রাকা (১)

0
1981

রাকা (১)
ফারজানা রহমান তৃনা

মাসখানেক আগে আমার আম্মু পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলো অন্য একজন পুরুষকে।লোকটাকে আমি আগেই চিনতাম। সে মাঝেমধ্যেই আমাদের বাসায় আসতো। কখনো বা দেখা করতে যেতাম আম্মু আর আমিই। আমি ছোট ছিলাম,
তাই আম্মু আমাকে নিয়েই দেখা করতে যেত,স্কুল-প্রাইভেটে নেওয়ার বাহানা দিয়ে।
ঐ আংকেল আমাকে ভীষণ আদর করতো।
তাই তাকে আমার ভালো লাগাটা ও স্বাভাবিক। আমি তাকে পছন্দ করতাম। কিন্তু আমার আব্বু আমার মত করে তাকে পছন্দ করতে পারেনি কখনোই। আমি তো তখন ক্লাস সেভেনে। হয়তো সেজন্যই আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ছিলো।

আমি ঐ আংকেলকে শুধু আংকেলই ভাবতাম। কিন্তু আব্বু ভাবতো অন্যকিছু। অর্থাৎ আমাদের দুজনের মধ্যে বোঝাবুঝির বিস্তর ফারাক ছিলো। সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এখন আর নেই।
আমার বড় বোন তানিশা আর আমি পিঠাপিঠি বয়সেরই প্রায়। বোন ক্লাস এইটে পড়ে আর আমি ক্লাস সেভেনে। আমি রাকা। আমি খুব সুখী পরিবারের একজন সুখী সদস্য বলছি। দু:খিত, সুখী সদস্য ছিলাম,এখন আর নেই সম্ভবত।
আমার আব্বা একজন ব্যবসায়ী।
আমাদের অবস্থা ভালোই চলছিলো। একেবারে ধনী ও না আবার একেবারে গরীব ও না।
মানে সংসারে টানাপোড়নের কোনো ছাপ ছিলো না।

কিন্তু সেই সুখীচিত্র যে এভাবে বিরহাতুর হয়ে ফলবে তা কে জানতো?
আমি ভীষণভাবে হতাশাগ্রস্থ হয়ে আছি।
শুধু আমি না। আমার পুরো ফ্যামিলিচিত্র এখন ভয়াবহ রুপ ধারণ করে আছে।
সত্যি বলতে আমি নিজেও আমার আম্মুকে অতটা পছন্দ করিনা।
তার পেছনেও অনেক কারণ আছে।
এখন আমি আমার আব্বু আর বোনের সাথে আমাদের বাসায় আছি।
আম্মু নেই। আম্মু আম্মুর নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বোন,আব্বু আর আমি- আমরা সবাই সব ভুলে এখন ভালোই আছি। আব্বু বলেছে,
যে সব বাঁধন ছেড়ে চলে যায়, তাকে নিয়ে পড়ে থাকার কোনো মানে নেই। সে যখন নতুন জীবন শুরু করতে পেরেছে তখন আমরা কেন পারবোনা?
আমরাও পারবো।

বোন আর আমি একযোগে সেদিন বলেছিলাম,
হ্যাঁ আব্বু।
কিন্তু আমরা দুজনেই জানি, আব্বুর এই কথা মন থেকে আসেনি। আমার আব্বু আমার আম্মুকে মনে-প্রাণে ভালোবাসে।
সেটা হয়তো আমার আম্মু কখনো বুঝেনি।
আমার বোন বুঝে কিনা জানিনা। তবে আমি বুঝি। আমি মাঝেমধ্যে গভীর রাতে জেগে যাই। কেন?
আমার আব্বুর স্তব্ধ,গম্ভীরস্বর কান্নার আওয়াজে।
সে আওয়াজ আর কেউ শোনেনা।
শুধু আমিই শুনি।
আমি ছুটে যাই তার ঘরের দরজায়।
নিজের বাবাকে আবিষ্কার করি মায়ের ছবি আঁকড়ে ধরে থাকা অবস্থায়।
আব্বু অঝোর ধারায় কাঁদে।

অশ্রুসিক্ত অবস্থায় অস্পষ্ট স্বরে বার বার শুধু আওড়ায়,
” কেন চলে গেলে অনু? কী আছে তার যা আমার নেই? আমি তোমায় কী দিতে পারিনি? আমাদের এত সুখের সংসার! দুই মেয়ে! তুমি পারলে? এত পাষাণ তুমি হতে পারলে? ”

আমি কখনো আমার আব্বুর কান্না দেখিনি। আজকে দেড়মাস যাবত প্রতিদিনই প্রায় দেখছি।
পুরুষের কান্না ও খুব ভয়াবহ, করুন হতে পারে- সেটা তো আমরা অনেকেই জানিনা। আমরা মনে করি কাঁদবে শুধু মেয়েরা। ছেলেরা বুক ফুলিয়ে থাকবে। তাদের জন্য কান্না নয়। কিন্তু না! কান্না! অশ্রু! সে তো অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে আসে! পরম কষ্টের ফলাফলই হলো অশ্রু।
পুরুষের ও তাদের পরম কষ্টে কান্না চেপে না রেখে প্রাণ খুলে কাঁদা উচিত। অন্তত এই বিধান করা উচিত।

আমার আব্বু প্রতিদিন রাতে কাঁদে।
আমি দেখি। কাছে যাইনা। সাহস হয়না যে!
কারণ আমি জানি, আমি এখন তার কাছাকাছি গেলে, আমি নিজেও কেঁদে দিবো। আমার আব্বু তো আমার কান্না সহ্য করতে পারবেনা। সে তখন আরো কষ্ট পাবে। আমার আম্মু আমার আব্বুকে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু আমি জেনে-শুনে কোনোভাবেই আমার আব্বুকে কষ্ট দিতে চাইনা।
আমি জানি,আমি কাছে গেলে আব্বুর যন্ত্রণা আরো বেড়ে যাবে। তাই আমি দাঁড়িয়ে থাকি। ততক্ষন, যতক্ষন না আব্বুর কান্না থামে।

কান্না থেমে গেলে আম্মুর ছবিটা হাত থেকে নামিয়ে বালিশের নিচে রাখবে। তারপর কিছুক্ষন সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকবে স্থির চোখে।
তখন শুধু চোখের পানিগুলো দু পাশ দিয়ে বেয়ে পড়বে। তারপর আস্তে আস্তে আব্বুর চোখের পাতা ছোট হতে থাকবে। এরপর সে ঘুমিয়ে যায়।
ঠিক তখনই আমি তার ঘরে প্রবেশ করি।
তার মাথায় কিছুক্ষন হাত বুলিয়ে দেই আর আমার অসহায় আব্বুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি। ভাবি,কি দোষ করেছিলো এই মানুষটা?

বালিশের নিচে পড়ে থাকা আম্মুর ছবির অনাবৃত অংশ যেন আমাকেই আকৃষ্ট করছে। তাকাতে চাইনা! তবুও দেখে ফেলি।
তার চোখের এক অংশ দেখতে পাই। দেখেও না দেখার ভাণ করার চেষ্টা করি। তবুও কান্না চলে আসে!

আম্মুতো আব্বুর ঐপাশে শুয়ে থাকার কথা!
কই আম্মুকে দেখছিনা তো!
আম্মু এখন কোথায়?
ওড়না দিয়ে কোনোমতে মুখ চেপে ধরি।
কোনোভাবেই কান্নার আওয়াজ বের হওয়া যাবেনা!
আব্বুর গায়ে কাঁথা দিয়ে দেই।
তারপর নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ি।
আপু ঘুমায় নির্বিঘ্নে। এসব নিয়ে তার হয়তো কোনো চিন্তা নেই। কোনো আপত্তি আছে বলে ও মনে হয়না।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, আম্মু যেদিন চলে গেছিলো, সেদিন একবারের জন্য ও আপুকে কাঁদতে দেখা যায়নি। সে হয়তো মনে মনে আম্মুকেই সাপোর্ট করে। কেন করে তা এখনো জানা হয়নি।

যেদিন আব্বুর এই করুণ দৃশ্য দেখি সেদিন রাতে আমার আর ঘুমে আসেনা।
শুয়ে থাকি। কিন্তু ঘুম আসেনা।
আমি শুধু স্মৃতিচারণ করি তখন।
আহা, কি সুখী ছিলাম, কি ভালো ছিলাম আমরা..

আমরা এখন আর কোথাও বের হইনা।
বের হলেই লোকের কটু কথা শুনতে হবে।
প্রথম দুই সপ্তাহ তো নিজের ঘর থেকেই বের হতাম না। আপু রান্না করতো। কোনোমতে খেয়ে বেঁচেছি বলা চলে। আব্বু তখন পাগলের মত হয়ে ছিলো। তার কোনোকিছুরই কোনো হদিস ছিলোনা তখন।

আমি মোটামুটি রকমের স্টুডেন্ট। স্কুলে প্রথম পাঁচজনের তালিকায় সবসময় আমার নাম থাকে।
পড়াশোনা করতে আমার ভালোই লাগে।
কিন্তু এখন আর আমার স্কুলে যাওয়া হয়না।
স্কুলের বন্ধু-বান্ধব এমনকি স্যার-মিসরাও ছেড়ে দেয়না। যে যেভাবে পারে টিপ্পনী কাঁটে।
যেন এটা একটা প্রতিযোগিতা!
কে কত বেশি করে আঘাত করতে পারে,সে_ই উইন।

দুই সপ্তাহ পর যখন স্কুলে গেলাম,
দারোয়ান চাচা গেইটে আমাকে দেখেই বলে উঠলেন,
ওমা তোমাকে তোমার মা নেয়নি?
ইচ্ছা করছিলো মুখের উপর বলি,
নিলে এখানে আসতাম? আপনি নিবেন?
আমি উত্তর না দিয়ে চলে গিয়েছিলাম ভেতরে।

মাঠে সবাই তখন রুমাল চুরি খেলায় বিভোর। সেখানে পৌঁছাতেই সবাই দাঁড়িয়ে একযোগে হাত তালি দিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,
– ঐ যে দেখ রাকা,
যার বাবা ফাঁকা,
বউ গেছে ভেগে,
তাদের দিন যায় কেঁদে! হাহ্ হা হা।
আমি তাদের এই জঘণ্য ছড়া শুনেও না শোনার ভাণ করি।

ভেতরে চলে যাই। ক্লাসে ঢুকি।
কিছুক্ষন পর স্যার আসে।
সেও তীরচক্ষু নিয়ে তাকায়।
সব জানা সত্ত্বেও সবার সামনে আবার হেয়ালী করে জিজ্ঞেস করে,
– রাকা, তোমার আম্মু নাকি পালিয়ে গেছে? তার কী খবর? আর তোমার আব্বু কেমন আছে? – প্রশ্নগুলো শুনেই ক্লাসের সবাই আবার হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করতে শুরু করে। স্যার একবার শুধু হাস্যজ্জ্বল মুখে থামিয়ে দিয়ে বলে,
” এই তোরা চুপ কর। রাকাকে বলতে দে। ”
আমি কোনো জবাব দিতে পারিনা।
চোখে পানি চলে আসে কেবল। লুকাতে হবে।
তাই মাথা নিচু করে থাকি।

এভাবে পালাক্রমে সব স্যার-মিস আসতে থাকে আর আমাকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে এসব জিজ্ঞেস করতে থাকে। সে কি লজ্জ্বা!
শুধু একজন স্যার কখনো কিছু বলেনি।
সে এসেই তার ক্লাস শুরু করে দিতো।
স্কুল ছুটি হলে প্রতিদিন ডেকে নিয়ে যেত।
গোপনে এসব জিজ্ঞেস করতো।
সান্ত্বনা দিতো। আর বলতো,
” কখনো হেরে যাবেনা রাকা। লাইফে স্ট্রাগল করতে হয়। ইটস এ্য ওয়াকিং শ্যাডো।
সবকিছুরই একটা সমাধান থাকে। তোমার যেকোনো সমস্যার কথা আমাকে বলবে। আমি সবসময় আছি তোমার পাশে। ”
স্যারের নাম আপন। আপন স্যার নামেই খ্যাত।

এভাবে ক’দিন স্কুলে যাই। পথে-ঘাটে তো যে যা পারে বলতোই। স্কুলেও সারাক্ষন এসব শুনতে হতো। কি মুশকিল।
আম্মু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে তার পছন্দের মানুষের কাছে। এখানে আমাদেরই এত লাঞ্ছনা সইতে হবে,আমাদেরই কেবল কষ্ট সইতে হবে! কেন?
অত:পর আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। আমি হেরে গেলাম।
সবাই জিতে যাক। ভালো থাকুক আমার আম্মু।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here