“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৯১

0
2470

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯১
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে যখন খাওয়াদাওয়া শেষ হলো তখন আরমান জিহানকে নিজের সাথে নিতে চাইলে জিহান কান্না শুরু করলো৷ গত রাতগুলোও তার সাথে কাটায়নি। আজও নানান বাহানা দিয়েও লাভ হলো না। জোরপূর্বক কোলে নেওয়া মাত্রই “আম্মু, দাদু” ডেকে চিৎকার করছে! পরক্ষণে ইমরান তাকে শান্ত করতে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আরমান ব্যর্থতার নিশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেলো। যে ছেলে আব্বু বলতে পাগল, আজ তিনদিন হলো সেই ছেলেকে কাছে পায় না সে। বাসার কেউই কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। যে বাচ্চারা মা চেনে তাদের মা ছাড়া লালন পালন করা যায় না। সেটা উপস্থিত সবাই জানে কিন্তু কি করবে! জিহানের অবস্থা দেখে সবারই খারাপ লাগছে কিন্তু কারোই কিছু করার নেই। যার যেমন কর্ম তাকে তেমন ফল ভোগ করতে হবে। কিন্তু বাচ্চাটা যে কষ্ট পাচ্ছে!
নাফিসা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ইমরান জিহানকে দোকানে নিয়ে গিয়েছিলো। এখন উঠুনেই হাটছে। জিহান তার গলা ঝাপটে পড়ে আছে, হাতে চিপসের প্যাকেট। মাত্র ডিনার করেছে তাই নাফিসাও চুপচাপ ইমরানের সাথে একটু হাটছে। হঠাৎই চোখ পড়লো আরমানের রুমের দিকে! অন্ধকারে দৃষ্টি রেখে জানালার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে। মুখটা সারাক্ষণই গম্ভীর থাকে। সেদিনের পর থেকে কারো মুখেই স্পষ্ট হাসি দেখা যায়নি। নাফিসা ইমরানকে বললো,
– জিহান আজ আমাদের সাথে থাকুক?
– হুম।
– ভাইয়া অপেক্ষা করছে বোধহয়। বলে এসো ভাইয়াকে।
– রুমে যাও, আসছি আমি।
মিনিটের মধ্যেই ইমরান আরমানের কাছে বলে চলে এলো। নাফিসা বিছানা গুছিয়ে মশারী টানিয়ে নিয়েছে। ইমরান জিহানকে রেখে গেইট তালা দিতে চাইছিলো কিন্তু জিহান তাকে ছাড়লো না! গলায় ঝুলে আছে। এই মুহূর্তে নাফিসার হাসি পেয়েছিলো তাই মুখ চেপে হেসেছে। ইমরানকে বলে সে নিজেই গেইটে তালা লাগাতে গেলো। ফিরে আসার সময় আবারও তাকালো আরমানের রুমের দিকে। জানালা তো আর দেখা যায় না এদিক থেকে কিন্তু লাইটের আলোতে জানালা ও গ্রিল ধরে দাড়িয়ে থাকা আরমানের ছায়া দেখতে পেয়েছে। এখনো সেখানেই দাড়িয়ে আছে সে। “শূন্যতা বোধহয় খুব প্রকটভাবেই ঘিরে ধরেছে! হবেই না কেন! দুদিনের জন্য নিশ্চয়ই কেউ সংসার বাধে না! আর অল্পতেই নিশ্চয়ই এতো সহজসরল মানুষ এতোটা কঠোর হয় না। নিজের কপাল নিজে ভাঙলি রে জেরিন! কি হতো, যদি একটু সেক্রিফাইস করে সুন্দরভাবে সংসারটা সাজিয়ে নিতি!”
নাফিসা রুমে এসে দেখলো জিহান ইমরানের গলা ঝাপটে ধরে মিশে আছে। সে দরজা লাগিয়ে চিপসের প্যাকেটটা খাট থেকেও টেবিলে রাখলো। অত:পর নিজের জন্য অবশিষ্ট ফাঁকা জায়গায় না শুয়ে ইমরানের পেছনে অবশিষ্ট অল্প জায়গা দখল করে নিলো।
– এটা কোথায় এলে! ওপাশে যাও?
– উহুম।
– পড়ে যাবে তো!
নাফিসা পেছন থেকে ইমরানের সাথে মিশে বললো,
– উহুম।
অত:পর ইমরানই জিহানকে ঠেলে বিপরীতে একটু চেপে জায়গা করে দিলো।
– জিহান ঘুমিয়ে গেছে?
– পুরোপুরি না।
নাফিসা ইতস্তত বোধ করে বললো,
– মা ছাড়া এইটুকু বাচ্চা থাকবে কি করে!
– আমরা মরে গেছি?
– আচ্ছা, এভাবে কথা বলো কেন! আমি কি এখন তোমার সাথে রেগে কথা বলেছি?
প্রথমে বিরক্তিকর ভাবে জবাব দিলেও ইমরান এবার স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। আমাদের যত্নাদি থাকলেই হয়।
– তবুও, মায়ের সাথে সন্তানের তো আলাদা সম্পর্ক, ভিন্ন মায়া জড়িত।
– মায়ের আগে দেখতে হবে সে একজন মানুষ। যে মানুষ কাউকে খুন করতে অগ্রসর হয় সে কোনো কারণে সন্তানকেও খুন করতে দ্বিধাবোধ করবে না। দরকার নেই তো এমন মায়ের।
– তুমি কি সত্যি সত্যিই থানায় ডায়েরি করবে?
– ভেবেছিলাম করবো। আরাফ ভাইয়া নিষেধ করেছে। তোমার মতো একই কথা বললো। বাবার সম্মান নষ্ট হবে, বাড়ির বদনাম হবে। বাড়ি থেকে বিদায় করা হয়েছে এটাই নাকি তার জন্য বড় শাস্তি হবে।
– মামাবাড়ির সবাইও তো তোমাদের সাথে রেগে আছে। তাই না?
– ভাইয়ার নামে নাকি মামী নারী নির্যাতনের মামলা করতে চেয়েছিলো। আরাফ ভাইয়াই ঠেকিয়ে দিলো এই বলে, নারী নির্যাতনের মামলা করতে গেলে তার আগে খুনের মামলা করা হবে তাদের মেয়ের নামে।
– ঠিকই তো করেছে ভাইয়া। এতো ঝামেলায় জড়ানোর প্রয়োজন নেই তো। এজন্যই ভাইয়াকে খুব ভালো লাগে। আরাফ ভাইয়া শান্তি প্রিয় মানুষ। সবদিকের ঝামেলা মিটিয়ে শান্ত করে দিলো।
– সবাই তো শান্তি চায়। কিন্তু শান্তি কি সবার ভাগ্যে জুটে? টেনে হিচড়ে সেই অশান্তিই বয়ে আনে!
– হুম। তুমিও বড্ড অশান্ত হয়ে গেছো। এবার নিজের দিকটা ভেবে একটু শান্ত হও।
ইমরান তাদের ছাড়িয়ে বাইরে গেলো। ফ্রেশ হয়ে আবার রুমে এসে দেখলো এইটুকু সময়ে নাফিসা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে! মেয়েটার প্রায় সারাদিন ঘুমিয়ে কাটলো এখনো আবার শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়লো! ওষুধের প্রতিক্রিয়া খুব বেশিই কাবু করে ফেলেছে তাকে! ইমরান বড়সড় এক নিশ্বাস ফেলে নাফিসাকে জিহানের দিকে চাপিয়ে সে উভয়কে এক হাত দ্বারা আবদ্ধ করে শুয়ে পড়লো।
পরদিন বিকেলে একটু তারাতাড়িই ফিরেছে আরমান। নিজে রেডি হয়ে জিহানকে চকলেট জুস কিনে দিয়ে মানিয়ে নিয়ে ঘুরতে বের হলো। জিহান ফ্রেশ মাইন্ডে এতোক্ষণ খেলাধুলা করছিলো বিধায় এখন কান্না করেনি। সারা বিকেল ঘুরেফিরে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেছে বাবা ছেলে। আজ একটু তারাতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছে জিহান। ঘুমন্ত জিহানকে নিয়ে চারদিন পর আরমান রাত কাটালো। কিন্তু সীমিত সময়ের জন্য। মাঝরাতে জিহান তার মাকে না পেয়ে কান্না শুরু করেছে। বাবার প্রতি আবারও সেই ভয়টা হানা দিয়েছে। যেই বাবাকে পেলে জিহান কাদে না আজ সেই বাবার পক্ষেই তার কান্না থামানো দায় হয়ে পড়েছে। এ ঘরের সকলেরই ঘুম ভেঙে গেছে। দাদুরাও শান্ত করতে পারছে না। নিশাত তাকে কোলে নিয়ে সারা ঘর হাটলো এবং শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। মানসিকভাবে অসহ্য এক যন্ত্রণায় ভুগছে আরমান! যা সবাই বুঝতে পারলেও কেউই মানতে পারছে না, আর না পারছে শুধরাতে!
প্রায় এক সপ্তাহের মতো কাটলো এভাবে। আরামান প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভাবে চেষ্টা করছে তার ছেলেকে স্বাভাবিক করতে। কখনো ঘুরতে যাওয়া, কখনো দোকানে নিয়ে গিয়ে এটাসেটা কিনে দেওয়া, কখনো বা খেলনা কিনে দেওয়া। সবকিছুর পরেও সে মাকে তেমনভাবে ভুলতে পারেনি। দিনের কোনো না কোনো সময় সে মাকে মনে করবেই, এমনকি কান্নাও করবে। আর জেরিনও প্রতিদিনই কারো না কারো ফোনে কল করে কিন্তু রিসিভ করার মতো কেউই নেই! শুধু বড় মায়ের সাথে কথা হয়েছে দুইবার। কিন্তু সেটা কেউই জানে না। এর মাঝে নাফিসা একদিন বড় মা’র সাথে কথা বলে এক প্রকার চুপিচুপিই জেরিনকে কল করলো বড় মায়ের ফোন থেকে। তারা কোনো কথা না বলে জিহানকে কথা বলতে দিলো। জিহান অভিমানী সুরে জিজ্ঞাসা করেছিলো,
– আম্মু, তুমি কই?
জেরিন কান্নাজড়িত কন্ঠে জবাব দিয়েছে,
– আমি তো নানু বাড়িতে আছি, আব্বু।
– আমি যাবো নানু বাড়ি।
– তোমার আব্বু নিয়ে আসবে না তোমাকে।
– কেন? আমি যাবো।
– তাহলে তুমি আব্বুকে বলো নিয়ে আসতে।
– না।
– কেন? তুমি দুষ্টুমি করো?
– না।
– গুড বয়। দুষ্টুমি করবে না একদম। আব্বুর কথা শুনো তো?
– না।
– কেন? আব্বুর কথা শুনবে।
– না, আব্বু মাবে।
– মারবে না। আব্বু তোমাকে আদর করবে।
– উউ! মাবে। মেএছে না তোমাকে!
জেরিন চুপ হয়ে গেছে! জিহান আবার ডাকলো তাকে,
– আম্মু?
– হু?
– তুমি আসো।
– আসবো?
– হু।
– আমি তো একা আসতে পারিনা। আব্বুকে বলো নিয়ে যেতে।
– পিপিপ দিয়ে আসো।
ছেলে যত কথা বাড়িয়ে চলেছে জেরিনের চাপা কান্না ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রায় বিশ মিনিটের মতো কথা বলেছে জিহান।
.
প্রায় দু সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে নাফিসা হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরেছে। সেদিনের পর থেকে দিনগুলো যেনো তার ঘুমে ঘুমেই কাটছে! হাফ ডে হওয়ায় দুপুরে বাড়ি ফিরেছে ইমরান। এখনো তাকে ঘুমাতেই দেখলো। দিনে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গড়ে ষোলো ঘন্টা তার ঘুমে কাটে! ঘুম থেকে ডাকলেই বিরক্ত হয়ে পড়ে! সারাদিন ঘুমাতে ঘুমাতে শরীর ফুলে গেছে। এই ঘুমের জন্য ইমরান এখন তাকে ডেইলি সকাল বিকাল দুইবার গোসল করায়! নাফিসা বিরক্ত হয় বলে নিজেও বাধ্য হয়ে দুইবার গোসল করে। কিন্তু তবুও তার ঘুমের রেশ তেমন কাটছে না! গোসলের পর আধ-ঘন্টা বা এক ঘন্টার মতো ফ্রেশ থাকে তারপর আবার চোখে ঘুম এসে জড়ো হয়! এভাবে চললে তো আরও খারাপ হয়ে যাবে তার অবস্থা! অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হবে বেশি বেশি। এতো আয়েশে কি মানুষ স্ট্রং ভাবে বেঁচে থাকতে পারে! নাহ, অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
ভাবতে ভাবতে ইমরান পোশাকাশাক চেঞ্জ করে নিলো। নাফিসার পাশে বসে কপালে ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে ডাকলো তাকে। সে যেমন মৃদুস্বরে ডেকে চলেছে, নাফিসাও তেমন ঘুমের ঘোরে তার ডাকে সারা দিয়ে চলেছে
কিন্তু চোখের পাতা খুলছে না! এবার ইমরান জোর গলায় হাক ছাড়তেই নাফিসা চমকে উঠে বসলো। ওদিকে বাইরে থেকে নিশাত জবাব দিলো,
– ভাইয়া, ভাবি তো রুমেই ঘুমাচ্ছে। দেখোনি?
– হ্যাঁ, দেখেছি। ঘুম ভাঙানোর জন্যই ডেকেছি।
– তো এভাবে ডাকতে হয়! হুহ্!
এদিকে নাফিসার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে ইমরান এভাবে চিৎকার করায়! ইমরান ব্রু কুচকে বললো,
– এভাবে তাকাও কেন? কখন থেকে আদুরে গলায় ডাকছি কানে যাচ্ছে না? এতো ঘুম কিসের!
– আমি ঘুমাবো তোর কি! এতো ডাকাডাকি কেন করিস! একটাবারও শান্তিতে ঘুমাতে পারি না! শুধু নাফিসা, নাফিসা আর নাফিসা!
রেগে একদমে কথাগুলো বলে ফেললো নাফিসা। ইমরান ফোন চার্জে লাগাতে লাগাতে বললো,
– নিজেকে আয়নায় দেখেছো একবার? ঘুমাতে ঘুমাতে যে ফুটবল হয়ে যাচ্ছো!
নাফিসা বিছানা ছেড়ে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজেকে একটু ভালো করে দেখলো, সত্যিই সে মুটকি হয়ে যাচ্ছে৷ ঢিলেঢালা জামাকাপড় সব ফিটিং হয়ে গেছে। নিজেকে এভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখে ইমরান বললো,
– মিথ্যা বলিনি আমি।
নাফিসা এগিয়ে এসে বললো,
– সত্যি সত্যিই মটো হয়ে গেছি না?
– হু।
– তো তোর কি? তোর কোলে উঠে চড়ি আমি! ইডিয়ট!
নাফিসা চুল খোপা করতে করতে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে আর ইমরান কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে পরক্ষণে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! তার হাসির শব্দ শুনে বেরিয়ে যাওয়া নাফিসার মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here