল ”
-” উমমম ,খুঁজে পাচ্ছি না কিছু ,,”
-“ভাইয়া !!” মাহির এবার কাদো কাদো হয়ে গেল ।
এতক্ষণ থেকে রাহাত একপাশে দাড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দুই ভাই-বোনের কীর্তিকলাপ দেখছিল । ও আদিলার দায়িত্ববোধ দেখে অবাক হয়ে যায় । আদিলা চলে যেতেই ফাহিমকে বলল,
-” ও কি এমনি ? ”
হাসল ফাহিম । বলল,
– “হ্যাঁ । চিরকালই ওকে এমনই দেখে আসছি । কথা কম বলে ঠিকই কিন্তু সবাইকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারে । দেখলি তো আমার সমস্যার কিভাবে এত সহজ একটা সমাধান দিয়ে দিল ।”
– “হ্যাঁ । দেখছি তো ! তোর বোনটা সত্যি অ্যাডোরেবল”
ফাহিম রাহাতের চোখে মুগ্ধতা দেখতে পায় । চোখ ফিরিয়ে একবার আদিলাকে দেখে । বলে ,
-” রাহাত , একটা সত্যি কথা বলবি ? তুই কি ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছিস ? ”
-” হ্যাঁ । সেরকমই ” বলে রাহাত মুচকি হাসে । ফাহিম রাহাতের কাধেঁ হাত দিয়ে বলে ,
– ” কিন্তু ও সবার কথা ভাবলেও নিজে কখনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না ।”
এরকম একটা কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না রাহাত । ভ্রু সামান্য কুচকে যায় ওর।
– “কেন ?”
-” কারণ ও সম্পর্কগুলোতে খুব ভয় পায় ”
চুপ করে থাকে রাহাত । ফাহিমকে বলতে দেয় ,
-” ছোট বেলা থেকেই খালা খালুকে ,পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশী সবার বাড়িতে নিত্যনতুন ঝগড়া, মারামারি , সম্পর্কের তিক্ততা দেখে ওর মনে সম্পর্ক নিয়ে অনীহা জন্মে গেছে । আমরা অনেক চেষ্টা করেও ওর ধারণা বদলাতে পারিনি ” ফাহিমকে কিছুটা হতাশ দেখায় ।
-” বুঝলাম ” রাহাত একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে ।
-“আচ্ছা তুই বস । আমি গিয়ে মিতুকে নিয়ে আসি। এতক্ষণে পৌছে গেছে হয় তো ? ”
ফাহিম বেরিয়ে যায় । আর জমা রেখে যায় রাহাতের মনে হাজারো আকুতি ।
ফাহিম মিতুকে নিয়ে আসলে আদিলা মিতুর সঙ্গে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয় নিজের বান্ধবী বলে । শান্তশিষ্ট মিতুকে দেখে আদিলার খালা-খালুর খুব পছন্দ হয়ে যায় । ফাহিম আর মিতুকে পাশাপাশি খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল ।সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর মিতুকে নিয়ে উপরে চলে যায় আদিলা । মিতুকে ফ্রেশ হতে বলে বেরিয়ে আসে । ফাহিম আদিলার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে যায় । এরকমটা সত্যিই আশা করেনি ও । বাবা মায়ের চোখে কিছু একটা তো ছিল । যা স্বস্তি দিচ্ছে ওকে ।
পুরো বাড়ি আলো দিয়ে সেজে উঠেছে আজ । আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে আস্তে আস্তে ভরে যাচ্ছে প্রতিটি কোণ ।আদিলা , মেঘনা ,মিতু মিলে মাহিকে খুব সুন্দর করে লাল বেনারসিতে সাজিয়ে তুলেছে। আজ যে মাহিকে সবচেয়ে সুন্দর দেখার দিন । অবশ্য বিয়ের সাজে সব মেয়েকেই সুন্দর দেখায় ।
সাজানো শেষে দুষ্টুমি করে আদিলা বলে , -“মাশাল্লাহ ! জিজু আজকে তোকে দেখে অজ্ঞান না হয়ে যায় । আমার তো বেচারার জন্য চিন্তা হচ্ছে ”
-” ধ্যাত । কি যে বলিস না তুই ,,” মাহি লজ্জারাঙা হয়ে ওঠে । ওকে লজ্জা পেতে দেখে সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে ।
আদিলা আজ একটি ঘিয়ে কালারের মধ্যে লাল সুতোর কাজ করা একটা শাড়ি পড়েছে । সঙ্গে ফুল স্লিভ ব্লাউজ , খোলা চুল ,ডান হাতে চুরি, বাঁ হাতে ঘড়ি । হালকা সাজে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে ।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানের ঝুমকো গুলো দেখে ওর বিকেলের কথা মনে পড়ে যায় । লাল হয়ে যায় ওর গাল দুটো । আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বকে দেখে ধমকে ওঠে ও ,
– “আদিলা, তুই কি পাগল হয়ে গেছিস ,? কি ভাবছিস তুই এসব ? সম্পর্ক , ভালোবাসা এসব তোর জন্য নয় । বুঝেছিস ? ” ।
মেঘনার চোখ রাহাতকে খুঁজছে। আদিলা ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায় । মেঘনাকে এদিক সেদিক উকি দিতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
-” তুই কি কাউকে খুজছিস ? ”
– “আমি ? না না। কাকে খুজব ? আমি তো দেখছি । ডেকোরেশন টা খুব সুন্দর হয়েছে তাই না ? ” মেঘনা প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায় ।
– ” হ্যাঁ ঠিক বলেছিস”
কথা বলতে বলতেই দুজনেরই চোখ সিঁড়ির দিকে পড়ে । দেখে রাহাত আর ফাহিম একসঙ্গে নেমে আসছে নিচে। দুজনেই আজ ফরমাল পোশাক পড়েছে । তবুও দুজনকেই কল্পনার রাজপুত্রদের মতো দেখাচ্ছে । মেঘনা হাঁ করে রাহাতের দিকে তাকিয়ে থাকে । আদিলা রাহাতকে এক নজর দেখেই চোখ নামিয়ে নেয় । বেশি সুন্দর জিনিস অনেক সময় নিয়ে দেখতে নেই । যদি নজর লেগে যায় । পাশেই মিতু ছিল । আদিলা বলল,
– ” সাবধান আপু। ফাহিম ভাইয়াকে কিন্তু আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে । চোখে চোখে রাখবে বুঝলে । দেখো আবার আজ তোমার কোন সতিন না এসে হাজির হয় ! ”
– ” আদিলা ,,, তুমি কিন্তু খুব দুষ্টু হয়ে গেছ আজকাল ” বলেই মিতু মৃদু কিল বসিয়ে দেয় আদিলার হাতে ।
নিচে নেমে এসে রাহাত ,ফাহিম দুজনেই এদিক ওদিক কাউকে খুজছে । এত লোকের ভীরে কাঙ্খিত মানুষ টিকে না পেয়ে হতাশই হল একটু । আদিলা হাত নেড়ে ফাহিমকে ডেকে উঠল , “ভাইয়া এদিকে ” ।ফাহিম দেখে আদিলা আর মিতু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে । মিতুকে দেখে ফাহিম মৃদু হাসে। গোল্ডেন কাজ করা নীল শাড়িতে মিতুকে আজ অপরূপা লাগছে ।
– “ভাইয়া এভাবে দেখো না গো আমার আপুটাকে । নইলে কিন্তু আমাকে আপুকে কালো টিপ পড়িয়ে দিতে হবে ”
আদিলার কথা শুনে ফাহিম মিতু দুজনেই লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নেয় ।
ভীড় এড়িয়ে এক কোনায় দাড়িয়ে আদিলাকে দেখছে রাহাত । সত্যি বলতে রাহাত ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ হচ্ছে । এই এখন যেমন শাড়ি পরা আদিলাকে দেখে থাকতে ভালো লাগছে ওর । ইচ্ছে করছে সময়ের কাটাকে এখানেই থামিয়ে দিতে । থমকে যাক সময় । এভাবেই রাহাত অনন্তকাল দেখে যেতে চায় ওর মানসপ্রিয়াকে । তবুও হয়তো এই চোখের তৃষ্ণা মিটবে না । এটাকে কি ভালোবাসা বলে ? যদি হ্যাঁ , তবে হ্যাঁ ভালোবাসে রাহাত আদিলাকে । এই ধ্রুব সত্যিটা উপলব্ধি করে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায় । শরীরের প্রতিটি শিরায় উপশিরায় এক শিরশিরে উষ্ন স্রোত বয়ে যায় যেন । তখনই চোখে চোখে পড়ে যায় । কত কথায় যেন বলতে চায় ওই দুই জোড়া আঁখি । কিন্তু আদিলা তাকিয়ে থাকতে পারে না । দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় । বুকের ভেতর তখন দ্রিম দ্রিম করে ঢাক বাজছে ।আদিলা অসহায় বোধ করে । এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না । তাহলে কেন হচ্ছে ? নাকি দুনিয়ার সব থেকে বিরক্তিকর , অসহ্য ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা এমন বিনা নোটিশেই এসে কড়া নাড়ে ?
এদিকে তখন আরও একজন তৃষিত চোখে দেখে যাচ্ছে রাহাতকে । কিন্তু হৃদয়ের অন্তপুরে পরম যত্নে লালন করা মানুষটার চোখে অন্য একজনকে দেখে কষ্টে ,প্রতিহিংসায় জ্বলে ওঠে মেঘনা । কিসের অভাব আছে ওর মাঝে ? রঙে, রূপে , টাকায় সব থেকে ও আদিলার থেকে অনেক এগিয়ে । তাহলে কেন ?কেন ওকে না দেখে আদিলাকেই মনে ধরল তোমার রাহাত ? এত এত আলোর ঝলকানিতেও তাই অন্ধকার দেখতে লাগল মেঘনা ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ” বর এসেছে …বর এসেছে ” বলে শোরগোল পড়ে যায় পুরো বাড়িতে।আরমানকে এই প্রথম আদিলা সামনাসামনি দেখল ।এমনিতে মাহির ফোনে অনেক ছবি দেখেছে সে , ফোনে কথাও বলেছে। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে ফটো থেকে বাস্তবে বেশি হ্যান্ডসাম আরমান । আর আজ বর বেশে আরমানকে আরো বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে । আদিলা মাহির কাছে গিয়ে মাহিকে সুখবরটা দিয়ে আসে ।
বিয়ে পড়ানো ,খাওয়া-দাওয়া ,অতিথি আপ্যায়ন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে রাত দুটোই দিকে বরযাত্রী মাহিকে নিয়ে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় । পুরো বাড়িতে বিদায়ের বিষন্নতা ছেয়ে আছে । মাহি ওর আম্মুর গলা ধরে খুব কান্না করে । সবার চোখে জল । মাহির আব্বু ,ফাহিমের চোখেও আদিলা জল দেখতে পেল ।আদিলাও কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও ও সবার মত শব্দ করে কান্না করতে পারল না । কখনোই পারে না । তাই চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে ওর । মাথা ধরে আসে ওর । তবুও ঠায় দাড়িয়ে থাকে ।
চোখে জল নিয়ে সবাই মাহিকে বিদায় জানায় । পুরো বাড়িতে আজ রাতের নিরবতা এই বিদায়ের বেলাকে আরো বেশি নিস্তব্ধ করে রেখেছে । সবাইকে উদ্দেশ্য করে মাহির বাবা বলেন,
-” সবাই ঘুমাতে যাও । অনেক রাত হয়ে গেছে ”
কেউ কেউ ঘুমোতে যায় আবার কেউ বসে গল্প করে কাটিয়ে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে ।আদিলা আর মিতু মাহির রুমে চলে যায় । ফজরের নামাজের জন্য আদিলা অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ।সাড়ে চারটার দিকে এলাম বাজলে আদিলা আর মিতু দুজনেই উঠে নামাজ পড়ে নেয় । নামাজ আদায় করে মিতু আবার ঘুমিয়ে পড়লেও আদিলা আর না ঘুমিয়ে ছাদে উঠে আসে ।
রাহাত আর ফাহিম মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে আসে । ফাহিম নিজের রুমে চলে গেলে রাহাত সকালের তাজা হওয়া নিতে ছাদে উঠে আসে । ছাদে গিয়ে দেখে হালকা অন্ধকারের মধ্যে মাথায় ওড়না দিয়ে কেউ একজন ছাদের রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে । রাহাত পিছন থেকে দেখেও চিনতে পারে আদিলাকে । আস্তে আস্তে গিয়ে আদিলার পাশে দাঁড়ায়……
To be continue..