রাকা-২৫,২৬
ফারজানা রহমান তৃনা।
পার্ট-২৫
অনু চৌধুরী তুলকালাম কান্ড পাঁকিয়ে ফেলেছে। আজমল উদ্দীনের মাথা ভনভন করছে। যেকোনো মুহূর্তে সে ঘুরে পড়ে যেতে পারে। অনু চৌধুরীর মুখ থেকে অনর্গল, যাচ্ছেতাই গালিগালাজ বের হচ্ছে। সেসব শাহানা বেগম কানেই তুলছেন না। তার অযথা অশান্তি ভালো লাগেনা। সে অনেক বারই আজমল উদ্দীনকে বলেছিলো, অনুকে এখানে নিয়ে আসার আগে সব জানিয়ে শুনিয়ে তবেই যেন এই বাড়িতে আনে। অন্যথা ভুলেও না।
কারণ তার অশান্তি ভালো লাগেনা।
আজমল উদ্দীন ও তাই ই চাচ্ছিলেন।
কিন্তু সে তো শুনলো না।
শাহানা বেগম দেখতে সুন্দর না।
এই নিয়েও কয়েকবার কথা তুললো অনু চৌধুরী। একাধিকবার জিজ্ঞেস করলো,
তুমি ওইডার মধ্যে কি দেইখ্যা বিয়া করলা? কি আছে ওর?হিজড়ার মত চেহারা,কালা মহিলা।
আরো বললো, কেন আমারে না জানাইয়া এই কাজ করলা! তোমার গোটা একটা সংসার আছে!
এরকম এরকম হাজারো প্রশ্ন,হাজারো গালিগালাজ,কটাক্ষ ফেরিয়ে যাওয়ার পর আজমল উদ্দীন বাধ্য হয়েই তার চোখের সামনে শাহানা বেগমের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আজমল যেন শুধু একটা ঘরের দরজাই না তার মনের দরজাটাও যেন বন্ধ করে দিলেন তার জন্য! অনু চৌধুরীর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে বুক-পেটে জ্বলন শুরু হয়ে গেলো এটা দেখে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই দরজা খুললেন শাহানা বেগম। দরজা খুলেই সে সোজা অনু চৌধুরীর রুমে ঢুকলেন। দেখলেন অনু চৌধুরী ইরাকে খাওয়াচ্ছে।
এই দৃশ্য দেখে শাহানা বেগমের চোখে জল এসে গেলো। এরকমটা তো তার জীবনেও হওয়ার কথা ছিলো। তার ও তো একটা বাচ্চা থাকার কথা ছিলো। অথচ বিধাতা কি নির্মম নিয়তি দিয়েছে তার! তার ভাগ্যে মা হওয়ার মত এই বিশাল সুখটুকুই নেই!
– অনু, বোন আমার, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে! তুমি আর এটা নিয়ে অশান্তি করিওনা বোন। আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো। মাত্রই তো আসছো। গোসল করো,কিছু মুখে দাও আগে।
অনু চৌধুরী রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বললো,
– এই তুই যা। তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ, শয়তান।
পিছন থেকে আজমল উদ্দীন হুংকার ছেড়ে বললেন, এই অনু! এই! তুমি কাকে কি বলতেছো! ও তোমার বড় বোনের মত! এইভাবে কেন কথা বলছো!
অনু চৌধুরী রাগে গিজগিজ করতে লাগলো।
শাহানা বেগমের অনু চৌধুরীর ফুটফুটে মেয়েটাকে দেখে ভীষণ লোভ হলো। ইরাও চোখ বড় বড় করে তাকেই দেখছে আর আঁ উঁ করে কথা বলার চেষ্টা করছে। তার ইচ্ছা করছে এক্ষুনি বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলতে!
এই পাড়ার কেউই তো তার কোলে তাদের বাচ্চাদের দিয়ে চায়না, দেয়না।
কারণ অলক্ষী,অভিশাপগ্রস্ত, কলঙ্কিনী উপমা তার। তার কোলে তাদের বাচ্চা দিলে তাদের বাচ্চাদের অমঙল হবে।
তাই এখন নিজের সতীনের বাচ্চা দেখে মনে মনে ভাবছে,
এই বাচ্চাটাতো আজমলেরই!
আর আজমল তো তারই স্বামী!
সে হিসেবে এই বাচ্চাটা তো তার ও বাচ্চা!
সে লোভ সামলাতে পারছেনা।
তবুও চেপে রেখে বললো,
– অনু, দেখো, আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো পরে। এখন ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে। গরম পানি দিবো? গোসলে যাবা?
অনু চৌধুরী জবাব দিলো না।
শুধু নড়েচড়ে বসলো একটু।
শাহানা বেগম আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।
সে পট করে ইরাকে কোলে তুলে নিয়ে বেদমে আদর করতে লাগলো।
বাচ্চাটাও যেন চিরচেনা কারো কোলেই উঠেছে।
হাসছে,কথা বলছে শব্দ করে।
অনু চৌধুরী টান দিয়ে ইরাকে শাহানা বেগমের কোল থেকে নিয়ে বললো,
– পাগল নাকি? আমার বাচ্চা নিয়ে টানাটানি করোস ক্যাঁ? একজনের বাচ্চা যে হুট কইর্যা এইভাবে কোলে নেওয়া যায়না,এইডা তুই জানোস না নাকি? অনুমতি নিছোস আমার? তারপর আস্তে করে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
এই তোর কি এখনো বাচ্চা টাচ্চা পয়দাই হয়নাই নাকি? কই দেখিনা তো কাউরে!
এত বছর করলিটা কি?
আজমল উদ্দীন এসব দেখে তাজ্জব বনে গেলেন।
সে গলা ছেড়ে বললো,
– অনু! তুমি কাকে কি বলতেছো! তুমি কার বাড়িতে এখন জানো? এটা কার বাড়ি? কার বাড়িতে এসে উঠছো? বলো!
অনু চৌধুরী জিজ্ঞেস করলো,
– কার বাড়ি আর, তোমার বাড়ি! যার বাড়িই হোক, এই সব ভিটামাটি আমিই কিইন্না নিমু।
আজমল উদ্দীন শান্ত গলায় বললেন,
– হ্যাঁ,কিন্নো, স্বপ্নে কিনিও। এই বাড়িটা শাহানার অনু। তুমি প্লিজ ওর সাথে এইভাবে কথা বইলো না। দোহাই তোমার!
শাহানা বেগম কিছু বললেন না।
সোজা উঠে চলে গেলেন নিজের রুমে।
খাবার বেড়ে দেওয়ার কথা ছিলো।
কিন্তু তার এসব দেখে আর রুচিতে কুলালো না।
আজমল উদ্দীন শাহানা বেগমের চেয়েও বেশি ব্যথিত হলো। কারণ শাহানা বেগমের কষ্ট সে সহ্য করতে পারেনা। সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে তার মন ঠিক রেখে চলতে।
অনু চৌধুরী বাচ্চাকে এইভাবে রেখে দিয়েই গোসলে গেলেন। বাচ্চা কাঁদতেছে,আজমল উদ্দীন সামলাতে পারছেনা। বাচ্চার কান্না শুনে শাহানা বেগম ছুটে আসলেন। কোলে নিলেন।
বাচ্চার কান্না থামলো। শাহানা বেগমের গজলের টানে ঘুম ও চলে আসলো তার। তারপর তাকে শুইয়ে দিয়ে সে আবার হুড়মুড়িয়ে চলে গেলো, পলাতক কোনো চোরের ন্যায়। আজমল উদ্দীন সবিস্ময় চোখে শুধু দেখলেন তাকে। আহা, একটা নারীর জীবনের কত বড় একটা আকাঙ্ক্ষা শুধুমাত্র একটি বাচ্চা!
অনু চৌধুরী গোসল সেরে এসে কাউকে কিছু না বলেই ভাত বেড়ে নিজে খেয়ে নিলেন। এমনভাবে সব করছে যেন এটা তারই বাড়ি। আর ওদিকে যার বাড়ি সে এক রুমে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে।
কিছুক্ষন পরেই তার টেলিফোন এলো।
অনু চৌধুরীর হাতে কিছুক্ষনের মধ্যেই ডিভোর্স পেপার এসে পড়বে। সে বিস্মিত হয়ে গেলো এই খবর শুনে। সে ভাবছে আনমনে,ডিভোর্স তো এইভাবে,এত সহজে দেওয়া যাবেনা! এই উসিলা দিয়ে যদি আরো কিছু উশুল করে নেওয়া যায়,তাহলে তো আরো কিছু লাভ হবে! এত সহজে ডিভোর্স পেপারে সই করা যাবে না। টালবাহানা করে আগে কিছু আদায় করে নিতে হবে! এমনিতেও তো অনেক পাওয়ার কথা!
নরম মনের মানুষ, কিছু চাইলেই দিয়ে দিবে।
আগে তানিশার দেওয়া ক্ষতটা শুকিয়ে নিক বেচারা। তারপর আবার নতুন ক্ষত করা যাবে!
একসাথে দুই ঘা দেওয়া সমীচীন হবে না! এত পাষাণ ও না আমি! মনে মনে ফন্দি আঁটলেন অনু চৌধুরী।
পরের দিন।
শাহানা বেগম নিজের রান্না ঘরে গেলেন।
গিয়ে সে তুমুল পরিমাণে চমকালেন।
অনু চৌধুরী বসে আছে।
সে রান্নাবান্না করছে।
সকালে উঠে সে নিজেই মাল-মসলা,তরু-তরকারি কিনে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু কি অদ্ভুত, যার বাড়ি – যার রান্নাঘর তার অনুমতি ছাড়াই সে এভাবে বিনা দ্বিধায় নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
শাহানা বেগম কড়া কিছুই বললেন না।
সে আদরমাখা স্বরে বললেন,
– বাহ্ অনু। তা আজকে থেকেই রান্নাবান্না না শুরু করলেই পারতে, বোন। তোমার বাচ্চা আছে, আমিই না হয় সেরে নিতাম! তুমি কেন … আচ্ছা যাই করছো,রেখে যাও এখন,বাকিটা আমি করি।
অনু চৌধুরী চক্ষু গরম করে প্রত্যুত্তর দিলো,
– আমি যতক্ষন রান্না ঘরে থাকবো ততক্ষন আপনি এখানে আসবেন না। আপনি ও যতক্ষন রান্না ঘরে থাকবেন,ততক্ষন আমি আসবো না। ভুলেও না। মনে থাকবে?
সে নরম কণ্ঠে বললো,
– এত রাগ রাখতে নেই বোন। আসো আমার সাথে। বারান্দায় বসে তোমার মাথায় তেল দিয়ে দেই। আমার জীবনের গল্পটা শোনাবো তোমাকে আজ।
অনু চৌধুরী হাই তুলে খুব ব্যঙ্গবাণী করে বললো,
– কিসের গল্প বলবেন তা আমার শোনা শেষ। আমার এত সময় নাই। আর তেল দেওয়ার নাম কইর্যা চুল কাইট্যা দিবেন, ভালো কইর্যাই জানি। এখন যান এইখান থেকে।
– কী জানো তুমি? আজমল বলছে নাকি?
– না। বাড়ির বাইরে বের হলেই সারে। খারাপের গন্ধ তো সবাই চেনে।
– মানে?
– মানে আপনে একজন বন্ধ্যা নারী। বন্ধ্যা নারীদের সাথে এক ছাদের নিচে বসবাস করা ভালো না। এরকম শুনে আসছি। আপনি কবে আমগোরে একা ছাড়বেন সইত্য কইর্যা কন দেহি! অপয়া মাইষ্যের লগে তো এক ছাদের তলায় থাওন ঠিক না! ছোট মাইয়্যা আছে তো আমার! আপনার নজর লাগলে কি হইবো আমার মাইয়্যার!
শাহানা বেগম আর কিছুই বলতে পারলেন না। কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে চলে গেলেন।
দুপুরের খাবার বাড়া হলে সে শুধু দুইজনের প্লেটেই ভাত দিলো।
ওদিকে শাহানা বেগম তখন থেকেই শুধু কাঁদছেন।নামাজ পড়ছেন অনবরত। অতিরিক্ত
কষ্ট পেলে সে রান্না খাওয়া সব ভুলে যায়।
অনু চৌধুরীর উচিত ছিলো তার জন্যও রান্না বসানো। কিন্তু সে তা করেনি।
আজমল উদ্দীনের এসব দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেলো।
শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
– এই তুমি শাহানার জন্য রান্না করোনি?
শুধু দুজনের জন্যই করছো? ওর কী হইছে?
সে গলা হাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কী কইলেন আম্নে? আপনার ওই শাহানার চাকরানী হইয়্যা আমি এই বাড়িতে আসছি? আমি তার জন্য রান্নাবান্না করুম বইস্যা বইস্যা! দেহেন, এত বালা না আমি! নিজেরডা নিজেরেই কইর্যা খাইতে কন! ঢং যত্তসব!
সে আবারো শান্ত থাকার চেষ্টা করলো।
জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি আবার কিছু বলছো ওরে?
– সত্য কথা গায়ে লাগছে এখন আমি কি করমু বলেন?
– কী সত্য কথা?
– বলছি সে একটা বন্ধ্যা। আমগো গ্রামে সবাই কয়, বন্ধ্যাদের লগে এক ছাদের নিচে থাকা নাকি খুব খারাপ। সকালে তরকারি কিনতে যাওয়্যায়ো তাই শুনলাম অনেকের থেকে। এইডাই কইছিলাম! ব্যস! মহারাণীর গায়ে লাগছে,সত্য কথা বালা লাগলো না।
আজমল উদ্দীন সাথে সাথে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন। শাহানা বেগমের কাছে গিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দিলেন।
এইভাবে বার বার রুমে ঢুকে ঠাঁস করে দরজা বন্ধ করতে দেখলেও অনু চৌধুরীর গা রি রি করে ওঠে। একে কিভাবে বাদ দেওয়া যায়?
আগাছা ছাটাই করার উপায় কি?
অনু চৌধুরী তার পাতের ভাতগুলোকে পিষতে লাগলেন জোরে জোরে। আর দলা পাকানো ভাতের দিকে হিংস্র দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে উপায় বের করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন।
★
রিমা খালার সব গোছানো শেষে,সে চলে যাবে তখনই আব্বু বাঁধা দিলো।
হঠাৎ করে খুব নরম স্বরে বললো,
– আমি খুব দু:খিত রিমা। কষ্ট পাইছো জানি।।আসলে আমার মাথা ঠিক নাই। এইভাবে রাগ করে চলে যেও না।
রিমা খালার এইটুকুতেই মন গললেও সে তা বাইরে প্রকাশ করলো না।
আব্বু এখনো দু:খ বোধ করছেন।
সে আবার শুধালো,
– রিমা!
সাথে সাথে জবাব এলো,
– জ্বী।
– আগামীকাল আমরা বেড়াতে যাবো।
আমার ডাক্তার কি বলছে? মনে নাই?
– হুম। হাসিখুশি থাকতে হবে। মনকে আনন্দে রাখতে হবে সবসময়।
– তো এই পিচ্চি মেয়ে আমাকে কতটুকুই বা আনন্দ দিতে পারবে? বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, নাহ্, ওই অবশ্য আমার জন্য অনেক।
– এখন আমি কী করবো বলেন।
আব্বু হঠাৎ আদেশের স্বরে তুচ্ছার্থক প্রয়োগ করে বললেন,
– তুই থাক! আরো কিছুদিন থেকে যা। ব্যস। আমি এখন আসলাম।
রিমা খালার মনে খুশির ঝিলিক দেখা দিলো। এই প্রথম রেজা চৌধুরী তাকে বেড়াতে যাওয়ার জন্য অফার করেছে।
কিন্তু তার কি যাওয়া উচিত হবে?
উল্টোটা যদি হয়?
আবার যদি তার জন্য পাঁচজনে পাঁচ কথা শোনায় উনাকে? তখন কি হবে!
আমি আমার রুমে ঢুকে আমার বিগি ব্যাংকটা ভাঙলাম।
সতেরশো টাকা হলো।
এই টাকা দিয়ে আমি অনেক কিছু কিনবো।
রিমা খালার জন্য একটা শাড়ি, আব্বুর জন্য একটা শার্ট আর আপন স্যারের জন্য একটা ঘড়ি।
এই টাকায় হবে তো?
কিন্তু এখন খুব আফসোস করি!
ইশ, ওই টাকাটাও যদি এখন আমার কাছে থাকতো!…
(চলবে)
#রাকা (২৬)
রিমা খালাকে আব্বু আদেশের স্বরেই বলে গিয়েছে, রিমা তুই এখানেই থাকবি। আজকে কোথাও যাবিনা, ব্যস। আর হ্যাঁ,আমি সত্যিই খুব দু:খিত আমার দুর্ব্যবহারের জন্য।
আব্বু চলে যাবার পর খালা কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকলেন। তারপর আমাকে ডেকে বললেন,
রাকা মা, বল তো তুই আজকে কী কী খাবি?
আমি হাসিমুখে একটার পর একটা বলতে লাগলাম। সব হাবিজাবি খাবার।
সে কিছুক্ষন ভুরু উঁচিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ব্যাগ রেখে সোজা চলে গেলো রান্নাঘরে। এখন সে তার পক্ষে যা যা সম্ভব তাই তাই ই বানাবে। না হলে কিনে আনবে। আমি জানি।
খালা চলে যাওয়ার পর আমি নিজেই তার ব্যাগ থেকে তার সব জামা কাপড় বের করে রেকে,আলনায় রাখছি। এটা গোছানো থাকা মানেই বিপদ,খালা টুপ করে উধাও হয়ে যেতে পারে। তাইজন্যই নিজেই গুছিয়ে রেখে দিলাম।
হঠাৎ একদম সবার নিচে একটা ছোট ব্যাগ হাতে পড়লো।
অনুমতি ছাড়া কারো ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেওয়া বা দেখা ঠিক না। তবুও কোন শয়তান যেন ঘাড়ে চেপেছিলো,খুলে ফেললাম। ছোট একটা ডায়েরী পেলাম ভেতরে আর সাথে কিছু ছবি। দুটো ছবি। একটাতে খালার সাথে একজন ভদ্রলোককে দেখা যাচ্ছে। আরেকটায় আরেকজন ভদ্রলোককে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মুখটা মনে হচ্ছে যেন অস্পষ্ট অথবা ইচ্ছে করেই কেউ মুখের অংশটা নষ্ট করে দিয়েছে।
লোকটা কে?
রিমা খালার আগের বর মারা গেছে তা জানি। এই ই হয়তো সেই লোক,যার মুখ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এই ছবিটার লোকটার সাথে তো এইটার কোনো মিল নেই। এরপর ছোট ডায়েরীটা কিছুক্ষন ঘাঁটলাম। একটা জায়গায় দেখলাম বাচ্চাদের নিয়ে নানান ধরণের কথাবার্তা লিখা। শেষ পেইজগুলো উল্টাতেই দেখলাম বোল্ড হরফে আমার আব্বুর নাম লিখা।
খুবই ছোট্ট একটা লিখা। লিখাটা এমন,
রেজা ভাই,
আপনি আজো বুঝলেন না আমাকে?
আর কী করলে আপনি বুঝবেন আমাকে?
আর কতদিন,কত বছর অপেক্ষা করাবেন আমাকে? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।
মরলেও তো আমি শান্তি পাবো না,আমার কবর ফাঁক হয়ে যাবে।
এই লিখা পড়ে আমার মাথা ভনভন করতে লাগলো। এসবের মানে কী?
খালা আমার আব্বুকে নিয়ে এসব কী লিখছে, কেন লিখছে কিছুই বুঝলাম না।
ডায়েরী বন্ধ করে ব্যাগের কোণায় রাখবো তখনই খালা আমার সামনে এসে দু হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে কঠিন দৃষ্টি স্থাপন করে জিজ্ঞেস করলেন,
– এসব কী হচ্ছে রাকা?
আমি আস্তে করে বললাম, কই খালামণি, কিছু না তো!
সে আবার ভীষণ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– তুই আমার ব্যাগ নিয়ে কী করছিস? বল!
আমি ইনিয়েবিনিয়ে বললাম,
– খালামণি কিছুই করিনি তো। তোমার জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখছি আমি। ওইযে দেখো?
খালা আবারো চাপা গলায় বললো,
– না বলে অন্য কারো জিনিসে হাত দেওয়া ঠিক না। এটা তুই জানিস? আমি তোকে পার্মিশন দিছিলাম?
আমি ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে বললাম,
– না। দাওনি। সরি খালামণি, খুব ভুল হয়ে গেছে।
খালা তখনই আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
– হাহ্ হা হা! কী হইছে! ভয় পেয়েছিস? ওমা! আমি তো ঠাট্টা করলাম!
বিছানায় বসে আমার মাথা তার বুকে রেখে, চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে সে বললো, তুই অনেক ভাগ্যবতী রে রাকা। এই বয়সেই তুই নিজ থেকে কত কি করে ফেলিস,কত কি বুঝিস নিজ থেকে! তোর মা-বোন নাই তো কি হইছে তুই নিজেই সব পারিস। এত লক্ষী মেয়েকে যে মশাই বিয়ে করবে সে তো মহাভাগ্যবান হবে রে!
আমি তখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি।
আমার এখন অল্প কিছুতেই ভীষণ সমস্যা হয়।
ভয় পেয়ে যাই। ছোটখাটো ভুল করলে কেউ সামান্য কিছু বললেও মনে হয়, এই পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ কাজটিই বোধ হয় আমি করে ফেলেছি।
তখন নিজেকে ফাঁসির আসামির মত মনে হয়।
এইতো আর মাত্র কয়েক মিনিট! পাঁচ,চার,তিন,দুই,এক কাউন্ট হলেই আমি ঝুলে যাবো।
খালা ঝাঁকাচ্ছে।
আমি চোখ ফেরালাম।
সে আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
– রাকা, তুই আমার ব্যাগ থেকে জামা-কাপড় বের করে গুছিয়ে রেখে দিয়েছিস যাতে আমি না যেতে পারি,তাইনা?
আমি হ্যাঁসূচকভাবে মাথা নাড়ালাম।
খালা হাসিমাখা স্বরে বললো,
– আমার কেন জানিনা মনে হয়,তুই আমারই সন্তান। আমারই মেয়ে। আমার যা যা ভালো লাগে, সব গুণই তোর মধ্যে আছে।
আমি হাসলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
– আজকে তুমি থাকবা তো?
সে অন্যদিকে চোখ নিয়ে খুব খুশির ছলে বললো,
– খালামণি যাবো না তো আজ। আজকে বিকেলের দিকে আমরা পার্কে যাবো। তোর জন্য কয়েকটা ফ্রক কিনবো। ফ্রক ভালো লাগে তোর?
আমি বললাম,
– না খালামণি। আমি আর ফ্রক পরবো না। আমার অনেক ফ্রক আছে। তুমি আমাকে যদি কিনেই দাও তাহলে থ্রি-পিস কিনে দিও। আমার এখন বড়দের ড্রেস পরতে ইচ্ছা হয় খুব।
খালা শব্দ করে হাসলেন। বললেন,
– বাব্বাহ্! বড় হয়ে গেছিস! আচ্ছা ঠিক আছে! তোকে থ্রি-পিস কিনে দিবো। শাড়ি লাগবে?
আমি খুব দ্রুত মাথা ঝাঁকালাম, শাড়িও লাগবে আমার!
খালা উঠে যেতে যেতে বললেন,
– আচ্ছা আচ্ছা! সব কিনে দেওয়া হবে! পাগলি মেয়ে একটা। তোর চিকেন বার্গার রেডি হয়ে যাবে এখন। সস নিয়ে আয়।
আমি খুশিমনে চলে গেলাম। বার্গার খেলাম।
খালা এখনো রান্নাঘরে।
সে সব তৈরী করলো আমার জন্য,যা যা আমি বলেছি। আমিও ভীষণ আয়েশ করে খেলাম। খালার রান্না ভীষণ ভালো। যেহেতু আমি মোটা,সেহেতু বলা বাহুল্য আমি অনেক খাই। খালাও খুশি হলো আমার তৃপ্তিকর ভজনবিলাস দেখে।
দুপুরে আব্বুও আসলো।
সেও আয়েশ কর খেলো। রান্নার খুব প্রশংসা ও করলো। খালা তো আমাদের প্রশংসায় একদম খুশিতে আত্মহারা! তার মনে হচ্ছে,এ যেন তার নিজেরই সাজানো-গোছানো স্বাদের সংসার।
খালা আমাকে ডেকে বললো,
– রাকা! আজকে না বের হবো আমরা?
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
– তো তোর আব্বু এখন কই যায়?
– কেন দোকানে!
– দোকানে গেলে আমরা আর যাবো কখন? তোর থ্রি-পিস কিনবো কখন?
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
– দাঁড়াও! আমি আব্বুকে গিয়ে বলে আসি?
খালা চাপা গলায় বললো,
– শুধু বললেই হবে না,রিকুয়েস্ট করতে হবে। নয়তো তোর যেই আব্বু, আজকে বললে আজকেই ভুলে যায়। দেখ গিয়ে মনে আছে কিনা!
আমার আব্বুকে রিকুয়েস্ট করতে হলো না। শুধু কথা উঠিয়েছি।
– আব্বু তুমি না বলছো ঘুরবে যাবা?
– এরকম কথা ছিলো নাকি?
– ভুলে গেছো তুমি!
– হাহ্ হা। না ভুলিনি। বলছি,আগামীকাল যাবো।
– আজকেই চলো না প্লিজ।
– আজকে! আজকে তো আমার মালামাল আসবে। আজকে তো যাওয়া যাবেনা।
আমি আব্বুর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললাম,
– আজকে যেতেই হবে আব্বু।
আব্বুও ফিসফিস করে বললো,
– কেন?
– আজকে না গেলে রিমা খালামণি চলেই যাবে।
– তোমাকে এরকম কিছু বলছে নাকি?
– উহুম। আমি আইডিয়া করে বলছি।
– তাহলে ঠিক আছে। তোমার আইডিয়া রং। আগামীকালই যাবো আমরা।
– না আব্বু,আজকেই চলো।
আব্বু উঠতে উঠতে জোরেই বললো,
– আজকে না। আজকে সময় নেই। কাজ আছে।
খালা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আব্বুর নিষেধাত্মক বাণী শোনার সাথে সাথেই সে স্থান ত্যাগ করায় আব্বুর ভ্রম ভাঙলো যে এই প্ল্যান একা আমার না। খালাও এর শামিল।
আব্বু কি যেন ভাবলো কিছুক্ষন,তারপর বললো,
– রাকা মা, যাও তোমরা রেডি হয়ে নাও। আমরা একটু পরেই বেরোচ্ছি।
আমি শুনেই ভোঁ দৌঁড় দিয়ে খালাকে সংবাদ দিতে গেলাম।
বিকেলের দিকে..
আমরা এই মুহূর্তে একটি পার্কে আছি।
খুব সুন্দর একটা জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে,সেখানেই বসে আছি তিনজন। আমি আব্বুর গা ঘেষেই বসে ছিলাম এতক্ষন।
খালা একটু দূরে বসেছে।
আব্বু বললো, তুই ওর কাছে যা। একা একা বসে আছে।
আমি গেলাম।
খালা বললো,
– কিরে আর কখন যাবি মার্কেটে? বাবার কোলেই বসে আছিস! আমাকে তো কেউ মনেই রাখেনা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– আব্বুকে বলবো?
– আমি জানিনা।
আমি আব্বুকে ডেকে বললাম, আমরা আজকে মার্কেটে যাবো।
আব্বু খালাকে জিজ্ঞেস করলো,
– তোমরা আজকে মার্কেটে যাবা নাকি?
খালা হ্যাঁসূচকভাবে মাথা নাড়ালো।
– কেন? কেনাকাটা আছে ?
– হুম।
– এখনি উঠবা নাকি আরো কিছুক্ষন থাকবা? আমার মনে হয় সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে বসে থাকা উচিত। পরিবেশটা দেখার মত হবে তখনই। এজন্যই তো এখানে নিয়ে আসলাম।
খালা রাগী স্বরে বললো,
– হ্যাঁ। মূর্তির মত এভাবেই এখানে বসে থাকতে হবে। কেউ তো কিছু বলবেনা, কোনো কথা হবেনা, সামান্য আড্ডা দিবে তা তো দূরের কথা। বাচ্চা নিয়ে আসছি। একটু কিছু কিনে খাওয়াবো ও না। কেবল মূর্তির মত বসে বসে অন্য সবার আনন্দ দেখবো!
আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো, শাস্তি দিচ্ছেন নাকি ভাই? আপনার ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটালাম বলে? আচ্ছা থাক। আপনি চলে যান। আমি রাকাকে নিয়ে একটু নিউ মার্কেটে যাবো। সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরবো।
আব্বু খালার দিকে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষন। খালার কথা শেষে দূরের দিকে
তাকিয়ে খুব উদাস গলায় বললো,
– এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। অনুকে বিয়ে করার পর এখানেই প্রথম আমাদের ভাব হয়। অনুরও ও এই জায়গাটা খুব পছন্দের। প্রতি সপ্তাহেই বায়না করতো এখানে আসার জন্য।
কিন্তু আমি মাসে একবার ও আনতাম না।
কয়েকটা নতুন ব্যবসার শুরু ছিলো তখন,ব্যস্ত ছিলাম খুব। কিন্তু অনুতো এসব বুঝতোই না।
এসব বলে আব্বু এভাবে উদাসীন হয়েই বসে রইলেন।
খালা আব্বুর মন খারাপ দেখে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষন। আমি কিছুই বললাম না। কারণ আমার অনু চৌধুরীকে নিয়ে বেশি ভাবাভাবি করতে ভালো লাগেনা। দূরের কিছু ছেলেমেয়ে বাবল ফুলিয়ে মজা করছে,কেউ দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে কেউবা করছে খেলাধুলা।
সেসবই দেখছি। কিন্তু নিজে গিয়ে তাদের সঙ্গ দিচ্ছিনা কারণ আমি অসামাজিক হয়ে গেছি। কারো সাথেই এখন আর আমার জমে না।
আব্বু আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
– রাকা তুমি ইচ্ছা করলে ওখানে গিয়ে খেলতে পারো।
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– না, ঠিক আছে।
খালা ও গলা মিলিয়ে বললো,
– রাকা তুই ওখানে যাবি। তার আগে একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে নে। বলে সে বাচ্চাদের মত চিৎকার করে হাওয়াই মিঠাইওয়ালাকে ডাকলো। তিনটা নিলো।
আব্বু জীবনেও এই জিনিস মুখে দিবেনা।,আমি জানি,খালাও অবশ্যই জানে। অথচ সে তিনটা কিনলো।
আমার হাতে একটা ধরিয়ে দিয়ে ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বয়সী কিছু মেয়েদের প্রতি ইঙ্গিত করে খালা বললো,
– ওই দেখ, ওরা দোলনায় উঠে কি মজা করছে। তুই ও যা। মজা কর। আমিও আসতেছি।
আমি দোলনা খুব পছন্দ করি। উঠে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলাম,
– খালামণি, আরেকটা হাওয়াই মিঠাই কে খাবে?
– তোর আব্বু।
– আব্বু তো খায়না এগুলো।
– আজকে খাবে।
– কেন! আজকে খাবে কেন?
– এমনিই। আচ্ছা,বাদাম কিনবো। এখন খাবি?
– না,আমি দোলনায় উঠে আসি আগে।
– আচ্ছা যা।
আমি চলে গেলাম ওদের কাছে। গিয়ে ওদের সাথে কথা বললাম। ভাগ্য ভালো। সবাই আমাকে সঙ্গ দিলো। অনেক মজার মজার দুষ্টামিও করছি আমরা। আমাদের কোম্পানি ভালো জমেছে কারণ সবাই একই স্বভাবের।
আমি চলে যাবার পর খালা আব্বুকে জিজ্ঞেস করলো,
– এই জায়গায় যে আপনার আর আপার এত স্মৃতি জড়িয়ে আছে, আমি জানতাম না। জানলে কিছু বলতাম না।
আব্বু বললো,
– ঠিক আছে। বাদ দাও।
তোমার চাকরীর কী খবর?
– করবো না।
আব্বু হতচকিত হয়ে খালার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– করবা না মানে? কেন?
“আপনি মানা করছেন তাই”- এই কথাটা না বলে খালা বললো,
– ইচ্ছা করেনা। টিউশন করলেই হয়ে যাবে আমার।
– টিউশন করতে পারলে চাকরী ও করতে পারবা। পাইছো যখন ছাড়ার দরকার কি!
খালা অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন,
– আপনিই তো কত কি বললেন! কত জ্ঞান দিলেন!
– এখন আমিই আবার বলছি, নিজের পায়ে নিজেই দাঁড়াও। আসলে আমি ভুলেই গেছি তুমি তোমার ভাইয়ের বাসায় থাকো। আমি তোমার ভাইকে চিনি। ও আমার ক্লাসমেট। খুব বাজে কিছু স্মৃতি আছে ওর সাথে। যার দরুন সে এখনো আমাকে সহ্য করতে পারেনা।
– আসলেই! কী রকম স্মৃতি?
– থাক সেসব। এগুলা জেনে কি হবে!চলো রাকার কাছে যাই।
– না,বলেন না প্লিজ। কিসের স্মৃতি আপনাদের মাঝে?
– ওই আরকি.. ও একটু আনসোশ্যাল,বখাটে টাইপ ছিলো কলেজে।
তাছাড়া ও রাজনীতি করতো,নেতা টাইপ।
তাই সবাই ই একটু ভয় পেয়ে চলতো ওকে। একটা মেয়েকে পছন্দ করতো ও। কিন্তু ওই মেয়েটা ওকে প্রত্যাখান করে। এবং কি দুর্ভাগ্য আমার,ওই মেয়ে এমন হাবভাব শুরু করে যে সবাই ই জেনে যায় এই মেয়ে আমাকেই পছন্দ করে। বাস স্টপে একদিন প্রপোজ ও করে বন্ধুদের সামনে। ব্যস,তোমার ভাইয়ের কানে চলে যায় এই খবর। সে থেকেই শুরু হয়ে যায় দুশমনির। এই নিয়ে সে কয়েকবার আমাকে মারছিলো পর্যন্ত। তবুও রাগ মিটেনি। তোমার মায়ের সাথে আমার মায়ের কত বোঝাপড়া হয়েছিলো এ নিয়ে। পরে অবশ্য ওই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছিলো। কিন্তু তোমার ভাইয়ের রাগ এখনো কমেনি। কমবে বলে মনেও হয়না! হাহ্ হা।
খালা চুপ করে শুনে ছিলো এতক্ষন।
তারপর বললো,
– আচ্ছা আচ্ছা! এইজন্যই ভাই আপনার নাম শুনলেই ক্ষেপে যায়!
– হুম।
খালা কিছুক্ষন নীরব রইলেন তারপর জিজ্ঞেস করলেন স্তিমিত কন্ঠে,
– ভাই একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আপনাকে?
– করো।
– আপনি রেগে যাবেন না তো?
– নাহ্। করে ফেলো।
খুব সমীহ করে অত:পর জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
– আপনি অনু ভাবীকে ডিভোর্স দিবেন না?
তার আসলেই বিয়ে হইছিলো তো ওই লোকের সাথে?
আব্বু গলা ভারী করে বললো,
– আসলেই আই মিন অফিশিয়ালি বিয়ে হবে না। কারণ আমাদের এখনো অফিশিয়ালি ডিভোর্স হয়নি। বেয়াইনীভাবে ওরা বসবাস করতেছে আরকি। এনিওয়েজ!
ও এতটা খারাপ হবে; এটা যদি আমি আগে জানতে পারতাম, তাহলে হয়তো ওকে এতটা ভালোবেসে ফেলতাম না। আমার দুর্ভাগ্য, সব দিকেই দুর্ভাগ্য।
– ডিভোর্স? দিবেন না?
– অবশ্যই দিতে হবে। ওকে জানানো হইছে। দুদিনের ভেতরেই ওর কাছ থেকে আমার সারাজীবনের জন্য নিষ্কৃতি হয়ে যাবে, আশা করছি।
– তারপর কী চিন্তাভাবনা?
– তারপর আর কী? কিছুই না..
– বিয়ে করবেন না?
– না।
– রাকা একা একা বাসায় পড়ে থাকবে এভাবে! ওর একজন সঙ্গীর, একজন কথা বলার মানুষ হলেও তো একজনকে দরকার! বাচ্চা মানুষ কিভাবে এভাবে সারা বাসায় একা একা থাকবে, এ নিয়ে কিছু ভাবেন নি?
আব্বু কথাগুলো শুনে কিছুটা ভড়কে গেলো। আসলেই সে এরম কিছু আগে ভাবেনি।
রাকা তো এভাবে দিনের পর দিন একা থাকলে মানসিকভাবে নিসঙ্গ হয়ে যেতে পারে!
আব্বু বললো,
– কিছু করার নেই। আমিই সময় দেওয়ার চেষ্টা করবো আরকি। আমাকেই দিতে হবে। আর তুমি তো আছোই।
– কিন্তু আমি তো প্রতিদিন থাকতে পারবো না। আমার ও তো আলাদা কাজ থাকতে পারে। টিউশন করলে টিউশনের জন্য, চাকরী করলে চাকরীর জন্য, এসবের জন্য হয়তো রাকার কাছে আসতেই পারবো না,ওকে বেশি সময় দিতে পারবো না। আবার ওকে যে নিজের কাছে নিয়ে রাখবো, তার ও উপায় নেই, কারণ আমি নিজেই তো ভাইয়ের বাসায় থাকতে পারিনা, সেখানে আরেকজন। তাই আমার মনে হয় আপনার ওকে নিয়ে আরেকটু ভাবা উচিত।
আব্বু স্বাভাবিক স্বরে বললো,
– জানি। যতদিন পারো,ততদিনই না হয় আমার মেয়েটার কাছে থাকবা। আর আমি একজন বয়স্ক কাজের মানুষ রাখবো। উনি সারাক্ষন বাসায় থাকবে,বাসার সব কাজকর্ম করবে। পাশাপাশি রাকার নি:সঙ্গতা কাটবে।
খালা খুব আহত গলায় বললো,
– রাকার ভাগ্য খুব খারাপ। আমার মনে হয়না ওকে এভাবে একা একজন কাজের মানুষের সাথে রাখা ঠিক হবে বলে। একদিন দেখা যাবে, সে সবকিছু নিয়ে পালিয়ে গেলো অথবা রাকাকে দিয়ে খারাপ কিছু করিয়ে নিলো অথবা বেচে দিলো! কত কিই তো হতে পারে। যেখানে ওর নিজের মা ই..
আব্বুকে এবার চিন্তিত দেখা গেলো।
সে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে একটু পানি পান করলো। খালা তার হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাইয়ের প্যাকেটটা আব্বুকে নিতে বললো।
– ভাই, এইটা নিন। খেতে খেতে রাকার কাছে চলুন।
– তা চলো। কিন্তু এইটা কেন? বাচ্চাদের জিনিস!
– ওর ভালো লাগবে। মানসিক প্রশান্তি ফিরে আসবে ওর। অনেকদিন হয়েছে মেয়েটা নিজের চোখের সামনে ভালো কিছু, তার আনন্দ লাগার মত কিছু দেখেনা। আসুন, ওকে একটু খুশি করাই আজ। আমরা দুজন মিলে কি এইটুকু ও করতে পারবো না? আজকে ও কি করছে জানেন? বলে আমার ব্যাগ গোছানোর কাহিনী ছাড়াও আরো কিছু কাহিনী বলতে লাগলো খুশি খুশি চেহারা নিয়ে।
আব্বু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খালার দিকে। তার চোখে কৃতজ্ঞতার ভারী বর্ষণ! কিন্তু খালা দেখছে না। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দোলনায় উঠেছি। দুলছি। খালা আমাকে দেখছে আর হাসছে।
আব্বু খালার হাত থেকে হাওয়াই মিঠাই নিজের হাতে নিলো।
তারপর ইশারা করে বললো,
– চলো যাই। রাকার কাছে।
আমি লক্ষ্য করলাম, তারা এদিক পানেই আসছে। এতক্ষন যতটুকু ভালো লাগছিলো এখন তারচেয়ে দ্বিগুন বেশি ভালো লাগছে।
খালা আর আব্বু দুজনেই একসাথেই খেতে খেতে আসছে। কি সুন্দর দৃশ্য!
খালা দু প্যাকেট বাদাম কিনেছে, ধরতে পারছে না ভালো করে;তাই আব্বু খালার ব্যাগ ধরেছে।
আমি তাকিয়ে আছি তাদের দুজনের দিকে।
ভাবছি,
আহা, আমার কি দুর্ভাগ্য।
এই দৃশ্যে কেন অনু চৌধুরী শামিল হলো না?
কেন এই দৃশ্যটা আমি আমার আব্বু আম্মুর মাঝে এখন আর দেখতে পাইনা?
আর কি কখনো দেখবো?
না!
হঠাৎ করে আম্মুর জন্য ভীষণ খারাপ লাগলো। কি পাষাণ আমার আম্মু! চলে গেছে আমাকে ছেড়ে!
এতদিন পর এসব মাথায় আসতেই আমার চোখে জল এসে গেলো।
আজকে সত্যিই আমি অনু চৌধুরীকে মিস করছি।
(চলবে)