আরেক_ফাল্গুনে,পর্ব-05
সামানিয়া_জামান_প্রজ্ঞা
ড্রয়িং রুমে সোফাতে বসে আছি আমার পাশেই মুহতাসিন মাহিদ চৌধুরী। কিছুক্ষন আগে মেহেকে নিয়ে এই বাড়িতে পৌঁছে যায়। ডোরবেল বাজতেই মেহেকের মা এশা মুহতাসিন চৌধুরী দরজা খুলে। মেহেককে দেখেই একপ্রকার অবাক হয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেন। মেহেক ও কিছু না বলে মাকে জরিয়ে ধরে। আজছয়দিন পর উনি মেহেককে দেখলেন। মা তো এমনি হয় সন্তানকে কাছে পেলে ছাড়তেই চাইনা হাজার হোক নাড়ীর টান বলে কথা।
মেহেক মামুনি আমার কোথায় ছিলি তুই এতোদিন?
এনি কে আমাকে দেখিয়ে বললেন।
ভিতরে এসে বলি?
হ্যা হ্যা অবশ্যই। ভিতরে আসো।
এশা চৌধুরী মেহেকে আমার সঙ্গে দেখে যে প্রচন্ড অবাক হয়ে তা উনার চেহেরা দেখে বোঝা যাচ্ছে।
ভিতরে প্রবেশ করতেই মুহতাসিন আঙ্কেলকে দেখলাম সোফায় বসে খবরের কাগজ পরছেন। উনাদের চেহেরা দেখে বোঝা যাচ্ছে মেহেককে না পেয়ে উনাদের এক কয়েকদিন কতো বাজে ভাবে কেটেছে।
মেহেককে দেখে আঙ্কেল উঠে দাড়ালঁ। মেহেক দৌড়ে আঙ্কেলকে জরিয়ে ধরে কেদেঁ দিলো। দুজনের চোখে পানি। আঙ্কেল ও কান্নার সুরে বলল কোথায় ছিলে মামুনি জানো আমি মেধাকে নিয়ে তোমার অনেক খোঁজ করেছি। শেষে না পেয়ে পুলিশ কে জানিয়েছিলাম উনারাও খোঁজ করছে। টুর থেকে সবাই ফিরেছিলো কিন্তু তুমি নাকি ফিরোনি কিন্তু কেনো?
আমি না বাপি উনি তোমাকে সবটা বলবে। আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে।
মাহিদ আঙ্কেল আমার দিকে তাকালে আমি শুকনো একটা হাসি উপহার দিলাম। উনি আমাকে বসতে বললেন। তারপর অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে মেহেকে বলল,
এই কে মামুনি?
আমি ডা.ফায়াজ আবরার জুবায়ের!!!
আমার নাম শুনে উনি হচকিয়ে উঠলেন তারপর কিছুক্ষন তাকিয়ে আন্টির উদ্দেশ্যে বললেন ওর জন্য
কফি নিয়ে এসো। তারপর মেহেকের উদ্দেশ্যে বললেন,
মামুনি তুমি মেধার সঙ্গে কথা বলবে না? ছাদে যাও মেধাকে পাবে। ও তোমার জন্য চিন্তিত ছিলো যাও দেখা করে আসো।
আমি তো ওর কথা ভুলেই গেছি আমি আসছি।
মেহেক চলে যেতেই আঙ্কেল বললেন,
কেমন আছো আবরার?
মেহেকেকে আমার থেকে দুর করে কেমন আছো জানতে চাইছেন আঙ্কেল?
উনি হালকা হাসলেন তারপর বললেন,
আমার সেদিনের কথাগুলো মনে রেখেছো? অনেক উন্নতি করেছো দেখছি। যাইহোক মেহেক তোমার কাছে ছিলো তো আমাদের জানাও নি কেনো? কোথায় পেয়েছো মেহেককে?
আপনার কথা ধারটা খুব তীক্ষ্ম ছিলো আঙ্কেল। কিভাবে ভুলবো বলুন? আর আপনার কথার জোরেই এতোদুর আসতে পেরেছি এজন্য ধন্যবাদ দিলেও কম হবে।
উনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমার খোচা মারা কথায় উনি জবাব দেওয়ার মতো উত্তর খুজে পাচ্ছেন না।
এজন্য আমি উনাকে স্বাভাবিক করতেই বললাম,
মেহেককে আমি কিডন্যাপ করেছিলাম সেন্টমার্টিন এর লাস্ট টুরে। এবং সে আমার কাছে চারদিন ধরে বন্দি ছিলো।
আঙ্কেল চমকে বলে উঠল ,
কিইই!
হ্যা ঠিক শুনেছেন। মেহেককে দেখতে পুরোই আপনার মতো এজন্য আমি সৌন্দহ করেছিলাম পরে দেখি আমার সৌন্দহ ঠিক। তখন ই আমি ওকে কিডন্যাপ করে বন্দি করে রাখি। আর ঠিক করি আপনাদের না জানিয়ে ওকে বিয়ে করবো। এতে ছোট বেলার প্রতিশোধ টাও নেওয়া হতো। কিন্তু পরে ভাবলাম এটা করলে আমি আমার হবু শ্বশুর শাশুড়ির,বউ এর কাছে ভিলেন হয়ে যাবো বলে হেসে উঠল।
দেখ ছোটবেলার সেই কথা তোমার উপর কতোটা প্রভাব ফেলেছে জানিনা আমি। আমি শুধু জানি তোমাকে যদি মেহেকের থেকে না সরাতাম তবে তুমি
কিছুতেই সফল হতে পারতে না নিজের লক্ষে। কারন তুমি এতটাই পাগল ছিলে মেহেকের উপর। তখন সদ্য তোমার বাবা মা মারা গেছে। তোমার এক চাচা তোমাদের সম্পত্তি নিজের আয়ত্বে করে নিয়েছিল সেই টাইমে তুমি মেহেক ছাড়া কিছুই বুঝতেই চাইছিলেনা। একসময় দেখলাম তোমার না আছে নিজের প্রতি টান আর না আছে নিজের প্রতি যত্ন। সবটা দেখে তোমার ভালোর জন্যই আমি সেদিন ওগুলো বলে তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আর তোমার নামে যে একাউন্ট আছে আর সেখানে যে মোটা অঙ্কের টাকা আছে এটা আমার জানা ছিলো।তারপর ও আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছি রাখিনি নিজের কাছে কারন তোমার সঙ্গে সঙ্গে মেহেকের ও জীবনের ঝুঁকি ছিলো। আমি জানি সেই সময় টা তোমার জন্য হার্ড ছিলো কিন্তু আমি এটাও জানতাম আমার কথা ভেবে জীবনে তুমি অনেক নাম করবে। নিজেকে ঠিক ততটাই প্রস্তুত করবে যতটা হলে আমার মুখোমুখি দাড়িয়ে তুমি একদিন বলবে আমার আমানত আমাকে ফিরিয়ে দিন। যখন তুমি বিদেশে পড়াশুনা করতে চলে গেছিলে এরপর থেকে আমি তোমার ব্যপারে খোজ খবর রাখা শুরু করি তোমার লওরিয়ার আঙ্কের মাধ্যমে। যখন জানতে পারি তুমি সাইনটিস্ট হয়েছো আমার তখন এটাই মনে হয়েছিল মেহেকের চেয়ে বেটার তুমি ছাড়া আর কেউ না। আমি জানতাম একদিন তুমি ঠিক মেহেককে চাইতে আসবে আমার কাছে কিন্তু ভাবিনি আমার উপর রাগ করে ওকে তুলে বিয়ে করার কথা ভাববে।
ভেবেছিলাম আমাকে দেখে আঙ্কেল শকড্ হবে কিন্তু তা না উনার কথা শুনে আমিই শকড্।
ওকি আবরার?
আন্টির কথায় আমি আঙ্কেল ঘুরে তাকালাম। দেখি আন্টি কফি হাতে দাড়িয়ে আর উনার চোখে পানির আভাস।
আঙ্কেল চোখ নামিয়ে বলে উঠল হ্যা এই আমাদের আবরার বিশ্বসেরা সাইনটিস্ট ডা. ফায়াছ আবরার জুবায়ের। আমার কলিজার বন্ধু ফরহাদ জুবায়েরের ছেলে।
আন্টি কিছু না বলে কান্নায় ভেঙে পরে বললেন,
সেদিন আমি কিছু বলতে পারিনি। তোমাকে ওইভাবে চলে যেতে হয়েছিল বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।আমি আটকাতে চেয়েছিলাম সেদিন মেহেকের আব্বু আমাকে শক্ত হতে বলেছিল। আর এটাও বলেছিলো ও আবার ফিরবে তবে নিজেকে যগ্য করে । ভাবতে পারছিনা এতো দেরি করে কেনো এলে?
আমি কি বলবো ভাষায় খুজে পাচ্ছি না। আমার শ্বশুর এতোকিছু আগাম ভেবে রেখেছিলো। কিন্তু আমি উনাকে কতো ভুল বুঝেছি। কি বলবো কিছুই নি বুঝে উনাদের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম।
মাহিদ আঙ্কেল বলে উঠল,
মেহেক তোমার অধিকার। তোমাকে অনেক দুরে রেখেছি ওর থেকে আমাকে ক্ষমা করে দেও আবরার। দেখো আমরা চাই তুমি সসম্মানে মেহেক কে বিয়ে করো। আর আমাদের ভুল বুঝোনা কারন আমরা যা করেছি তোমাদের দুজনের ভালোর জন্য।
মেহেক আজো তোমাকে মনে করে কাদে। আমরা ওরে এটা বুঝিয়ে রেখেছি আবরার ফিরবে। আমাদের ত অনেক বয়স হলো এবার তুমি তোমার আমানতকে সামলাও।
আঙ্কের কথায় আমার চোখ কটর থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি ভেবেছিলাম আঙ্কেলকে রাজি করাতে না পারলে জোর করে বিয়ে করবো মেহেককে কিন্তু আমার এতোদিনের ভুল ধারনা একমিনিটেই শেষ করে দিলেন আমার হবু শ্বশুর মুহতাসিন মাহিদ চৌধুরী।
কি হলো কি ভাবছো মাফ করবে না তোমার এই আঙ্কেলকে? মেহেককে বিয়ে করবে না?
আমাকে মাফ করবেন আঙ্কেল।
মাফ করবো কিন্তু কেনো? মাফ তো আমাদের চাওয়া উচিত। তুমি কি মেহেককে বিয়ে করতে চাওনা?
না। আমি মেহেকে বিয়ে করতে চাই আর সেটাও আপনাদের সামনে। আমি তো আমার অন্যায় এর জন্য সরি বলছি। আমি আপনাদের সম্পর্কে অনেক উল্টোপাল্টা ধারনা রেখেছিলাম সরি আঙ্কেল।
সরি বলছো কেনো? তোমার জাইগায় থাকলে আমি ও হয়তো এটাই করতাম আবরার। আমি চাইতাম আমার বন্ধুর ছেলে বড় হোক অর মেহেকের যগ্য হোক কিন্তু তেমন কোন লক্ষন খুজে পাইনি তোমার মধ্যে আমি। এজন্য তোমার উপর কঠিন হয়েছিলাম তোমরা ভালো থাকো এটাই আমার চাওয়া ছিলো উপরে যতই শক্ত হইনা কেনো।
আঙ্কেল আপনারা চাইলে আমি পরশুই মেহেকে নিজের স্ত্রীর সম্মান দিতে চাই।
আমাদের চাওয়া তো এটাই। আর মেহেক তোমার ।তুমি ওকে স্ত্রির সম্মান দিতে চাও এটা ভালো আমাদের কোন আপত্তি নেই।
থাঙ্ক ইউ আঙ্কেল। থাঙ্ক ইউ সো মাচ। আজ আমাকে যেতে হবে ল্যাবে কাজ আছে। আর হ্যা মেহেককে আমার পরিচয় টা বললবেন না। কারন ওকে সময় হলে আমি নিজেই সবটা বলবো।
…….
সময় হলে কি বলবেন?
মেহেকের কথায় আমরা সবাই একে ওপরের দিকে তাকালাম।
কি ব্যাপার তোমরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছো কেনো?
মেহেক মামুনি তুমি না মেধার সঙ্গে কথা বলতে গেছিলে।
হুম গেছিলাম তো ও বাড়িতে নেই। ওর সঙ্গে পরে কথা বলে নিবো আগে তোমরা বলো কি নিয়ে কথা বলছো আর সময় হলে কি বলবে আমাকে? ভ্রু উচিয়ে বললাম।
ও কিছু না তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছে।
বিয়ে? কার বিয়ে? সবার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে।
ডা. ফায়াজ আবরার জুবায়ের মুখে হাসি নিয়ে বলল,
ওকে আঙ্কেল আপনি আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন আমি আসছি।
মানে কি কথা বলবে শুনন।চলে গেলেন উনি। উনার এই অভ্যাসটা ভিষণ বিরক্ত লাগে আমার। পুরো কথা না বলেই চলে যায়।
আমি বাপি মাম্মার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করতেই উনারা বলল,
পরশু তোমার আর ফায়াজের বিয়ে ধুম ধাম করে অনুষ্ঠান করে। নিজেকে পিপিয়ার করে নেও মামুনি। আমি জানি তোমাদের ব্যাপারে সবটা।
মানেটা কি?ওই লোকটির থেকে সবটা শুনার পর ও তোমরা আমাকে উনার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাও? সবচেয়ে বড় কথা আমার জিবনে যে একজন আছে মাথায় আছে তোমাদের?
দেখো সবটা শুনার পরই আমি আর তোমার মাভ্মা ডিসাইড করলাম তোমরা বিয়ে হবে আর আমাদের উপস্থিতিতে ধুমধাম করে। আর তুমি যার জন্য অপেক্ষা করছো সে আর ফিরে আসবে না মেহেক ভুলে যেয়ো না সে তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন সবটা ভুলে ভবিষ্যৎ চিন্তা করো। এখন থেকে যা ভাবার ফায়াজ কে নিয়েই ভাববে কারন ওর সঙ্গেই তোমার বিয়ে হচ্ছে টোটাল এন্ড ফাইনাল চলো এশা।
আরে বাপি মাম্মা কোথায় যাচ্ছো আমার কথাটা শুনো আমি ওকে ভুলতে পারবো না। এই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
ডা. ফায়াজকে বিয়ে তোমার করতেই হবে মেহেক।
কি ব্যাপার একটু আগে ভাবলাম আমাকে কিডন্যাপ করার কথা শুনে বাপি রেগে যাবে উনার উপর কিন্তু এখন আবার ওর সঙ্গেই বিয়ের জন্য উঠে পরে লাগছে কেনো?
চলবে