স্বপ্ন,পর্বঃ- ০৪

0
645

স্বপ্ন,পর্বঃ- ০৪
সাদিয়া_সৃষ্টি

বাড়ি ফিরে গোসল সেরেই তারপর ঘর থেকে বের হলো। ঘর থেকে বের হতেই মাথায় মায়ের খুন্তির আলতো মারটাও মিস করল না বৃষ্টি। ওদিকে মা মেরে দিয়ে কখন আবার রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু তার কথা অনবরত চলতে থাকছেন।

— “কি জন্য যে এতদিন নিজেকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলি, সেটা আমাকেও একবার বল। আমিও একবার তোর কষ্টটা অনুভব করি। যত সব ভালো কাজ ছেলে ইউজলেস কাজগুলো করিস। বললাম পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তার হ, কিন্তু সেটাও হতে পারলি না। নিজের ইচ্ছামতো কাজ করিস। দিন রাত ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্ধ করে কি প্রমাণ করতে চাস? তুই যদি এখন স্টুডেন্ট হতি, তাহলে নাহয় ভাবতাম যে তুই পড়াশোনা করছিস, কিন্তু তাও না। কি না কি কাজ করে! তার জন্য আবার ঘরের দরজা সারাদিন বন্ধ রাখা লাগবে! আসছে নবাব এর মেয়ে।”

মূলত এতদিনের রাগ আর জমানো কথা একেবারেই বলার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু বৃষ্টি সেসব আমলে নিচ্ছে না। মায়ের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেও মন খারাপ লাগে না তার। বরং মায়ের মনে নিজের জন্য চিন্তা দেখে খুব আনন্দ হয়। কই, সবার মা তো এমনভাবে চিন্তা করে না? বিশেষ করে যাদের মা চাকুরীজীবী তারা তো মায়ের দেখাও পায় না সারাদিনে। সেই হিসেবে বৃষ্টি নিজেকে ভাগ্যবতীই মনে করে। এর জন্য একটু বকা সহ্য করাই যায়। টেবিলে রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল নিয়ে সেটা নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে পড়ল সে। এখানে খেতে খেতে মায়ের বকা শুনবে সে। পাশে তাকাল সে। বিভোর ফোনে গেমস খেলছে। হঠাৎ বৃষ্টির নজরে পড়ল চলতে থাকা টিভিটা। সেখানে খবরের চ্যানেল খোলা দেখে সাথে সাথে টিভি বন্ধ করে দিল। দরকার নেই কোন খবর দেখা। হঠাৎ বাবা বিভোরকে ডাক দিল। সাথে সাথে বৃষ্টির হাত কাঁপা শুরু করল। বিভোর সেই স্বপ্নের মতই ফোনটা বন্ধ করে বাবার দিকে চলে গেল। বৃষ্টির খেয়াল হলো স্বপ্নের বাকি অংশ; রক্ত। তার ডান হাতে আপেল থাকায় বাম হাতটা সরাসরি মাথায় চলে গেল। ভেজা অনুভুত হতেই কাপাকাপির পরিমাণ আরও বেড়ে গেল তার। হাতটা সামনে আনার ইচ্ছাটুকু আর এলো না তার মধ্যে। হঠার কলিং বেলের শব্দ আসতেই সচকিত চোখে দরজার দিকে তাকাল। তার হাতে কম্পন তখনও বিদ্যমান। শুধু একটুর জন্য হাতে থাকা আধ খাওয়া আপেলটা পড়ে যায়নি। দরজা খুলে চেনা মানুষকে ঢুকতে দেখে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। আবার ঘামতে শুরু করেছে সে। ভয়ে তার অবস্থা নাজেহাল।

নিশান্ত বৃষ্টিকে এভাবে বসে পড়তে দেখে সে দ্রুত তার কাছে চলে আসে। কোনোমতে বৃষ্টির গালে দুই হাত রেখে এক হাত দিয়ে আস্তে করে মারতে থাকে। আর বলতে থাকে,

— “কি হয়েছে বৃষ্টি? কোন সমস্যা? আমাকে বলো, তুমি ঠিক আছো তো? আমাকে হঠাৎ করে এভাবে দরজায় নক না করে ঢুকতে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলে? নাকি অন্য কিছু? বলো আমাকে। আমি ঠিক করে দেব সব। তুমি কাঁপছ কেন?”

বৃষ্টির খেয়াল হলো সে কি ভাবছিল। সব কিছু স্বাভাবিক দেখে নিজের বাম হাতটা সামনে আনলো। হাতে পানি দেখে মনে পড়ল সে গোসল করেছিল। তাই ভেজা অনুভুত হচ্ছে। এটা রক্ত ছিল না। পাশের রুম থেকে বাবা আর বিভোরকে বের হতে দেখে এক ঝটকায় ঠিক হয়ে বসল। আর ইশারায় নিশান্তকে ফ্লোর থেকে উঠে সোফায় বসতে বলল। বৃষ্টির এমন হঠাৎ পরিবর্তনে ভড়কে গিয়ে নিশান্ত উঠে সোফায় বসল। বৃষ্টি ধীর কণ্ঠে বলল,

— “আমি একদম ঠিক আছি। চিন্তা করবেন না।”

বলেই আর সামনের দেওয়ালে ঝোলানো টিভির দিকে তাকিয়ে আনমনে আপেলে এক কামড় বসাল। নিশান্ত আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে হতাশ হলো। নিশান্তের মনে হলো বৃষ্টি সবার থেকে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। এমনকি নিজের বাবার থেকেও হয়তো। নিশান্ত আসার কয়েক সেকেন্ড আগেই হয়তো এমন কিছু হয়েছে যার জন্য বৃষ্টি ভয় পেয়েছিল। কিন্তু কি? কৌতূহলী করে তুলল নিশান্তকে। কিন্তু না এর জন্য কোন ক্লু আছে, আর না বৃষ্টির থেকে কোন জবাব পাওয়া গেল। বোঝার কোন উপায় নেই আপাতত। বৃষ্টির দিকে তাকাল আবার। এক মনে আপেলে কামড় বসিয়ে যাচ্ছে। অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই। সেই যে সোজা হয়ে বসেছে, তারপর আর নড়াচড়াও করেনি। ভেজা চুল থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। ফ্যানের শব্দ কিংবা বৃষ্টির বাবা আর বিভোরের কথা বলার শব্দ কিংবা রান্না ঘোরে বৃষ্টির মায়ের রান্না করার শব্দ আর বাইরে চলমান যানবাহনের শব্দ- সব কিছুর মধ্যে সেই টুপটুপ শব্দটা শোনা হয়ে উঠছে না। কিন্তু নিশান্তের ইচ্ছা করছে। হয়তো এমন কিছু আগে খেয়াল করেনি বলেই এই সামান্য জিনিসের প্রতি এতো কৌতূহল। আর নাহলে ‘বৃষ্টি’ নামক মানুষটার প্রতিই কৌতূহলে মাত্রা বেশি। নাহলে এমন অদ্ভুত ইচ্ছা কি কখনো তার জাগত? জানা নেই।

“কি করছিস নিশান্ত? জানতাম, এই বার তুই অকাজে বেশি সময় নষ্ট করবি! নিজেকে সামলে আংকেলের সাথে কথা শুরু কর। অকাজ বাদ দিয়ে।”

নিজেকে মনে মনে ধমকাল নিশান্ত। কিন্তু মনের কোন এক কোণ থেকে নিশান্ত হয়তো নিজেই বলে উঠল,

“অকাজ না রে পাগল, বুঝবি না তুই!”

তবে সেই কণ্ঠের মাত্রা খুবই কম ছিল, যেন দূর থেকে কেউ চিৎকার করছে। পাত্তা দিল না সেসবে। নিজের উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল বৃষ্টির বাবাকে। বৃষ্টির বাবা নিশান্তকে দেখে অবাক হলেন না। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। তিনি সালামের উত্তর দিতে দিতে নিশান্তকে জড়িয়ে ধরলেন। কুশল বিনিময় করলেন। তারপর কথার এক পর্যায়ে জানালেন নিশান্ত আজ থেকে বৃষ্টিদের ফ্ল্যাটেই থাকবে। এতক্ষণ আপেলের দিকে মন প্রাণ দিয়ে বসে থাকা বৃষ্টির কর্ণগোচর হতেই আবার লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল বৃষ্টি।

“এই বাচালটা এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবে?”

কথাটা মনে হতেই আরেক লাফ দিতে গিয়েও দিল না। সামনে বাবা আর ছোট ভাই আছে। লাফানো যাবে না। বাবা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নিশান্তকে ঘর দেখিয়ে চলে গেলেন। বিভোরও মায়ের ফোনটা নিজে নিজের ঘরে চলে গেল গেমস খেলতে। বৃষ্টি অসহায়ের মতো মুখ করে আবার সোফায় বসে পড়ল ঠুস করে। আর আপেলে কামড় দিতে লাগল। তার খেয়াল নেই যে কেউ তার পাশে বসে তার আপেল খাওয়া মন দিয়ে দেখছে।

— “কি? আজ কি এভাবেই এক্সারসাইজ করছ না কি? একবার উঠছ, আবার বসছ।”

কথাটা কানে সময় মতো পৌঁছালেও মস্তিষ্ক ধরতে পারল না সাথে সাথে। আর যখন ধরতে পারল, তখন বৃষ্টি মাথা ঘুরিয়ে নিশান্তের দিকে তাকাল। এর জবাবে কিছু বলবে তার আগেই নিশান্তের বলা আরেকটা কথা বৃষ্টির মুখ বন্ধ করে দিল।

— “ফ্যান চলছে পুরো গতিতে। ঠাণ্ডা পরিবেশ। হ্যাঁ, রান্নাঘরে রান্না হলেও সেই উত্তাপ এই পর্যন্ত পাচ্ছি না। গোসল করে আসলেও শুকিয়ে যাওয়ার কথা। চুল থেকে পানি পড়লেও সেটা পিঠে লাগার কথা। তাও ঘেমে যাচ্ছ। কিন্তু তোমার মুখ বলে দিচ্ছে তুমি কিছু নিয়ে চিন্তিত। হয়তো ভয় পেয়েছ। কারণটা কি?”

বৃষ্টি কি বলবে ভেবে না পেয়ে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল কথাটা। নিশান্ত ওর খাপছাড়া হাসি দেখে আবার বলা শুরু করল,

— “চোখের কোণ বেয়ে পানি পড়ার উপক্রম। এখন যেভাবে হাসছ তাতে হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসার কথা একদম নয়। কান্না করতে যাচ্ছিলে? কেন? কি ভেবে? এক্সের বিয়ে কথা নাকি এক্স কবে হানিমুনে যাবে সেই কথা ভেবে?”

এতক্ষণ শান্ত থাকলেও শেষ কথায় তেঁতে উঠল বৃষ্টি। কি পেয়েছে লোকটা? শুধু একবার বিয়ে বাড়িতে হাতে থাকা প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম গ্লাস মুচড়াতেই তো দেখেছে। তারপর থেকেই এক্স এক্স করে যাচ্ছে। সে রেগেই বলে উঠল,

— “এই শুনে রাখুন, আমার কোন এক্স ফেক্স নেই। আমি এমনিই বসে ছিলাম তারপর হঠাৎ স্বপ্নের কথা ভেবে… ওই কাজের প্রেসারে আর গরম লেগেছিল। তেমন কিছু না। গোয়েন্দার মতো ভাবনা বা কমনসেন্স যাই বলেই- ওটা বন্ধ রাখেন আপাতত। এতো রাতে জার্নি করে এসেছেন হয়তো, খাবার খেয়ে রেস্ট নিতে যান।”

— “রাগছ কেন? গরম লাগছে বুঝলাম। কিন্তু… আচ্ছা সেসব কথা বাদ। কোন এক্স নেই মানে আমার রাস্তা পরিষ্কার। তবে যাই বল, ভেজা চুলে তোমাকে…”

— “থেমে যান। ওখানেই থামেন, ফ্লার্ট করছেন? আমি না আপনার বোনের মতো?”

— “হ্যাঁ, করছি। আর চাইলে তো মাঝে মাঝে একটু বউ এর মতও ভাবতে পারো। তোমরা মেয়ে জাতি কি বোন ছাড়া আর কিছু পাও না ছেলে দেখলে?”

— “না, পাই না।”

বলেই নিজের ঘোরে এসে শব্দ করে দরজা লাগাল। নিশান্ত হাসতে হাসতে নিজের কাঁধে ব্যাগটা আবার ঝুলিয়ে আংকেলের দেখানো ঘরের দিকে পা বাড়াল। বৃষ্টি ঠিকই বলেছে। একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার।

নিজের ঘরে ঢুকতেই বৃষ্টির মনে কিছু সময় আগের কথা হানা দিল। স্বপ্নের কথাটা এবার ভুলতে পারেনি সে। তাই তো এতো সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে অন্যান্য সময় স্বপ্নের শুধু একটা অংশ মনে থাকত। সেটা তেমন একটা সমস্যা করে না। কিন্তু স্বপ্নটা যদি পুরোই মনে থাকে তাহলে সেটা বেশ ঝামেলা করে।

অনেকসময় দেখা যায় গত রাতে দেখা স্বপ্ন আমরা ভুলে যাই কিন্তু বহু বছর আগে দেখা একটা স্বপ্ন তখন থেকে শুরু করে বর্তমানেও মনে থাকে আমাদের। রেখার আজ দেখা স্বপ্নটা সেই চিরকাল মনে থাকার মতো স্বপ্নের ক্যাটাগরিতে পড়ে হয়তো। যত দুঃখ এখানেই।

বৃষ্টি দরজা হালকা ফাঁকা করে বাইরে দেখার চেষ্টা করল। আজই দরজা বন্ধ রাখা শেষ করল। আজ আবার কয়েক দিনের জন্য দরজা বন্ধ করা যাবে কিনা সেটা বোঝার চেষ্টা করছে সে। তখনই ভেসে এলো মায়ের ডাক।

— “আবার যদি দরজা আটকিয়েছিস, তাহলে দেখে নিস, তোর আমি কি অবস্থা করি।”

পরিকল্পনা শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল। সে দরজা হালকা ভিড়িয়ে রেখেই নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। এই স্বপ্নের কথা অন্যভাবে ভুলতে হবে। চট করে মাথায় এলো গেমসের কথা। সব কাজ বাদ দিয়ে ফোন নিয়ে চলে গেল বিভোরের ঘরে। দুজনে মিলে গেমস খেলা যাক আজ।

তাতে যদি কিছুটা ভোলা যায় স্বপ্ন। অন্ততপক্ষে ওই লাশের মুখ থেকে বৃষ্টির নাম বের হয়ে আসার অংশটা।

_____

বিন্দু বিন্দু জলকণা কপাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছে নিশান্তের। কৃত্রিম ঝর্ণার পানির দিকে কোন খেয়াল নেই তার। প্রতিবারের মতো চিন্তায় মগ্ন সে। তবে প্রতিবার কাজের চিন্তা করলেও এই প্রথম কাজের বাইরে কোন চিন্তা করছে সে। বৃষ্টির সেই টইটম্বুর চোখজোড়া শান্তি দিচ্ছে না নিশান্তকে। কি এমন কারণ যার জন্য বৃষ্টির কান্না করার পর্যায়ে চলে গিয়েছে? সত্যিই কি সে ভয় পেয়েছে? নাকি আবিরের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে? ২য় চিন্তা মাথায় আসতেই নিজের অজান্তে ঘুষি মেরে বসল দেওয়ালে। তারপর হালকা ব্যথা অনুভুত হতেই মনে পড়ল আসল কথা। আবার বিড়বিড় করে উঠল সে,

“তোকে আগেই বলেছিলাম, এবার তুই বড্ড সময় নষ্ট করবি নিশান্ত, নিজের কাজ বাদ দিয়ে।”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here