ভৌতিকপ্রেম,পর্বঃ১৫,১৬

0
960

ভৌতিকপ্রেম,পর্বঃ১৫,১৬
লেখা – Mahfuza_Monira
পর্বঃ১৫

খুব সকালে চিল্লাচিল্লি তে তোহার ঘুম ভাঙে। না চাইতেও নিচে নেমে দেখে রিনির মা সোফায় বসে আছে। ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। তোহা খানিকটা অবাক হয়। মনে মনে ভাবে -‘ রিনির মা এখানে কেন! ‘

তোহাকে সিড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিনির মা শায়েরা বেগম উঠে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বেশ চিন্তিত স্বরে বলেন-
– তোহা,রিনির কোনো খবর জানো? ওর সাথে কথা হয়েছে কী তোমার?

তোহা আশ্চর্য হয়। সে কিছু জবাব না দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তা দেখে শায়েরা বেগম আবার বলেন-
– আজ ২ দিন হয়ে গেলো,আমি রিনির কোনো খবর জানিনা। ওর সাথে কথাও হয়নি আমার। ফোন বন্ধ বলছে বারবার। আমি ভেবেছি নেটওয়ার্ক প্রবলেম। কিন্তু যখন আমি কাল রাতে মিলি কে ধানমণ্ডি লেকে দেখি,আমি অবাক হই। ওকে জিজ্ঞেস করতে ও বলে যে তোমরা নাকি চলে এসেছো। তাহলে রিনি? ও কোথায়?

শায়েরা বেগম ঢুকরে কেঁদে উঠেন। তোহার মাথায় কিছুই ঘুরছে না। এখন ওর কি বলা উচিত! কি ধরনের বাহানা দিয়ে কথা কাটিয়ে নেওয়া যায় তাই ভাবতে থাকে তোহা।

তোহার ভাবনার ছেদ পড়ে যখন শায়েরা বেগম এর ঢুকরে কান্না করাটা বিলাপে পরিণত হয়। তোহার মা শেফা এসে স্বান্তনা দিতে থাকেন তাকে। আর তোহার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে –
– কি হলো? চুপ আছিস কেন? আমি তো আগেই জানতাম কিছু একটা হয়েছে। নিশ্চিত হয়েছে। আমাকে তো বললি না,কিন্তু ওনাকে তো বল। আমি না হয় তোকে ভালোবাসি না,তোর থেকে টাকাই বড় কিন্তু উনার জন্য তো রিনিই সব। উনাকে তো এবার বলবি না???

তোহার ভীষণ কান্না পায়। বুক ফেটে চাপা কান্না….
তোহা কিছু না বলে হুহু করে কেঁদে ফেলে।
তা দেখে শায়েরা বেগম এর বিলাপ করা বন্ধ হয়ে যায়। সে জলভরা চোখে তাকিয়ে থাকে তোহার দিকে।
.
.
তোহার সামনের সোফায় মুখোমুখি বসেছে শেফা এবং শায়েরা। তাদের দৃষ্টিতে তোহার দিকে। কঠিন সে দৃষ্টি। আজকে তোহাকে সবটা বলতেই হবে।
হবেই হবে….

তোহা একহাজার সমান গভীর লম্বা শ্বাস ফেলে বলে-
– সিলেটে আমাদের একজনের সাথে পরিচয় হয়। নাম তার আবিদ, সিলেটের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। রিনি তার প্রেমে পড়ে যায়।

তোহা এটুকু বলে চুপ হয়ে গেলে শায়েরা বেগম আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। ব্যস্ত হয়ে বলেন-
– থামলে কেন? এরপর? এরপর কি হলো?

তোহা নিচের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে আবার।
– কিন্তু সে কোনো সাধারণ মানুষ নয়। আধা মানুষ আধা রক্তচোষা। মানে ভ্যাম্পায়ার। আমি কোনোভাবে কথাটা জানতে পারি।

শায়েরা বেগম ভয়ার্ত দৃষ্টিতে শেফার দিকে তাকায়। শেফা তার হাত শায়েরা বেগম এর হাতের উপর রেখে তাকে আশ্বাস দেয় যে রিনি অবশ্যই ঠিক আছে। এবং তার কিচ্ছু হয়নি।

তোহা আবার বলে-
– কিন্তু আবিদ মানুষ না।ভ্যাম্পায়ার। কোনোভাবে কথাটা জানতে পারি আমি। আমি সেটা রিনিকে বললেও সে বিশ্বাস করেনা। সে ভাবে আমি আবিদকে পছন্দ করি এবং তাকে এসব ভুলভাল বলছি যেন সে আমার আর আবিদের মাঝথেকে চলে যায়। কোনোভাবেই বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না তাকে জানো। আমাকে উল্টো রিনি বললো,আমি নাকি তার কেউ না। তার জীবনে তোহা নামের কোনো বোন ছিলই না,কেউ ছিল না তার জীবনে।

যখন লাইফের সব থেকে কাছের মানুষ টা মিথ্যে অভিমানের চাদর গায়ে মাখিয়ে আড়াল হয়ে যায় কতটা কষ্ট হয় জানো?

সেই কষ্টের ছাপ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি সেদিনি রাগ করে সিলেট ছেড়ে চলে আসি। আমি আসায় আমার বন্ধুরাও চলে আসে। কিন্তু রিনি আসেনি। সে আবিদের কাছেই রয়ে যায়৷ এরপর থেকে আর রিনির সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি।

তোহার গাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে।
শায়েরা বেগম তার চোখ মুছে নেন। শক্ত গলায় বলেন-
– যে মেয়ে দুদিনের একটা অপরিচিত পুরুষের মোহে পড়ে তার আপনজনদের ভুলে যায়, তার কাছের মানুষদের অবিশ্বাস করে, তাদের কষ্ট দেয়,সেসব মেয়ের ফিরে না আসায় ভালো।

শেফা শায়েরার দিকে তাকিয়ে বলে-
– এসব কি বলছেন আপা! শত হোক,রিনি আমাদের মেয়ে। ও ঠিক আমাদের কাছে ফিরে আসবে। দেখবেন,ও ওর ভুল বুঝতে পারবে।

শায়েরা কিছু না বলে কঠিন দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।
.
.
.
– বুঝলি মিলি,এভাবে চলবে না। আমাদের কে কিছু একটা করতেই হবে। তোহা এভাবে আমাদের থেকে এত দূরত্ব বজায় করে চলতে পারেনা। উঁহু নেভার…

মিলি রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে-
– শুধু তোহার কথাই ভাবছিস? আর শীষ? ও কি আমাদের কেউ না? ও আগের থেকে কত চুপচাপ হয়ে গেছে। গম্ভীর হয়ে গেছে? তা কি দেখলি না বিধান?

বিধান চুপ করে রয়। তার কপালে সূক্ষ্ম রেখার ভাজ জমেছে। সে ভাজের প্রতিটা পাতায় চিন্তা…চিন্তা…চিন্তা….

মিলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে –
– আমাদের কে দুজনের দিক টাই দেখতে হবে। দুজনকেই কিভাবে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় সেটা ভাবতে হবে বুঝেছিস?

বিধান মাথা দুলায়।
– বুঝেছি।

হঠাৎ বিধানের ফোন বেজে উঠে। বিধান ফোন হাতে নিতেই তার চেহারা চকচক করে উঠে। উল্লাসিত কণ্ঠে মিলি কে বলে-
– বলেছিলি না,তোহা আমাদের মাঝে আবার ফিরে আসবে? আসলেই তাই হলো। এই দেখ তোহা ফোন করেছে।

মিলি রেলিং থেকে নেমে দৌড়ে বিধানের কাছে আসে। আসলেই স্ক্রিনে তোহার নাম্বার টা ভাসছে।

বিধান ঝটপট ফোন ধরে। ফোন ধরতেই তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ৭ সেকেন্ড পর কল কেটে যায়। মিলি ব্যস্ত গলায় বলে –
– কি হয়েছে? কি বললো তোহা?
বিধান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে –
– লাইফ কেয়ার হসপিটালে চল,রিনি ওখানে।
.
.
.

করিডোরে বসে আছে তোহা। ঠকঠক করে কাঁপছে সে। কে ছিল সকালে ওটা! যে ফোন করে জানালো যে রিনি হাসপাতালে!
রিনি ঠিক আছে তো?
তোহা এতদিন রিনির উপর রেগে থাকলেও,তাকে হাজারো অভিশাপ দিলেও এখন মনে প্রাণে একটা জিনিসই চাচ্ছে যে রিনি যেন ঠিক থাকে। সে যেন সুস্থ থাকে। একদম সুস্থ….
.
– তোহা ভেতরে যা..

শেফা এসে কথাটা বললে তোহা তার হাত টেনে ধরে। চিন্তিত সুরে বলে-
– মা,রিনি কেমন আছে? ঠিক আছে তো ও?
শেফা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে-
– নিজেই গিয়ে দেখ।
শেফার চোখে স্পষ্টত পানি। এর মানে কি? রিনি ঠিক নেই?
তোহার ভেতর টা আবারো কেঁপে উঠে। কাঁপা কাঁপা পায়ে সে প্রবেশ করে রিনির কেবিনে।
.
বা-হাতে কেনোলা,চোখের তলা শুকিয়ে কোটরে ঢুকে গেছে,সারা শরীর সাদা হয়ে আছে,যেন শরীরে রক্ত নেই একটুও। মুখটা ফ্যাকাশে। হাত পায়ে ছোট ছোট কাটা দাগ।

এটা কি সেই রিনি যাকে তোহা কয়দিন আগে দেখেছিল? যাকে তোহা হাসিখুশি ভাবে সিলেট ভ্রমণে যেতে দেখেছিল?

তোহা নিচু গলায় বলে –
– মা, মা আমায় ধরো। আমি বোধহয় জ্ঞান হারাবো।
.
.
তোহার জ্ঞান ফিরে বিকেল নাগাদ। পাক্কা ৪ ঘন্টা সে অজ্ঞান ছিল। ডাক্তার অবশ্য বলেছে সিরিয়াস কিছুনা, হয়তো মানসিক চাপের কারনেই সে অজ্ঞান হয়েছিল।

ভাগ্যিস তোহার বাবা দ্রুত মানিকগঞ্জ থেকে তার কাজ কর্ম ফেলে ছুটে এসেছিল। নয়তো একা শেফার হাতে দুদিক সামলানো বড্ড কঠিন হয়ে পড়তো।

ওদিকে রিনির ঐ অবস্থা,আবার তোহা বেহুশ,শায়েরা বেগম ও যেন পাথর প্রায়…
নিজের মেয়েকে এই অবস্থায় দেখার পর থেকে সে একটি শব্দ ও বলছে না। কাঁদতেও যেন ভুলে গেছে।

মিলি সবটা দেখে শুধু মাথা নেড়ে ছোট্ট করে বলে-
– আহারে….বেচারি….
.
.
তোহার কেবিনে আপাতত বিধান,মিলি,শীষ রয়েছে। লিমন টা কোথাও নেই।
তোহার মেজাজ গরম হচ্ছে লিমনের প্রতি খুব। এদিকে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে অথচ লিমন টা সেই সকাল থেকে গায়েব। তোহা মনে মনে কয়েকবার লিমন কে ডাকলেও লিমন আসেনি।
কে জানে কোথায় আছে।
হয়তো আরেকটা ভূত গফ জুটিয়ে নিয়েছে…..
.
মিলি প্রশ্ন করে –
– কিভাবে কি হলো?

তোহা মাথা নাড়ায়। অসহায় গলায় বলে-
– নিজেও জানিনা। কেউ একজন ফোন করেছে জানায় রিনি হাসপাতালে। আমরা আসি। আর ওকে এই অবস্থায় দেখি। ডাক্তার এর ভাষ্যমতে কোনো একজন গোয়েন্দা পুলিশ রিনিকে এখানে এডমিট করিয়ে গেছেন। উনিই নাকি রিনির ঠিকানা বলেছেন এবং সে নাকি সন্ধ্যার দিকে আসবে। আপাতত নাকি কাজে আছে!

শীষ মুখ অন্ধকার করে বসে আছে।

তার কাধে হাত রাখে বিধান। শীষ একটু নড়েও না। চুপ করেই বসে থাকে।

মিলি ভয়ার্ত গলায় বলে-
– আবিদ নাকি?

কেবিনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কেউ বলে-
– আমার নাম আবিদ না,নির্জন। আহনাফ নির্জন।

সবাই সেদিকে তাকায়। উচ্চতায় ৬’২। শ্যাম বর্নের, ছোট ছোট চুলের অধিকারী একজন দাঁড়িয়ে।

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে-
– এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন সবাই! আমি কি ভূত নাকি!?

তোহা চেঁচিয়ে বলে –
– আপনি!!!

নির্জনও তোহাকে খেয়াল করে বলে-
– তুমি???

তোহা পালটা প্রশ্ন করে।
– আপনি এখানে কেন?
– আগে বলো তুমি এখানে কেন?
– রিনি আমার কাজিন।সো আমি থাকবো না তো কে থাকবে!!
– ওহ! তাই বলো। আমিই সে যে রিনি কে সিলেটের বিছানাকান্দিতে পড়ে থাকতে দেখি। সেখান থেকে সিলেট সদরে নিয়ে যায়। সেখানে জ্ঞান ফিরলে রিনি বলে সে ঢাকায় থাকে এবং তার মার নাম্বার টাও দেয়ম এরপর আবার অজ্ঞান। আমি ওকে এম্বুলেন্সে করে ঢাকায় আনি।এখানে এডমিট করাই আর তার মাকে কল করে সবটা জানাই।

তোহা সিট থেকে উঠে দাঁড়ায়। নির্জনের কাছে গিয়ে বলে-
– ধন্যবাদ,আর সরি সেদিন বাসে ওভাবে রিয়েক্ট করার জন্য।
নির্জন মাথা চুলকে একটু হেসে বলে –
– ইটস ওকে…

বিধান ভ্রু কুঁচকে বলে-
– তুই উনাকে চিনিস তোহা?

তোহা বিধানের দিকে তাকিয়ে বলে-
– হুম। সিলেট থেকে আসার পথে বাসে দেখা হয়েছিল। আর ছোট খাটো একটা যুদ্ধ হয়েছিল দুজনের মধ্যে। আই মিন ঝগড়া..

এরপর নির্জনের দিকে ফিরে বলে –
– কিন্তু রিনি বিছানাকান্দি তে পড়ে রইলো কিভাবে! আর ওর এই অবস্থা করলোই বা কে?

নির্জন আবারো মাথা চুলকে বলে-.
– হাউ ক্যান আই নো! সেটা রিনির জ্ঞান ফিরলেই শোনা যাবে।

চলবে…..

ভৌতিকপ্রেম
পর্বঃ১৬
লেখা – Mahfuza_Monira

বেডের উপর বালিশে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে আছে রিনি। কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরেছে তার। পুলিশ এসেছে তার থেকে স্টেটমেন্ট নিতে। কিভাবে তার এই অবস্থা সেটা পুলিশকেও বলতে হবে তার।

রিনি নিচু গলায় বলে –
– আমি আমার পরিবারের সাথেই ঘটনা টা আগে শেয়ার করতে চাই। সো পুলিশরা যদি একটু বাহিরে থাকতেন…

তোহার বাবা একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হওয়ায় পুলিশরা কিছু বলে না। তারা বাহিরে অপেক্ষা করে।

রিনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে।
.
– কিচ্ছু লুকাবো না কারো থেকে। প্রথমে তোহা তোকে সরি বলছি। কারন হয়তো তোর কথা মানলে আজ এই দিন আসতো না আমার।
আমার একটা রিলেশন হয়। আবিদ…
আবিদ নাম তার। প্রথম দেখায় ভালো লেগে যায়। লাগবে নাইবা কেন,সেরকম সুদর্শন সে বটে। কিন্তু জানতে পারিনি সেই সৌন্দর্যের ভেতরের রূপ টা এত ভয়ংকর। তোহা আমাকে মানা করেছিল এই সম্পর্কে না জড়াতে। বলেছিল আবিদ আমার জন্য ঠিক ছেলে না। কিন্তু আমি শুনিনি। ভেবেছি হয়তো তোহা আমাকে আর আবিদকে দূরে রাখতে চায়! আসলে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ভালোবাসায়। কে ভুল আর কে ঠিক কিছুই মাথায় ঘুরছিল না আমার। যেদিন তোহা এবং বাকি সবাই আমার উপর রাগ চলে যায় সেদিনি ঘটে যায় ঘটনা। রাতের বেলা ঘুমোচ্ছিলাম। গভীর ঘুম…
এত গভীর ছিল যে আমাকে কখন বিছানা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়া হয় আমি টেরই পাইনি। চোখ খুলতেই দেখি উপরে আকাশ। আমি মাটিতে শুয়ে৷ মাটি না, ঘাস। ছোট্ট ছোট্ট ঘাস। আমি উঠে বসি। মাথায় তীব্র ব্যথা হচ্ছিল। বুঝতেই পারছিলাম না কোথায় আছি। আশেপাশে তাকিয়ে যতটুকু বুঝলাম যে আবিদের বাড়ির পেছনের বাগানে আছি। পাশেই বড় পুকুর৷ আমি উঠে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে নেই। ভাগ্যির ঢুকি নি। তার আগেই শুনতে পাই,ভেতর থেকে আবিদ কাউকে বলছে আমাকে খাওয়ার কথা। কেটে কেটে কুচি কুচি করে আমার প্রতিটা মাংস পিছ তারা তৃপ্তি করে খাওয়ার কথা বলছিল। শুনে গা রি রি করে উঠে। আমি ভেতরে উকি মারি। সেখানে আবিদ,ক্যাটি এবং সাথে আরো একজন কেউ ছিল। কিন্তু সে কে আমি জানিনা। আবিদের দিকে তাকাতেই আমার চোখ কপালে উঠে যায়। বড় বড় দাত,হলুদ চোখ আর সাদা শরীর,যেন একফোঁটা রক্ত নেই সেই শরীরে। তখনি টিভিতে দেখা ভ্যাম্পায়ার এর কথা মাথায় আসে। কিচ্ছু না ভেবে ঝেড়ে দৌড় দেই। বিছানাকান্দি তে এসে জ্ঞান হারাই।
জ্ঞান ফিরে দেখি সিলেটের এক হাসপাতালে আছি। তারপর নির্জন ভাইয়ার থেকে সব শুনি। কিভাবে আমাকে পেয়েছে,সেখানে এনেছে সব বলে আমায়।

তাকেই বলি আমাকে ঢাকায় নিয়ে চলো। ঢাকায় আমার পরিবার আছে। তাকেই মার নাম্বার টা দেই। এরপর….এরপর আর কিচ্ছু মনে নেই।
.
রিনি থামে। গলা শুকিয়ে গেছে তার। শায়েরা বেগম এর দিকে তাকিয়ে বলে-
– মা,পানি খাবো।

শায়েরা বেগম দ্রুত জগ থেকে পানি ঢালেন। মেয়ে দেন৷ এক নিশ্বাসে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে ফেলে রিনি।

ধীরে ধীরে বিছানায় শুয়ে পড়ে আবার। বসার শক্তিটাও যেন হারিয়ে গেছে। তোহার দিকে তাকিয়ে বলে-
– সরি বোন, তোকে সেদিন বিশ্বাস করলে আজ এমন হতো না আমার। তবে আমার মনে হয়,ওরা একবার আমার রক্ত খেয়েছে। এই দেখ,কাধে দুটো দাগ।

রিনি দেখায়। তোহা সেটা দেখে সেদিকেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রিনি আবার বলে-
– তুই আমাকে ক্ষমা করেছিস তো? তুই ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাবো না। আমার কি মনে হয় জানিস? আমি বাঁঁচবো না হয়তো। আমার শরীরের সব রক্ত ওরা খেয়ে ফেলেছে। আমি মরে যাবো,দেখিস আমি মরে যাবো।

রিনির হঠাৎই শ্বাস নিতে প্রবলেম হয়। সে হাসফাস করতে লাগে। আবরার দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার রিনিকে অক্সিজেন মাক্স পড়িয়ে দেয়। তোহার চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।

এই দৃশ্য দেখার আগে সে কেন মরে গেলো না?
কেন……….
.
.
বাহিরে করিডোরে বসে আছে সবাই। নির্জন সবটাই শুনেছে। সে সব শুনে হতবাক। এত আধুনিক জুগে এসেও মানুষ ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাসী? আচ্ছা,ভ্যাম্পায়ার কি সত্যিই হয়?
যদি রিনি মিথ্যেই বলতো,তবে কে করলো তার এমন অবস্থা? আর সত্যিই তো রিনির শরীরে রক্ত কমে গেছে খুব।ডাক্তাররাও সে কথাই বলেছে।
তবুও নির্জনের যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না।

নির্জন তোহার পাশে বসে। ভনিতা না করে সোজা প্রশ্ন করে তোহাকে।

– আচ্ছা তোহা,সত্যিই কি ভ্যাম্পায়ার বলতে কিছু আছে?
– থাকবে না কেন? আছে। আমিও সেই আবিদ কে দেখেছি।
– কেমন দেখতে?
– আর দশটা মানুষের মতোই সাধারন। শুধু তার চোখ গুলো আর গায়ের ত্বক একটু অন্যরকম।
– ওওও… তার মানে রিনি সত্যিই বলছে?

তোহা রেগে যায়।

– তো কি ও মিথ্যে বলছে? এসব কিছু আপনার কাছে মিথ্যে মনে হয়?
– ওকে,কুল তোহা। জাস্ট আস্ক করছি আমি! একচুয়ালি এরকম সিচুয়েশনে আগে কখনো পড়িনি এন্ড এসব শুনিও নি। সো তাই…
– হুম ইটস ওকে। বাট শুনোন,একটা কথা মনে রাখবেন,এই পৃথিবীটা অনেক বড়। এখানে এমন অনেক কিছু ঘটে যা আমাদের চোখের আড়ালেই রয়ে যায়। যা আমরা কখনোই দেখি না। তবে কারো না কারো চোখে সেগুলো ঠিকি ধরা পড়ে।

নির্জন নিচু গলায় বলে –
– হুম।
হঠাৎ নির্জনের কল আসে। এখুনি সিলেট রওনা হতে হবে তাকে। বিছানাকান্দির পানির নিচে মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যেন তেন মানুষ নয়,বাংলাদেশে ড্রাগ প্রচারকারী একটা বড় গ্যাংস্টার তারা। কে যেন সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে তাদের ব্যাপারে খবর দিয়েছে। তাও প্রমাণসহ। সেখানেই যেতে হবে নির্জন কে।

নির্জন উঠে পড়ে। তোহাকে বলে-
– আমি সিলেট যাচ্ছি। যদি কোনো সাহায্য দরকার হয়,আমাকে অবশ্যই জানিয়ো। এবং রিনি সুস্থ হলে আমাকে প্লিজ জানাবে। এই নাও আমার কার্ড।

মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে তোহার হাতে দেয় নির্জন। তোহা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে –
– এত কিসের তাড়া! কেন যাচ্ছেন সিলেট?
– বিছানাকান্দির পানির নিচে ড্রাগ গ্যাংস্টার দের দল পাওয়া গেছে। সেই মিশনেই।
– কেন? আপনি কি পুলিশ?
– নাহ,গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান।

তোহার মনে পড়ে যায় আবিদ ও বলেছিল সেও গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। তাহলে তো নির্জনের তাকে চেনার কথা!

তোহা প্রশ্ন করে ফেলে।
– আপনি তো তাহলে আবিদ কে চেনেন। সেও নাকি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিল। আমাদের তাই বলেছিল।

খানিকক্ষণ ভাবে নির্জন। এরপর বলে-
– এ নামের কাউকে তো শুনিনি! ওকে আমি এবার যেয়ে খোঁজ করবো। আর তোমাকে অবশ্যই জানাবো। আসি, বায়।

নির্জন চলে যায়। তোহা ভাবনায় পড়ে যায়। একমাত্র তার বন্ধু,সে,লিমন আর আবিদ জানতো পানির নিচের সেই লোকদের কথা। তাহলে সেই খবর সরকারের কাছে দিলো কে? আবিদ!!!!
.
.
রাতের বেলা তোহাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয় শেফা। আবরার ও এসে পড়ে। কেননা হাসপাতালে রাতের বেলা জেন্টস নট এলাউ।
.
নিজের রুমে এসে তোহার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। লিমন বিছানার উপর নাক ডেকে ডেকে ঘুমাচ্ছে!
আর এদিকে এত কিছু হয়ে গেলো!!
আর ও কিনা শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে!

তোহার মেজাজ চড়ে যায়। এক বালতি পানি এনে ঝট করে পুরোটা ঢেলে দেয় লিমনের উপর।

লিমন লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে ।
ছানাবড়া চোখ করে বলে –
– কি হয়েছে! আগুন কোথায় লাগছে??
তোহা দাতে দাত চেঁপে বলে-
– তোমার ব্যাকসাইডে আগুন লাগছে। সেটা নিভাতে পানি ঢালছি। শয়তানের সর্দার কোথাকার। আমি এদিকে এত টেনশনে মরতেছি আর তুই কিনা ঘুমোচ্ছিস!! কোথায় ছিলি তুই???

তুমি থেকে ডাইরেক্ট তুই!!
লিমন বুঝে পরিস্থিতি ভালো না। একটু উল্টো পালটা কিছু বললে মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না।

লিমন উঠে গিয়ে হাটু ভর করে বলে –
– আসলে খুব,ব্যস্ত ছিলাম আজ বুঝলে। তবে আমি কিন্তু সব পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি যতই দূরে থাকি না কেন,তোমাকে সব সময় চোখের কাছে রাখি। তোমার সাথে কি হয় না হয় সব খবর রাখি আমি। আচ্ছা বাবা,সরি। মাফ করে দাও?

তোহা কথা বলে না। বালতি টা ছুড়ে মেরে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। গাল ফুলে গেছে,নাক লাল হয়ে গেছে।

লিমন তার পাশে এসে বসে বলে-
– এত রাগ?

তোহা নিশ্চুপ।
লিমন আবারো বলে-
– ওকে বলছি কোথায় ছিলাম। সিলেট গিয়েছিলাম। বিছানাকান্দি। সেই পানির নিচে। সেই গ্যাংস্টার দের ব্যাপারে প্রমান কালেক্ট করতে। সেটা করে সরাসরি সরকারি গোয়েন্দা বিভাগে। তাদের সামনে মানুষ রূপে গেছি। অদৃশ্য হয়ে না। তাদের কে সব বলেছি,প্রমান দিয়েছি। আশা করি,খুব দ্রুতই সেই গ্যাংস্টার দল কে ধরবে তারা।

তোহা এবার অবাক চোখে তাকায় লিমনের দিকে। চেঁচিয়ে বলে –
– তুমিই তাহলে এই খবর সরকারের কাছে পৌঁছেছো!

মৃদু হেসে লিমন বলে-
– হু।
– আর আমি ভাবলাম,আবিদ!
– আবিদ!!!! উফ ওকে নিয়ে ভাবা টা গেলো না তোমার তাইনা? এত কিছু হলো ঐ আবিদের জন্য আর এখনো ওকে নিয়েই ভেবে যাচ্ছো তুমি। ফাইন, থাকো ওকে নিয়ে। আমি গেলাম।

লিমন উঠে দাঁড়ায়। তোহা হাত ধরে লিমনের। চোখ পাকিয়ে বলে-
– একে তো না বলে গেছো,সারাদিন অপেক্ষা করিয়েছো,ডাকার পরেও আসো নি আর এখন উল্টো আমার উপর রাগ দেখাচ্ছো?
এটা কি ঠিক হচ্ছে?

লিমন মাথা চুলকে তোহার পাশে বসে। মিষ্টি করে বলে-
– না ঠিক হচ্ছে না। তা আপনার রাগ এখনো ভাঙে নি জনাবা?

তোহা মাথা দুলায় এপাশে ওপাশে।
লিমন তোহার কপালে লেগে থাকা এলোচুল সরাতে সরাতে বলে-
– কি করলে রাগ ভাঙবে?
তোহা ফিসফিসিয়ে বলে-
– জানিনা।
লিমন তোহার চোখের কাছে নিজের মুখ টা নেয়। প্রথমে তোহার ডান চোখে,এরপর তোহার বাম চোখে পরাপর দুটো চুমু খায়। তারপর নাকে, এরপর ডান গালে,তারপর বাম গালে।
এরপর….
এরপর…….

হঠাৎ আবরার সাহেব তোহার দরজায় নক করে। তোহা ঠেলে লিমন কে সরিয়ে দেয়। আবরার সাহেব ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে-
– কিরে, বিছানায় পানি কেন! আর বালতি কি করে ঘরে!

তোহা সাত-পাঁচ ভেবে বলে-
– ঘরের ভেতর বিছানার উপর গোসল করার কেমন মজা,সেটা ট্রাই করছিলাম বাবা।

আবরার সাহেব তোহার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। মনে মনে ভাবে-
– অতিরিক্ত মেন্টাল চাপে মেয়েটার মাথা গেলো টেলো নাকি!!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here