রাকা (২০)

0
467

রাকা (২০)

আব্বুর সাথে আপন স্যারের অনেকক্ষন যাবত খোশগল্প চললো। ততক্ষন পর্যন্ত আমি আমার রুম থেকে আর বেরোই নি।
আবার ডাক পড়তেই ছুটে যেতে হলো সব লজ্জ্বা,জড়তা উপেক্ষা করে।
কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর বুঝলাম, আপন স্যারের আর ওটা মনে নেই।
সে তো অনেক বড় মানুষ।
আমার ক্লাসমেট কিংবা সমবয়সী কেউ না।
অমন কেউ হলে নিশ্চিত এখন খিলখিল করে হাসতো,লজ্জ্বা পাওয়ার জন্য টিটকারি করতো।
আপন স্যার বসে আছেন হাতে একটা ফাইল নিয়ে। খুব মনোযোগ সহকারে সে সেই ফাইলটা হাতাচ্ছে।

আমি যেতেই আব্বু বললো,
– মা, তুই নাকি নিয়মিত স্কুলে যাস না? ব্যাপার কী বলতো?
আমি চুপসে গেলাম ভয়ে। ধরা পড়েছি এবার!
আপন স্যার উঠে বলে উঠলেন,
– চাচা, আপনাকে কি বোঝালাম এতক্ষন?
ওকে এইভাবে এসব জিজ্ঞেস করার কিছু নেই তো। আপনাকে এতক্ষন যা যা বললাম তাই ই বলেন না, প্লিজ।
আব্বু ইতস্তবোধ করে বললো,
– হুম। আচ্ছা আচ্ছা। রাকা, তুই এখন থেকে আবার আপনের কাছে পড়া শুরু করবি। তোর বোনকেও সাথে বসাবি। আর স্কুল একদিন ও মিস দিবিনা। কথা কি কানে গেছে?
আমি হ্যাঁসূচকভাবে মাথা নাড়ালাম।
– তোর আপু কই? তারে ডাক তো।
আমি ডাকলাম। আপু কোমরে কাপড় গুজে কোনোমতে হাজির হলো।
তারপর বললো,
– বলো আব্বু।
আব্বু বললো,
– তুই ও রাকার সাথে বসিস। কোনো সমস্যা নাই। আপন আমাদের কাছের মানুষ। ওকে সব বলা হইছে।
আপন স্যারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– ঠিক বললাম কিনা আপন?
স্যার মাথা নাড়ালো।

আপু কিছু না বলেই ঠোঁট উল্টে চলে গেলো।
আব্বু কিছুক্ষন তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আপুর চলে যাওয়ার দিকে।
তারপর বললো,
– মেয়েটা এখনো সামাজিকতা শিখেনাই।
একে যে কবে আমি মানুষ করতে পারবো,
আল্লাহ জানে।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
আচ্ছা, রাকা, তুই আজকে থেকেই শুরু কর। আপন ও তাই চায়।
আমি আপন স্যারের দিকে তাকালাম।

সে মৃদ্যু হাসি মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি এক পলক তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ইদানিং কেন জানিনা আমার লজ্জ্বা-শরম একটু বেশিই বেড়ে গেছে। সহসা কারো সামনে যেতে পারি না। কথা বলতে পারিনা। আর সেটা যদি আপন স্যার হয়,তাহলে তো হলোই।
আর দ্বিতীয় কোনো কথাই হবেনা!
স্যারকে এখন দেখলেই আমার কেন যেন অন্যরকম লাগে, হার্টবিট বেড়ে যায়, গলা শুকিয়ে যায়, লজ্জ্বা করে খুব! ইচ্ছা করে তাকিয়ে থাকি এক দৃষ্টিতে। কিন্তু পারিনা, স্যার তো! যদি বকা দেয়!

ব্যস, আবার শুরু হয়ে গেলো আমার লেখাপড়ার অধ্যায়।
স্যার আমার আড়ষ্টতার কিছু বুঝলো কিনা জানিনা, ডেকে বললো, এক গ্লাস পানি দিও তো রাকা।
আমি নিয়ে আনলাম।
তারপর বললো,
– আজকে থেকেই স্টার্ট। বই খাতা কই? যাও নিয়ে আসো।
বাধ্য মেয়ের মত তাই করলাম।
বই নিয়ে বসার পর সে তার ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরী আর কতগুলো চকোলেট বের করে আমার সামনে রেখে বললো,
– নাও। এগুলো হচ্ছে তোমার উপহার।
– কিসের? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
– এত কিছু বলতে পারবো না। অংক বইটা আগে নাও।
__
আপন স্যার চলে যাওয়ার পর দেখলাম আব্বু আপুর হাতে কিসের যেন একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– তানিশা, এই নে।

আপু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কী এইটা আব্বু?

আব্বু স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– ডিভোর্স পেপার। রফিকের সাথে কথা বলে ওর কাছে পাঠায়ে দিছিলাম। সে সাইন করে দিছে। এবার তুই করে দে। জলদি কর। আমার কাজে বেরোতে হবে।
আপু একটু স্তব্ধ হয়ে গেলো। বললো,
– আব্বু, তুমি রেখে যাও। আমি সাইন করে দিবো। এখন রান্না শেষ করে, গোসল করে একটু ঘুমাবো। শরীরটা ভাল্লাগতেছেনা।
– আচ্ছা ঠিক আছে। রেস্ট নে। আমি গেলাম। তুই সাইন করে রাখিস।

আব্বু ব্যবসার কাজে চলে গেলেন।
দাদিকে বলে রিমা খালাকে একবার পাঠাতে বললেন, কিন্ত রিমা খালা আসার নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারেনি। রিমা খালা নাকি এখন চাকরী খুঁজছে হন্য হয়ে। তাই তার হাতে সময় একেবারেই নেই।

বিকেলের দিকে তানিশা আপুকে বারান্দায় দেখলাম অনেকক্ষন যাবত কথা বলছে ফোনে।
আমি যেতেই আপু চিৎকার করে বলে উঠলো,
– এইযে রাকা আসছে আম্মু! কথা বলো এবার।
বলেই আমার কানের কাছে তুলে দিলো কিন্তু আমি আবার ওটা ওর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে দৌঁড়ে চলে এলাম ভেতরে।
আপু এখনো কথা বলছে।
হাসি-ঠাট্টা চলছে তাদের মধ্যে।
তাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা প্রথম থেকেই কত মধুর! শুধু আমার বেলাতেই সবেতে কাঁচকলা।

তানিশা আপু আর অনু চৌধুরীর আলাপ আমি শুনলাম না। ভেতরে গিয়ে টিভি ছেড়ে বসলাম।
স্যারের ডায়েরীটা কোলেই পড়ে আছে।
কলম এনেছি। কী লিখবো ভাবছি..
লিখার মত তো অনেক কিছুই আছে।
তারপর ভাবলাম, যে দিয়েছে তার ব্যাপারেই কিছু লিখা যাক। কিছুই করার নেই।
এই কাজটা তো মন্দ না। ব্যস,টিভি অফ করে দিয়ে স্যারকে নিয়ে কয়েকটা লাইন লিখলাম।
নিজেকে তখন কেন যেন হিরোয়িন হিরোয়িন লাগছিলো। সোফায় উবু হয়ে বসে ডায়েরীতে স্যারকে নিয়ে লিখছি!
আমি ও মনের কথাই শুনলাম।
কিছুক্ষনের জন্য হিরোয়িন হয়ে গেলাম।
যা যা মনে আসলো তখন; তাই তাই লিপিবদ্ধ করলাম ডায়েরীর পাতায় পাতায়।

ওদিকে তানিশা আপু অনু চৌধুরীকে বলেছে,
আব্বু তার জন্য ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসেছে।
অনু চৌধুরী মনে মনে একবার ভাবলো, এইবার বোধ হয় তাকেও পাঠাবে।
তানিশা আপুকে সে খুব ইনিয়েবিনিয়ে বললো, তাড়াতাড়িই যেন সে তার কাছে ফিরে যায়। তানিশা আপু কিছুক্ষন কথা বলে জোর করেই ফোন রেখে দিলো।


আজমল উদ্দীন বাসায় নেই। সে ফিরছে না। ওখানে গেলেই সে আটকে যায়। কিসের এত টান কে জানে! অনু চৌধুরীর আর ভালো লাগেনা। তাই সে তানিশাকে তাড়া দিলো নিজের কাছে আসার জন্য। কিছুদিন থেকে যাওয়ার জন্য।

পরের দিন আব্বু আবার আসলো ডিভোর্সের ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে।
কিন্তু তানিশা আপু একবার এক কথা বলে। একবার বলে সে হারিয়ে ফেলছে ডিভোর্স পেপার। আরেকবার বলে, সে এখনি ডিভোর্স দিতে চায়না। আব্বু আবারো ধৈর্য্য ধরে সব বোঝালো।
কিন্তু সে কোনোভাবেই মানলো না।
জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলার বাহানায় মুখে মুখে তর্ক করলো অনেকক্ষন।
একসময় ধৈর্য্যহারা হয়ে আব্বু বিরক্ত হয়ে গেলেন।
শেষমেশ চলেই গেলেন।


প্রতিদিন রাতেই দেখলাম, আপু রাতের খাওয়া শেষে আব্বুকে জোর করে ঔষধ খাওয়াচ্ছে। আব্বুর নাকি হাই প্রেসার, ঘুমের সমস্যা ভীষণ। আমি ঘুমের ঔষধ খাওয়ার কথা বলছিলাম কিন্ত আব্বু শোনেনি। আপুর জোরাজোরিতে এখন শুনছে। আমাকে যে ছেড়ে দিচ্ছে, তা না।
আমাকে ও প্রতিদিন রাতে গরম দুধ খেয়ে শুতে যেতে হচ্ছে এখন।

আশ্চর্যের বিষয় হলো,
রাতের খাবার খাওয়া মাত্রই ঘুমে গদগদ হয়ে যাই আমরা দুজন। আমার রাতে ঘুম আসে একটু দেরীতে। সেই আমিই এখন রাত ১০ টা বাজতেই বিছানায় কাত হয়ে পড়ে যাই। আব্বুও তাই। সেই ঘুম এতটাই গভীর হয় যে রাতের কোনোপ্রকারেরই কোনো ঘটনা বা কোনো শব্দ, কিছুই আর আমাদের কানে পৌঁছায় না। তাই ঘুম ও ভাঙেনা কোনোভাবেই। এত ভারী ঘুম যে রাত ১০টায় ঘুমালে আর উঠি একদম সকালে।
মানে এক ঘুমেই পুরো রাত কাভার।
আব্বুও ইদানিং এমন করছে।
সে ৬/৭টাতেই বসুন্ধরার মলে চলে যেত প্রতিদিন।
ওখানে তার অনেক কাজ। সেই আব্বু ও ইদানিং কাজে যাচ্ছে ১০টার পরে।
আব্বুর, আমার দুজনেরই ইদানিং মাথা কেমন যেন ভারী ভারী হয়ে থাকে।
বুঝিনা, কেন হঠাৎ এমন হচ্ছে।
তানিশা আপু আসছে, কোথায় ওকে একটু দেখেশুনে রাখবো,যত্ন করবো,সেখানে আমাদের নিজেদের অবস্থা এখন ওর চেয়েও বেশি খারাপ।

একদিন আমি কেন যেন ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।
তাই সেদিন আর আমাকে ভাত বা দুধ কিছুই খেতে হলো না।
আপু আসার তৃতীয় দিন ছিলো সেদিন।
রাত ১২টায় আমার হঠাৎ ঘুম ভাঙে।
আপু আমার সাথেই শোয়।
কিন্তু সে পাশে নেই তখন। আমি বাথরুম করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম আব্বুর রুম থেকে সামান্য সামান্য আলো আসছে।
ওখানে কে? আব্বু এখন উঠলো নাকি?
আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাবো তখনই মনে হলো কি দরকার, বাথরুম সেরে এসে শুয়ে পড়ি। ঘুম ঘুম ভাবে বললাম, ধুর, আব্বুর রুমে আব্বুই তো হবে।
তাই করলাম। এসেই শুয়ে পড়লাম।

এভাবে এভাবে কেটে গেলো ৩দিন।
চতুর্থ দিন ঘুম থেকে উঠেই আবিষ্কার করলাম তানিশা আপু আবার লাপাত্তা হয়ে গেছে।
আমি এবারে আর অপেক্ষা করলাম না।
সাথে সাথে ফোন দিলাম আব্বুকে।
আব্বু ও সব ছেড়ে চলে এলো।
আব্বু মাত্রই গেছে, আবার ফিরে আসতে হলো এই দূর্বল শরীর নিয়ে।
তানিশা আপুর ফোন স্বভাবগতভাবেই বন্ধ।

আব্বুর চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো।
খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো একটা প্ল্যান!
কিন্তু আব্বুর সন্দেহ হলো এবার।
তানিশা যখন থাকবেই না তখন এখানে এ ক’দিন এভাবে পড়ে থাকার কি দরকার ছিলো?
ওর কি কোনো উদ্দেশ্য ছিলো?
কোনো কার্যসিদ্ধি করে নিলো না তো ঐ বদমাইশ রফিক?

আব্বু সন্দেহভাজন দৃষ্টিচালন করে বাসার ভেতরের সব চেক করতে লাগলো।
জানা গেলো, আমাদের একটা নতুন ফোন পাওয়া যাচ্ছে না,যেটা কিছুদিন আগেই আব্বু উপহার হিসেবে পেয়েছিলো। খুব দামী ফোন।
তাছাড়া ও আব্বুর কিছু পাঞ্জাবি,শার্ট,প্যান্ট উধাও।
আব্বু বুঝলো সব প্ল্যান করা একটা চক্র ছিলো কেবল।
সে সন্দেহ নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিজ রুমে গেলো।
সব চেক করতে হবে।
কিছুদিন আগেই টাকা তুলে এনেছিলো।
সব এই ঘরের আলমারিতে আর বিছানার তলায় রাখা হয়েছিলো।
আলমারির চাবি তো তানিশার বা রফিকের কারোরই পাওয়ার কথা না।
আব্বু খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আলমারি খুললেন।

(চলবে)

ফারজানা রহমান তৃনা।

(গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। তবে রিমা এবং আপন নামের এই চরিত্র দুটো বিশেষ কারণে আনা হয়েছে। এই চরিত্র দুটি কাল্পনিক। ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here