“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৯৭

0
2472

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯৭
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সকাল দশটার পর ইমরান যখন অফিসে তখন আননোন নম্বর থেকে কল আসে নাফিসার ফোনে। নম্বরটা দেখে নাফিসার মনে হচ্ছে সেই নম্বরটাই! সে রিসিভ করে সালাম দিলো। ওপাশ থেকে সালামের জবাবে জেরিনের কণ্ঠ শোনা গেলো! নাফিসা বললো,
– আল্লাহর রহমতে আমি তো বেঁচে গিয়ে এখন খুব ভালোই আছি। হানিমুনও সেড়ে এলাম। তো আপনার কি অবস্থা? কেমন আছেন ভাবি?
– কিছু জরুরী কথা বলতে কল করেছি।
নাফিসা তার রুমের দরজা চাপিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
– হুম, বলুন।
– জিহান কি করে?
– ভাইয়ার কাছে কল করে জানলেই পারেন সেটা।
– সে এখন অফিসে। তুমি বাড়িতে আছো বিধায় তোমার কাছে জানতে চাইলাম।
– ভাইয়ার নিষেধ আছে, কোনো ইনফরমেশন দেওয়া যাবে না আপনাকে।
জেরিন কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,
– আমি একটা ভুল করেছি, আর এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে একটা সুযোগ দিবে আমাকে?
– প্রায়শ্চিত্ত! তাও আবার আপনি! শুনেছি ভাইয়া নাকি আপনাকে ওয়ার্নিংয়ে রেখেছিলো। প্রায়শ্চিত্ত তো তখন করার কথা ছিলো! সেটা তো আপনি করলেন না। তো এটা আশা করেন কিভাবে যে এখন সুযোগ পাবেন!
– প্লিজ, একটা সুযোগ দাও। আমি আর কখনো কারো সাথে বাজে আচরণ করবো না। একবার আমাকে বাড়িতে আসার সুযোগ দাও তোমরা।
– আমি কি আপনাকে বাড়ি থেকে বের করেছি?
– না।
– তাহলে আমাকে বলছেন কেন!
– যাকে বলবো তাকে বলার সুযোগ নেই। আর তোমার জন্যই আমি বাড়ি ছাড়া হয়েছি। তাই তোমাকেই বলছি।
– আমার জন্য কেন? আমি কি কাউকে বলেছি আপনাকে বাড়ি ছাড়া করতে?
– আমার ভুলের জন্য বাড়ি ছাড়া হয়েছি। হয়েছে এবার? এখন ভুল শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ দাও আমাকে।
– আমি এ ব্যাপারে কিছু করতে পারছি না। দুঃখিত।
– নাফিসা, প্লিজ। জিহানের কথাটা একবার চিন্তা করো। একটা বাচ্চার কাছে তো মাকে প্রয়োজন হয়। প্লিজ একটু বুঝাও আরমানকে।
– জঘন্য কাজ করার পূর্বে আপনারও জিহানের কথাটা একবার চিন্তা করা উচিত ছিলো। আর ভাইয়া আমার ছোট নয় যে বুদ্ধিশুদ্ধির অভাব আছে আর আমি ভাইয়াকে বুঝাবো। তাছাড়া আমি ভাইয়ার সাথে তেমন একটা কথা বলেও অভ্যস্ত নই।
– তুমি ইমরানকে একটু বলো। সে কথা বলতে পারবে।
– আপনার কথা শুনে অবাক না হয়ে পারি না! আরে আপনার ভাগ্য ভালো ইমরান আমাকে নিয়ে হসপিটাল পড়ে ছিলো! নতুবা আপনার জান নিয়ে নিতো! আর সেখানে সে আপনার সুপারিশ কিভাবে করে!
– প্লিজ কিছু একটা করো। তোমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েই এমন কিছু হচ্ছে। তুমি চাইলে পারবে কিছু একটা করতে। প্লিজ না করো না। নতুবা আরমান ডিভোর্স দিয়ে দিবে!
– সেটাই তো আপনি চান ভাবি। আপনি তো ভাইয়ার সাথে সংসার করতে চান না বলেই এতোসব করে এসেছেন।
– বলছি তো একটা ভুল করেছি। কিছু একটা করো। আরমানকে থামাও। সে ডিভোর্স দিলে অনেক খারাপ হবে আমার সাথে। বাবা-মা আমার বিয়ে দিয়ে দিবে অন্যত্র। তারা এখন ডিভোর্সের আশায়ই আছে।
– ভালোই তো! পাত্র তো মনে হচ্ছে আগে থেকেই ঠিক করা!
– না, ঠিক করা না। ঘটকের সাথে কথা বলেছে মাত্র।
– ভাইয়াকে যখন ভালো লাগে না তো করে নিন বিয়ে। নতুবা কি আর করবেন, জীবন তো একা চলে না।
– নাফিসা আমি মস্করা করছি না। সত্যি বলছি।
– আমিও সত্যিটাই বললাম।
– আমি করবো না কাউকে বিয়ে।
– কেন?
– কেন আবার! তুমি জানো না?
– ওহ্! ইমরানকে বিয়ে করবেন বুঝি?
জেরিন চুপ হয়ে গেছে! নাফিসা আবার বললো,
– কি ভাবছেন? চলে যাবো আমি? আসবেন ইমরানের সংসার করতে?
– কি বলছো এসব!
– আপনি যা চেয়েছিলেন তা-ই বলছি।
– মিথ্যে বলবো না। ইমরানের প্রতি আমি আকৃষ্ট ছিলাম তোমাদের বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত। তুমি আসার পর কেন জানি আমার সেই আকৃষ্ট উঠে গিয়ে তোমার প্রতি একটা ক্রোধ জন্মেছিলো। সহ্য হতো না তোমাকে। কিন্তু বিশ্বাস করো, ইমরানকে নিয়ে আমার মধ্যে কোনো অনুভূতি ছিলো না তখন। এখনো নেই।
– বিশ্বাস জিনিসটা অনেক আপন। তাকে যদি ভেঙে দেওয়া হয় তবে সেটা হৃদপিণ্ডে আঘাত হানে। আর সত্য বলতে আপনার উপর কখনোই আমার বিশ্বাস ছিলো না। আজও নেই। আমার কাজ আছে। রাখি আমি।
– প্লিজ নাফিসা। একটু মেহেরবানি করো।
– আল্লাহ মেহেরবান। তা-ও মানুষের মধ্যে যতটুকু ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছেন আপনি সেটার যোগ্য না।
– প্লিজ এমন করো না। এতোগুলো জীবন নষ্ট হতে দিও না প্লিজ। কিছু একটা করো। আরমান আমাকে অনেক ভালোবাসে। শুধু রেগে এমন কাজ করছে। তাকে আটকাও।
– অনেক ভালোবাসে সেটা জেনেও মর্যাদা লঙ্ঘন করেছেন! আপনি মানুষ নাকি আরও কিছু?
– প্রথমে অন্ধ থাকলেও পরে বুঝতে পেরে মর্যাদা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ধ্বংস কামনার মোহে পড়ে সুযোগটা আর হয়নি।
– আমার ধ্বংস করতে চেয়েছেন আবার আমার কাছেই সাহায্য চাইছেন! কি আযব না ব্যাপারটা!
– প্লিজ বোন, মাফ করো। আমি প্রেগন্যান্ট। আমাদের জীবনের সাথে দুইটা বাচ্চার জীবন এভাবে নষ্ট হতে দিও না। প্লিজ পায়ে পড়ি তোমার।
– প্রেগন্যান্ট! এবাড়িতে আসার জন্য আবার নতুন পরিকল্পনা সাজিয়েছেন!
– ও বাড়িতে আসতে চাই। কিন্তু কোনো মিথ্যা পরিকল্পনা না। সত্যি বলছি আমি। আমি প্রেগন্যান্ট তা জানার পরই বাবা-মা বিয়ের ব্যবস্থা করছে।
নাফিসা কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না! এমনিতেই জিহানের জন্য খারাপ লাগছে এখন আরও বেশি মায়া হচ্ছে জেরিনের উপর! যদিও জেরিনের সাথে প্রকাশ করেনি সমবেদনা। কিন্তু মনে মনে ভাবছিলো কিছু একটা করার। জেরিন যেহেতু এভাবে কথা বলছে সত্য হলেও হতে পারে। কিন্তু জিহানের ব্যাপারটা তো চোখের সামনে দেখা! আরাফ ভাইয়া তো এসেছিলো, কি কথা হয়েছে তা-ও তো জানা হলো না। বড়মার সাথে কথা বলতে হবে বিষয়টি নিয়ে। এদিকে জেরিন “হ্যালো? হ্যালো?” করেই যাচ্ছে। নাফিসা মন খারাপ করে জবাব দিলো,
– আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। রাখি এখন। আর জিহান এখন গাড়ি নিয়ে খেলা করছে নিশাতের সাথে।
এইটুকু বলে নাফিসা ফোন রেখে দিলো। দুপুরে ইমরান বাড়ি ফিরলে নাফিসা সুযোগ বুঝে জেরিনকে নিয়ে একটু কথা বলতে শুরু করলেই ইমরান তাকে ধমকে থামিয়ে দিলো। সে জেরিন সম্পর্কে কিছু শুনতেই রাজি না। আর নাফিসাকেও তাকে নিয়ে কিছু ভাবতে নিষেধ করে দিলো। নাফিসা বেশ বুঝতে পারছে এর সাথে কথাও বলা যাবে না, কিছু করাও যাবে না। তাই সে সুযোগ বুঝে আবার বড়মার সাথে কথা বললো। জেরিন প্রেগন্যান্ট সেটা জানতো না ঠিকই কিন্তু জিহানের জন্য বড়মাও ভাবছিলো জেরিনকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আরমানের সাথে কথাও বলেছিলো আগে, কিন্তু আরমান উল্টো বুঝিয়ে দিয়েছিলো তাকে ফিরিয়ে আনা মানে পুরো পরিবারটাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া। সন্ধ্যায় নাফিসার মুখে শুনে রাতে বড়মা নিজে কল করে কথা বলেছিলো জেরিনের সাথে। জেরিন কান্নাকাটি করলো বড়মার সাথে কথা বলে। বড়মা তার মায়ের সাথে কথা বললো। তার মা রাগান্বিত গলায় পরিস্কার বলে দিলো ডিভোর্স পেপার যেন তারাতাড়ি পাঠিয়ে দেয়, তারা মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিবে।
বাবামায়ের অভিমানটাও বুঝে বড় মা। তিনি আবারও আরমানের সাথে কথা বললেন। আরমান নিষেধ করলো সে কখনোই যাবে না জেরিনকে আনতে৷ আর সাথে অনুরোধও করলো যেন তাকে এমন কিছু করতে বাধ্য না করে! ছেলে বিরক্ত হয়ে অনুরোধ করেছে তাই আর দ্বিতীয়বার বড়মা বললো না জেরিনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা।
শনিবার নাফিসা ভার্সিটি গিয়েছে। নাহিদা ই কল করে বলেছে ভার্সিটি যেতে। সে একটু লেট করে আসায় নাহিদা বললো,
– এতো লেট করে এলি কেন?
– আরে আর বলো না! হিজাব আটকাতে আটকাতে ঘন্টা লেগে গেছে! কতবার যে খুললাম আর বাধলাম! তা তুমি এখানে দাড়িয়ে আছো কেন? ক্লাস করবে না?
– না। কোচিং করতে এসেছি। তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম৷ তুই কোচিং করছ না?
– করি তো। ছুটির পর। এই ক’দিন তো অসুস্থতায়ই কাটলো! তাই অফ।
নাহিদা একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
– নে, ধর। এটা রাখ।
– এটা কি?
– তোর গিফট।
– কিসের গিফট! আমার তো বার্থডেও না, এনিভার্সারিও না!
– এমনি গিফট করলাম।
নাফিসা ফিসফিস করে বললো,
– বেবির উদ্দেশ্যে গিফট করছো খালামনিকে?
– চুপ! ফাজিল!
নাফিসা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো এবং প্যাকেটটা খুলতে লাগলো। নাহিদা বললো,
– এখন তোর এটা দেখতে হবে! ক্লাসে যা। আর এক্সামের বেশিদিন নেই। পড়াশোনা একটু ভালোমতো করিস।
– হুম। দোয়া করো।
– তা তো অবশ্যই। কিন্তু নিজে প্রেজেন্টেশন না করলে কি দোয়া কাজ করবে!
– হুম। ক্লাস তো একটা মিস হলোই, চলো এক কাপ কফি খাওয়া যাক।
– আজ না। আমি একটু বাসায় যাবো। মায়ের সাথে দেখা করে আবার ওবাড়িতে যাবো।
– আমারও তো যেতে ইচ্ছে করছে এখন!
– ক্লাস করবি না!
– করতেই তো এসেছিলাম।
– তো ক্লাস কর। যা।
– না, বাসায় যাবো। চলো।
নাহিদা নিষেধ করলেও নাফিসা শুনলো না। ইমরানের কথা মনে হতেই নাফিসা রিকশায় বসে কল করলো। এমন ভঙ্গি প্রকাশ করলো যেন তার এখন যেতেই হবে! কিন্তু ইমরানের পারমিশন ছাড়া নড়তেও পারছে না। মিথ্যে বলে অতি সহজেই সে ধরা পড়ে গেছে। হর্নের শব্দে ইমরান বলে দিয়েছে নাফিসা ভার্সিটিতে নেই। ইতোমধ্যে সে রাস্তার পাশে আছে নতুবা বাসায় যাওয়ার মাঝপথে আছে। ধরা পড়ে যাওয়ায় নাফিসা খিলখিল করে হেসে উঠে তাকে ধন্যবাদ জানালো মিথ্যেটা ধরে ফেলার কারণে! ফলশ্রুতিতে ইমরান তাকে “পাগলী” উপাধিতে ভূষিত করেছে।
দুইবোন বাসায় এসে মা ও বাবা উভয়কেই পেয়েছে। দেখাসাক্ষাৎ করে দুপুরে খেয়ে তারপর নিজ নিজ শ্বশুর বাড়ি ফিরেছে। যদিও পরিকল্পনা ছিলো যাবে আর দশ-বিশ মিনিট সময় কাটিয়ে আবার চলে আসবে। কিন্তু তা আর হলো না। সন্ধ্যার একটু আগে খুব জোরে বাতাস বইলো। সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এটা ছোট খাটো এক বৈশাখী ঝর। ইমরান ও আরমান কিছুক্ষণ আগেই বাসায় ফিরেছিলো। এখন সবাই ঘরে বন্দী। তীব্র বাতাসে ঝরঝর করে ছোট ছোট আমগুলো মাটিতে আছড়ে পড়েছে। নাফিসা অনেক চেষ্টা করেছিলো ঝড়ের মাঝে আম কুড়াবে বলে। কিন্তু ইমরানের জন্য পারলো না। ইমরান তাকে বকাঝকা করেছে এবং বলেছে এতো খেতে ইচ্ছে করলে ঝড় সারলেও কুড়ানো যাবে। কিন্তু ঝড়ের মাঝে আম কুড়াতে যেই সুখ, তা এই ইমরাইন্না বুঝবে কি!
ঝড় থামলেও নাফিসা মন খারাপ করে জানালার ধারে বসে ছিলো। ইমরান মাগরিবের নামাজ পড়ে টর্চ দিয়ে খুজে খুজে আম কুড়িয়ে এনে দিয়েছে৷ কিন্তু নাফিসা তা গ্রহণ করলো না। বিছানায় ছুড়ে মেরে বললো, “তুই খা বেশি করে!” ইমরানও তা-ই করলো। বড় ঘর থেকে জিহানকে ও লবন মরিচ এনে একটা আম খেতে খেতে মুখ চেটে শব্দ করলো। জিহান লবণ ছাড়াই তার দেখাদেখি চেটে শব্দ করে যাচ্ছে। যা একদমই সহ্য হচ্ছিলো না নাফিসার! যার ফলে সে জোরপূর্বক বাকি আমগুলো এবং মরিচের গুড়ো মিশ্রিত লবণ নিয়ে নিশাতের কাছে চলে গেলো। সে প্রকাশ না করলেও ইমরান জানে নাফিসার জ্বিভে জল এসে গেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here