“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০৩
(নূর নাফিসা)
.
.
“পারবো না আমি ছাড়তে তোকে
পারবো না আমি ভুলতে তোকে
পারবো না ছেড়ে বাঁচতে তোকে
হয়ে যা না রাজি একবার…!”
তার পরপরই আরেকটা টেক্সট,
“এটা কিন্তু সিনেমার গান ছিলো।”
নিশাত হেসে উঠলো! এরপর আর কোনো কল বা মেসেজ আসেনি। নিশাত অন্ধকারে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজায় ধুপধাপ শব্দে ঘুম ভেঙেছে। ইমরান ডাকছে। সে চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এলো। সবাই ডিনারের জন্য প্রস্তুত আর তার নামাজই পড়া হয়নি! সে বড়মার রুমে এসে নামাজ পড়ে নিয়েছে। জেরিনের খাওয়াদাওয়া একা একা তার নিজ রুমেই চলে। ইফতারের সময় বড়মা তাকে ডাকে কিন্তু সে নিজ থেকেই আসতে চায় না। আরমানের মতো অনেকেরই খারাপ লাগে বিষয়টি কিন্তু কেউই কিছু বলে না।
মায়ের উপর ভার ছেড়ে দিয়ে আশিক নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে। আয়েশা বেগম ও আবিদা বেগমের তাড়ায় দুই পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা সম্পাদিত হলো। সপ্তম রমজানে নিয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে ইফতারের দাওয়াত পড়েছে তৃ-তনয়ার শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের। মোটামুটি বড়সড় এক আয়োজন। সেই সুবাদে নাফিসা সেখানে দুদিন কাটিয়ে এসেছে। দশম রমজানে আবার আরাফের বাড়িতে ইফতারের দাওয়াত পড়েছে। সবাই গিয়েছে কিন্তু নাফিসা বাদে। ইমরান বারবার বলেও তাকে রাজি করাতে পারেনি। আরাফ ও নাজিয়াও মন খারাপ করেছিলো এ নিয়ে। কিন্তু তার উক্তি পরিষ্কার, সে ওই বাড়িতে কখনোই পা রাখবে না! যদিও এবাড়ির লোকজনের সামনে অসুস্থতার অযুহাতই দিয়েছে। অন্যদিকে সবার অবাধ্য হওয়ায় ইমরান একটু রাগারাগিও করেছিলো তার সাথে। কিন্তু নাফিসা চুপচাপ বসে ছিলো। যে যা-ই বলুক, যাবে না সে। অত:পর তাকে বাড়িতে রেখেই সবাই চলে গেছে। আজ বহুদিন পর নীরব বাড়িতে থেকে সেই দিনটার কথা বেশ নাড়া দিয়েছে তার মাঝে। এমনিতে সে রাগ নিয়ে বেশিক্ষণ স্থির থাকে না। কিন্তু সেই ব্যাপারটা তার আত্মসম্মানে লেগেছে খুব। তার পরিবারের অসম্মান হয়েছে সেখানে! যদি বাবা-মা জানতো তাহলে হয়তো একটা না একটা ঝামেলা ঠিকই হতো। কিন্তু আয়েশা বেগমের কুৎসিত মানসিকতার কথা জানায়নি তাদের তৃ-তনয়ার একজনও।
কুরআন পড়তে পড়তে মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। নাফিসা এক গ্লাস পানি পান করে সিয়াম ভঙ্গ করলো। অত:পর এইঘরে তালা দিয়ে বড় ঘরে এলো। ভেতর থেকে গেইটে তালা লাগিয়ে সে ড্রয়িং রুমে নামাজ আদায় করে নিলো। অত:পর কিচেনে এলো। যদিও কিছুক্ষণ আগে ইমরান কল করে বলেছিলো ইফতারের জন্য খাবারদাবার সব আগেই নিজের রুমে এনে রাখতে। কিন্তু সে তা করেনি। ভেবেছে বড়ঘরে থাকলে টিভি দেখেও একা একা সময় কাটানো যাবে তাই এখানে এসেই নামাজ আদায় করলো। একা বাসায় থাকায় আর কিছু তৈরিও করেনি। এমনিতে ঘরে ফাস্টফুড আছে খাওয়ার জন্য। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে বেগুনি বানানোর ব্যবস্থা করলো। নিরবতার ভয় কাটাতে মোবাইলে ওয়াজ শুনছে আর একা একা বেগুনি তৈরি করে খাচ্ছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলে নাফিসা আঁতকে উঠল! এক ঢোক পানি পান করে ফোন রিসিভ করলো। সে “হ্যালো” বলতেই ওপাশ থেকে ইমরান ধমকের সুরে বললো,
– কোথায় তুমি?
– কেন? বড় ঘরে বসে আছি।
– কখন থেকে ডাকছি! গেইট খুলো।
নাফিসা ফোন রেখে চাবি নিয়ে গেইটের কাছে এলো। ইমরান হাতে ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে গেইট খুলতে লাগলে ইমরান বললো,
– কানে তুলা লাগিয়েছো? ডাকতে ডাকতে গলা ব্যাথা হয়ে গেছে!
– আহ! চেচাও কেন! ওয়াজ চলছিলো ফোনে তাই তোমার গলার আওয়াজ যায়নি কানে।
– বাইরের লাইটটাও জ্বালায়নি আবার বলে চেচাই কেন!
গেইট ঠেলে ভেতরে এসে মাত্রই ব্যাগটা তার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলো ইমরান। এদিকে নাফিসা তার কথা শোনার জন্য দাড়িয়ে না থেকে দৌড় দিলো কিচেনে। তার বেগুনি পুড়ে যাচ্ছে! ইমরান আবার গেইটে তালা লাগিয়ে টেবিলে ব্যাগটা রেখে কিচেনে এসে দেখলো সে বেগুনি বানাচ্ছে। তাই বললো,
– এখন এগুলো বানাও, তো ইফতার করছো কি?
– এই যে, ইফতার করছি এখন।
– এতোক্ষণে!
– হুম। তখন পানি পান করে নামাজ আদায় করেছি। এখন নিশ্চিন্তে বসে বসে খাবার তৈরি করছি আর খাচ্ছি। তুমি এসে পড়লে কেন এতো তারাতাড়ি?
– আমি তো ব্যস্ত মানুষ, কাজকর্ম বেশি থাকে তাই বেড়ানোর সুযোগ হয় না কোথাও।
– হুহ্! ব্যস্ত মানুষ! এটা বললেই পারো হৃদপিণ্ডটা বাসায় রেখে গেছো তাই দেহ টিকেনি সেখানে।
ইমরান তার দিকে এক পলক তাকিয়ে শার্ট খুলতে খুলতে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– প্যাকেটে খাবার দিয়ে দিছে ভাবি। এগুলো খাও। নাকি এখন তাদের বাড়ির খাবারও খেতে পারবে না?
নাফিসা কিছু বললো না। ইমরান বাইরের লাইট জ্বালিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে গেলো। নাফিসা চুলা বন্ধ করে বেগুনির প্লেটে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলো। ইমরান সেন্টু গেঞ্জি পরে ফ্যান অন করে খাটে বসে টিভি দেখছে। ইমরানের সামনে প্লেট দিয়ে খেতে বলে নাফিসা ডাইনিং টেবিলের সামনে এলো। ইফতারসহ রাতের খাবার দিয়ে দিয়েছে নাজিয়া। প্যাকেট নাড়াচাড়ার শব্দ পেয়ে ইমরান বললো,
– ভাজা জিনিস এখন বেশি খেয়ো না। পেট ব্যাথা করবে। বরং ডিনার করে ফেলো।
নাফিসাও তাই করলো। ইফতারের খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে প্লেটে পোলাও মাংস নিলো। দুই প্লেট হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো প্লেটের তিনটা বেগুনিই খেয়ে ফেলেছে ইমরান! তাই বললো,
– তুমি কি ইফতার না করেই চলে এসেছো?
– করেছি।
– কিভাবে করলে! এইটুকু সময় তো পথ অতিক্রম করতেই লাগবে!
– এক গ্লাস জুস, একটা চপ আর এক টুকরো আপেল খেয়ে নামাজ আদায় করেছি। এতোক্ষণে ভাবি গুছিয়ে রেখেছে সব। এরপর ব্যাগটা নিয়ে ছুটেছি। মাগরিবের আগেই দেখা করে চলে আসতাম, তারা আসতে দেয়নি।
– নিজেই ইফতার করোনি আবার আমাকে শাসাও! হাত ধুয়ে খেয়ে নাও।
– ইশার নামাজ পড়ে তারপর।
– না, এখন খাও। একটু পরে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে থেকো।
ইমরান তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে অত:পর হা করলো। নাফিসা ব্রু কুচকে বললো,
– বাইরে থেকে এসেছো হাতমুখ তো অন্তত ধুয়ে এসো!
– একটু পর ওযু করবো তাই আলসেমি করছিলাম।
ইমরান হাতমুখ ধুয়ে এসে আরাম করে বসলো। অত:পর টিভি দেখতে দেখতে এক প্লেটেই খাবার নিয়ে নাফিসার হাতে দুজনের ডিনার হলো।
খাওয়াদাওয়া শেষে নাফিসা ভোর রাতের রান্না বসিয়ে দিলো। আর ইমরান টিভি দেখে সময় কাটিয়ে একটু জিরিয়ে নিলো। অত:পর দুজন একসাথে নামাজ আদায় করলো। নামাজ পড়ে আবার খেলা দেখছে ইমরান আর নাফিসা রান্না শেষ করে ইমরানের ফোনে গেমস খেলছে। এমনি সবাই হাজির। নাফিসা রান্না করে রাখায় শ্বাশুড়িরা উভয়েই খুশি হয়ে প্রশংসা করলো। কেননা কোথাও ঘুরে এসে রান্না করাটা সবার জন্যই বিরক্তিকর হয়ে পড়ে! আর সেখানে নাফিসা তাদের ক্লান্তিটা নাশ করে রেখেছে! প্রশংসাটা যদিও বড়মা একটু বেশিই প্রকাশ করলো আর আবিদা বেগম তুলনামূলক কম। কিন্তু ইমরান ও নাফিসা উভয়েই মনে মনে খুশি এতে। কিছুক্ষণ পরেই দুজন নিজেদের ঘরে চলে এলো। ইমরান ঘরে এসেই নাফিসার মুখখানা ধরে কপালে খুব গভীরভাবে চুমু একে দিলো। নাফিসা হয়তো বুঝতে পেরেছে সে কেন দিলো এই উপহারটা তাই আর কারণ জানতে চায়নি। বরং মনের মধ্যে খুশিটা আরও তীব্রভাবে ধারণ করেছে। স্বেচ্ছায় কিছু কিছু কাজ করে যদি শ্বাশুড়িদের আর স্বামীকে খুশি করানো যায় তাহলে কে না অনুপ্রাণিত হবে এমন কাজগুলো আবার করতে! একটু প্রশংসা শুনতে আর একটু ভালোবাসা পেতে কার না ভালো লাগে!
অত:পর ষোড়শ রমজানেই ইফতারের পর ঘরোয়াভাবে বিয়ে সম্পাদিত হয়ে গেলো আশিক ও নিশাতের! তাড়া ছিলো আশিকের কিন্তু প্রকাশ্য তাড়া ও ব্যবস্থা আয়েশা বেগম ও আবিদা বেগমের। তাদের ধারণা রমজান মাসে সম্পর্ক স্থাপনে আল্লাহর রহমত বেশি থাকবে। ইমরানের মোটেও মত ছিলো না এখন এমন বিয়েতে। কিন্তু বাকিদের বিপরীতে গিয়ে অমতও পোষণ করলো না। বিয়ে উপলক্ষে তাদের বাড়িতেও আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে মোটামুটি বড়সড় আয়োজন হলো। যদিও জেরিনের বাবা মা আসেনি। আর মেহেদীর পরিবারও আসতে পারেনি। তাদের অন্যত্র দাওয়াত আছে। কিন্তু তারা এই নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, যখন আনুষ্ঠানিকভাবে আবার বিয়ে হবে তখন ইনশাআল্লাহ আসবে।
নাফিসার মতো নিশাতও বউ সাজেনি বিয়েতে। গর্জিয়াছ থ্রিপিস পড়েই তার বিয়ে সম্পাদিত হয়েছে। নাফিসা বলেছিলো শাড়ি পড়তে কিন্তু সে নিজ আত্মীয়দের মাঝে এমনিতেই লজ্জায় মরে যাচ্ছে! সেখানে শাড়ি পড়ার কথা ভাবতেও পারেনি! তবে আজ আশিকের মাঝেও লজ্জা স্পষ্ট ছিলো! বাইরের লোক হলে হয়তো এতোটা নার্ভাস ফিল হতো না। এতোদিন যাদের সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক ছিলো, আজ তারা তার মুরুব্বি হয়ে বসে আছে। লজ্জা তো পাবেই! তবুও ধৈর্য ধারণ করে সময় কাটিয়েছে সে। কেননা, এমন লজ্জা তো আর প্রতিদিন আসছে না। বিয়েটা সম্পাদন হলেই সে মুক্ত। বিয়ে হওয়ার পর থেকে নাফিসা নাজিয়াকে বেয়াইন ডাকছে আর আরাফকে বেয়াই সাহেব ডাকছে! নিয়াজ উদ্দিন ও রুমানা বেগম বাড়ি চলে যাবে। তাই নাজিয়া, নাফিসা, আরাফ, ইমরান কথা বলতে বলতে এগিয়ে দিতে এলো। নাজিয়া আর নাফিসা রাস্তার গেইটের সামনে দাড়িয়ে ছিলো। ইমরান আর আরাফ রাস্তায় এসে রিজার্ভ গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলো। বাবা-মা চলে গেলে তারা আবার বাড়ির ভেতরে এসে উঠুনে হাটছে আর কথা বলছে। নাফিসাকে রাগিয়ে দিতে দুষ্টুমির ছলে উপহাস করছিলো আরাফ। নাফিসা তার বিয়ের দিন কেমন আচরণ করেছিলো, ইমরান কেমন ভেজা বিড়াল হয়ে ছিলো সেদিন! নাফিসা কেমন তাদের দাওয়াত না দিয়েই ইমরানের খরচ বাচাতে একেবারে একা একাই শ্বশুর বাড়ি এসে পড়েছে! এসব কথাবার্তা নিয়ে হাসাহাসি চলছে। ইমরান হাসছে আর চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। কেননা আরাফের বিপরীতে নাফিসা চাপা ছাড়ছে। এক পর্যায়ে নাফিসা বললো,
– ওকে, মানলাম আমি আপনার ভাইয়ের খরচ বাঁচিয়েছি। কি করবো বলুন, ছোট্ট একটা সংসার। তারউপর কমার্সের স্টুডেন্ট! হিসেব না করে চললে কি হবে নাকি! তা বেয়াই মশাই, একটা জবাবদিহি করেন তো।
– কি?
– আপনার বিয়ের ঘটক কে ছিলো?
– আমি নিজে।
– বড় আপুর বিয়ের ঘটক কে ছিলো?
– বিয়ে আমাদের, ঘটক তো একই হলো না!
– এক আর দুই বুঝি না। সরাসরি উত্তর চাই।
– হুম, তোমার বড় আপুর বিয়ের ঘটকও আমিই ছিলাম।
– এবার বলুন আমার বিয়ের ঘটক কে ছিলো?
নাফিসার প্যাচ ধরতে পেরে আরাফ চুপ হয়ে গেছে! মুখে তার চাপা হাসি! ইমরান ফিক করে হেসে উঠে বললো,
– কি হলো, মাস্টার মশাই? বলুন, বলুন? আপনি প্রফেশনাল মাস্টারের পাশাপাশি কি প্রফেশনাল ঘটকও? দুইটা বিয়ের চারটা পক্ষের ঘটক আপনি একা! ডিয়ার ওয়াইফি, একটা গিফট পাওনা তোমার।
– ওপ্স! কি গিফট?
– গিফট একটা হলেই হলো। বলতে হবে কেন!
– ওকে, ভালো হওয়া চাই।
আরাফ নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি গো? তুমিও কিছু বলো, ওরা দুজন আমাকে চাপানোর চেষ্টা করছে যে!
– আমাকে কিছু বলেছো? আমি শুনিনি তো কিছু!
– ওহ! আমিও তো শুনিনি! চলো চলো, বাসায় যেতে হবে। কিরে আশিক? তোর বিয়ে করা হয়েছে? এবার বাড়ি যাবি, নাকি ঘরজামাই থাকবি?
আরাফ উঠুন থেকে ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে আর তারা সবাই হাসছে!