রাকা-৪

0
1013

রাকা-৪
ফারজানা রহমান তৃনা

সেদিন নিউমার্কেট থেকে ফিরে আসতে আসতে দেরী হয়ে গিয়েছিলো অনেক। আম্মু আর আংকেল ফিরে আসতে প্রায় এক ঘন্টার বেশি দেরী করে ফেলেছিলো। তারপর জ্যাম পেরিয়ে বাসায় আসতে আসতে হয়ে যায় সন্ধ্যা। আব্বু প্রতিদিনই সন্ধ্যার দিকে বাসায় আসে। চা টা খায়, টিভিতে নিউজ দেখে, আম্মুর সাথে কিছুক্ষন খোশগল্প করে আবার দোকান দেখতে চলে যায়।

আমরা বাসায় পৌঁছে দরজার সামনে গিয়েই বুঝে যাই,আব্বু এখন বাসায়। বাইরে আব্বুর জুতা পড়ে আছে। আম্মু সাথে সাথে আমার স্কুল ব্যাগ থেকে কালো বোরখাটা বের করে তাড়াতাড়ি ওটা পরে নেয়। ভেতরের ওড়না দিয়ে লিপস্টিক মুছে ফেলে আস্তে আস্তে কড়া নাড়ে দরজায়।

দরজা খুলে দিলো আমার আপু। আপু চোখের ইশারায় জানিয়ে দেয়, ঘরে আব্বু আছে।
আম্মুকে আবার ফিসফিস করে বলে,
– আমি আব্বুকে বলছি তুমি পাশের বাসার একটা অনুষ্ঠানে গেছো রাকাকে নিয়ে। আমি যাইনাই কারণ আমার এসব ভালো লাগেনা। তুমি তাড়াতাড়ি বোরখাটা খুলে আমার কাছে দাও। আর তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকো।

আম্মু ও ফিসফিস করে বলে,
– তুই আবার এটা বলতে গেলি কেন! আমিই তো ম্যানেজ করে নিতে পারতাম। এখন যদি ধরা পড়ে যাই!
আপু বলে,
– আমি কি করবো। আব্বু এসেই রাগারাগি করছে কিছুক্ষন। বার বার জিজ্ঞেস করতেছিলো তোমার কথা। তাই হুট করে মাথায় যা আসছে তাই বলে দিছি।

আম্মু আর কথা বাড়ালো না।
আমাদের ভেতরে ঢুকতে হলো খুব সাবধানে। আব্বু ড্রয়িংরুমে টিভি দেখতে দেখতে চা, সিগারেট নিচ্ছিলো।
আমরা ডায়নিং রুম কোনোরকমে পেরিয়ে যেতেই আব্বুর ভারী স্বর শোনা গেলো।
– কই গেছিলা এত সাজগোজ করে?

আম্মু হকচকিত হয়ে তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয়,
– ঐ তো তানিশা বলছে না আপনারে, পাশের বাসায়…
আব্বু জোরে বলে উঠে,
– থামো তুমি! তানিশা বলছে! এই মেয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলে আমি জানি। ও, তুমি পাশের বাসায় গেছো? কই পাশের বাসায় তো আজকে কোনো অনুষ্ঠান নাই। আমি তো ভাইয়ের সাথেই আজ বাসায় ফিরলাম। সারাক্ষন ঐ ভাইয়ের সাথেই ছিলাম। এমন কিছু হইলে কি আমাকে বলতো না? আর আমি যতদূর জানি, তোমার তো কোনো বাসার কোনো ভাবীর সাথেই বনিবনা হয়না। তাইলে?
আর ঐ বাসায় তো আজকে শোক দিবস। বুড়িটার মরমর অবস্থা। তুমি আমাকে বুঝাও? কই গেছিলা বলো।

আম্মু থর থর করে কাঁপতে থাকে।
আব্বু টিভির দিকে তাক হয়ে সিগারেটে আগুন ধরাচ্ছে।
আপু ততক্ষনে ভয় পেয়ে চলে গেছে তার রুমে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি নিঃশব্দে ।

আব্বু আবার চেঁচিয়ে উঠলো,
– কী হইছে? উত্তর দেওনা কেন?
আম্মুর মুখ তখন ছানাবড়া হয়ে কুৎসিত কোনো পোকার রুপ ধারণ করে আছে।

আমার দিকে একবার তাকিয়ে আব্বু বলে,
– আচ্ছা অনু,তুমি আমার এই মেয়েটাকে সাথে নিয়ে যাও কেন? তোমার প্রেম পিরিতি দেখাইতে? তুমি না মা! নিজের মেয়েকে এই শিক্ষা দাও?
কথাগুলো বলতে বলতে আব্বু উঠে আসে।
আম্মুর হাত থেকে টান দিয়ে শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে নেয়।
তারপর সব এক এক করে বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বলে,
– বাহ্! হাজার হাজার টাকার জিনিস দেখছি! তোমাকে কি আমি এগুলা কিনে দেইনা অনু? তোমাকে তো আমি প্রতি মাসেই তোমার প্রয়োজনীয় টাকাটা দিয়ে দেই। তাহলে কেন এগুলা অন্য কারো থেকে নাও? বলো?

আম্মু এবার টেনে টেনে বলে,
– আমার এক বান্ধবী কিনে দিছে। না করি ক্যাম্নে বলেন…

আব্বু কঠিন চেহারা করে বলে,
– ধুর, রাখো তোমার বান্ধবী। কোন বান্ধবীর এত দরদ উঁতলায়ে পড়ছে যে এতকিছু কিনে দিবে! আর তোমার যে ঘনিষ্ঠ কোনো বান্ধবী টান্ধবী নাই,এইটা আমি জানি। আমাকে গাঁধা পাইছো? কার সাথে গেছো মার্কেটে? বলো অনু।

আম্মু ভ্রু কুঁচকে চোখজোড়া দিয়ে এলোপাথাড়ি তাকাতে থাকে।
আব্বু উত্তর না পেয়ে আম্মুর খুব কাছাকাছি এসে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে আবার,
– বলো কই গেছো,কার সাথে গেছো। না বললে আজকে আর রক্ষা নাই তোমার।
আম্মু উত্তর দেয়না। বাসে করে আসতে আসতে আম্মু আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছে,কোনোভাবেই যেন আব্বুকে কিছু না বলি। কোনো কথাই না বলার জন্য বলেছে।

কিন্তু উত্তর না পেয়ে আব্বুর রাগ বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় চলে যায় যে, আব্বু আম্মুকে ধাক্কা দিয়ে দেয়।
আমি মনে মনে ভয় পেতে লাগলাম।
আজকে আবার মারবে নাতো?
এবার তো নিশ্চয় মারবে!

আমি আর সহ্য না করতে পেরে বলেই দেই।
নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বলে দিলাম,
– আব্বু আম্মু আর আমি মার্কেটে গেছিলাম আজকে। একজন আন্টি ও ছিলো আমাদের সাথে।
আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
– তাই! আচ্ছা বাবা, তোমার আন্টির নাম কী? ফোন নাম্বার দিতে বলো তো তোমার আম্মুকে।
আম্মু এবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো আমাকে। তারপর আমি আন্দাজে নাম বলতে নিলে, আম্মুই হাতের আঙুলে ইশারা দিয়ে বলে, চুপ করো।
তাই আমি চুপ করে গেলাম তখনই।
আব্বু উত্তর না পেয়ে বুঝলো, আমিও মিথ্যা বলেছি।

তারপর আমাকে কোলে করে নিয়ে গেলো আমার রুমে। নিয়ে গিয়ে বাইরে দিয়ে দরজা লক করে দিয়েছিলো।
ঘন্টাখানেক যাবত এভাবেই পড়ে ছিলাম।
মাঝেমধ্যে আঁ,উঁ আওয়াজ পেয়েছি, বুঝেছিলাম আম্মুকে মারছে, আবার কিছু তর্কাতর্কি ও শুনলাম। আম্মুর গলার আওয়াজই বেশি।
কিছুক্ষন চিৎকার করে কেঁদেছি,আব্বুকে ইচ্ছামত বকেছি। তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে গেছিলাম।

পরের দিন সকালে।
ঘুম থেকে উঠে দেখি আম্মু ব্যাগ গুছিয়ে সব রেডি করে ফেলছে।
আমরা আমাদের নানুর বাড়িতে যাচ্ছি।
আহ্ কি আনন্দ। আমাদের নানুর বাড়ি হলো গ্রামে। টিনের তিন তিনটা বাড়ি, তিন মামার। পুকুরঘাট আছে। পুকুরেই গোসল করতে হয়।
কিন্তু আমি ছোট মানুষ, শহরে বড় হয়েছি, সাঁতার ও জানিনা।
তাই নানুবাড়ি গেলে কলেই গোসল সারতাম।
হাঁস মুরগীর খোঁয়াড় আছে সেখানে। প্রতিদিন সকালে উঠে সবার আগে ওখানে যেতাম নানুসহ। ওখান থেকে মুরিগীর ডিম, হাঁসের ডিম সংগ্রহ করতাম। ঐ ডিম ভেজে রুটি দিয়ে খেতাম। পুকুরের মাছ ধরতাম ছিপ-বালাম দিয়ে।
মাটির চুলায় রান্না। সে কি মজার দিনাতিপাত ছিলো!

তাই এতদিন পর নানুর বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে তো খুশিতে গদগদ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা আমার।
তারপর আর কি,আম্মু আব্বুর সাথে রাগ করে চলে আসে গ্রামের বাড়িতে। আমরা প্রায় তিন-চার মাস নানু বাড়িতেই ছিলাম। এত লম্বা সময় আমি আমার জন্মের পরে এই প্রথম কাটালাম।

আমার নানা নেই।
তিন মামা আছে। বড় মামা গ্রামের খুব নামীদামী মানুষ। আম্মুর মুখে যখন শুনলো, আব্বু আম্মুকে প্রায়াশই মারে, তখনই সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো- ” ক্ষমা না চাইলে, অনুকে আর কখনোই ওখানে যেতে দিবোনা। ওকে ওর বউ ফেরত দেওয়া হবে না ততদিন যাবত। ব্যস।
কত বড় স্পর্ধা, আমার বোনের গায়ে হাত তোলে!”

আব্বু অনেকবার ফোন করেছে তবুও।
মামাদের কাছে,নানুর কাছে।
বার বার শুধু বলতো, আমার মেয়ে দুইটাকে ছাড়া কেন আমাকে থাকতে হচ্ছে? আমার মেয়েদের সাথে কথা বলতে দেন না কেন আপনারা?

আমরা দুই মেয়েই আব্বুর প্রাণ বলা চলে।
কিন্তু আব্বু ফোন করলে আমাদের সাথে কথা বলতে দিতো না।
আমরাও কথা না বলেই ছিলাম।
আসলে ঠিক তা না। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে আব্বুকে ফোন দিতাম মাঝেমধ্যে।
কখনো নানুর ফোন দিয়ে,কখনো বা কোনো মামির ফোন দিয়ে। যখন যেটা সামনে পেতাম ওটা দিয়েই ফোন দিতাম। কারণ স্কুলের একটা লেসনে সেল্ফ সেইফটির জন্য বাবার নাম্বার মুখস্থ করতে হয়েছিলো। তারপর আবার ডায়াল লিস্ট চেক করে ডিলেট করে দিতাম।

আপু তো একবারের জন্য ও ফিরতে চায়নি। আমিই বার বার বলেছিলাম, আব্বুর কাছে যাবো। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

আম্মুসহ যখন নানুর বাড়িতে ছিলাম, তখন এক অন্য আম্মুকে আবিষ্কার করেছিলাম আমি।
দিন-রাত মিলিয়ে আনুমানিক বিশ-ত্রিশবার কল আসতো তার। মাঝেমধ্যেই তার দেখা পাওয়া যেত না ঘন্টার পর ঘন্টা।
একদিন আমাদের কিছু না বলেই কোথায় যেন থেকে যায়।

বড় মামা ফোন করলে জানায়,
চাচাতো বোনের বাসায় গিয়েছে।
রাতে আর ফিরবে না।
কোন চাচাতো বোনের বাসায় বা কোন জায়গায়, সেটা আর জানালো না। মামা ও জানার চেষ্টা করেনি। মামারা কেউই ঘাঁটায় না তাকে। নানুও না।

আম্মুর দেখাদেখি এখন আপুও তাই করে।
তাকে ও সারাক্ষন ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। বিছানায় আমরা তিনজন শুতাম।
রাতে দেখা যেত, আম্মু একপাশে শুয়ে বা বসে ফোনে কথা বলছে। কখনো চুপচাপ হয়ে শুনছে কখনো বা কোনো হাসির কথা শুনে খিল খিল করে হাসছে।
আরেকপাশে তানিশা আপু ও একই কাজ করছে। তবে একটু সাবধানে। আপু বেশি জোরে কথা ও বলছে না, হাসছেও না। মাঝখান দিয়ে আমিই শুধু একা একা এসব দেখে যাচ্ছি।
যদি আম্মুর কাছে গিয়ে বলতাম,
কার সাথে কথা বলো আম্মু? আব্বুর সাথে? আমাকে ও একটু দাওনা। আমিও একটু বলি।
আম্মু আমাকে হয় চোখ পাঁকিয়ে ইশারায় চলে যেতে বলতো, নতুবা বলতো, তোর নানুর কাছে যা।
অথবা বলতো, ঘুমাগে যা।

এরপর একদিন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে।
আব্বু আমার এক্সামের আগে আগেই গ্রামের বাড়িতে চলে আসে। আব্বু আসার পর আদর-আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি ছিলো না।
মেয়ে জামাই বলে কথা।
আম্মু তখন ও বাড়িতে নেই।
তানিশা আপু আব্বুকে দেখে তটস্থ হয়ে আছে। আর সন্ধিক্ষণ দেখছে, কখন আম্মু এসে হাজির হবে। নাজানি আবার দুজনকে নিয়েই বাসায় চলে যায়। আপু ভুগছিলো এসব উদ্বিগ্নতায়।

আব্বু আসার পর আপু একবারো আব্বুর সামনে যায়নি। একবার ও জিজ্ঞেস করেনি, আব্বু কেমন আছো? আমি আসামাত্রই আব্বুর কোলে উঠে বসেছিলাম। আব্বুই পরে নিজেই ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো তানিশা আপুকে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করলো, আপু উত্তর দিলো।

বিকেল বেলার দিকে, আব্বু পারিবারিক আলোচনার এক ফাঁকে গোপনে বড় মামাকে আম্মুর অবৈধ কোনো সম্পর্ক আছে, এমন দাবি জানায়।

মামা তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলে,
– ধুর মিয়া! এই বয়সে এগুলা কি বলেন! অনুর দুই মেয়ে আছে না? এহন এমন করার কোনো অর্থ আছে? আর অনু খুব বুঝদার মেয়ে। এমন কিছুই না। আমি বললাম তো, আপনি মিলায়ে নিয়েন।

আব্বু যখন জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা! তো কই? এখন কই আপনার বোন? আমি তো সকালে আসার পর থেকে একবারের জন্য ও তাকে দেখলাম না। কোথায় সে?

মামা তখন কাচুমাচু করতে থাকে।
মামিদের ডেকে জিজ্ঞেস করার পর উত্তর আসে, অনু সম্ভবত ওর চাচাতো বোনের বাসায় গেছে।
মামা হাসিমুখে বলে তখন,
– ঐযে.. শুনলেন ই তো। অনু ওর চাচাতো বোনের বাসায় গেছে। চলে আসবে। দাঁড়ান! আপনি চা খান তো নিশ্চিন্তে!

আব্বু কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে,
– কোন চাচাতো বোনের বাসায় গেছে আপনার বোন? দয়া করে ঐ বোনের ফোন নাম্বার দিতে পারবেন?
– ফোন নাম্বার! ফোন নাম্বার দিয়ে কী করবেন?
– ফোন নাম্বার দিয়ে যা করে লোকে,তাই করবো। কল করবো ওকে। অনুর বর্তমান অবস্থা জানবো। আসলেই ও ওখানে আছে কিনা।

বড় মামা হচ্ছে মাথা গরমওয়ালা মানুষ। তাই অল্পতেই রেগে আগুন হয়ে যায়।
মামা কঠিন চোখে তাকিয়ে এবার জিজ্ঞেস করে,
– ভাই সাহেব, আপনি তো দেখছি সত্যি সত্যিই খুব প্যাঁচাল মার্কা মানুষ! আপনি কি সন্দেহ করেন নাকি ওরে? আমার তো এইবার মনে হইতেছে, সমস্যা আপনের আছে। আমার বোনের না।আপনিই খুব একটা সুবিধার লোক না। শুনছিলাম,আপনি ওর গায়ে ও হাত তুললেন।

আব্বু নরম স্বরে বলে,
– ভাই কম দু:খে এসব করিনা। বুঝলেন? আপনার যেমন বোন, আমার তেমন স্ত্রী। ও আমার দুই মেয়ের মা ও। আমি ওকে কোন পজিশনে গেলে মারি একবার বোঝার চেষ্টা করেন। আচ্ছা, আপনি এখনই আমাকে ওর নাম্বারটা অথবা ওর চাচাতো বোনের নাম্বারটা দেন না। আমি আপনাকে প্রমাণ দিচ্ছি।

– দাঁড়ান। আমি নাম্বার নিয়ে আসতেছি। আমি নিজেই কল দিবো ওকে।
বলে মামা মামিদের কাছে চলে যায়।
নানুও উপস্থিত সেখানে।

কিন্তু কেউ সেই অজ্ঞাত চাচাতো বোনের নাম্বার জানেনা। চেনে কিনা তাও নানু স্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাচ্ছেনা।
মামা ফিরলেন হতাশ হয়ে।
নাম্বার জোগাড় করা যায়নি।
অনুর নাম্বারে তিনি নিজেই কয়েকবার ডায়াল করে ব্যর্থ হয়েছেন।
তার নাম্বার অফ আসছে বার বার।

আব্বুর সামনে এসে মাথা নিচু করে বললেন,
– আপনি একটু অপেক্ষা করেন। ও চলে আসবে। আজকে রাতে না আসলে কালকে সকালেই চলে আসবে।

আব্বু কঠিন গলায় বলে তখন,
– এরকম কি দুই দিন পর পরই করে নাকি? বাহ্,ভাবলাম বাড়িতে গেলে হয়তো ফ্যামিলির চাপে একটু ঠিক হবে। এখন তো দেখছি, রাত কাটানোর স্টেপটাও আর বাকি নেই। আপনারা আপনাদের মেয়ে রাতে বাড়ি ফিরছে না, অজ্ঞাত কোনো চাচাতো বোনের কাছে যাওয়ার নাম করে অন্য ছেলেপুলের কাছে গিয়ে রাত কাটায়, নিজের দুই দুইটা মেয়ে থাকা সত্ত্বেও। এরপর ও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না আপনারা? ওকে তো আপনারাই বুঝিয়ে ঠিক করতে পারতেন। আমি তো আমার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেও পারিনাই।
এমন একটা অবাধ্য মেয়ে আমার কাছে ছেড়ে দিয়েছিলেন আপনারা?
আমার জীবন তো ধ্বংস করে দিয়েছেন আপনারা ভাই। কী ক্ষতি করছিলাম আপনাদের?

মামা কোনোভাবেই আর বোঝাতে পারলো না আব্বুকে।
আব্বুকে জোর করে রেখে দেওয়া হলো পরের দিন সকাল পর্যন্ত। মনে মনে সারাক্ষনই অপেক্ষা করে গেলো আব্বু, এই বুঝি আম্মু দরজায় টোকা দিচ্ছে!
কিন্তু না। আম্মু আর ফেরেনি।
এমনকি সকালে ও না।

সকালে উঠেই আব্বু আমাদের কাছে এসে বললো, সব গুছিয়ে নিতে।
আমরা আজকেই ঢাকায় চলে যাচ্ছি।
কথাটা শুনে আপু খুশি হলো না।
বাসায় চলে গেলে তার এই বাঁধাহীন সুন্দর জীবন আর উপভোগ করা যাবেনা।
আপুর জীবনের আইকন হচ্ছে আমার আম্মু।
তাই সে আম্মুর মতই আনন্দঘন লাইফ চায়।

আব্বু কোনোভাবেই আপুকে রাজি করাতে পারলো না।
আব্বুর নিখাদ আদর, সোহাগ কোনোটাই তার মন গলায় নি।
আব্বু বাধ্য হয়ে আমাকে নিয়েই চলে আসে বাসায়।

তারপর আমার এক্সামের প্রস্তুতি চলতে থাকে দু মাস। আপন স্যার আমাকে এক্সামের জন্য খুব ভালোভাবেই তৈরী করে দেয়।
আমার আম্মু মাঝখানে একদিন ফোন করে আব্বুকে সাফ কথা জানিয়ে দেয়,
সে আর ফিরবে না আমাদের বাসায়। তার বড় মেয়েকে যেন সে নিয়ে যায় তার কাছে। সে পারবে না রাখতে।

আব্বু কিছুই বলেনি।
দু মাস পর মামারা আম্মুকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কোনোমতে আবার ঢাকায় নিয়ে আসে। আব্বুর হাতে-পায়ে ধরিয়ে মাফ চাওয়ায় আম্মুকে দিয়ে। আব্বু খুব কঠোর থাকা সত্ত্বেও আর কঠিন থাকতে পারলো না। ক্ষমা করে দেয় আরো একবার।
আম্মু ওয়াদা করে সবার সামনে, আর কখনো এমন কিছুই করবেনা। দুই মেয়ে রেখে এমন কিছু করলে নাকি তার রুহ্ তাকে বদ-দোয়া দিবে। আমাদের ছাড়া নাকি থাকতে পারেনা। আরো কত কী….

আব্বু আরো একবার বিশ্বাস করে…
বাসায় আবার আশ্রয় দেয় আম্মুকে।

আমার ক্লাস ফাইভের পরীক্ষা শুরু হয়ে যায় কিছুদিন পরেই। আম্মু আমার খেয়াল রাখছিলো মোটামুটি ভালোই। আব্বু যখন বাসায় থাকতো তখন একটু বেশিই যত্ম করতো। হয়তো আব্বুর মন যোগানোর জন্যই। অথবা অন্য কোনো কারণ ছিলো এর পেছনে।

তবে আপুকে শাসন করা যেত না।
আব্বু কিছু বললেই ও ওর আত্বহত্যা করার হুমকি শুনিয়ে দেয়। আর আম্মু তো ওকে কিছুই বলেনা। কোনোদিন কোনো বিষয় নিজের চোখে দেখলেও ডাক দেয়না।
আমার পরীক্ষা শেষ হলো নির্বিঘ্নে।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার মাসখানেক পর আবার সব আগের মত হয়ে যায়।
আম্মু আবার একই কাজ করতে শুরু করে। ফলপ্রসূ, প্রতিদিন বাসায় ঝামেলাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হতে লাগলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here