রাকা-২১,২২

0
476

রাকা-২১,২২
ফারজানা রহমান তৃনা
পার্ট-২১

আব্বু আলমারি খুলছে চাবি দিয়ে।
তার হাত কাঁপছে অনবরত, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
আমি মনে মনে ‘আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম। সবকিছু যেন স্বাভাবিক হয়ে যায় আবার,আপু যেন ফিরে আসে আবার! এসব বিড়বিড় করতে লাগলাম। আব্বু আলমারি খুলে ভেতরে অনেকক্ষন পর্যন্ত সব উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখলো। অনেক সময় অতিক্রমের পর আমি উত্তেজিত হয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
– কী আব্বু? সব ঠিকঠাক আছে না?
আব্বু উত্তর দিলো না।
আগের চেয়েও আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে গেছে বলেই জানান দিচ্ছে তার মুখায়ব।
সে উঠে দাঁড়ালো খুব ব্যস্ত হয়ে।
এবার খাট চেক করার পালা।
আব্বু বিছানার পাশে উবু হয়ে বসলো।
বিছানার নিচে তিনটা তোশক আছে।
একটা নতুন। বাকি দুটো পুরোনো,অনেক আগের, ফেলা হয়নি, ব্যবহার করা হচ্ছে। একে একে সবগুলোই তোলা হলো। লাস্টটা তোলার আগে আব্বু আরো বেশি কাঁপতে লাগলো।
তোলার পরই আব্বু সাথে সাথে মাথায় হাত দিয়ে নিচে ধপ করে পড়ে গেলেন। তার চোখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা।
চোখ ছল ছল করছে আব্বুর।

প্রায় দেড় লাখ টাকার বেশি উধাও।

আব্বু কিছুক্ষন হাপিত্যেশ করলো গলা নামিয়েই।
তারপর অনু চৌধুরীকে ফোন দিলো।

ফোন তুলেই অনু চৌধুরী বললেন,
– হ্যাঁ,বলেন। কেমন আছেন?
– তানিশা কোথায়? তোমার কাছে গেছে না?

সে একশো বিশ ডিগ্রি এংগেলে ঘুরে অবাক হওয়ার মত করে জবাব দিলো,
– ওমা! কি বলেন! ও আমার কাছে কেন আসবে! ওমা! তানিশা কোথায় এখন?
আব্বু তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
– ছি:! অনু, ছি:! তুমি এতটা খারাপ হবে আমি কল্পনাও করিনি। তুমি শেষমেশ নিজের মেয়েটাকে দিয়েও ক্রাইম করালে? এত নিষ্ঠুর তুমি! আমি আমার শরীরের এই অবস্থা নিয়েও আমার বিজনেস চালাচ্ছি এত কষ্ট করে,আর তুমি শেষ পর্যন্ত আমার টাকা চুরি করালে তোমার মেয়েকে দিয়ে? তোমার শরীরে কি এক ফোঁটাও দয়া মায়া ও নেই অনু?

– আপনি এসব কি কইতেছেন তানিশার বাপ! আমি কখন এমন করলাম! আমি তো তারে বুঝাইয়্যা শুনাইয়্যা আপনার কথামতই আপনার কাছেই পাঠাইলাম। এখন সে কি আবার পালায়ে গেছে? পালানোর কথা বাদ রাখলাম কিন্তু টাকা চুরি করার কথা তো ছিলোনা!
আচ্ছা আমাকে বলেন আগে, আমিতো কিছুই বুঝতাছিনা।

আব্বু অগ্নির মত জ্বল জ্বল করে উঠলেন।
– তোমার এইসব ঢং দেখার ইচ্ছা নেই আমার, বুঝলা? বিলিভ মি,আমার একটুও ইচ্ছা নেই। আমার বুঝা হয়ে গেছে,তুমি একটা লোভী, একটা নিচ প্রকৃতির মহিলা। এখন ভালোয় ভালোয় আমার আমার টাকা ফেরত দাও অনু। আমার টাকা ফের‍ত দাও বললাম। নইলে খুব খারাপ হবে। আমি আর তোমাকে ছাড় দিবো না। খুব গুরুতর উদ্যোগ নিবো এবার। আমি কারো কথা ভাবিবো না আর।

অনু চৌধুরী নরম গলায় বললো,
– বিশ্বাস করেন, আমি এসবের কিছুই জানিনা। আর তানিশা আমার বাসাতে এখনো আসেনাই। ওকে আমি আসতে বলছিলাম একবার। কিন্তু টাকা চুরি কইর‍্যা আসতে বলিনাই। আজমলের কি টাকার অভাব পড়ছে নাকি যে আমি আপনার কাছ থেকে চুরি কইর‍্যা টাকা আনতে যামু? আমি এত হেংলা না তানিশার বাপ। আমার কথা শোনেন, মেয়ে কই গেছে খোঁজ নেন। আর শুধু এক মেয়ের উপরেই দোষ চাপালে হয়না। মাইয়্যা তো ঘরে দুইটা। একটারে নিয়াই সারাদিন সন্দেহে থাকার কী কোনো মানে আছে বলেন?

আব্বু নিজের সর্বোচ্চ গলা দিয়ে চিৎকার করে বাজখাঁই গলায় জবাব দিলো,
– ঐ কুত্তার বাচ্চা, তুই নিজের দোষ আমার মেয়েদের উপর চাপাচ্ছিস? তানিশাকে তো তুই নিজের ডুপ্লিকেট বানাইছোস। সব তোর দোষ। আমার রাকা অমন হয়নাই। এখন তুই ওর ঘাড়েও দোষ চাপাইতেছোস? তুই আমার টাকা ফেরত দিবি কবে বল। আর কোনো কথা আমি শুনতে চাইনা। আমি থানায় কেইস করবো তোর নামে শুওরের বাচ্চা। তুই আমার জীবন তছনছ করে দিছোস। তোর কোনোদিন ভালো হবেনা। কোনোদিন তুই সুখী হবিনা।

– ও। ভালো কথা তো। আচ্ছা আচ্ছা,তো করেন কেইস। যা ইচ্ছা করেন গে। আমারে আর ফোন দিবেন না। আমি টাকাটুকার এই ব্যাপারে নাই। আমারে আর জালাইয়্যেন না। আমি কিছুই জানিনা,আল্লার কিরা।
বলে ফোন কেটে দিলো।

আব্বু মাথায় হাত দিয়েই বসে আছে।
ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যাচ্ছে।
আব্বু এভাবেই পড়ে আছে।
কাউকে খবর দেয়নাই।
এই লজ্জ্বার কথা কাকেই বা বলবে?
কে আছে শোনার মত?
বললেও বা কি বলবে,আমার বড় মেয়ে আবার পালাইছে? মান-সম্মান কই গিয়ে দাঁড়াইছে!
হায় হায় হায়!
আব্বুর মনের ভেতর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে গেছে। তার চোখে আজ জল নেই।
লাল টকটকে হয়ে গেছে।
মুখ মলিন। এই মানুষটা আর কতবার এরকম দুর্ধর্ষ ঘটনার স্বীকার হবে?
আর কতবার সে এভাবে মানসিকভাবে আঘাত পাবে? মানুষটা তো খুব অসুস্থ এমনিতেও।


বিকেলের দিকেই তানিশা আপুর ফোন এসেছে।
অনু চৌধুরী ফোন বাজতে না বাজতেই রিসিভ করেছে।
– হ্যালো আম্মু।
– হ্যাঁ,তুই কই আছিস?
– আমি তোমার কাছে আসতেছি।
আর ১০ মিনিট। দরজা খোলা রাইখো।
– ওই তুই কি টাকা নিয়েই ভাগছোস নাকি?
– হুম।
– ওমা,ক্যান? কত টাকা নিছোস?
– পরে বলবো। আমি আগে এসে নেই। বেশিক্ষন থাকবো না। শুধু ভাত খেয়েই চলে আসবো। বাসা থেকে ভাত খেয়ে আসতেই ভুলে গেছি। এক্সাইটমেন্টের জন্য মনেও ছিলো না খাওয়ার কথা। এখন তোমার কাছে এসে খাবো। আর হ্যাঁ, তোমার জামাই ও সাথে আসতেছে।

তানিশা আপুরা ভেতরে ঢুকতেই অনু চৌধুরী শব্দ করে বেশ জোরেই দরজা বন্ধ করে দিলো।
আসতে না আসতেই শঙ্কাহর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– এবার বল তানিশা, কত টাকা আনছোস?
– এক লাখ আশি হাজার টাকা।
– তোর আব্বু যে বললো, দেড় লাখ?
– আব্বুর হয়তো হিসেব ছিলো না আরকি। আর একটা আই ফোন ও আনছি। রফিকের খুব শখ একটা আই ফোনের…
তাই এইটা আর রেখে আসতে পারিনি।
– ওমা… তো তুই এইভাবে এতগুলা টাকা নিয়ে চলে আসলি??
– হুম। আর কি করবো বলো? নিজ থেকে তো আর এক টাকাও সে দিবেনা। এই টাকায় তো আমার ও অধিকার আছে,নাকি? তো আমি আমার অধিকারের টাকাটা নিয়ে আসছি। এইবার কি করে আমিও দেখি!
– তোর অধিকারের টাকা এটা?
– হ্যাঁ।
– কে বলছে?

সে তীরচক্ষুজোড়া নিয়ে বললো,
– কেন আমার জামাই বলছে! আব্বুর যেহেতু ছেলে নাই, সেহেতু তার অর্ধেক সম্পত্তি তো আমারই হওয়ার কথা। তাইনা? তো আব্বু তো আমাকে সোজাসাপ্টাভাবে জানিয়েই দিলো যে রফিকের সাথে থাকলে সে আমাকে এক টাকাও দিবেনা। কেন দিবেনা? আমার নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম কেন থাকবেনা তার কাছে?

– তোর আব্বুতো বলছিলো রফিকের সাথে ডিভোর্স করিয়ে তোকে অনেক ভালো জায়গায় বিয়ে দিবে। তখন তো আর তোর নিজের আব্বুর টাকার কথা মাথাতেই থাকতো না! এখন তোর জামাইয়ের টাকা নেই বলেই তো তুই টাকা টাকা করছিস। কেন বুঝিস না?

– আচ্ছা, ডিভোর্স করালে কি সত্যিই আবার বিয়ে হওয়া এত সহজ আম্মু? আর আমার আদৌ হবে আর বিয়ে? যার আম্মু পালায়ে গেছে, যে নিজেও পালায়ে গেছিলো একদিন, এমন মেয়েকে কে ঘরে তুলবে বলো? নিজের জীবন এভাবে ধ্বংস করার চেয়ে তো রফিকের সাথে এভাবে কাটিয়ে দেওয়াই অনেক ভালো! আর রফিক তো আমাকে ভালোবাসে। আমিও ওকে ভালোবাসি!

– তুই কার কথায় এতগুলা টাকা আনছোস?
– তুমি আবার কাউকে বইলো না। বললে রফিক খুব রেগে যাবে।
– আচ্ছা কাউকে বলবো না। তুই উত্তর দে।
– হুম, আমি রফিকের কথাই শুনছি। ও_ই আমাকে বলেছে কোথায় কোথায় টাকা থাকতে পারে। আর এটাও বলছে, যদি টাকা না নিয়ে ওর কাছে যাই, তাহলে ও আমাকে আর কখনো গ্রহণ করবেনা। আমি না করে দিছিলাম দেখে ও আব্বুর পাঠানো ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিছিলো। এইটা আমি সহ্য করতে পারিনি আম্মু। আমি তো ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না! কিভাবে ওকে ডিভোর্স দিবো! তাই ওর কথাই মেনে নিলাম। খারাপ কিছু তো করিনাই! নিজের অধিকারের কিছুটা হাতিয়ে নিয়ে চলে এলাম। রফিক ও বলছে, এখানে আমি কোনো অন্যায় কাজ করিনাই। যা করছি ঠিক করছি, আমি এরচেয়েও অনেক বেশি ডিজার্ব করি, যেটা আমার আব্বু দিতে অপরাগ।

অনু চৌধুরী হতাশ গলায় বললেন,
– তাও তুই কাজটা ঠিক করিস নাই তানিশা। লোকটা অসুস্থ, সম্পর্কে তোর বাবা হয়। আমাকে কিছুক্ষন আগেও কল দিছিলো। খুব হতাশ হয়ে আছে লোকটা,কিনা কি হয় আবার কে জানে!
সে তোকে খুঁজে বের করবেই।
যদি শুধরাতে চাস, তাহলে টাকাগুলো সব আমার কাছে দিয়ে দে। আমি আবার সব পাঠিয়ে দিবো তার কাছে।

এ পর্যায়ে রফিককে ডেকে তানিশা ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করলো।
রফিক ঠোঁট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চোখের মধ্যে শয়তানি হাসি দৃশ্যমান রেখে বললো,
– শাশুড়ি, ও শাশুড়ি! কি ব্যাপার বলেন তো! নিজের মেয়েকে তার স্বামীর অবাধ্য হতে শিক্ষা দিতাছেন? কামডা কি ঠিক করতাছেন আম্নে?
অনু চৌধুরী চোখ গরম করে উত্তর দিলো,
– তুমি চুপ করো। দূরে গিয়া বসো, তোমার গা থেকে পঁচা ইঁদুরের গন্ধ আসে। দূরে গিয়ে বসো, যাও।
রফিক সেসব কথা কানেই তুললো না।
– তো শাশুড়ি কী করতে চান? টাকা ফেরত পাঠাতে চান?
– হ্যাঁ।
– না দিলে কী করবেন?
– কিছু একটা তো করবোই।
– হিহ্ হি! পুরান স্বামীর জন্য ও এত দরদ?
– রফিক!
– আইচ্ছা,শাশুড়ি আম্মা, তাইলে চলেন শেয়ারে যাই। আম্নেও কিছু পাইবেন। এইবার বলেন কোনো গিরিঙ্গি লাগাইবেন কিনা?
বলেই সে দাঁত বের করে হাসলো।
অনু চৌধুরী এবার একটু নড়ে বসলেন।
তার ও তো টাকার ভীষণ প্রয়োজন এই মুহূর্তে!

নরম গলায় বললেন,
– শেয়ারে কত টাকা আমার?
– আম্নে ৩৫,০০০ টাকা রাখেন।

অনু চৌধুরী তব্ধা খেয়ে বললো,
– কত বললা?
– কত আর, পঁয়ত্রিশ হাজার।
আহত গলায় বললেন,
– তোমরা প্রায় দুই লাখের ও বেশি টাকা হাতাইছো। আর আমাকে শেয়ারে দিবা মাত্র ৩৫,০০০ টাকা?
– ওম্মা! তো কত দিমু আম্নেরে? আম্নে তো নিবেন খালি মুখ বন্ধ রাখার জন্য। আম্নে তো আর আমার কোনো কাজেই লাগেন নাই। হুদাই। এদ্দুর দিমু কইছি যে এডাই তো অনেক বেশি শাশুড়ি আম্মা! হিহ্ হি! এইবার কন কী করবেন! টাকা নিবেন না মুখ খুলবেন?

(চলবে)

ফারজানা রহমান তৃনা।

#রাকা (২২)

টাকা শেয়ারের ব্যাপারটা কানে আসতেই অনু চৌধুরীর ভাবান্তর হলো। সে এখন আর রেজা চৌধুরী নামের কারো জন্য ব্যথিত না।
না চিন্তিত অন্য কারো জন্য।
তার এখন একটাই লক্ষ্য, টাকার পরিমাণ কিভাবে একটু বাড়ানো যায়।
সে গলা উঁচিয়ে রফিককে বললো,
– শোনো রফিক, তুমি তো টাকার সাথে সাথে আই ফোন ও একটা নিছো। টাকাও তো কম না। তো, আমার সাথে কি এইডা ঠিক হইতাছে? অন্যায় হইতাছে না কও?
আমি তো চাইলেই তোমাগরে ধরায়ে দিতে পারি।
তখন এই টাকাও যাইবো লগে জীবন ও যাইবো।

রফিকের সাথে কয়েক দফা তর্ক-বিতর্ক শেষে অবশেষে অনু চৌধুরী ৫০,০০০ টাকাই হাতিয়ে নিলো। একদম হাতে হাতেই।
রফিক আর তানিশা বাদ বাকিসব নিয়ে চলে গেছে।
তানিশা যাওয়ার আগে একবার শুধু বললো,
” আম্মু দোয়া কইর‍্যো। আমি ঠিক করছি না, বলো?”

অনু চৌধুরীর সেদিকে মন নেই দেখে সে কিছু কথা বলে গেলো।
” আম্মু শোনো,আমরা এখানে আর থাকবো না। এই টাকা দিয়ে রফিক বলছে, ও ব্যবসা শুরু করবে, অন্য শহরে গিয়ে। এজন্যই মূলত এতকিছু করলাম। আব্বু তো চাইলে ওকে যেকোনো একটা দোকান বা ব্যবসা ধরায়ে দিতে পারতো। আব্বুর তো অভাব নাই দোকান,ব্যবসার। তখন তো আমরা কোনোমতে হলেও চলতে পারতাম। কিন্তু আব্বু তো খুব জেদ ধরে বসে ছিলো। কত বোঝালাম,কোনোভাবেই বুঝলো না! যাক গে, আমরা আগামীকাল ভোরেই চলে যাবো। আমার মনে হয় না আর কখনো তোমাদের কাউকে দেখবো বলে। কারণ যোগাযোগ রাখলেই ধরা খেয়ে যাবো। আচ্ছা, এবার আসি। আল্লাহ হাফেজ।”

অনু চৌধুরীর অত শত খেয়াল করার সময় নেই। তার হাতে এখন এতগুলো টাকা!
ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
এবার তো আজমলের সাথে ওদের বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটা নির্ধারণ না করলেই নয়। জমি-জমার বিষয় আশয়, টাকাকড়ি দিয়ে কোনোমতে বেশ খানিকটা অথবা পুরোটাই নিজেদের নামে লিখিয়ে নিয়ে নিলে কেমন হয়? একটা বাড়ি ও তো উসুল করে নিলে মন্দ হয়না! হাতে টাকাকড়ি আছে,সমানে টাকা ফেলে-টেলে যা যা নেওয়া যায় তাই ই তো লাভ!

মেয়েকে কোনোমতে বিদায় দিয়ে দিয়েই সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিজ কাজে। অত:পর আজমল উদ্দীনের ফোনে সীমাহীন উত্তেজনায় অনু চৌধুরী ফোন দিয়েই দিলো। ফোন রিসিভ হতেই আজমল উদ্দীন কাঁচুমাচু করে বললেন,
– হ্যাঁ অনু? এইতো আমার আসতে আর ১ঘন্টা লাগবে। চলে আসছি।
– কোথায়, কোন জায়গায় আছো?
– এইতো সায়দাবাদ।
– তুমি ওখানেই থাকো। আমি আসতেছি।
– কেন কেন? তুমি আসবা কেন?
– আমি আজকে, এখনই তোমার বাড়িতে যাবো।

আজমল উদ্দীন হকচকিয়ে গেলেন এই কথা শুনে।
– আমার বাড়িতে যাবা মানে? এক মাস সময় দিছিলা না?
– এখন আর এক মাস অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই।
– মানে কি!
– মানে হইলো, এক মাস চাইছিলেন টাকা পয়সা জোগাড়ের জন্য। সেই টাকা পয়সা জোগাড় হয়ে গেছে। তার চেয়েও অনেক বেশিই হয়েছে বরং।

আজমল উদ্দীন এবার চাপা কন্ঠে জবাব দিলেন,
– অনু, এত কম সময়ে কিভাবে তুমি এত টাকা জোগাড় করতে পারলে? কিভাবে সম্ভব?
– আপনি আর কথা বাড়াইয়েন না তো। আমি এখনি রওনা হবো। আপনি ওখানেই অপেক্ষা করেন।
এবার তিনি কঠিন গলায় বললেন,
– না। আমিই বাসায় আসতেছি। তুমি এক চুল ও নড়বা না। আমি আসতেছি।

বাসায় এসেই এক প্রকার হাঙ্গামা বেঁধে গেলো তাদের মধ্যে।
বিষয়বস্তু হলো, এত কম সময়ে, এত তাড়াতাড়ি কিভাবে এতগুলো টাকার জোগাড়যন্ত্র করলো অনু চৌধুরী?
আজমল উদ্দীন অনু চৌধুরীর চোখের সামনে বসে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
– কত টাকা জোগাড় করছো?
– যতই হোক। বলা যাবে না।
– কেন? কেন বলা যাবে না??

ঢোঁক গিলে চোখ ঘুরিয়ে সে জবাব দিলো,
– বললেই তো আপনি সব একসাথে শেষ কইর‍্যা দিবেন। আমি জানি। আর আমি সেটা কখনোই হতে দিতে পারবো না। কারণ এই টাকার সাথে আরো কিছু যোগ করে অনেক কিছু করার মতলব আছে আমার।

– তোমার মতলব খুব বেশি সুখনীয় হয়না অনু।
এবার ভালোয় ভালোয় বলো, কোন কাজে জড়ায়ে এত বিপুল পরিমাণের টাকা আনলে।

এবার সে বিষম খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আজমল, আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?

সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
– দেখো, আমি নিরুপায় অনু। আমি নিরুপায়। তোমার হাবভাব দেখে বোঝাই যাচ্ছে তুমি অনেক টাকাই এনেছো। কিন্তু কোথা থেকে?

– যেখান থেকেই হোক, এনেছি। বেশি না, মাত্র ৩০,০০০ টাকা। আরো ৩০,০০০ টাকা আপনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে উঠায়ে নিয়ে গেলেই হবে।

– এত টাকা কে দিলো তোমাকে? এটা এমন কী কাজ যে কাজে এত অল্প সময়েই ৩০,০০০ টাকা মাইনে দিয়ে দেয় একেবারে? আর আমি যতদূর জানি, তোমার পরিবার ও তোমাকে টাকা বা সাপোর্ট কোনোটাই দিচ্ছে না এখন। তাহলে কোথা থেকে আনলা বলো?

– আপনি তো খুব ঝামেলার মানুষ! বিয়ের আগে তো এমন করেন নাই!

সে ভ্রুকপাটি কুঞ্চিত করে বললো,
– বিয়ের আগে তুমি আমার বউ ছিলে? না। এখন তুমি আমার দায়িত্ব,আমার মেয়ের মা। এখন তোমার সব খবরাখবর রাখাটা আমার শুধু দায়িত্বই না, উচিতব্য।

– হইছে। এত জ্ঞানী জ্ঞানী কথা কওন লাগবো না। আমি কোনো মন্দ কাজ করছি,এমন ভাবতেছেন না তো?

– তুমি না বললে তো না ভেবেও উপায় নেই।

– ছি:! আপনি এসব কি বলতেছেন!

আজমল উদ্দীন চোখ গরম করে জিজ্ঞেস করলেন,
– বলো, তোমাকে এত টাকা কে দেয়?
কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
স্বামী পাল্টাতেই ভাল্লাগে খুব?

অনু চৌধুরী এবার রেগে গেলেন।
সে মুখে যা আসলো তাই তাই বলে আজমল উদ্দীনকে আহত করলো। তারপর বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো দেখে আজমল উদ্দীন আর মুখ খুললেন না।

আজমল উদ্দীন একা একা নিথর দেহ নিয়ে ঘরের এক কোণে বসে আছেন চুপচাপ।
তার নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছা করছে। সে ভাবছে,
হায়রে কি ভুল করলাম!
এই অনু, যে নিজের স্বামী,এত বড় বড় সন্তান থাকা সত্ত্বেও আমার সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়াতে দ্বিধাবোধ করেনি, সে যে একই কাজ আমার সাথেও করবেনা তার কি গ্যারান্টি? নিশ্চয় সে টাকার বিনিময়ে শরীর বিক্রি করছে!
অথবা অন্য কোনো বাজে কাজে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে হয়তো।
কিন্তু ওকে তো ছেড়েও দেওয়া যাবেনা।

ওকে দরকার নেই আমার,ঠিক আছে।
কিন্তু ওর বাচ্চা, আমার মেয়েটার মা তো ও। মেয়ের জন্যই আমার অনুকে সহ্য করতে হবে!
না করে আর কোনো উপায় নেই। অনুকে ভালো করার জন্য ওকে এই শহরে আর না রাখাই শ্রেয়। ওকে গ্রামের বাড়িতে রাখলেই ও হাতে থাকবে। নয়তো কখন কোন দিকে কি করে বসবে তার তো ঠিকঠিকানা নেই!
আচ্ছা,শাহানাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ওর বাপের বাড়িতে একটা ব্যবস্থা করা যাবে কি?
ও কি এত সহজে নিজের অধিকারটুকু ছাড়তে রাজি হবে?

আজমল উদ্দীনের প্রাক্তন স্ত্রী শাহানা।
তাকেই তিনি অতি সন্তপর্ণে ফোন লাগালেন, খুব দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে।
শাহানার সাথে কথা বলে দেখা যাক ও মানে কিনা। কিন্তু কি অদ্ভুত টান আর মায়ার খেলা।
আজমল উদ্দীন কিছুতেই তার প্রথম স্ত্রীকে এই প্রস্তাব দিতে পারলেন না যে, যাও, তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও, বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকো।কারণ এখানে এখন আমার নতুন বউ থাকবে।

এটা ওটা নিয়েই কিছুক্ষন আলাপ চললো তাদের। যতক্ষন কথা হলো ততক্ষন যেন আজমল উদ্দীন তার জীবনের সব দু:খ,কষ্ট,ব্যর্থতা ভুলে গেলেন।
ভাবলেন,ইশ,কেন বিধাতা একটি মেয়ের জীবনে সব ক্ষমতাই একটু একটু করে দিয়ে দেন না? কিছুক্ষন কথা বলার পর তার অশান্ত মন শান্ত হয়ে গেলো।
কিন্তু যখনই শাহানা ফোন কেটে দিলো,আবার সে মানসিক চাপে বিধ্বস্ত হয়ে গেলো।
মোদ্দাকথা হলো, অনুকে ভালোবাসার চেয়েও সন্দেহই বেশি হয় তার। চাইলেও সে কমাতে পারে না তার এই সন্দেহ বাতিকের সমস্যাটা।
এভাবে কি সাংসারিক জীবন সুখের হতে পারে?
এত সন্দেহ, এত চাহিদা নিয়ে কেউ কিভাবে সংসার করবে?
অনুর কি আদৌ আমার সংসারে মন বসবে?
ও কি আসলেই আমাকে ভালোবাসে?
আমার বাচ্চাটাকে নিশ্চয় আগের ঘরের বাচ্চাদের মত ওরকম অযত্ন,অবহেলা করবেনা!
মনে হচ্ছে না,তবুও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে।
অনেক বড় ভুল।
আনমনে বসে বসে ভাবছেন আজমল উদ্দীন।


পরের দিন আবার আব্বু কল দিলো অনু চৌধুরীকে। তানিশা আপুর জন্য আমাদের দিনগুলো এখন খুবই জঘণ্য আর অগোছালো হয়ে গেছে। আব্বু কেমন যেন পাগলামি করে এখন।
এই দুই দিন সে দুই চোখের পাতা এক করেনি। যদিও বা ঘুমের তাড়নায় চোখের পাতা একটু লেগে আসে, তাও সে ধপ করে উঠে বসে হঠাৎ হঠাৎ।
উঠেই উত্তেজিত হয়ে ‘তানিশা তানিশা’ বলে চিৎকার করা আরম্ভ করে।
আর তখনই বেশি সমস্যা শুরু করে, ভীষণ পাগলামি শুরু করে তখন।
আমার এই ছোট্ট জীবনটায় কত কিই না দেখতে হচ্ছে আমায়, একবার ভাবুন তো!
মায়ের নোংরামি,
বোনের বিশ্বাসঘাতকতা,
বাবার পাগলামি!!

কেউ নেই পাশে দাঁড়ানোর মত।
কোনো আত্মীয়-স্বজন ও নেই।
ফুফা আসলেও বেশিক্ষন থাকতে পারেনা,যোগাযোগ করলেও তা করে খুব গোপনে। কারণ ফুফুর কড়া নিষেধাজ্ঞা, আমাদের মত নষ্ট ফ্যামিলির সাথে কোনোভাবেই কোনো যোগাযোগ রাখা যাবে না। কলঙ্ক লাগবে,কলঙ্ক।

সামান্য সান্ত্বনা দেওয়ার মত ও কেউ নেই আমাদের।
আপন স্যার থাকলেও চলতো,কিন্তু স্যার ও এখন নেই। স্যার ১৪দিনের ট্রেনিয়ে চলে গেছেন।

আব্বুর জন্য ডাক্তার আনা হয়েছে।
রিমা খালা আজ ভোরেই চলে এসেছেন।
আসতেন না,আমি ফোন করে বেদমে কাঁদলাম বলেই ছুটে চলে এসেছেন।
রিমা খালা আসার সময় সাথে করে ডাক্তার নিয়ে এসেছেন। ডাক্তার বলতেছে, তাকে এখনই হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেওয়া উচিত। নার্সের আন্ডারে দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা রাখতে হবে।
ঘুমই এখন তার জন্য প্রধান এবং একমাত্র ঔষধ। মেয়ের শোকে মানসিক আঘাত পেয়েছে ভীষণ তাই।
কিন্তু রিমা খালা রাজি হচ্ছেন না।

খালা রাজি হচ্ছেন না কারণ আব্বু এখনো ভালোই সজ্ঞানে আছেন। সে নিজেই নিষেধ করতেছে, আমাকে ওখানে পাঠাইয়ো না রিমা।
আমি ওখানে গেলে আরো শেষ হয়ে যাবো। আমাকে এখানে থাকতে দাও। তানিশার খবর না পেলে আমার মরণেও সুখ হবে না।
-ইত্যাদি সব কথাবার্তার জের ধরে সে বার বার শুধু ডাক্তারকে বলতেছে, যা করার এখানেই করেন।

ওদিকে কায়সার ফুফা খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছেন, তানিশারা আগের বাড়িতে নেই এমনকি আশেপাশে বা অন্য কোথাও আছে কিনা তার ও ইয়েত্তা পাওয়া যাচ্ছে না।
ওই চোর দম্পতি পুরো এলাকা থেকে একেবারেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।

এই বিষয়টা না চাইতেও আব্বুকে জানাতে হলো।
সে অনেক জোর জবরদস্তি করে রিমা খালার সাহায্য নিয়ে অনু চৌধুরীকে ফোন দিলো।
শুধুমাত্র জানার জন্য, তানিশার আসল বিষয়টা কি। ও এখন কোথায়? টাকা কি আসলেই ও নিয়েছে? ও সুখী আছে কিনা? রফিকের সাথেই প্ল্যান করে এই কাজ করছে?

অনু চৌধুরী জানালো,
” দেখেন,আমার তানিশার সাথে মাত্র একবার
কথা হইছে। ও টাকা চুরি করছে এবং বলছে এই টাকায় তার অধিকার আছে। তাকে দেওয়া হচ্ছে না দেখে সে সেটার কিছু অংশ কেবল ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আর তাকে খোঁজাখুঁজি করেও কোনো লাভ নেই। সে অনেক দূরে চলে গেছে। এবং আরো বলেছে, সে আর কখনোই আমাদের কারো সাথে যোগাযোগ করবেনা। আমি এর বেশি আর কিছুই জানিনা। ”

আব্বু জিজ্ঞেস করলো,
– তানিশা আমাকে এইভাবে ধোঁকা দিলো? এতগুলো মিথ্যা বললো মেয়েটা আমার সাথে?
ও আমার মেয়েই তো,অনু? বিশ্বাসঘাতকতা! চরম বিশ্বাসঘাতকতা! নিজের বাবার সঙ্গে! আমার প্রথম কন্যা সন্তান আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে অনু! ও ওর নিজের বাবাকে এতটা ছোট করলো সবার সামনে? এতটা কষ্ট দিতে পারলো মেয়েটা!

অনু চৌধুরী আঁতকে উঠে বললো,
– আপনে শান্ত হন তানিশার বাপ। যা হওনের তা হইয়্যা গেছে। আপনার জন্য এই টাকা জোগানো কোনো বিষয়? আবার দেখবেন সব ঠিক হইয়্যা গেছে। শান্ত হন আপনে।

আব্বু তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে বলে উঠলো,
– আমি আজ এই মুহূর্তে আমার বড় মেয়ে,তানিশাকে ত্যাজ্য কন্যা ঘোষণা করলাম। এই নামে আমার কোনো মেয়ে নাই। আমার একটাই মেয়ে আছে।

অনু চৌধুরী বিরহের স্বরে বললেন,
– কি বলতেছেন আপনে!

আব্বু ফোন কেটে নীরবে কিছুক্ষন কাঁদলো।
আমি কাছে যেতাম।
কিন্তু রিমা খালা বললো,
– থাক, কাঁদতে দে। আজকে অনেক বড় একটা কাজ করছে তোর আব্বু। আজ সে নিজের অস্তিত্বকে ত্যাজ্য করেছে। তাকে কিছুক্ষন শোক করতে দে রাকা। এখন যাস না ওখানে।

আমি বুঝলাম না তার কথার মর্মার্থ; তবুও তার কথাই শুনলাম। দিলাম,আব্বুকে কাঁদতে।


এরপর আর কি করার?
কিছুই করার রইলো না আব্বুর।
সে অশান্ত হয়েই কাটিয়ে দিলো কয়েকদিন।
আব্বুর ব্যবসার অবস্থা নুঁইয়ে পড়বে,এতে সে মোটামুটি নিশ্চিত। তবুও যা আছে তা দিয়ে চলা যাবে। ব্যবসা,দোকান তো তার একটা দুইটা না। অনেক আছে। তন্মধ্যে বেশ কয়েকটিই বন্ধ করে দিতে হবে। যা পাওয়ার না,যেটা চুরি হয়ে গেছে সেসব নিয়ে ভেঙে পড়লে কোনো লাভই হবে না।

রিমা খালা একজন কাজের বুয়া, একজন নার্স, একজন বউয়ের চেয়েও বেশি খাটুনি খাটছে।
তার পরিশ্রম,তার যত্নের কাছে আব্বুর অসুস্থতা হার মেনেছে ইতোমধ্যে।
সে এখন ভারসাম্যহীনতা ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক, শান্ত হতে চলেছে আস্তে আস্তে।

কিছুটা শান্ত হওয়ার পরই তার মাথায় এক অন্য চিন্তা ঢুকলো।
একটা না। কয়েকটাই।
তন্মধ্য কয়েকটি চিন্তা কিছুদিন পরই আমার জীবনের মহা কাল হয়ে দাঁড়াবে।
এই ব্যাপারে যদি আমি আগে আগে জানতাম, তাহলে আমি নিশ্চিত হতে পারতাম, আমার সর্বনাশ সামনেই ওঁৎ পেয়ে বসে আছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here