রাকা (১৪)

0
642

রাকা (১৪)
ফারজানা রহমান তৃনা

অনু চৌধুরীর ফোন আসার পর থেকেই আব্বুর আর্তনাদে সারা বাড়ি মুখরিত হয়ে গেলো।
বিষয়টা আর এক জায়গায় থেমে নেই।
অনেক দূর ছড়িয়ে গেছে।
কায়সার ফুফা বাসায় এসে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। দাদিকে ফোন করে সবটা জানানো হলো। দাদি মুখ উল্টে শুধু বলেছে,
– জানতাম! জানতাম আমি এমন কিছুই হইবো! যার মা অমন সেই মেয়ে আর ভালো হইবো কেম্নে? এইবার আমিও দেখি আমার এই পোলা আর কতদিন এই অনুর চিহ্ন নিয়া পইড়্যা থাকতে পারে।

ফুফা কোনোভাবেই রাজি করাতে পারলো না তাকে, আমাদের বাসায় আসতে।
আব্বু আগে থেকেই জানে,
এই ঝড় তাকে একাই সামলাতে হবে।
পাশে পাবে একজনকে।
নিজের অবুঝ, ছোট্ট মেয়ে, রাকাকে।
যে কিছুই করতে বা বুঝে উঠতে পারছেনা,কি কি ঘটে যাচ্ছে তার চারপাশে। আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরেই ঘন্টার পর ঘন্টা কেঁদে পার করে দিলো।
আমিও কাঁদলাম। আমার মনে ও প্রগাঢ় কষ্ট এসে ভীড় করেছিলো এই ভেবে, এক এক করে সবাই
আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে!
আচ্ছা, এরপর কার পালা?

অনু চৌধুরীকে ফোনে আর পাওয়া যায়নি।
সে আর ফোন রিসিভই করেনি ভয়ে।
আব্বু তাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতো,সাথেও ফুফাও করতো-
কিন্তু সে আর সম্ভব হয়ে উঠেনি।
আর অনু চৌধুরী তো বলেই দিয়েছে, মেয়ে অবাধ্য, তার কোনো কথাই কানে তোলেনা।
উপরন্তু তাকেই জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে লাফাতে লাফাতে বিয়ে করে নিয়েছে ঐ ছেলেটাকে।
আব্বু কিছুতেই মানতে পারছেনা,
এমন বখাটে ছেলের সাথে তার নিজের বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
সে তানিশার ফোনে এখনো ফোন দিয়েই যায়। ফোন বন্ধ।

অবশেষে,সেই রেশ কাটাতে কাটাতে ও এক সপ্তাহ শেষ হয়ে গেলো।
রফিকের বস্তি বাড়িতে হানা দেওয়া হয়েছে কয়েকবারই। কিন্তু ওখানে তারা নেই।
রফিকের আব্বা-আম্মা,ভাই-বোন আছে শুধু।
তাদের সাথে কথা বলাও দুষ্কর।
এমন ভাব আর বাজে স্বভাব যেন গায়ে পড়ে ঝগড়া করে ফেলবে।
কিংবা ১৯/২০ হলেই গায়ে হাত তুলবে।
তাদের তেমন কিছুই বলা যায়নি। এরা একেবারেই নিচু বংশ থেকে উঠে এসেছে, এদের ব্যবহার ও তাই অতিব নিম্নমানের। কথাই ছোঁয়ানো যায়না। তাই ছোট ফুফা আর আব্বু ব্যর্থ হয়েই ফিরে এসেছে বার বার।

আব্বু ইতোমধ্যেই একবার অনু চৌধুরীকে ফোন করেছে। অনু চৌধুরী ও ফোন রিসিভ করেছে।
তাদের মধ্যের কথোপকথন,
– অনু, তুমি কি সত্যিই জানো না, আমার তানিশা এখন কোথায় আছে?
– না। তানিশার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নাই। ওর ফোন সবসময় খোলা থাকেনা। অন্য সিম নিছে বোধ হয়।
– ওর এখনকার নাম্বারটা আমাকে দাও।
– ওর নাম্বার দিয়েও লাভ নাই। সে আমাকেও দেয়নাই। ঐ ছেলে খুব চালাক। তানিশাকে তানিশার আগের সিম দিয়েই আমার সাথে কথা বলায়,তারপর কথা বলা শেষ হলে আবার খুলে রেখে দেয়।
– ও। তারমানে তোমাকে তানিশা প্রায়ই ফোন করে?
– একদিন একটু হইছিলো। এই ৫মিনিট! কিন্তু কেন যেন কথার মাঝখান দিয়েই কেটে দিছিলো। আর এখন পর্যন্ত কোনো ফোন আসেনাই।
– আচ্ছা, ওকে বলবা, ওর কোনোপ্রকার সমস্যা হচ্ছে কিনা ওখানে, আমাদের এটা অন্তত যেন জানায়। এটাও বলে দিবা, ও চাইলে এখনো আমার কাছে ফিরে আসতে পারে। আমি ওকে আবার বিয়ে দিবো। খুব ভালো জায়গায় ওর বিয়ে দিবো। ওর সব ইচ্ছা পূরণ করবো আমি। দয়া করে মেয়েটাকে বুঝাইয়ো,এই ছেলের সাথে ও টিকতে পারবে না। শুনছি এই ছেলে মাতাল। কে জানে কেমন আছে আমার তানিশা।

এসব শুনে অনু চৌধুরীর চোখ ভিজে গেলো। আসলেই লোকটা ভালো।
কিন্তু রফিক যে মাতাল ও,এটা তার জানা ছিলো না। তানিশার কি অবস্থা, কে জানে.. ফোন ও করেনি মেয়েটা।
অনু চৌধুরী এসব ভাবছে আর নিজের স্বাদের টক-ঝাল-মিষ্টি আমের আচার গোগ্রাসে খাচ্ছে।


আজমল উদ্দীনের টাকার অভাব হলেও ভালোবাসার কোনো অভাব নেই।
তা এই ক’দিনে খুব ভালো করেই অনু চৌধুরী বুঝে গেছে। কিন্তু আজমল উদ্দীনের এই বড়লোক ভাবের রহস্যটা সে কিছুতেই ভেদ করতে পারছেনা।
আজমল উদ্দীন এটার জন্য মাফ ও চেয়েছে বার বার করে। ঢাকার বড়ো,সুন্দর বাসাটা ছেড়ে এখন দুই রুমের ছোট্ট বাসায় উঠতে হয়েছে।
কিন্তু আজমল এখনো তার শখ পূরণ করে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই এটা-ওটা নিয়ে আসছে সে,অনু চৌধুরীর মন পাওয়ার জন্য। অনু চৌধুরী ও আর রাগ চেপে রাখতে পারলো না। আজমলের বাচ্চা তার পেটে। রাগ চেপেও আর লাভ নেই। আজমলের সাথেই সে থাকবে বলে স্থির করেছে। আর পিছু ফিরে দেখা যাবেনা।
ফিরলেও লাভ নেই কোনো।
রেজা চৌধুরীর দেওয়ার মত সবকিছুই মোটামুটি সে সাথে করে নিয়ে এসেছে।
আর ফিরে গেলেও বা নতুন করে কি দিবে?
এখন যা পাওয়ার সব আজমলের থেকেই পাবে। তার সব শখ আহ্লাদ পূরণ করার দায়িত্ব এখন শুধু একজনেরই। আজমল উদ্দীন।

এভাবে এভাবে চলে গেলো অনেকগুলো দিন। আমি কিছুদিন হলো আবার স্কুলে যাওয়া আরম্ভ করেছি। আপন স্যার আমাকে খুব ভালো সাপোর্ট দিচ্ছে। ক্লাস শেষে একদম একান্তে আমাকে পড়াচ্ছে। আমার পড়াশোনার গ্যাপটা সে পূরণ করে দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আমিও খুব আগ্রহ নিয়েই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। আব্বু আমার লেখাপড়ার মনোযোগ দেখে খুশি হলেও সে খুশি প্রকাশ করেনি।
সে সারাদিনই মুখ অন্ধকার করে রাখে।
আমার সাথে ঠিক করে কথা বলেনা।
সব জায়গাতেই এমন। তার জবান বন্ধ হয়ে গেছে। না পারতেই কথা বলে। এরকমটাই সবাই বলে।
কিন্তু আমি বলিনা। কারণ আমার পৃথিবী এখন শুধু একজন মানুষ নিয়েই পরিপূর্ণ।
সে হলো আমার আব্বু।

এই মধ্যে তানিশা আপু না আমাদেরকে ফোন করেছে না করেছে অনু চৌধুরীকে। আমি তো রোজ বাসার ফোন দিয়ে আপুকে কল দেই। যদি খোলা পাই,এই আশায়। হয়তো আব্বুও লুকিয়ে লুকিয়ে তাই করে।

হঠাৎ একদিন অনু চৌধুরীর কাছে তানিশা ফোন দিলো।
অনু চৌধুরী প্রথমে রিসিভ করতে পারেনি।
তার এখন অবস্থা খারাপের দিকে।
পেট ফুলেছে একটু একটু। সারা শরীর ব্যথা ব্যথা। কাজের মেয়ে রেখেছে কিন্তু বেতন পায়না ঠিকমত তাই সেও ভেগেছে। তাই তার নিজ হাতেই সব সামলাতে হচ্ছিলো সেদিন।
সব কাজ শেষ শুতে গিয়ে যখন দেখলো অচেনা নাম্বার থেকে কল, তখনই সে কলব্যাক করলো।
কল রিসিভ হলো।
ওপাশ থেকে ক্যাঁচক্যাঁচ করে কে যেন বললো,
– হ্যালো কে আফনে?
– আমি অনু। আমাকে ফোন করছিলেন এই নাম্বার থেকে ঘন্টাখানেক আগে।
– ও আচ্ছা। তাইলে তানিশা ভাবিই হবে।
তানিশার নাম শুনেই তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
– হ্যাঁ হ্যাঁ। তানিশা কই?
– আপনি লাইনে থাকেন, আমি গিয়া দেহি ভাবি ফ্রি আছে কিনা।

অনু চৌধুরী লাইনেই থাকলেন।
মেয়ের অবস্থা জানা যাবে এই আশায়।
কতদিন হয়ে গেলো ফোন পায়না।
অত:পর তানিশার গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো।
– হ্যালো আম্মু।
– হ্যাঁ। বল। কেমন আছিস? কী অবস্থা?
তানিশা কাঁদো কাঁদো গলায় উত্তর দিলো,
– ভালো না আম্মু… তুমি কেমন আছো?
– আমি আছি ভালোই। কিন্তু তুই ভালো নাই ক্যান? কী হইছে?
– আম্মু রফিক আমাকে মারছে।
– মারছে মানে?
– ও অনেক রাত করে বাড়িতে ফিরে। কি জানি খেয়ে আসে প্রতিদিন। মুখের গন্ধে টেকা যায়না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেই রেগে যায়। মারে।
– বলিস কি!
– ও আমাকে খুব ভালোবাসে আম্মু.. কিন্তু..
– কিন্তু কী? আর ভালোই যখন বাসে তহন মারে ক্যান?
– সবাই ই তো শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক নেয়। যৌতুক না হলেও অনেকে শখ করে এটা ওটা জামাইকে দেয়। রফিককে তো তোমরা কিছুই দিলানা.. অবশ্য তুমি তো দেওয়ার কথা না। আব্বু দিবে। কিন্তু আব্বুর সাথে তো কথা বলারই সাহস হয়না।
– তোকে এইসব দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারে কেউ খোঁটা দিছে নাকি?
– হ্যাঁ। প্রতিদিনই তো উঠতে বসতে শুনয়ে হয় এসব। সয়ে যাচ্ছে আমার। তবুও… আর ভাল্লাগেনা.. অশান্তি লাগে সব…
– কে খোঁটা দেয়? তোর জামাই?
– শাশুড়ি আর জামাই। দুজনেই।
– কী বলে? তারে কিছু দেয়না এটা?
তারে দিবো ক্যাম্নে? সে তো আমগো মেয়েরে ভাগাইয়া নিয়া বিয়ে করছে আমগো অমতে। খুব বড় বড় গলায় বলছিলো না,ভা_লো_বা_সে? কই এখন কই তার ভালোবাসা? বই পেটায় ক্যান? যৌতুক চায় ক্যান? দেখছোস তানিশা? তোরে আমি বলছিলাম না,এই ছেলে ভালো হইব্যো না? দেখলি তো?
– আম্মু সবাইকেই তো যৌতুক দেয়। রফিককে তো তোমরা কেউই কিছুই দাওনাই। ওর তো এত টাকাও নাই জানো তো.. আর..
– আর কী?
– কিছুনা।
– শুন, তোকে কি বেশিই মারে নাকি রে?
– না। আমি ভালোই আছি।
– শুন তানিশা, তোর আব্বু বলছে তুই এখনো যদি তোর বাপের কাছে ফিরে যাস, সে তোকে ঘরে রাখবে। তোর আবার নতুন করে ভালো জায়গায় বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবে। বুঝলি? তুই শুধু আমাকে একবার বল। আমি তাকে জানাই। তোর বাপ এখনি তোকে বাড়িতে নিয়ে যাবে।
তানিশা কাঁদো কাঁদো গলাতেই শক্ত হয়ে বললো,
– না আম্মু। এখন রাখি। আবার পরে কথা বলবো। তোমার সাথে কথা বললে খুব ভালো লাগে আম্মু।
– আচ্ছা রাখ। ফোন দিস তুই।
– আম্মু শোনো,
– বল।
– তোমার কাছে কিছু টাকা হবে?
– ক্যান? টাকা দিয়া কী করবি?
– আমার একটু লাগতো….
– তোর কি লাগবে বল, আমি কিনে পাঠিয়ে দেই।
– কিছু লাগবে না। শুধু টাকা লাগবে।
– কত টাকা?
– এই ১০-১৫,০০০’র মত…
– তুই এত টাকা দিয়ে কি করবি!
– এত কিছু বলতে পারবো না। আমার খুব জরুরি..
– কিন্তু এত টাকা তো আমার হাতে নাই। আমি কিভাবে দিমু তোরে?
– কিভাবে দিবা আর? জোগাড় করে দিবা! আংকেলের তো টাকার অভাব নাই!
– আরে…. বুঝোস না…তোর আংকেলতো এখন এত টাকা দিতে পারবো না, মাসের শেষ সময়…
– থাক থাক হইছে! বুঝছি। লাগবেনা আমার তোমার টাকা।
বলে পট করে ফোনটা কেটে দিলো তানিশা।

অনু চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে আক্ষেপ প্রকাশ করলেন।
আব্বুকে কল দিয়ে বললেন,
– আপনার মেয়ের ২০,০০০ টাকা লাগবে।
– কোন মেয়ের?
– বড়টার আরকি!
– তো ওর টাকা লাগলে আমি কী করবো? ও আমার মেয়ে, আমার কাছে থাকলে ওর যত টাকা লাগবে আমি দিতে রাজি। কিন্তু ঐ ছেলের সাথে থাকলে তো আমি তাকে ১টাকাও দিবোনা। কেন দিবো?
– মেয়ে এতদিন পর একটা জিনিস চাইছে…
– চাইছে মানে! ওর চাওয়ার কোন জিনিসটা আমি ওকে দেইনি?
– আচ্ছা শুনেন, মেয়েদের বিয়ে হলে তো মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে অনেক কিছুই দেওয়া লাগে। আপনি তো কিছুই দেন নাই। এখন কিছু হলেও দেওয়া লাগে ওর জামাইরে। আপনার তো মেয়ের সুখের কথা ভাইব্যা হলেও কিছু পাঠানো উচিত ঐ বাড়িতে।
– মানে! আমি আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে লাখ লাখ টাকার জিনিস পাঠাবো। আমার এত ব্যবসা, এত টাকা-পয়সা সব তো ওদের জন্যই। কিন্তু আমিতো তানিশার শ্বশুরবাড়িকে শ্বশুরবাড়ি বলে মানিই না। তাহলে আমি কেন ঐ বাড়িতে জিনিস পাঠাতে যাবো। পাগল হইছো নাকি?
– আহা… আচ্ছা মেয়ের জামাইরে কিছু না দেন ঠিক আছে। কিন্তু এই ২০,০০০ টাকা তো আপনার মেয়ে তার নিজের জন্য চাইছে। এইটা তো অন্তত তারে দেন?
আব্বু হেসে বললো,
– হাহ্ হা! মেয়ের নিজের জন্য। যেই মেয়ে
আমার কথা ভাবেনা, তার জন্য আমি ভাববো কেন? আর তার টাকার দরকার হলে সে আমাকে ফোন করবে।
আমার সাথে কথা বলবে। তোমার সাথে কিসের কথা বলে? শিক্ষা নেয় নাকি? তোমার নিজের অভিজ্ঞতার শিক্ষা দাও?

অনি চৌধুরী এবার রেগে গেলেন।
ফোঁস ফোঁস করে ফুলতে লাগলেন।
– আপনি আমার এই নাম্বারের বিকাশে ২০,০০০ টাকা পাঠায়ে দেন, মেয়ের সুখ দেখতে চাইলে। এই টাকা আপনার জন্য কিছুই না,আমি জানি।
আব্বু শব্দ করে হেসে বললো,
– ও আচ্ছা, টাকার দরকার পড়লেই মা – মেয়ের আমার কথা মনে পড়ে। নতুবা ভুলেও না! তাইনা? হাহ্ হা হা।
গম্ভীর গলায় অনু চৌধুরী বললেন,
– আমার আপনার টাকার দরকার নাই। আপনার মেয়ের দরকার। সে ফোন করে বলছে তার কিছু টাকা লাগবে।
– তাকে বলবা আমাকে ফোন দিতে। আর বলবা আমার কাছে ফিরে আসতে।
– আপনি বুঝতেছেন না, মেয়েটা সুখে নাই। ছেলেটা শান্তি দিতে পারেনা তো।
আপনি বুঝেন না, তানিশা ঐখানে ক্যাম্নে ম্যানেজ করতাছে? মেয়ের কষ্টের দিকটা দ্যাখতে হইবো তো!
– ওর কষ্টের দিক আমি বুঝি বলেই আমি তোমাকে বলতেছি, ওকে বলো আমার কাছে চলে আসতে। বলবা,ওর আব্বু ওর জীবন আবার আগের মত করে গুছিয়ে দিবে। আমি ওর সব প্রয়োজন, সব ইচ্ছা মিটায়ে দিবো। আমি ওকে আবার পড়াশোনা করতে দিবো। প্রয়োজনে ওদের দুই বোনের জন্য বাসায় টিউশন মাস্টার রাখবো। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ্। তুমি শুধু মেয়েকে বোঝাও। ঐ বেয়াদব ছেলেটাকে ফেলে চলে আসতে বলো। আর আমাকে আর এই ব্যাপার নিয়ে কিছু বলবা না। আমার এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলা শেষ।

অনু চৌধুরী একপ্রকার বাধ্য হয়েই ফোন কেটে দিলেন। ভাবলেন, মেয়ের উছিলায় নিজে ও পাঁচ, ছয় হাজার টাকা পাবে। এই টাকা দিয়ে সে তার শখের থ্রি-পিস সেটগুলো কিনতে পারতো। কিন্তু লোকটা খুব নটখটে। কিছুতেই রাজি হলো না। নিজের মেয়ের জন্য ও না!
নিজের টাকা থেকেও দিতে ইচ্ছুক না সে।
এখন এই অভাবের সংসারে ১০০ টাকাও এদিক-ওদিক খরচ করা বোকামি।
তাই সেও আর কোনো উদ্যোগ নিলো না।


রিমা খালা ইদানিং আমাদের বাসায় আসা শুরু করেছে। খুব সম্ভবত এটা দাদিরই কারসাজি। খালা নিজেও একা মানুষ, সারাদিন বাসায় পড়ে থাকে একা একা, একদম আমার মত। আমাদের দুজনের দশাই এখন এক। তাই আমিও খুব ভালো আছি এখন। খালা যতক্ষন থাকে, ততক্ষন যেন আমাদের বাসাটায় প্রাণ থাকে।
যখনই চলে যায়, তখনই নিষ্প্রাণতায় ছেঁয়ে যায় সারা বাসা।
সে আব্বু আসার আগে আগেই চলে যায়।

কিন্তু সেদিন বিকেলে খুব জোরে বৃষ্টি নামলো। সারাক্ষন ভালো আবহাওয়া, গাঢ় রোদ ছিলো।
যখনই খালা রওনা দিবে তখনই ঝুম বৃষ্টি নামলো। তাই ছাতা নিয়ে বের হতে গেলো কিন্তু তখন শুরু হলো দমকা হাওয়া। দাঁড়িয়ে ও থাকা যায়না, যেন বাতাসই উড়িয়ে নিয়ে যায়। চারদিক কালো হয়ে গেলো। তুমুল গতিতে ঝড়-তুফান শুরু হলো। আব্বুও বাসায় নেই। আমি একা একা এত বড় বাসায়।

খালা চলে যাওয়ার জন্য দরজায় এসে হাপিত্যেশ করছে। আমিও খালার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। খালা খুব আফসোস করছে আজকের এই অদ্ভুত আবহাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি মনে মনে খুব খুশি হচ্ছি!

ইশ!
রিমা খালা মনে হচ্ছে আমাদের বাসায় আজকের রাতটা থেকেই যাবে!
অনেকদিন তো হলো আম্মুর সাথে ঘুমাই না।
আর ঘুমানোর ইচ্ছা বোধ করিনা। বাজে মহিলা। সব নিয়ে পালিয়েছে।
আজকে সেই খালি জায়গা হয়তো পূর্ণ হবে।
আমি খালাকে সারারাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। খালা আমার চুলে বিলি কেটে দিবে সারাক্ষন।
এসব মনে মনে কল্পনা করতেই আমার চোখে জল এসে গেলো।

আমি সবার কাছে সব লুকাতে পারলেও
এই খালার কাছে কখনো কিছু লুকাতে পারিনা।
সে ঠিকই ঠাওর করে নিলো আমার চোখের কোণে চিকচিক করতে থাকা সেই নোনা জল।
– কিরে রাকা? ভয় পাচ্ছিস নাকি?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– হুম খুব। তুমি আজকে থেকে যাওয়া না আন্টি।
– আবার আন্টি! বল খালামণি। কী বলবি?
– আচ্ছা খালামণি! ভুলে যাই!

এমন সময় কাকভেজা হয়ে আব্বু ঘরে ঢুকলো।
সে হন্য হয়ে ঘরে ঢুকেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার জামা-কাপড় নিয়ে। তাড়াহুড়ো করে আসার সময় বাঁশের কঞ্চিতে তার হাত ছিলে গেছে অনেকটা। রিমা খালা খুব গোপনে সুক্ষ্মভাবে সেটা লক্ষ্য করলো। কিন্তু এগোলো না।
কারণ আব্বু খালামণির সাথে কথা বলতে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
সেটা সে খুব ভালো করেই জানে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here